গত শতাব্দীর আটের দশকের কোনও এক সময় ‘প্রগতি’র হিন্দি বিভাগে জনৈক মাঝবয়সি অনুবাদক যোগ দিয়েছিলেন। পরিবার আপাতত দেশে রেখে একাই এসেছিলেন, আশা ছিল ভালোমতো রোজগারপাতি করে ঘরবাড়ি গুছিয়ে নিয়ে বছরখানেক বাদে পরিবারকে ওখানে নিয়ে যাবেন; উদয়াস্তু পরিশ্রম করে রোজগার ভালোই করছিলেন, ঘরবাড়ি দিব্যি সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়েছিলেন– কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতে হঠাৎই টিবি রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়লেন। সে রোগ এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল যে একদিন ঝলকে ঝলকে রক্ত তুলে তিনি ইহলীলা সংবরণ করলেন। যথা সময়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে বেঁচেই যেতেন। কিন্তু সে সময় কোথায়? অসুস্থ হওয়ার ফুরসত কোথায়?
১২.
মস্কোর অনুবাদ জগতের কিছু রন্ধ্রপথ ও বাস্তব সমস্যা
কোনও ব্যবস্থাই চূড়ান্ত আদর্শস্থানীয় হতে পারে না। বিদেশি ভাষায় সাহিত্য প্রকাশ ভবনগুলিতে চুক্তিভিত্তিতে নিযুক্ত অনুবাদকদের অন্যত্র আরও বাড়তি কাজের এবং রোজগারের সুযোগ থাকায়, বিশেষত তা যদি বেশি লাভজনক হত সেক্ষেত্রে, সেই রন্ধ্রপথে মূল কাজে ব্যাঘাত বা ক্ষতি হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা থেকে যেত।
অতিরিক্ত রোজগারের প্রলোভনবশত অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে, অনেক সময় দেশের আবহাওয়া, পরিবেশ পরিস্থিতি বা খাদ্যাভাসের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারার দরুন কোনও কোনও অনুবাদককে অনতিকালের মধ্যে শারীরিকভাবে অসুস্থ এমনকী, অবসাদগ্রস্ত হয়ে দেশে ফিরে যেতে হয়েছে; দেশে ফিরে যাওয়ার অব্যবহিত পরে তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ অসুস্থতার জেরে অকালে বিগতও হয়েছেন। সোভিয়েত ইউনিয়নে বিনা অর্থব্যয়ে চিকিৎসার এমন সুব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও সে সুযোগের সদ্ব্যবহার তাঁরা করতে পারেননি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
ইতিপূর্বে পাতার সংখ্যা অনুযায়ী পারিশ্রমিকের যে উল্লেখ করেছি, তার মধ্যেও একটা অদ্ভুত অসংগতি ছিল। অনুবাদক যে-ভাষা থেকে অনুবাদ করছেন, সেটা মূল রুশোর ইংরেজি অনুবাদ হলে মূল রুশ পাঠের তুলনায় তার আয়তন অনেকটাই বেড়ে যায়। ফলে ইংরেজি থেকে যাঁরা অনুবাদ করছেন, তাঁদের তুলনায় যাঁরা মূল রুশ থেকে অনুবাদ করছেন তাঁরা কম পারিশ্রমিক পাচ্ছেন। এই অসংগতিটার দিকে আমাদের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে কোনও কাজ হয়নি।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
মনে আছে, গত শতাব্দীর আটের দশকের কোনও এক সময় ‘প্রগতি’র হিন্দি বিভাগে জনৈক মাঝবয়সি অনুবাদক যোগ দিয়েছিলেন। পরিবার আপাতত দেশে রেখে একাই এসেছিলেন, আশা ছিল ভালোমতো রোজগারপাতি করে ঘরবাড়ি গুছিয়ে নিয়ে বছরখানেক বাদে পরিবারকে ওখানে নিয়ে যাবেন; উদয়াস্ত পরিশ্রম করে রোজগার ভালোই করছিলেন, ঘরবাড়ি দিব্যি সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়েছিলেন– কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতে হঠাৎই টিবি রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়লেন। সে রোগ এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল যে একদিন ঝলকে ঝলকে রক্ত তুলে তিনি ইহলীলা সংবরণ করলেন। যথা সময়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে বেঁচেই যেতেন। কিন্তু সে সময় কোথায়? অসুস্থ হওয়ার ফুরসত কোথায়? চিকিৎসাধীন থাকলে তো আর piece rate-এ কাজ করার প্রশ্ন আসছে না– তখন মাসে বাঁধা ৩০০ রুবল মাইনে পাওয়া যাবে, সেখান থেকে দেশে নিয়মিত টাকা পাঠানোর পর আর কতটুকুই বা হাতে থাকে? ছুটি পাওনা থাকলে তার সুযোগ নিতে গেলেও সেই একই বিপত্তি। কারও যদি নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রার বেশি কাজের দরুন মোটা অঙ্কের টাকা প্রকাশ ভবনে জমা হয়ে থাকে, তাহলে চিকিৎসাধীন থাকলেও চিকিৎসকের বা হাসপাতালের সার্টিফিকেট (রুশিরা যাকে ‘বুলেটিন’ বলে) জমা দিয়ে তথাকথিত সেই ‘সুবিধা’ গ্রহণের পরোয়া না করলেও চলে। সেরকম টাকা জমা থাকলে সেই সুযোগে অনুবাদক ইচ্ছে করলে অন্য কোথাও বেড়াতেও যেতে পারেন। তবে অনুবাদক সচরাচর তা করেন না– তার তো আবার অন্যত্রও কাজ আছে।
কাজ যেহেতু বাড়িতে বসে সেই কারণে দেশ থেকে আগত পরিচিত-অপরিচিত অনেকেই দিনেদুপুরে, যখন-তখন সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়ে হানা দিয়ে থাকেন– গল্পসল্প, পান-ভোজনে সময় কেটে যায়। কিন্তু কাজ তো নির্দিষ্ট সময় জমা দিতেই হয়– অগত্যা রাত জেগে হোক, যে করেই হোক, কাজ হাসিল করতে হয়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে অনুবাদের মান নিয়ে তাই প্রশ্ন উঠতেই পারে।
ইতিপূর্বে পাতার সংখ্যা অনুযায়ী পারিশ্রমিকের যে উল্লেখ করেছি, তার মধ্যেও একটা অদ্ভুত অসংগতি ছিল। অনুবাদক যে-ভাষা থেকে অনুবাদ করছেন, সেটা মূল রুশের ইংরেজি অনুবাদ হলে মূল রুশ পাঠের তুলনায় তার আয়তন অনেকটাই বেড়ে যায়। ফলে ইংরেজি থেকে যাঁরা অনুবাদ করছেন, তাঁদের তুলনায় যাঁরা মূল রুশ থেকে অনুবাদ করছেন তাঁরা কম পারিশ্রমিক পাচ্ছেন। এই অসংগতিটার দিকে আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে কোনও কাজ হয়নি। ব্যক্তিগতভাবে আমি জানিয়েছিলাম যে, আমি তাহলে ইংরেজি থেকেই অনুবাদ করব; কিন্তু কর্তৃপক্ষ তা মানবে কেন? আমার চুক্তিপত্রে যে লেখা আছে আমি রুশ থেকেই বাংলায় অনুবাদ করব বলে চুক্তিবদ্ধ। তাছাড়া ওসব সিদ্ধান্ত নাকি আরও অনেক ওপরের তলায় নেওয়া হয়, যেখানে দরবার করার সাধ্য অনুবাদকের কেন, আমাদের বিভাগীয় প্রধানদেরও নেই।
পেরেস্ত্রৈকা পর্বে বিদেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের খোলা হাওয়া ঢোকার ফলে অনুবাদকদের মহলে ব্যাপক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। সেই ডামাডোলের বাজারে কোনও কোনও অনুবাদক প্রকাশ ভবনের যাবতীয় সুযোগ সুবিধা যথারীতি বজায় রেখে বিভিন্ন বাণিজ্য সংস্থায় পূর্ণ সময়ের কাজে বহাল হন, কেউ কেউ নিজস্ব ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করে দেন, কেউ বা বছরের পর বছর নিজের দেশের কোনও সংবাদমাধ্যমে বা পত্রপত্রিকার স্থায়ী ও স্বীকৃত প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করার সঙ্গে সঙ্গে অনুবাদকের চাকরিটাও দিব্যি ধরে রেখে দিতেন। অনুবাদের কাজটা সামান্য কিছু পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ওদেশে পাঠরত ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে করিয়ে নিতেন। বলাই বাহুল্য, বেনামে। অবশ্য লেনদেনটা অনেক সময় ডলারেই হত (ডলারের আসল বাজারদর তখন সরকারি বিনিময় মূল্যের অন্তত পাঁচগুণ)। শেষদিকে অনুবাদের মান অনেকখানি নেমে গিয়েছিল।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মতোই ‘প্রগতি’ ও ‘রাদুগা’র এই অধঃপতনের বীজও হয়তো তার গঠনপ্রকৃতির মধ্যেই নিহিত ছিল।
মনে রাখতে হবে, বিদেশি ভাষায় সাহিত্য প্রকাশালয় গঠনের প্রস্তাব, এমনকী, তার গঠনতন্ত্রও কোনও সরকারি মন্ত্রিসভায় নয়– সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে গৃহীত হয়েছিল। তাহলে কি আমরা সোভিয়েত সরকারের কর্মী ছিলাম, নাকি সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির অন্তর্ভুক্ত কোন সংস্থার কর্মী ছিলাম? মাথা চুলকোতে হয় বইকি: এ বড় জটিল প্রশ্ন!
…পড়ুন রুশকথার অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১১। সমর সেনকে দিয়ে কি রুশ কাব্যসংকলন অনুবাদ করানো যেত না?
পর্ব ১০। সমর সেনের মহুয়ার দেশ থেকে সোভিয়েত দেশে যাত্রা
পর্ব ৯। মস্কোয় অনুবাদচর্চার যখন রমরমা, ঠিক তখনই ঘটে গেল আকস্মিক অঘটন
পর্ব ৮: একজন কথা রেখেছিলেন, কিন্তু অনেকেই রাখেননি
পর্ব ৭: লেনিনকে তাঁর নিজের দেশের অনেকে ‘জার্মান চর’ বলেও অভিহিত করত
পর্ব ৬: যে-পতাকা বিজয়গর্বে রাইখস্টাগের মাথায় উড়েছিল, তা আজ ক্রেমলিনের মাথা থেকে নামানো হবে
পর্ব ৫: কোনটা বিপ্লব, কোনটা অভ্যুত্থান– দেশের মানুষ আজও তা স্থির করতে পারছে না
পর্ব ৪: আমার সাদা-কালোর স্বপ্নের মধ্যে ছিল সোভিয়েত দেশ
পর্ব ৩: ক্রেমলিনে যে বছর লেনিনের মূর্তি স্থাপিত হয়, সে বছরই ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার সূচনাকাল
পর্ব ২: যে দেশে সূর্য অস্ত যায় না– আজও যায় না
পর্ব ১: এক প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে রাশিয়ার খণ্ডচিত্র ও অতীতে উঁকিঝুঁকি