Robbar

আপন যাপন হে বিজ্ঞাপন

Published by: Robbar Digital
  • Posted:October 8, 2023 8:47 pm
  • Updated:October 10, 2023 12:14 am  

দেশ-বিদেশের বিজ্ঞাপনের ছবি, তার ইতিহাস, টিকাটিপ্পনী– যা একেবারেই পাণ্ডিত‌্যের নাইলন দড়িতে বাঁধা নয়, কিন্তু তথ‌্যের আনন্দে ভরপুর। বিজ্ঞাপনে কাজ করার অভিজ্ঞতা, বিজ্ঞাপনের যে রীতি, যে বদলে যাওয়া এবং সর্বোপরি বাঙালিয়ানা নিয়ে তাঁর উদ্বেগ ও আবেগ এই বইয়ের মেরুদণ্ড।

সম্বিত বসু

জিনিসপত্তরের গ্রহ বানায় বিজ্ঞাপন। উপভোক্তাদের উপগ্রহ। অতঃপর উপগ্রহ বাঁইবাঁই করে অনন্তকাল কক্ষপথে ঘুরন্ত! পকেট ময়দান হলেও, শখ চৌরঙ্গির ‘দ্য ফরটি টু’-এর মতো তেঢ্যাঙা ৬৫ তলা! কিন্তু কী করে বিজ্ঞাপন প্রবেশ করে এক্কেরে উপভোক্তার অন্তরমহল ও অন্দরমহলে? এহেন জমকালো প্রশ্নের উত্তর একটিমাত্র শব্দেই দফারফা হয়ে যায়– ‘অভাব’। অভাব হল সেই মৌলিক কাঁচামাল, যা ডাঁই করে রাখা এই নীল রঙের গ্রহে। বহুকালের ব্র্যান্ডমাস্টার অরিন্দম নন্দী লিখছেন, “আমাদের দৈনন্দিন জীবনে মূল্যবোধ, আবেগ, সারল্য, বন্ধুত্ব, বিশ্বাস ইত্যাদির জায়গা ক্রমশ কমে যাচ্ছে, একটা ‘অভাব’ তৈরি হচ্ছে, আর সেটা যত বেশি করে তৈরি হচ্ছে, ততই বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে সেই সব জিনিস ফিরে ফিরে আসছে।” মানে, যা নেই, যা হুস কিংবা ভ্যানিশ, যা হাতড়াচ্ছি, অথচ পাচ্ছি না, বিজ্ঞাপন সেই ফাঁকা জমিতেই চারা পোঁতে, সার দেয়। দর্শক-শ্রোতার মনই বিজ্ঞাপনের মনস্তত্ত্ব। হতে পারেই সমাজের চোখে যে ব্যাপারখানা ডাহা নঞর্থক, ‘নেগেটিভ’ আর কী, এই যেমন স্বার্থপরতা, তাকেও বিজ্ঞাপনী ছকে দুরন্ত ব্যবহার করা যেতে পারে। অরিন্দম নন্দীই বিজ্ঞাপন লিখেছিলেন, এক গৃহনির্মাণ সংস্থার জন্য: ‘বি সেলফিশ অ্যান্ড সুইচ অফ ইলেকট্রিসিটি’। ব্যাপারখানা তো আসলে স্বার্থপরতা নয়, বরং ঘুরিয়ে নাক দেখানো, জনস্বার্থেই প্রচারিত।
বিজ্ঞাপন নিয়ে বাঙালি বেশ খুঁতখুঁতে। ইদানীংকালে আরও। কারণ শহর কিংবা মফস্‌সলের বিভিন্ন হোর্ডিংয়ে বাংলা বিজ্ঞাপনে বিস্তর বানান ভুলের বহর আর কদাকার বঙ্গানুবাদ ছেয়ে রয়েছে। বাংলা ভাষা নিয়ে যাঁদের উদ্বেগ, তাঁরা এ ব্যাপারে প্রায়শই সামাজিক মাধ্যমে মগজধোলাই করে থাকেন। বাকিরাও করেন, তবে দিনবিশেষে। ওই ২১ ফেব্রুয়ারি কিংবা পয়লা বৈশাখের মতো একটা-দুটো ‘বাংলা’ দিনে। বাংলা ভাষার যখন হাল বেহাল, তখন একা বিজ্ঞাপনের বাংলা কেন অটল-অজর থাকবে? তা জনঅরণ্যের চোখে পড়ে বলে শুদ্ধ হতে হবে, আর বাদবাকি সব এলেবেলে বাউন্ডুলে? যে অভাবের দরুন তৈরি হয় বিজ্ঞাপনী কেরদানি, সেই অভাবের দরুনই বাংলা ভাষা খানাখন্দে পড়ে। দুই অভাবের বিশেষত্ব অবশ্যই আলাদা। বাংলা বিজ্ঞাপনে অভাব মৌলিক বাংলা ভাষায় চিন্তা করেন, এমন মানুষের। অরিন্দম নন্দী, এক্ষেত্রে বলছেন, ঋতুপর্ণ ঘোষের কথা– যে ঋতুপর্ণ ঘোষ বাংলা বিজ্ঞাপনের ইতিহাসের চেয়ারে চিরস্থায়ী, মরণোত্তর কোনও মিউজিক্যাল চেয়ার প্রতিযোগিতাতেও সে চেয়ার কখনও ছিনিয়ে নেওয়া যাবে না। ঋতুপর্ণ লিখেছিলেন, “অনুবাদ করলে একরকম সময় লাগে, নতুন করে লিখলে আর একরকম সময় লাগে। এজেন্সির চাহিদা সাধারণত দ্বিতীয়টা। এজেন্সির ভাষায় ‘ট্রান্সলেশন’ নয়, ‘ট্রান্সক্রিয়েশন’।”
এসব কথা বলছি, কারণ ‘কিছু বিজ্ঞাপন কিছু আপন’ নামের একটি স্বাদু বই হাতে এসে জুটেছে। ঝরঝরে বাংলায় যা লিখেছেন অরিন্দম নন্দী। দেশ-বিদেশের বিজ্ঞাপনের ছবি, তার ইতিহাস, টিকাটিপ্পনী– যা একেবারেই পাণ্ডিত‌্যের নাইলন দড়িতে বাঁধা নয়, কিন্তু তথ‌্যের আনন্দে ভরপুর। বিজ্ঞাপনে কাজ করার অভিজ্ঞতা, বিজ্ঞাপনের যে রীতি, যে বদলে যাওয়া এবং সর্বোপরি বাঙালিয়ানা নিয়ে তাঁর উদ্বেগ ও আবেগ এই বইয়ের মেরুদণ্ড। কিন্তু পাঠককে সঙ্গে করে শুধু বিজ্ঞাপনের বিশ্বটাকেও ঘুরিয়ে দেখাননি তিনি, ব‌্যক্তিগতর লাবণ‌্য ঢুকে পড়েছে এই বইয়ের পাতায়। গ্রন্থনামে ‘কিছু আপন’ শব্দ দু’টি সেইদিকেই ইঙ্গিত করছে।
সেই ‘আপন’-এর মধ‌্যে পড়েন ‘রোববার’-কে ভাল-বাসার আদি লোক নবনীতা দেব সেন-ও। তাঁরই বাবা-মা কবিদম্পতি নরেন্দ্র দেব ও রাধারাণী দেবীকে নিয়ে তথ‌্যচিত্র করতে গিয়ে অরিন্দম-নবনীতা জুটি পৌঁছেছিলেন সত‌্যজিৎ রায়ের কাছেও। নরেন্দ্র দেব-এর ‘সিনেমা’ বইটির আলোচনা করার প্রস্তাবে রাজি হয়েছিলেন সত‌্যজিৎ। কিন্তু দোলের দিন। ‘ত্রিদেব’ ছবির গান বাজছিল নেপথ‌্যে। ফলে সত‌্যজিতের কথার সমান্তরালে সেই গানও রেকর্ড হয়ে যায়, তা কোনওভাবেই সম্পাদনা করে বাদ দেওয়া যায়নি আর। এই দুরন্ত দিনের একটি ছবি, নবনীতা-সত‌্যজিৎ পাশাপাশি বসে আছেন, অরিন্দম নন্দী সযত্নে রেখেছেন তাঁর বইয়ে।
কিন্তু ‘আপন’ মানে শুধু তো আরও ক’জন চেনা মানুষ নন। নিজেও তো নিজের কাছে আপন। ‘আত্মীয়’। রবীন্দ্রনাথ নিজের বিয়ের কার্ডে সে কারণেই ‘আত্মীয়’ শব্দটাকে যথোপযুক্ত ব‌্যবহার করেছিলেন। এই ‘আপন’-এর সঙ্গে জুড়ে রয়েছে আত্মার অমোঘ অভিজ্ঞতা। এন্টালিতে, লেখকের এককালের পাড়ায়, তিনি দেখা পেয়েছিলেন সাদা চুলের বৃদ্ধ এক ভিখারির, যিনি খালি গলায় গাইছিলেন একটি গান। কিন্তু কী গান? ‘মন রে কৃষিকাজ জানো না…’।
এসবের দেখা পেলে সত‌্যিই মানবজমিন কি পতিত হয়ে থাকতে পারে?
কিছু বিজ্ঞাপন কিছু আপন
অরিন্দম নন্দী 
রাবণ। ৫০০