ছবি আঁকার সময় খুব জোরের সঙ্গে কলম, পেনসিল বা তুলি চালানোর ফলে তাঁর ছবির কাগজ ছিঁড়েছে বহুবার, কলমের আঁচড়ে কাগজে কত যে ফুটো হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। শক্তপোক্ত মোটা কাগজ বা বোর্ডে আঁকা ছবিতেও তৈরি করেছে গভীর ক্ষত। আঁকার মুহূর্তে রংতুলি খাতাকলমের সঙ্গে প্রতিনিয়ত সে এক দুর্মর লড়াই। এ কি শুধু ছবির বেলায়? ‘পূরবী’র সেই বিখ্যাত খাতা, যা কিনা আর্টিস্ট রবিঠাকুরের আঁতুড়ঘর– সেখানেও চলেছে কলম আর কাগজের প্রবল ধ্বস্তাধস্তি। ফলে তার এমন অবস্থা, সে খাতা এখন আর হাতে নিয়ে দেখা যায় না। সংরক্ষণের দিক থেকে রীতিমতো নিষেধ জারি করা হয়েছে।
২৫.
ছবি আঁকার সময় রং-তুলি-কাগজ কোনও দিকেই নজর ছিল না রবীন্দ্রনাথের। সে এক পাগলপারা অবস্থা। এসব খবর প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে শুনতে পাই। রবিঠাকুরের মূল ছবির সামনে দাঁড়ালে আমরাও কিছুটা আঁচ করতে পারি। চিঠিপত্রের টুকরোও মাঝে মাঝে জানান দেয়, রবীন্দ্রনাথের কাছে ছবির উপকরণ প্রথম প্রায়োরিটি নয়। রং-তুলির নেশা একবার পেয়ে বসলে হাতের কাছে যা আছে তাই দিয়ে ছবি আঁকা শুরু হত। ‘চিত্রপট’ বলতে শৌখিন কেতাদুরস্ত কাগজপত্র– এসব কিছু লাগত না। কত সময় বাতিল কাগজের ঝুড়ি থেকে কাগজের পাতা উঠে এসেছে। শুধু তাই নয়, পুরনো খবরের কাগজ, ফেলে দেওয়া র্যাপিং পেপার– উপহার হিসেবে যা পৌঁছেছিল তাঁর টেবিলে– সেই বাতিল কাগজের মোড়ক, পিচ বোর্ডের টুকরো, ম্যাসোনাইট বোর্ডের পিছন দিক, ছেঁড়া ফোটোগ্রাফের উল্টোপিঠ ইত্যাদি ইত্যাদি। লিস্ট দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে উঠবে। এমনকী, কাগজের পরিবর্তে আলমারির কাঠের পাল্লাও বাদ পড়েনি তাঁর সৃষ্টির মাতলামি থেকে। যাকে ভাইপো অবন ঠাকুর যথার্থ সংজ্ঞায়িত করেছেন, ভিতর থেকে বেরিয়ে আসা আগ্নেয়গিরির জ্বলন্ত লাভার মতো এ সেই ‘creative urge’– যাকে ঠেকিয়ে রাখা যায় না, আগল দেওয়া অসম্ভব। কবি নিজেও স্বীকার করেছেন– ‘মাতনের মাত্রা অনুসারে বাণীর চেয়ে গানের বেগ বেশি, গানের চেয়ে ছবির’। এই আবেগের বশেই ছবি আঁকতে গিয়ে তাঁর পেনসিলের শিস পট পট করে ভেঙে যায়, প্যাস্টেল যায় টুকরো হয়ে, তুলির ডগায় রং জমিয়ে তুলতে তর সয় না, তুলির কাঠের হাতলও তৎপর হয়ে ওঠে। ফলে তাঁর ছবির কাগজ দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে পড়ে। তাই বলে ভালো কাগজে একেবারেই ছবি আঁকেননি, তা নয়। সময়ের কষ্টিপাথরে– যাকে ইংরেজিতে ‘aging’ বলতে পারি– সেই ছবির কন্ডিশন তুলনায় অনেক ভালো। স্বাভাবিক ভাবে বেশির ভাগ প্রদর্শনীর নির্বাচনে অপেক্ষাকৃত ভালো কন্ডিশনের ছবি প্রথম প্রায়োরিটি পায়। সামগ্রিক ভাবে রবীন্দ্রনাথের ছবির অবস্থা যে বেশ জীর্ণ ও সংকটজনক, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এই কারণে, রবীন্দ্রনাথের ছবি যথাযথ সংরক্ষণ (preservation এবং conservation) করা সহজ নয়, প্রধানত ছবির কাগজের জন্যে। আগেই বলেছি, ছবি আঁকার সময় খুব জোরের সঙ্গে কলম, পেনসিল বা তুলি চালানোর ফলে তাঁর ছবির কাগজ ছিঁড়েছে বহুবার, কলমের আঁচড়ে কাগজে কত যে ফুটো হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। শক্তপোক্ত মোটা কাগজ বা বোর্ডে আঁকা ছবিতেও তৈরি করেছে গভীর ক্ষত। আঁকার মুহূর্তে রংতুলি খাতাকলমের সঙ্গে প্রতিনিয়ত সে এক দুর্মর লড়াই। এ কি শুধু ছবির বেলায়? ‘পূরবী’র সেই বিখ্যাত খাতা, যা কিনা আর্টিস্ট রবিঠাকুরের আঁতুড়ঘর– সেখানেও চলেছে কলম আর কাগজের প্রবল ধ্বস্তাধস্তি। ফলে তার এমন অবস্থা, সে খাতা এখন আর হাতে নিয়ে দেখা যায় না। সংরক্ষণের দিক থেকে রীতিমতো নিষেধ জারি করা হয়েছে। রবীন্দ্রভবন আর্কাইভের ভল্টে অত্যন্ত সাবধানে রক্ষিত রবিঠাকুরের সে অমূল্য খাতা। তার প্রতিটি পাতায় আঁকিবুঁকির নকশা, পাতার দু’পিঠের লেখা ঘিরে কাটাকুটির চাপে ঝাঁঝরির মতো তা ফুটো হয়ে এসেছে। সে যেন জাফরি কাটা দেওয়াল, স্যাঁকরার হাতে সযত্নে ফিলিগ্রি করা রূপোর পাত। কবিতার ছত্র বা শব্দের বদল ঘিরে নির্মিত রেখার জাল, তার ক্রিসক্রস লাইন পরবর্তী কালে ছবিতেও বার বার ফিরে এসেছে।
মনে পড়বে, আর্জেন্টিনায় ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর আতিথ্যে থাকাকালীন রসিকতার সুরে ওকাম্পো তাঁকে বলেছিলেন– কাটাকুটি থেকে ছবি তৈরির নেশা রবীন্দ্রনাথকে তখন এমন পেয়ে বসেছিল, খানিকটা যেন ইচ্ছে করেই তিনি খারাপ কবিতা লিখতে চাইতেন, যাতে কাটাকুটির অঢেল সুযোগ থেকে যায়। রসিকতার ছলে ওকাম্পো সে কথা বললেও ‘পূরবী’র খাতাখানা দেখলে হতবাক হতে হয়– সেখানে কী আশ্চর্য কাণ্ডই না ঘটিয়েছেন রবিঠাকুর! সেই সঙ্গে আরেকটা বিষয় মনে রাখতে হয় আমাদের, তাঁর পছন্দের কলমের কালি ছবির কাগজের প্রভূত ক্ষতি করেছে। কালো কালি ছিল কবির বিশেষ পছন্দের, সে ছবি হোক বা লেখার সময়। সাদা খাতার পাতায় তাঁর কবিতার কাটাকুটির আলপনা যেন তাঁর গানের কলি হয়ে দেখা দেয়– ‘অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো’র আবির্ভাব। কালো বাদে আরেকটা কালী তিনি সংশোধন বা পরিমার্জনের সময় অকাতরে ব্যবহার করেছেন, সে কালির রং লাল। খেয়াল করলে দেখব, ‘পূরবী’র বছরখানেক আগে ‘রক্তকরবী’র পাতায় সেই জান্তব আকারের কাটাকুটির ছবিতে লাল আর কালোর ছড়াছড়ি। বিজ্ঞানের নিরিখে কালো আর লাল এই দুটো কালি প্রচুর পরিমাণে অ্যাসিড বহন করে, এরা ‘আয়রন গাল ইঙ্ক’। এই কালির ব্যবহারে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে লেখার পাতা অ্যাসিডিক হয়ে ওঠে। অতিরিক্ত অম্লত্বের জন্যে এই কালিতে লেখা কাগজ ছিঁড়ে বা ফেটে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। রবীন্দ্রনাথের পাণ্ডুলিপি এবং ছবির কাগজ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ এই রং বা কালি। কেবল কালি নির্বাচনের জন্যেও নয়, প্রচুর ঘনত্বের জিনিস একত্রে ব্যবহার করেছেন তিনি। ঝরনা কলমের কালি, জলরং, বিদেশি ওয়াটার-প্রুফ ইঙ্ক, প্যাস্টেল সবকিছু মিলেমিশে একাকার। কেমিস্ট্রির ভাষায় এই বিচিত্র উপকরণের রাসায়নিক বিক্রিয়া কাগজের তীব্রভাবে ক্ষয় করে। এখানেই ক্ষান্ত হননি ছবিঠাকুর, শিল্পীচিত্তের তাড়না মাঝে মাঝে এত জোরালো হয়ে উঠেছে যে, রং শুকোনোর তর সইতে পারতেন না। দ্রুত শুকোনোর জন্যে রঙের মধ্যে স্পিরিট ঢেলে দিতেন। ভারনিশ মাখিয়ে দিতেন। উপকরণের এমন বিচিত্র যোগসাজশে ছবির কাগজ দুর্বল এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
খেয়ালি মন আর হাতের কাছে থাকা উপকরণ দিয়ে ছবি আঁকার ফলে তার ছবির আয়ু যে বেশিদিন নেই, সেটা বুঝতে পেরেছিলেন অনেক পড়ে। এ বিষয়ে তাঁর গলায় কখনও মৃদু আফসোসের সুরও শোনা গিয়েছে। প্যারিসে ছবি প্রদর্শনীর পরে বিলেত থেকে পুত্র রথীন্দ্রনাথকে তিনি চিঠিতে লিখছেন,– ‘সার মাইকেল স্যাডলার ছবি সম্বন্ধে সমজদার বলে খ্যাত, তাই তাঁকে আমার ছবি দেখতে ডেকেছিলুম, ম্যুরহেড বোন-ও ছিলেন। ওঁদের খুব ভালো লেগেছে। বোন বলছিলেন, খারাপ কালী দিয়ে খারাপ কাগজে না আঁকলে আরো ভাল হ’ত’। ম্যুরহেড বোন ছাপাই-ছবির বিখ্যাত শিল্পী, রবীন্দ্রনাথের বন্ধুও বটে। তরুণ মুকুল দে একদা তাঁর কাছে ছাপাই ছবির কাজ শিখেছেন। ম্যুরহেডের কথা হয়তো রবীন্দ্রনাথকে এ ব্যাপারে সচেতন করেছিল। সেবারে ছবি আঁকার রং কাগজ আর কালি বিদেশ থেকে সংগ্রহ করে এনেছিলেন। আগ্রহের সঙ্গে রথী ঠাকুরকে লিখছেন– ‘কিছু বেশি পরিমাণে রঙীন কালী ও কাগজ দরকার হবে। কিছু কাগজ জার্মানি থেকে নিয়েচি। ফরাসী কালী সব চেয়ে ভালো। কিন্তু বড়ো শিশি চাই নইলে দুদিনে ফুরিয়ে যাবে। পাউন্ড পাঁচেক ওকে (আন্দ্রে কারপেলেস) যদি পাঠানো যায় তাহলে বোধ হয় কিছুদিনকার মতো সরঞ্জাম জোগাড় হতে পারবে’। একই তারিখে প্রতিমা দেবীকেও লিখেছেন– ‘এদেশ থেকে রঙীন কালী আর কাগজ নিয়ে যাব– তার পরে ভরসা করচি আমার ছবি আঁকা নিরর্থক হবে না’। কিছুকাল পরে শান্তিনিকেতনে ফিরে জার্মানিতে পাঠরত মীরা দেবীর পুত্র নীতীন্দ্রনাথকে লিখছেন,– ‘মোলারের কাছ থেকে যে টাকা পেয়েছিস তার থেকে ছবির কাগজ পাঠাস।… প্যারিস থেকে নানা রঙের কালী এনেছিলুম, ছবি আঁকতে সেগুলো খুব ভালো, তোদের ওখানে যদি ভালো কালী থাকে এক সেট পাঠাবার চেষ্টা করিস’ ইত্যাদি। অর্থাৎ কাগজ বা রঙের ব্যাপারে তিনি তখন যথেষ্ট সচেতন।
এই পর্বে ছবির স্থায়িত্ব নিয়ে তিনি এতটাই চিন্তিত, সরকারি আর্ট কলেজে মুকুল দে আয়োজিত প্রদর্শনীতে সম্মত হয়েছেন এই জন্য যে, ছবিগুলো যথাযথ মাউন্ট করা হয়ে যাবে। অবন ঠাকুরকে লিখেছেন– ‘মুকুল আমাকে একজিবিশনের পাকে টানবার চেষ্টায় আছে। মন স্থির করতে পারচি নে। শেষকালে জাতও যাবে পেটও ভরবে না। একটিমাত্র লোভের কারণ আছে। সব ছবিগুলো ও মাউণ্ট করে বাঁধিয়ে দিতে রাজি। বাঁধাতে না পারলে আমাদের জোলো হাওয়ায় ছবিগুলো বিবর্ণ হবে আশঙ্কা হয়। বাঁধাবার খরচ নিজের থেকে জোগাবার সাধ্য নেই’। এখানেই শেষ নয়, তাঁর জীর্ণ ছবিগুলি কপি করিয়ে রাখার কথাও মনে হয়েছে। কপি করার কাজে নির্বাচিত হয়েছেন নন্দলালের পুত্র বিশ্বরূপ। বিশ্বরূপের কাজ পরখ করে নিজের কিছু ছবি কপি করিয়ে রাখার তলব পাঠিয়েছেন। রথীন্দ্রনাথকে এ প্রসঙ্গে লিখেছেন,– ‘বিশু এসেচে– তার কাজ দেখে খুশি হয়েছি। আমার যে ছবি ভালো অথচ টেঁকসই নয় সেইগুলো তাকে দিয়ে পুনরঙ্কিত করে নিলে বোধ হয় তাদের একরকম উদ্ধার হয়ে যায়। মূলের সঙ্গে কপির কোন ভেদ থাকবে না’। এ চিঠির বক্তব্য আমাদের খানিকটা ভাবনায় ফেলে!
যদিও আজকের ডিজিটাইজেশন যুগের আগে এই পথই হয়তো একান্তভাবে গ্রহণীয় ছিল। তবে রবিঠাকুরের কতগুলো ছবি বিশ্বরূপ কপি করেছিলেন জানি না। আদৌ করেছিলেন কি না তাও নিশ্চিত বলা যায় না। মনের মধ্যে তবু একটা খটকা রয়ে যায়, এতকাল যে ছবির তুলির টান রবিঠাকুরের বলে জানি– তার কোনও কোনও ছবি কি তবে ‘বিশু’র কপি করে দেওয়া?