Robbar

অভিধানের যে শব্দটা সবচেয়ে বেশি মনুষ্যরূপ ধারণ করেছে

Published by: Robbar Digital
  • Posted:November 6, 2024 4:40 pm
  • Updated:November 6, 2024 4:40 pm  

যত দিন স্বার্থসিদ্ধি হচ্ছে, ‘আহা’, ‘অহো’, ‘সেলাম’ পর্ব নির্বিঘ্নে চলতে থাকে। মুখোশগুলো খুলতে শুরু করে স্বার্থের ল্যাজে পা পড়লে। তখন অবিকল শ্বাপদের মতো দেখতে লাগে এদের, শ্ব-দন্তে রক্ত-লালসা লেগে থাকে!‌ ২৩ বছরের জীবনে কম তো দেখলাম না। কাউকে আজন্ম দেখছি, কাউকে বছর ১৪ ধরে দেখছি। সমস্ত লিখতে গেলে রামায়ণ-মহাভারতের যৌথ খণ্ড আকারের বই প্রকাশ করতে হবে!

অরিঞ্জয় বোস

১০.

ছেলেবেলায় আমার একখানি বন্ধু ছিল। নামধাম গোপন রাখছি। এ বয়সে এসে মেলা অশান্তি আর ভালো লাগে না! বলতে গেলে ‘মানিকজোড়’ই ছিলাম আমরা। ইশকুলে এক বেঞ্চিতে পাশাপাশি বসা। ফাঁক পেলে রাজা-উজির মারা। ইশকুল শেষে গুলতানি আর ফক্কামির ডিপার্টমেন্টাল স্টোর খোলা। সবই চলত আমাদের। তা, আমার বন্ধুবরের মগজ একখানি ছিল বটে! কিন্তু সে মগজ বিশেষ শ্রম-পরিশ্রমের ধার ধারত না! অগত্যা নোটস চালান থেকে শুরু করে পড়া দেখিয়ে দেওয়া, পরীক্ষার হলে ‘বন্ধুকৃত্য’ নামক মহা দায়িত্বের লটবহর টানা, সবই চালাতে হত আমায়। কিন্তু একদিন সে মর্কটই যে আমায় বেমক্কা ফাঁসিয়ে দেবে, ভাবতে পারিনি।

একদা এক বাঘের গলায় কাঁটা ফুটিয়াছিল… অতঃপর?

বেশ মনে আছে, হিস্ট্রি ক্লাস চলছিল। তা, ক্লাস ক্লাসের মতো চলছিল। আর আমরা আমাদের মতো কাটাকুটি বা পেন ফাইটিং– দুটোর মধ্যে যে কোনও একটা খেলায় (ঠিক স্মরণ করতে পারছি না) নিজেদের নিমগ্ন রেখেছিলাম। খেয়ালই করিনি, কখন মহম্মদ বিন তুঘলক একরাশ প্রশ্নমালা নিয়ে দিল্লির বদলে আমাদের শিয়রে এসে উপস্থিত হয়েছে! চারপাশের নিস্তব্ধতা এবং ক্লাসরুম ভর্তি মিত্রবর্গের কাঁচাখেকো চাপা হাসির আওয়াজে ঘাড় তুলে দেখি, সার-সার উৎসুক চোখ কৌতুক-সহ আমাদের দিকে তাকিয়ে। যেন এখনই ট্রাপিজের খেলা শুরু হবে! ততক্ষণে হিস্ট্রি টিচার দ্বিতীয় বার হাঁক পেড়েছেন। আমি নয়, আমার বন্ধুর দিকে। প্রমাদ গুনছিলাম মনে-মনে‌। আরে, কেউ না জানুক, আমি তো জানি যে ব্যাটাচ্ছেলে মহম্মদ বলতে তুঘলক নয়, শামি বোঝে! কিন্তু সে মহামানব যে শামির মতো ইয়র্কারে আমার স্টাম্পই সোজা উড়িয়ে দেবে, কল্পনা করতে পারিনি! দিব্য উঠে দাঁড়িয়ে চ্যাঁ-ভ্যাঁ করে বলতে শুরু করে দিল, ক্লাসে ও নাকি মন দিয়ে পড়ালেখা করতে চায়। আমিই সে সমস্ত হতে দিই না। আমিই নাকি ক্লাসে বসে যত রকম বিদঘুটে খেলা খেলতে বাধ্য করি। আর ও এতটাই অবলা যে, কিছুই নাকি ওর করার থাকে না! মামলা বেশি দূর গড়ায়নি সে দিন। ধমক-চমকের উপর দিয়ে মিটে গিয়েছিল। কিন্তু রাগে গা-পিত্তি জ্বলে গিয়েছিল আমার। মাথায় টিকি থাকলে রেফের মতো খাড়া হয়ে যেত নির্ঘাৎ!

ব্যাটা বলে কী! এ তো মহা অকৃতজ্ঞ!

ছবিটি প্রতীকী। শিল্পী: পাওলিনা ক্যাডেনা

জানি, পড়ে হাসি পাচ্ছে। শৈশবের কুষ্মাণ্ড-কীর্তন হাস্যরসই সরবরাহ করে অধিকাংশে। কিন্তু ছেলেবেলায় কোনও আঘাত পেলে মনে লাগে বেশি। আজও তো ভুলতে পারলাম না। আর সময়ের নিয়ম মেনে ছোট থেকে বড় হয়েছি যত, খুদেবেলার সেই ক্ষতে পুঁজরক্ত জমা হয়েছে তত। আজ একটা বিষয় বেশ বুঝতে পারি। বাংলা অভিধানের যে শব্দটা সবচেয়ে বেশি মনুষ্যরূপ ধারণ করে, তা হল ‘অকৃতজ্ঞ’!

কলকাতার স্বচ্ছল পরিবারে জন্ম আমার। পারিবারিক শিক্ষা-আচার বরাবর আমায় মাটিতে পা রেখে চলতে শিখিয়েছে। বর্তমানেও সেভাবে চলি, ভবিষ্যতেও চলব। যাক গে! পারিবারিক শিক্ষার কারণে সমাজের বিবিধ স্তরে অবাধ মেলামেশা করেছি। করে জীবন ও তার দুঃখ নিয়ে একটা জিনিস অনুধাবনও করতে পেরেছি। ব্যাপারটা হল, দুঃখ দু’রকমের। নিম্ন কিংবা নিম্ন মধ্যবিত্তের কাছে দুঃখের সংজ্ঞা অনেকাংশে আর্থিক। জীবনের বাদবাকি জরা-জীর্ণতা নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় তার নেই। আত্মীয়-পরিজন, চেনাশোনারা কে কী বলল, কী করল, তাতে তারা আমল দেয় না। কারণ, তার সঙ্গে সরাসরি পেটের সম্পর্ক নেই। গন্ডগোল বাঁধে পেট ভর্তি থাকলে! খাওয়াদাওয়ার চিন্তা না থাকলে। তখন জীবনের বাকি শাখা-প্রশাখা থেকে বাদুড়ের মতো ঝুলতে দেখা যায়, ‘অকৃতজ্ঞ’, ‘বিশ্বাসঘাতক’, ‘তঞ্চক’ নামের নানা কুটিল শব্দবন্ধকে‌। যারা উদর নয়, হৃদয়কে তাক করে। বারবার। যন্ত্রণার ক্ষেপণাস্ত্র চালিয়ে বুকের বাঁ দিকটা এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিতে থাকে সুযোগ পেলে।

……………………………

এরা ভাবতেও যায় না, এত দিন ধরে বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়িয়েছে যে লোকটা, গ্রীষ্মের ছাতা কিংবা শীতের আলোয়ান হয়েছে, সে যদি কোনও বিষয়ে ‘না’ বলে, ‘পারব না’ বলে, অথবা রাগ করে, তা হলে কেন বলছে? আসলে দায়-ই নেই। ভাবার আগ্রহই নেই। এদের পলিসি খুব সহজ। ফ্যালো কড়ি, মাখো তেল। সুবিধা দাও, চামর নাও। সে পথ বন্ধ হলে তোমায় প্রকাশ্যে গালমন্দ করতে এতটুকু বাঁধবে না। সোশ্যাল মিডিয়ায় অপমান করতেও হাত বিন্দুমাত্র কাঁপবে না!

……………………………

এবং এদের আগমন ভঙ্গিমাও বড় চেনা। শকুনির মতো হাতে চামর নিয়ে এদের প্রবেশ ঘটে সর্বাগ্রে। যত দিন স্বার্থসিদ্ধি হচ্ছে, ‘আহা’, ‘অহো’, ‘সেলাম’ পর্ব নির্বিঘ্নে চলতে থাকে। মুখোশগুলো খুলতে শুরু করে স্বার্থের ল্যাজে পা পড়লে। তখন অবিকল শ্বাপদের মতো দেখতে লাগে এদের, শ্ব-দন্তে রক্ত-লালসা লেগে থাকে!‌ ২২ বছরের জীবনে কম তো দেখলাম না। কাউকে আজন্ম দেখছি, কাউকে বছর ১৪ ধরে দেখছি। সমস্ত লিখতে গেলে রামায়ণ-মহাভারতের যৌথ খণ্ড আকারের বই প্রকাশ করতে হবে! ইন্টারেস্টিং হল, সামাজিক প্রভাব-প্রতিপত্তিতে এদের মধ্যে যত পার্থক্যই থাক না কেন, অস্ত্র এদের সবার এক। ছুরি! অকুস্থলও এক। অ্যাদ্দিনের ‘পৃষ্ঠপোষকে’র পিঠ! এরা ভাবতেও যায় না, এত দিন ধরে বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়িয়েছে যে লোকটা, গ্রীষ্মের ছাতা কিংবা শীতের আলোয়ান হয়েছে, সে যদি কোনও বিষয়ে ‘না’ বলে, ‘পারব না’ বলে, অথবা রাগ করে, তা হলে কেন বলছে? আসলে দায়-ই নেই। ভাবার আগ্রহই নেই। এদের পলিসি খুব সহজ। ফ্যালো কড়ি, মাখো তেল। সুবিধা দাও, চামর নাও। সে পথ বন্ধ হলে তোমায় প্রকাশ্যে গালমন্দ করতে এতটুকু বাঁধবে না। সোশ্যাল মিডিয়ায় অপমান করতেও হাত বিন্দুমাত্র কাঁপবে না!

This may contain: a red bird sitting on top of a black ground under a blue and white sky
সূত্র: ইন্টারনেট

ওহ্, বলা হয়নি। এরাই উচ্চ মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তদের সমস্যা। যাদের ‘কীর্তিনামা’-র পাশে লেখার মুখবন্ধে আমার বন্ধুবরের বাঁদরামি নেহাতই পুঁচকে শিশুপাঠ্য। সময় সময় ভাবি, উচ্চবিত্ত কিংবা উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণিই বা কেন এদের এত তোল্লাই দেয়? মানুষকে কাছে টেনে নিতে গিয়ে কেনই বা মানুষের স্বাভাবিক ধর্ম ভুলে যায় তারা? মানুষ যে স্বভাবগত ভাবে আত্মকেন্দ্রিক। স্বার্থপর। পরার্থপরতার মাহাত্ম্য সে বিশেষ বোঝে না। তা হলে কেন এ সমস্ত কারা? কীসের টানে? কীসের মোহে? চারপাশে গমগমে আওয়াজ না থাকলে ভালো লাগে না বলে? নিজেকে একা মনে হয় বলে? কিন্তু উলুবনে মুক্তো ছড়াতে গিয়ে তো শেষ পর্যন্ত একাই হয়ে যেতে হয়! দুঃখ-কষ্টের উপত্যকায় কাটাতে হয় একাকী বন্দিজীবন। অথচ দাওয়াই আছে। এ হেন অকৃতজ্ঞ-দলের জন্য অব্যর্থ দাওয়াই আমাদের জীবনের পাঁজিতেই লেখা আছে। শুধু প্রথমেই চামর কেড়ে, মুখোশ খুলে, সেটা প্রয়োগ করতে হয়। সটান বলে দিতে হয়।

চল ফোট!