আমাদের বইপাড়ায় চিরকালের একটা সংকট হল, পাঠক হাতে নিয়ে পড়ে-দেখে বই বাছার বিশেষ সুযোগ পান না। সামান্য দুয়েকটা দোকান ছাড়া অন্য কোথাও সে-সুযোগ আজও নেই। আমাদের বাড়ির সামনেই ‘কথা ও কাহিনী’-র দোকান। কথা ও কাহিনী ক্রমশ টেক্সট বইয়ের ব্যবসায় চলে গেলেও, জয়ন্তদা-কল্যাণদা-বিজয়দাদের আমলে তাদের অনেক ভালো-ভালো সাহিত্যের বই ছিল, অনুবাদের বই ছিল। ওই দোকানে কিন্তু ভেতরে ঢুকে দেখে-পড়ে বই কেনার ব্যবস্থা ছিল। আমরা দে’জ পাবলিশিং-এ পাঠকদের জন্য দেখে বই নেওয়ার ব্যবস্থা দীর্ঘদিন করতে পারিনি। যদিও আমার ভাই বাবু অনেক দিন ধরেই ছাত্র-ছাত্রী, অল্পবয়সিদের দোকানে ঢুকে বই দেখার সুযোগ দেয়। এটা আমাদের বাবা-র শেখানো– প্রকৃত পড়ুয়াদের বাবাও নানাভাবে সাহায্য করতেন, নতুন বই হাতে তুলে দিতেন।
১৩.
কয়েক দিন আগে খবর পেলাম ‘রিফ্লেক্ট প্রকাশনী’ বন্ধের মুখে। রিফ্লেট-এর দপ্তরটা ছিল আমাদের শিয়ালদার বাড়ির একেবারে কাছেই, মহাত্মা গান্ধী রোডের এপারে আমাদের বাড়ি আর রাস্তার উল্টোদিকে রিফ্লেক্ট, একটা বাড়ির দোতলায়। ওই একই বাড়িতে একটা হোটেলও আছে। রিফ্লেক্ট-এর ঠিকানা ছিল ৩০ নম্বর মহাত্মা গান্ধী রোড আর আমাদের বাড়ির ঠিকানা হল ৩১/১ বি, মহাত্মা গান্ধী রোড। ৩০ নম্বর মহাত্মা গান্ধী রোডের দোতলায় ওদের চমৎকার অফিস ছিল। রিফ্লেক্ট নামটা শুনলেই যে-কোনও বাঙালির মতো আমার মনে পড়ে যায়, শ্যামল বসু-র লেখা ‘সুভাষ ঘরে ফেরে নাই’। এক সময় ওই বইটা কলেজ স্ট্রিটে হাজার-হাজার কপি বিক্রি হয়েছে। রিফ্লেক্ট খুব বেশি দিনের পুরনো প্রকাশন সংস্থা নয় বলেই আমার ধারণা। সম্ভবত দে’জ পাবলিশিং-এর সমসাময়িকই হবে। কয়েক বছর এদিক-ওদিক হতে পারে। অনেক পরে, ডিসেম্বর ২০০১-এ যখন রবীন্দ্রনাথের লেখার কপিরাইট উঠে গেল, তখন তাঁরা অবিশ্বাস্য সস্তায় রবীন্দ্রনাথের বই ছাপাও শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু বই তখন তাঁরা পেপারব্যাকে পকেটবুক সাইজে করেছিলেন। রিফ্লেক্ট-এর অনেক বই পাঠকমহলে বিপুল জনপ্রিয় ছিল, কিন্তু বইয়ের অঙ্গসৌষ্ঠবে তাঁরা খুব একটা নজর দিতেন বলে মনে হয় না।
আবার বইয়ের অঙ্গসজ্জা ও বিষয়বস্তুতে বাংলা প্রকাশনায় বিপ্লব ঘটিয়ে দেওয়া ‘সিগনেট বুক শপ’ কলেজ স্ট্রিটে আমাদের ঠিক পাশের বাড়িতে– ১২ এ বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট। সিগনেট-এর জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল আমার বাবার আমলে। ওই চারের দশকেই ডি কে (দিলীপকুমার গুপ্ত) সিগনেট থেকে একের পর এক অত্যাশ্চর্য প্রকাশনা করতে শুরু করেন। যতদূর জানি, ডি কে-র প্রকাশনায় আসার পিছনে তাঁর শাশুড়ি নীলিমা দেবীর একটি বড় ভূমিকা আছে। বাংলা প্রকাশনায় ডি কে নামটাই আজকে মিথ হয়ে গেছে। নীলিমা দেবীর নাম আর তত মানুষ জানে না। কিন্তু নীলিমা দেবীকে বাদ দিয়ে সিগনেটের কথা সবটা বোঝা যায় না। ১৯৪৩ সালে নীলিমা দেবীর স্বামী প্রভুচরণ গুহঠাকুরতার মৃত্যুর বছরেই সিগনেট প্রেসের প্রতিষ্ঠা। ডি কে ছিলেন বিজ্ঞাপনের লোক, ‘ডি জে কিমার’-এ উঁচু পদে কাজ করতেন। কিন্তু বাংলা প্রকাশনায় বদল ঘটানোর স্বপ্নে বিভোর একজন মানুষ। ডি জে কিমার-এই সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা। পরে সত্যজিতের মলাট আর ডি কে-র প্রোডাকশন বাংলা বইকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। শুনেছি প্রতিষ্ঠানের সবার মতো ডি কে-ও নীলিমা দেবীকে ‘ম্যাডাম’ বলে ডাকতেন। সিগনেট বুক শপ যখন কলেজ স্ট্রিটে তৈরি হল সেই সময়কার স্মৃতি শঙ্খদা (শঙ্খ ঘোষ) লিখেছেন ১৯৯৬-এ দে’জ পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত ‘বইয়ের ঘর’-এ ‘ফুটপাথে ফুলের গল্প’ নামের লেখাটিতে।
আমাদের বইপাড়ায় চিরকালের একটা সংকট হল, পাঠক হাতে নিয়ে পড়ে-দেখে বই বাছার বিশেষ সুযোগ পান না। সামান্য দুয়েকটা দোকান ছাড়া অন্য কোথাও সে-সুযোগ আজও নেই। বাংলা বইয়ের ক্ষেত্রে কলকাতায় এই সমস্যা খুবই প্রকট। আমাদের বাড়ির সামনেই, একই ঠিকানায়, ‘কথা ও কাহিনী’-র দোকান। এই দোকানটি ছিল শ্যামাচরণ দে-র উত্তরসূরিদের। আমাদের বাড়িটাও এককালে শ্যামাচরণ দে-র বাড়ি ছিল। কবি বিষ্ণু দে-র মামার বাড়ি। কথা ও কাহিনী-র সেসময়ের কর্ণধার ছিলেন– জয়ন্তদা, কল্যাণদা, বিজয়দারা। পরে ওই দোকানের মালিকানা বদল হয়। এখন গোটা কলকাতায় কথা ও কাহিনীর বেশ কয়েকটি দোকান হয়েছে। কথা ও কাহিনী ক্রমশ টেক্সট বইয়ের ব্যবসায় চলে গেলেও, জয়ন্তদা-কল্যাণদা-বিজয়দাদের আমলে তাদের অনেক ভালো-ভালো সাহিত্যের বই ছিল, অনুবাদের বই ছিল। এই শতাব্দীর শুরুর দিকেও তাঁরা বেশ কিছু সাহিত্যের বই করেছিলেন। ওই দোকানে কিন্তু ভেতরে ঢুকে দেখে-পড়ে বই কেনার ব্যবস্থা ছিল। আমরা দে’জ পাবলিশিং-এ পাঠকদের জন্য দেখে বই নেওয়ার ব্যবস্থা দীর্ঘদিন করতে পারিনি। যদিও আমার ভাই বাবু অনেক দিন ধরেই ছাত্র-ছাত্রী, অল্পবয়সিদের দোকানে ঢুকে বই দেখার সুযোগ দেয়। এটা আমাদের বাবা-র শেখানো– প্রকৃত পড়ুয়াদের বাবাও নানাভাবে সাহায্য করতেন, নতুন বই হাতে তুলে দিতেন। এখন অবশ্য বিদ্যাসাগর টাওয়ারে আমাদের নতুন দোকানে কিংবা দিঘার দোকানে বই হাতে নিয়ে দেখার যথেষ্ট সুযোগ আছে।
শঙ্খদার যে লেখাটার কথা বলছিলাম তাতেও সিগনেট বুক শপ-এ হাতে বই নিয়ে দেখার আনন্দের কথা আছে। তিনি লিখেছেন,
‘‘ছোট্ট দোকান, কিন্তু প্রথম প্রথম ভয় হতো তার ভিতরে পা দিতে। ফুটপাথের দিকে মুখ করিয়ে দাঁড় করানো আছে শেলফের ওপর অল্প কখানা বই, পথের ওপর সিঁড়িতে দাঁড়িয়েই তাকিয়ে থাকতাম আমরা। ‘ভিতরে আসুন না’: কেউ হয়তো ডাকতেন সাদরে। ‘না, দেখছি শুধু, কিনবার টাকা নেই’ এমন কোনো দ্বিধান্বিত উত্তর শুনলে বলতেন তাঁরা ‘তাতে কী হলো, ভিতরে আসুন, হাত দিয়ে দেখুন, পড়ুন। না কিনলেও চলবে।’ বই না কিনেও হাত দেওয়া যাবে বইয়ে খুশিমতো? পড়া যাবে এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই? এই নতুনরকমের অভ্যর্থনায় দিশেহারা হয়ে যাই আমরা, সময় পেলেই তাই চলে যাই একবার সিগনেটে।’’
ডি কে-র সঙ্গে আমার কখনও সাক্ষাৎ পরিচয় হয়নি। সাতের দশকে আমি যখন কলেজ স্ট্রিটে কাজ শুরু করলাম, ততদিনে ডি কে এবং সিগনেট-এর সেই রমরমা আর নেই। ডি কে-র মৃত্যু ১৯৭৭ সালে, কিন্তু তার অনেক দিন আগে থেকেই তিনি প্রকাশনায় খুব নিয়মিত ছিলেন না। তবে সিগনেট বুক শপ ছিল নিজস্ব ছন্দে, আর সেটি দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন বিকাশদা, বিকাশ বাগচী। বিকাশদা ১৯৫২ সাল থেকে সিগনেটে কাজ করেছেন। তারও আগে ১৯৪৮ সালে বউবাজার হাইস্কুলের পাশে অল্প কিছু দিনের জন্য তিনি একটা বইয়ের দোকানও করেছিলেন। যদিও বছর দুয়েকের মধ্যে পারিবারিক দায়-দায়িত্ব সামলাতে গিয়ে তিনি সে দোকান বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। বিকাশদার মতো সজ্জন অমায়িক মানুষ শুধু কলেজ স্ট্রিট কেন, বাঙালি সমাজেই দুর্লভ। একটি সাক্ষাৎকারে বিকাশদা বলেছিলেন–
‘এ পাড়াতে আমি সিগনেটেই প্রথম কাজ করি এবং আজও করছি। তারপর আস্তে আস্তে দিন যেতে লাগল, লোকজনের সঙ্গে আলাপ-টালাপ হল। কিন্তু আমি যখন এখানে ঢুকি তখন থেকেই আমার ইচ্ছা, পারলে কিছু ভালো বই-টই করব। আমার অর্থ ছিল না, তো যাইহোক, চেষ্টা করতে করতে ১৯৬৫ সালে ঠিক করলাম যে কিছু একটা করব। তখন আমি আমার কোম্পানিতে গিয়ে বললাম আমার এই এই অবস্থা, একটা কিছু করতে চাই; এখন পথ হচ্ছে দুটো এক আপনি আমাকে ছেড়ে দিন, আমি চেষ্টা করে… তা না হলে আপনাদের মধ্যে থেকেই যেটা করব, এমন ধরনের কাজ যেটা আপনাদের নেই (সেটা বলেছিলাম সিগনেটের, মানে দিলীপবাবুর শাশুড়িকে)। উনি শুনে বললেন– দেখো, আমাদের অবস্থাটা তো ততটা ভালো নয়, তুমি চলে গেলে কিন্তু আমি দোকান বন্ধ করে দেব। আমি বললাম সে কী! এটা কী একটা যুক্তিপূর্ণ কথা হল? তা আমাকে বললেন যে কী কাজ করতে চাও? বললাম কিছু বই-টই যদি ছাপি, তা আপনাদের ব্যতিরেকে। উনি রাজি হলেন, কিন্তু বললেন ঠিক আছে করতে পারো, তবে আমাকে যদি একটু দেখিয়ে নাও করার আগে… আমি বললাম আমার কোনো আপত্তি নেই। তা প্রথম দিকে দু-চারটে বইয়ের নমুনা আমি ওনাকে দেখিয়েছিলাম, উনি দেখে আপত্তি নেই বলে ছেড়ে দিয়েছিলেন।’
বিকাশদা নিজে যে প্রকাশনা খুলেছিলেন তার নাম ছিল ‘অরুণা প্রকাশনী’। সম্রাট সেনের ‘যমুনাবতী সরস্বতী’ উপন্যাস দিয়ে শুরু করে ধীরে ধীরে বিকাশদা অসামান্য সব বই প্রকাশ করেছিলেন। অরুণার ঠিকানা হিসেবে লেখা থাকত, ৭ যুগলকিশোর দাস লেন। সম্ভবত ওটা বিকাশদার বাড়ির ঠিকানা। ধুতি-পাঞ্জাবিতে নিপাট বাঙালি ভদ্রলোক বিকাশদার সঙ্গে আমার রোজই দেখা হত। তখন আমার ছিল পান খাওয়ার নেশা। বিকাশদাও পান খেতেন বলেই মনে হচ্ছে। রোজ বিকেলে তিনি একবার আমাদের দোকানে আসতেনই। সিগনেট বুকশপে কাজ করতে করতে বিকাশদারও ভালো বই ভালোভাবে ছাপার একটা রুচি তৈরি হয়ে গিয়েছিল। অরুণার গ্রন্থ তালিকায় চোখ বোলালে সেটা সহজেই বোঝা যায়– বিনয় ঘোষ, পূর্ণেন্দু পত্রী, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, অমিয়ভূষণ মজুমদার, তারাপ্রণব ব্রহ্মচারী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, দেবেশ রায়, গুণময় মান্না, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়– কার বই ছিল না ! শঙ্খদার সঙ্গেও বিকাশদার খুবই সুসম্পর্ক ছিল। ‘ছন্দের বারান্দা’, ‘কথা নিয়ে খেলা’, ‘আদিম লতাগুল্মময়’, ‘নিঃশব্দের তর্জনী’, ‘সকালবেলার আলো’, ‘সুপুরিবনের সারি’– শঙ্খদার এই সব বইয়ের প্রকাশক ছিলেন বিকাশদা। উনি আরেকটা আসামান্য কাজ করেছিলেন শঙ্খদা আর নির্মাল্য আচার্যের যৌথ সম্পাদনায়– ‘সতীনাথ গ্রন্থাবলী’র চারটি খণ্ড। বিকাশদা চলে যাওয়ার পর সিগনেট এখন আনন্দ পাবলিশার্স-এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে। অরুণা-র অনেক বই বিভিন্ন প্রকাশনায় চলে গেছে, দে’জ পাবলিশিং-এও এসেছে কিছু। তবে বিকাশদার ছেলে কিছু-কিছু টাইটেল এখনও রেখেছে। যদিও অরুণা-র আর কোনও দোকান নেই কলেজ স্ট্রিটে।
এদিকে, কলেজ স্ট্রিটে কোনও দিনই দোকান ছিল না ‘সাহিত্য সংসদ’-এর। সাহিত্য সংসদ-এর ইতিহাস আরও পুরনো– ‘সরস্বতী প্রেস’-এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে। মহেন্দ্রনাথ দত্ত পাঁচের দশকে প্রতিষ্ঠা করেন শিশু সাহিত্য সংসদ এবং তার পরে বড়দের বইয়ের জন্য সাহিত্য সংসদ। সাহিত্য সংসদ অসংখ্য ভালো বই প্রকাশ করেছে কিন্তু তাদের একটা বিশেষ পরিচিতি তৈরি হয় নানা রকম অভিধান প্রকাশের জন্য। সংসদের যে কোনও কাজে সুরুচি ও সম্পাদনার ছাপ পাওয়া যায়। তাঁরা যেমন-তেমন ভাবে অসম্পাদিত কোনও বই প্রকাশ করেন না। সংসদের বর্তমান কর্ণধার দেবজ্যোতি দত্তের সঙ্গে আমার বহুকালের পরিচয়। দেবজ্যোতিদা যাদবপুরের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। আমি আর দেবজ্যোতিদা প্রায় কাছাকাছি সময়েই প্রকাশনায় আসি। বই প্রকাশের প্রতিটি খুঁটিনাটি তিনি নিখুঁতভাবে জানেন। তাঁর হাতে তৈরি অশোক মুখোপাধ্যায়ের ‘সমার্থ শব্দকোষ’ তো বাংলা প্রকাশনায় একটা মাইল স্টোন। পরে দেবজ্যোতিদার স্ত্রী চন্দনা বউদিও প্রকাশনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে শুরু করেন। প্রতি বছর পয়লা অগাস্ট ‘শিশু সাহিত্য সংসদ প্রাইভেট লিমিটেড’-এর প্রতিষ্ঠা দিবস পালিত হয়। বহু দিন ধরেই আমি তাতে আমন্ত্রণ পাই। ১৯৯৬ সালের এমন একটা আমন্ত্রণপত্র খুঁজে পেলাম যাতে লেখা আছে–
‘সুধী,
আগামী ১ অগাস্ট ১৯৯৬ বৃহস্পতিবার আমাদের সংস্থার ৪৬ তম প্রতিষ্ঠা দিবস। এই সুদীর্ঘ চলার পথে সবসময় পেয়েছি আপনাদের সহৃদয় সহযোগিতা ও উষ্ণ সান্নিধ্য। আগামী দিনগুলোতেও আপনাদের সহযোগিতা পাব বলেই আশা রাখি। এই শুভ দিনটিতে আমাদের কার্যালয়ে আপনার উপস্থিতি আমরা একান্তভাবে কামনা করছি।…’
সেবার আমি ওই অনুষ্ঠানে যেতে পারিনি। আমন্ত্রণপত্রের খামের গায়ে দেখছি ১ আগস্ট তারিখেই আমার উত্তরের একটা খসড়া লেখা আছে–
‘শ্রীযুক্ত দেবজ্যোতি দত্ত
শ্রীমতী চন্দনা দত্ত,
শ্রদ্ধেয় দাদা/বৌদি
পত্রে আমার প্রণাম নেবেন। আজ আমি দেরাদুন ছেলেকে
নিয়ে চলে যাচ্ছি। তাই এবার ১লা আগষ্ট আপনাদের অনুষ্ঠানে যাওয়া হলো না। যেতে পারলে খুব আনন্দ হোত।
ইতি
সুধাংশু’
এই দেরাদুন যাওয়ার প্রসঙ্গটা আগেও বলেছি, অপুর পড়াশোনার জন্যই আমাদের সেবার দেরাদুন যাওয়া।
এর আগে একবার আমার কম বয়সে দেখা বইপাড়ার ছবিটা বলার চেষ্টা করেছিলাম। তখন বইপাড়ায় আমার পরিচিতি ছিল ‘ভগবানের ছেলে’ বলে। বাবার সুনাম আমাদের চার ভাইকেই জীবনে অনেকটা এগিয়ে দিয়েছে। ‘ভগবানের ছেলে’ বলে আমাকে সম্ভবত প্রথমবার সম্বোধন করেছিলেন প্রখ্যাত শিশুসাহিত্যিক ও ‘কিশোরভারতী’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক দীনেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বিদ্যোদয় লাইব্রেরি-তে বই আনতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে আমার কয়েকবার দেখা হয়েছিল। প্রকাশ ভবন-এর সহ শচীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, ‘ডি এম লাইব্রেরী’-র গোপালদাস মজুমদারের কাছেও আমার এই একই পরিচিতি ছিল। তখনও প্রকাশনা শুরু করিনি। পরে প্রকাশনায় আসার সময় ‘মণ্ডল বুক হাউস’-এর সুনীল মণ্ডল, ‘বিশ্ববাণী’র ব্রজকিশোর মণ্ডলরা আমাকে হাতে কলমে অনেক কিছু শিখিয়েছেন। ‘বেঙ্গল পাবলিশার্স’-এর ময়ূখ বসু, ‘নবপত্র’-র প্রসূন বসু, ‘এম সি সরকার’-এর সুপ্রিয় সরকার, ‘করুণা প্রকাশনী’র বামাচরণ মুখোপাধ্যায় আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। ‘এম সি সরকার’-এর শমিত সরকার আর ‘মিত্র ও ঘোষ’-এর ভানুদার (সবিতেন্দ্রনাথ রায়) সঙ্গেও আমার খুবই হার্দিক সম্পর্ক। প্রসূনদার কথা পরে বিশদে বলব। এখন বামাচরণ মুখোপাধ্যায়, আমার বামদা-র কথা বলি।
জীবনে চলার পথে এমন কিছু মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে যা অনেক ক্ষেত্রে রক্তের সম্পর্কের থেকে বড় হয়ে যায়। তাঁরা হয়ে ওঠেন আমাদের আত্মার আত্মীয়। আমার জীবনে এমনই একজন মানুষের ছিলেন বামাচরণ মুখোপাধ্যায়, আমার বামদা। ‘করুণা প্রকাশনী’র প্রতিষ্ঠাতা-কর্ণধার এই মানুষটি ছিলেন আক্ষরিক অর্থে জীবনরসিক। কথায় কথায় হরেকরকম রসিকতা করে একেবারে মাতিয়ে রাখার মতো মানুষ। বামদা প্রয়াত হয়েছেন গত বছর। তাঁর এই চলে যাওয়া আমার কাছে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক শোক।
বামদা ছিলেন অবিভক্ত বর্ধমান জেলার মানুষ । প্রথমে স্কুলপাঠ্য বই দিয়ে শুরু করে তিনি ক্রমশ গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধের বহু গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশ করেছেন। ‘করুণা’ প্রকাশনী থেকে ঈশানচন্দ্র ঘোষের ‘জাতক’, শঙ্করনাথ রায়ের ‘ভারতের সাধক’, ‘ভারতের সাধিকা’ ইত্যাদি বই খণ্ডে খণ্ডে বেরিয়েছে। এছাড়াও তিনি প্রকাশ করেছেন মহাশ্বেতা দেবীর ‘অরণ্যের অধিকার’, ‘হাজার চুরাশির মা’; অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’, ‘ঈশ্বরের বাগান’, ‘অলৌকিক জলযান’; শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কুবেরের বিষয় আশয়’; প্রফুল্ল রায়ের ‘কেয়াপাতার নৌকো’; অমর মিত্রর ‘ধ্রুবপুত্র’, ‘মালতি মাধব’, ‘গজেন ভুঁইঞার ফেরা’; নলিনী বেরার ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’, ‘শবর চরিত’ ইত্যাদি বই।
বামদার সঙ্গে আমার কবে প্রথম পরিচয় হয়েছিল তা আজ আর মনে নেই। তা সে পঞ্চাশ বছর তো হবেই। এই অর্ধশতাব্দীকাল নানা বিষয়ে তাঁর পরামর্শ পেয়েছি। তাঁকে পাশেও পেয়েছি। তাঁকে কোনও ব্যাপারে, কখনও ভেঙে পড়তে দেখিনি। ধুতি-পাঞ্জাবি, পায়ে চটি, চোখে চশমা। নেশা বলতে নস্যি আর বারে বারে চা। তাঁর দেশের বাড়িতে প্রতি বছর খুব ধুমধাম করে কালীপুজো হত। সাহিত্যিকদের অনেকেই সেই কালীপুজোয় গেছেন– সমরেশ বসু, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, বরেন গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ লেখক বিভিন্ন বছরে গেছেন বামদার ‘বাড়ি’র পুজোয়।
আটের দশকে ‘কলেজস্ট্রিট’ পত্রিকা করতে গিয়ে বামদাকে আমি নতুন করে আবিষ্কার করি। পত্রিকা নির্দিষ্ট তারিখে বেরনোর ব্যাপারে তাঁর কড়া নজর ছিল। ‘কলেজস্ট্রিট’-এর লেখা, বিজ্ঞাপন, লে-আউট, কোন কাগজে পত্রিকা ছাপা হবে, সব ব্যাপারেই তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল। আমরা সমব্যবসায়ী ছিলাম, দু’জনেই পুস্তক প্রকাশনা এবং বই-ব্যাবসা করি। বহু বছর আমরা কাটিয়েছি সুখ-দুখে। বাংলায় সেই অর্থে প্রকাশকদের তো কোনও মুখপত্র ছিল না, ‘কলেজস্ট্রিট’-এর আগে। সম্পূর্ণত বই ও বই বিষয়ক পত্রিকা এই ‘কলেজস্ট্রিট’। আমাদের মতো প্রকাশকদেরই একটা বড় অংশ তাকে লালন করেছি। পালন করেছি, করছি এখনও। ‘কলেজস্ট্রিট’কে বন্ধ হয়ে যেতে দিইনি। এই পত্রিকা সেই অর্থে কখনওই লাভজনক হয়ে ওঠেনি। আজও তার আর্থিক-সামর্থ্য খানিকটা নড়বড়ে জায়গাতেই। তবু আমরা– প্রকাশকদের একাংশ আশায় বুক বেঁধে থাকি– ভবিষ্যৎ-সোনালি ভবিষ্যৎ আসবেই আসবে। এই ব্যাপারে আমি সাহস সঞ্চয় করেছি বামাচরণ মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে। আজ থেকে বেশ কয়েক বছর আগে বামদার প্রেসে আগুন লেগে সমস্ত কিছু পুড়ে শেষ হয়ে যায়। তখন সেই বিশাল আর্থিক ক্ষতির সামনে দাঁড়িয়েও বামদাকে ভেঙে পড়তে দেখিনি।
বামদা-র মধ্যে অনেকগুলি স্তর ছিল। বাইরের থেকে মানুষটিকে যতই গম্ভীর ও কঠিন বলে মনে হোক না কেন ভিতরে ভিতরে মানুষটি ছিলেন শিশুর মতো সরল ও অসম্ভব রসিক। তাঁর সঙ্গে আড্ডায় মাতলে তিনি কখন কাকে যে কী বলে অপ্রস্তুত করবেন, তা বোঝা ছিল আমাদের সাধ্যের বাইরে।
কাজের বাইরেও তাঁর পরিবারের সঙ্গে আমার পরিবারের একটা সুমধুর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। বউদি, বাচ্চু (বামদার ছেলে) ও বউমার সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বহুদিনের। আমরা একসঙ্গে কলকাতার বাইরে সপরিবার অনেক জায়গায় বেড়াতে গিয়েছি। দিঘায় তো একাধিকবার। একবার দিঘায় বামদা সস্ত্রীক বেড়াতে গিয়ে আমাদের ‘হোটেল ব্লু ভিউ’তে উঠেছিলেন। আগে থেকেই আমার ভাই বাবু হোটেলে একটি ঘর তাঁদের জন্য ঠিক করে রেখে দিয়েছিল। আসলে আমরা জানতে পেরেছিলাম যে সে-বছরই বামদার ৫০তম বিবাহবার্ষিকী। এই সুযোগে হোটেলের কর্মীদের বলে রেখেছিলাম যে, বামদা যখন সন্ধেবেলা সমুদ্রতীরে বেড়াতে যাবেন, ঠিক সেই সুযোগে তাঁদের থাকার ঘরটিকে সুন্দর করে ফুল দিয়ে সাজিয়ে রাখতে। আমার কথামতো হোটেলের ছেলেরা ঘরটি ফুল দিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছিল। বামদা ও বউদি সন্ধ্যার পর যখন সমুদ্রতীর থেকে বেড়িয়ে ফিরে এসে ঘর সাজানো দেখে তাজ্জব। আমাকে সস্নেহে ধমক দিয়ে বলেছিলেন– ‘ঘর সাজিয়ে কোথাও কোনও ক্যামেরাও তো রেখে দিতে পারিস– সেজন্য সতর্ক থাকতে হচ্ছে !’
লিখন শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়
…………………… ইতি কলেজ স্ট্রিট-এর অন্যান্য পর্ব ……………………
পর্ব ১২: দীর্ঘায়ু বই ও আইয়ুব পরিবার
পর্ব ১১: প্রেমের নয়, অপ্রেমের গল্প সংকলনের সম্পাদনা করেছিলেন সুনীল জানা
পর্ব ১০: ছোট্ট অপুকে দেখেই রঙিন ছবিতে ভরা টানটান গল্পের বই করার ইচ্ছে জেগেছিল
পর্ব ৯: চানঘরে গান-এ সত্যজিৎ রায়ের চিঠি থাকায় ব্যাপারটা গড়িয়েছিল কোর্ট কেস পর্যন্ত
পর্ব ৮: প্রকাশক-লেখকের কেজো সম্পর্কে বুদ্ধদেব গুহর বিশ্বাস ছিল না
পর্ব ৭: পুজো সংখ্যায় না-বেরনো উপন্যাস বই আকারে সুপারহিট
পর্ব ৬: মানবদার বিপুল অনুবাদের কাজ দেখেই শিশির দাশ তাঁর নাম দিয়েছিলেন– ‘অনুবাদেন্দ্র’
পর্ব ৫: সাতবার প্রুফ দেখার পর বুদ্ধদেব বসু রাজি হয়েছিলেন বই ছাপানোয়!
পর্ব ৪: লেখকদের বেঁচে থাকার জন্য অনেক কিছুই লিখতে হয়, প্রফুল্ল রায়কে বলেছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র
পর্ব ৩: পয়লা বৈশাখের খাতায় শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় মজাচ্ছলে লিখেছিলেন, ‘সুধাংশুরা রাজা হোক’
পর্ব ২: বাংলা মাসের সাত তারিখকে বলা হত ‘গ্রন্থতিথি’, বিজ্ঞাপনেও বিখ্যাত ছিল ‘৭-ই’
পর্ব ১: সত্তরের উথাল-পাথাল রাজনৈতিক আবহাওয়ায় আমি প্রকাশনার স্বপ্ন দেখছিলাম