Robbar

মৃণাল সেনের ফরিদপুরের বাড়িতে নেতাজির নিয়মিত যাতায়াত থেকেই তাঁর রাজনৈতিক চিন্তার জীবন শুরু

Published by: Robbar Digital
  • Posted:June 4, 2025 9:05 pm
  • Updated:June 5, 2025 2:51 pm  
10th episode of desher bari on mrinal sen by kamrul hasan mithu

মৃণাল সেন প্রথম পুলিশের হাতে ধরা পড়েন ‘বন্দে মাতরম, পুলিশের মাথা গরম’ এই স্লোগান দেওয়ার অপরাধে। তখন তিনি ক্লাস থ্রি-র ছাত্র। ফরিদপুরের আকাশে প্রথম এরোপ্লেন দেখেন। ফরিদপুরেই প্রথম দেখেন শিশির ভাদুড়ীকে। ফরিদপুর শহরে তখন গাড়ি বলতে সবই ঘোড়ার গাড়ি। শহরের একমাত্র প্রাইভেট কার ছিল ‘নদী ও নারী’ উপন্যাসের লেখক হুমায়ুন কবীরের বাবার। ফরিদপুর শহরের সকল গুরুত্বপূর্ণ কাজে এই গাড়িটাই ব্যবহার করা হত। এই গাড়িতে উঠতে গিয়ে গাড়ির দরজায় মৃণাল সেনের আঙুল চাপা খায়। এই প্রথম আঙুল থেকে শিশুরক্ত ঝরে পড়ে।

কামরুল হাসান মিথুন

১০.

মৃণাল সেনের প্রথম দেখা সিনেমার নাম– ‘দেবদাস’। একটা টিনের চালের নীচে পর্দা টানিয়ে ফরিদপুরে স্বদেশি মেলায় এই সিনেমা দেখানোর আয়োজন হয়। নরেশ মিত্র পরিচালিত ‘দেবদাস’ ছিল নির্বাক চলচ্চিত্র। সিনেমার একটা দৃশ্যে দেখা যায় দেবদাস গাছে উঠে পেয়ারা পাড়ছে। দূর থেকে গুরুজনদের কাউকে দেখতে পেয়ে পারু চিৎকার করে ওঠে। চিৎকার মানে নিঃশব্দ চিৎকার। দেবদাস গাছ থেকে লাফিয়ে নামে, ভয় পেয়ে দু’জনে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়তে থাকে। এমন সময় আকাশ ভেঙে বৃষ্টি আসে। মজার ব্যাপারটা হচ্ছে যেখানে বসে তাঁরা সিনেমা দেখছিলেন, সেখানে সেই টিনের চালের ওপর হঠাৎ প্রচণ্ড বৃষ্টি নামে। পর্দায় বৃষ্টি, পর্দার ওপরে টিনের চালে বৃষ্টি। এই বৃষ্টির শব্দ নেমে আসে মৃণাল সেনের বুকের মধ্যে। ক্লাস থ্রি কিংবা ফোরের একটা ছেলে সেদিনই প্রথম জেনে গিয়েছিল, সিনেমায় সাউন্ডের প্রভাব কী, সিনেমায় সাউন্ডের প্রয়োজন কোনখানে।

ফরিদপুরের ঝিলটুলির পৈতৃক বাড়ির সামনে গীতা সেন ও মৃণাল সেন। ছবি: নাসির আলী মামুন। ছবির সময়কাল: ২৫ জানুয়ারি ১৯৯১

মৃণাল সেন প্রথম পুলিশের হাতে ধরা পড়েন ‘বন্দে মাতরম, পুলিশের মাথা গরম’ এই স্লোগান দেওয়ার অপরাধে। তখন তিনি ক্লাস থ্রি-র ছাত্র। ফরিদপুরের আকাশে প্রথম এরোপ্লেন দেখেন। ফরিদপুরেই প্রথম দেখেন শিশির ভাদুড়ীকে। ফরিদপুর শহরে তখন গাড়ি বলতে সবই ঘোড়ার গাড়ি। শহরের একমাত্র প্রাইভেট কার ছিল ‘নদী ও নারী’ উপন্যাসের লেখক হুমায়ুন কবীরের বাবার। ফরিদপুর শহরের সকল গুরুত্বপূর্ণ কাজে এই গাড়িটাই ব্যবহার করা হত। এই গাড়িতে উঠতে গিয়ে গাড়ির দরজায় মৃণাল সেনের আঙুল চাপা খায়। এই প্রথম আঙুল থেকে শিশুরক্ত ঝরে পড়ে।

মৃণাল সেনের স্মৃতিতে ফরিদপুরের ঝিলটুলির বাড়ির সামনে মৃণাল সেনের শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়

মৃণাল সেনের প্রথম স্কুল ‘ফরিদপুর ঈশান ইনস্টিটিউশন’। প্রথম কলেজ ঝিলটুলির বাড়ি থেকে পায়ে হাঁটা পাঁচ মিনিটের দূরত্বে ‘সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ, ফরিদপুর’।

মৃণাল সেনের প্রথম স্কুল। ফরিদপুর ঈশান ইনস্টিটিউশন (১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত)। এই ভবনটি এখনও আছে শুধু ইশকুল বদলে গিয়ে মেডিক্যাল ইনিস্টিটিউট হয়েছে।

মৃণাল সেনের জীবনের প্রথম ডেন্টিস্ট নেতাজি সুভাসচন্দ্র বসু। ফরিদপুর তখন রাজনৈতিকভাবে উত্তপ্ত। নেতাজি প্রায়ই আসেন ফরিদপুরে। ফরিদপুর আসলে মৃণাল সেনদের ঝিলটুলির বাড়িতে কিছু সময় কাটান। একদিন ছোট্ট মৃণাল দাঁতের ব্যথায় খুব কাঁদছেন– এই দেখে নেতাজি ওষুধ লিখে দেন এবং পরের সপ্তাহে কলকাতা থেকে ফরিদপুর ফেরার সময় মৃণাল সেনের জন্য একটা মলম নিয়ে আসেন।

ঢাকায় মৃণাল সেন। ছবি: মুহম্মদ খসরু, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ

মৃণাল সেনের শৈশব-কৈশোরে দেখা স্বপ্নদৃশ্য, কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতা পরবর্তী জীবনে তাঁর নির্মিত ‘পদাতিক’, ‘ইন্টারভিউ’ ও ‘মাটির মনিষ’ ছবিতে দেখা যায়। এবং ফরিদপুর থাকাকালীন সরাসরি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন– ‘ফরিদপুর জেলা স্টুডেন্ট ফেডারেশন’-এর সেক্রেটারি পর্যন্ত হয়েছিলেন।

ফরিদপুরের ঝিলটুলি মহল্লার পৈত্রিক বাড়ির পুকুরপাড়ে ছোট বোন রেবার স্মৃতিস্তম্ভের পাশে বসে আছেন মৃণাল সেন ও গীতা সেন। ছোট বোন রেবা খুব শৈশবেই এই পুকুরে ডুবে মারা গিয়েছিল। ছবি: নাসির আলী মামুন। ছবির সময়কাল: ২৫ জানুয়ারি ১৯৯১

ফরিদপুর জেলার পূর্বনাম ‘ফতেহাবাদ’। পদ্মা থেকে সমুদ্রে প্রবাহিত প্রাচীন নদীগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘কুমার নদ’। কুমার নদের পাড়ে গড়ে উঠেছে ফরিদপুর শহর ও ফরিদপুর জেলার নগরকান্দা উপজেলা। ফরিদপুরে মোগল শাসনের সূত্রপাত ঘটে ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে। ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে ফরিদপুরে ব্রিটিশ শাসনের ছোঁয়া লাগে। পরবর্তী সময়ে কলকাতার সঙ্গে ছয় ঘণ্টার দূরত্বে রেল যোগাযোগ স্থাপিত হলে এই ফরিদপুর হয়ে ওঠে পূর্ববঙ্গের অন্যতম রাজনৈতিক শহর হিসেবে। স্বদেশি আন্দোলনে কংগ্রেসের নেতা ছিলেন ফরিদপুরের আইনজীবী দীনেশচন্দ্র সেন। বিশেষ করে চরমপন্থী বা সশস্ত্র অংশের ছেলেদের আইনি আশ্রয় ছিলেন দীনেশচন্দ্র সেন।

মৃণাল সেনের কলেজ ভবন। এই ভবনেই দুইবছর নিয়মিত ক্লাস করেছেন। সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ, ফরিদপুর, স্থাপিত ১৯১৮

মৃণাল সেনের জন্ম ফরিদপুর শহরের ঝিলটুলি এলাকায়। মৃণাল সেনের মাতা সরযূবালা সেন ছিলেন বিক্রমপুরের মেয়ে। মৃণাল সেনরা সাত ভাই, পাঁচ বোন (রমা, গোপা, লীলা, শৈলেশ, গোপেশ, অমরেশ, প্রাণেশ, পবিত্র, মৃণাল, চিত্রা, রেবা ও দিলীপ)। মৃণাল সেনের পিতা দীনেশচন্দ্র সেনের দুই বিয়ে। মৃণাল সেন দ্বিতীয় পক্ষের।

দেশভাগের আগে ফরিদপুর ছেড়ে যান। বাংলাদেশ হওয়ার পর কয়েকবার ঢাকায় এসেছেন। পরিণত বয়সে মাত্র একবারই আসেন ফরিদপুরে মৃণাল সেন সঙ্গে গীতা সেন। আগমনের সময়কাল ২৫ জানুয়ারি ১৯৯১।

মৃণাল সেনের পিতা দীনেশচন্দ্র সেন ছিলেন পেশায় আইনজীবী, রাজনৈতিকভাবে ঘনিষ্ঠ ছিলেন চরমপন্থী কংগ্রেসিদের সঙ্গে। দীনেশচন্দ্র সেনের গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলায়। পরবর্তী সময়ে যৌথ পরিবারের কথা চিন্তা করে ফরিদপুর শহরের ঝিলটুলি এলাকায় পাকা বাড়ি নির্মাণ করেন। নিজের মা তীর্থমণির নাম অনুসারে বাড়িটির নাম রাখেন ‘তীর্থ নিবাস’। এই তীর্থ নিবাসে সেই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ সকল রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের আনাগোনা ছিল। হঠাৎ হঠাৎ বিপ্লবী পূর্ণচন্দ্র দাস তাঁর ‘শান্তিসেনা’ নিয়ে চলে আসতেন দুপুররাত্রে ঝিলটুলিতে, সকলের খাওয়ার রান্না একহাতে করতেন মৃণাল সেনের মা সরযূবালা সেন।

মৃণাল সেনের ফরিদপুরের বাড়ি। এই বাড়ির অর্ধেক অংশে নতুন দশ তলা ভবন হয়েছে। জমির মালিক মৃণাল সেনের স্মৃতি রক্ষার্থে বাড়ির এই অংশটুকু রেখেছেন

ফরিদপুরে ‘অল বেঙ্গল রায়ত কনফারেন্স’ অনুষ্ঠিত হয়। দীনেশচন্দ্র সেন ছিলেন এই কনফারেন্সের রিসিপশন কমিটির চেয়ারম্যান। এই কনফারেন্সে দীনেশচন্দ্র সেন যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তা আলাদা করে ছাপিয়ে বিতরণ করা হয়। এই কনফারেন্স দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ বক্তব্য রাখেন। এই কনফারেন্সে বিপিনচন্দ্র পাল গান করান মৃণাল সেনের মাতা সরযূবালা সেনকে দিয়ে। সেই সময়ে কোনও ভদ্রলোক বাড়ির বউ বাইরে গিয়ে গান গেয়েছেন– এটাই ছিল বিপ্লব।

মৃণাল সেনের বাড়ির জানালা। মৃণাল সেন যেবার ফরিদপুর আসেন তখন বলেছিলেন এই জানালার ঘরটাতেই মৃণাল সেন থাকতেন। তাঁর স্কুল কলেজ জীবনের পড়াশোনার পড়ার টেবিল এই জানালার পাশেই ছিল।

কলেজের পাট শেষ হওয়ার পর মৃণাল সেনকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কলকাতায়। দেশভাগের পর ১৯৪৮ সাল নাগাদ ঝিলটুলির বাড়ি বিক্রি করে ফরিদপুরের পাট চুকিয়ে পুরো পরিবার চলে যান কলকাতায়। ফরিদপুর মৃণাল সেনের জন্মভূমি, কলকাতা মৃণাল সেনের ‘এল ডোরাডো’।

ছবি: কামরুল হাসান মিথুন

দ্যাশের বাড়ি-র অন্যান্য পর্ব …

পর্ব ৯: শেষবার বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার আগে জানলায় নিজের আঁকা দুটো ছবি সেঁটে দিয়েছিলেন গণেশ হালুই

পর্ব ৮: শীর্ষেন্দুর শৈশবের ভিটেবাড়ি ‘দূরবীন’ ছাড়াও দেখা যায়

পর্ব ৭: হাতে লেখা বা ছাপা ‘প্রগতি’র ঠিকানাই ছিল বুদ্ধদেব বসুর পুরানা পল্টনের বাড়ি

পর্ব ৬ : জীবনের কালি-কলম-তুলিতে জিন্দাবাহারের পোর্ট্রেট এঁকেছিলেন পরিতোষ সেন

পর্ব ৫ : কলাতিয়ার প্রবীণরা এখনও নবেন্দু ঘোষকে ‘উকিল বাড়ির মুকুল’ হিসেবেই চেনেন

পর্ব ৪ : পুকুর আর বাঁধানো ঘাটই প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের দেশের বাড়ির একমাত্র অবশিষ্ট স্মৃতিচিহ্ন

পর্ব ৩ : ‘আরতি দাস’কে দেশভাগ নাম দিয়েছিল ‘মিস শেফালি’

পর্ব ২: সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় শৈশবের স্মৃতির নন্দা দিঘি চিরতরে হারিয়ে গেছে হাজীগঞ্জ থেকে

পর্ব ১: যোগেন চৌধুরীর প্রথম দিকের ছবিতে যে মাছ-গাছ-মুখ– তা বাংলাদেশের ভিটেমাটির