দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, বিজ্ঞান যখন বিশ্বকে আলোকিত করল, এই কুসংস্কারের মতো বিশ্বাসগুলো ম্লান হতে শুরু করল ধীরে ধীরে। তবু নস্টালজিক হৃদয় কাঁহাতক ভুলতে পারে অপয়ার ছন্দ। বিশ্বায়ন এই কুসংস্কারকে নিয়ে গেল নতুন দেশে। প্রেমের দেশে। যেখানে খোলা আকাশের নিচেও এক পক্ষের কৌতূহল আর অন্যপক্ষের শরীর বিনিময়ের মধ্যে দিয়ে জিনিসটা অবতরণ করল নতুনভাবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াও ছাতা খোলা প্রয়োজন হয়ে পড়ল প্রাকৃতিক চাহিদায়। লেকে বা সেন্ট্রাল পার্কে, সাঁঝের আলো-আঁধারিতে খোলা ছাতা উঠে এল দৃষ্টি এড়ানোর ঢাল হিসেবে।
১৪.
ধরুন আপনি ঘরে বসে ভাবছেন এই বাদলায় বেরোবেন কি না। বাইরে বৃষ্টির শব্দ যত বাড়ছে আপনার হাতটা ছাতার হাতলে মুঠো হচ্ছে আরও একটু কনফিউশনের সঙ্গে। হঠাৎ চমকে দিয়ে কড়াৎ করে একটা বাজ পড়ল কান ফাটিয়ে আর আপনি অজান্তেই আপনার ছাতার হাতলের বোতামটা টিপে দিতেই তার পাঁজরগুলো খুলে গেল এক ঝটকায়। ব্যস! আপনি জানলেনই না কত বড় সর্বনাশের ঘণ্টা বেজে গেল অলক্ষে। কারণ ঘরের ভেতর ছাতা খোলা হল অপয়ার ইনভিটেশন। মানে পায়ে পা দিয়ে দুর্ভাগ্যকে ডেকে আনা।
আসলে এ এমন একটা কুসংস্কার যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আমাদের মনে গেঁথে গেছে, ভাগ্যের সঙ্গে খেলা করার গভীর ভয় জাগিয়ে। এমন একটা অন্ধ বিশ্বাস যা মানব সভ্যতার কাপড়ে জড়িয়ে গেছে চোরকাঁটার মতো হাজার হাজার বছর ধরে। কিন্তু কীভাবে বৃষ্টির সাধারণ একটা ঢাল অকারণ ভয় আর বিস্ময়ের সিম্বলে পরিণত হল, কীভাবে ছাতাকে আমরা ঘরে বাইরের বর্ডারে দ্বিখণ্ডিত করে ফেললাম– তার গল্প শুরু হয়েছিল প্রায় ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বে, প্রাচীন মেসোপটেমিয়া আর মিশরে। তখন ছাতাকে ছাতা বলা হত না। বলা হত ‘প্যারাসল’। এবং সে জিনিস শুধু সরঞ্জামই ছিল না, ছিল ঐশ্বরিক সুরক্ষার পবিত্র প্রতীক। মিশরে, সূর্যের আলোর নিচে প্যারাসলের এই অলংকৃত ছোট ছোট ছায়াগুলোকে ধরে নেওয়া হত আকাশের দেবীর মূর্ত প্রতিরূপ– যিনি স্বর্গীয় বা মৃতদের রক্ষা করতেন স্বর্গের দুনিয়ায়। তাই ঘরের ভেতর বা কোনও পবিত্র প্রাসাদে এমন একটা জিনিস খোলা ছিল অকল্পনীয়। সূর্যের আলো ছাড়া একে মেলে ধরা মানে সোজা কথায় দেবতাদের রাগিয়ে তোলা। এমন একটা ভুলের মাশুলকে সেকালে হিসেব করা হত কোনও মূল্যবান স্থাপত্য ভেঙে ফেলার নিক্তিতে। অর্থাৎ আকাশ আর মানুষের মাথার মাঝে থাকবে শুধু ছাতা, কিন্তু তার মধ্যে যদি কাবাব মে হাড্ডি হয়ে ওঠে কোনও ছাদ তবে তাকে ভেঙে পড়তে হবে দেবীর অভিশাপ ঠেকাতে।
স্বাভাবিকভাবেই একটা গভীর ভয়, একটা সুপ্রাচীন নিষেধাজ্ঞার বীজ উপ্ত হয়েছিল– যা প্রতিধ্বনিত হয়েছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ সালের মধ্যে কিন্তু প্যারাসলগুলো চিন আর ভারতে পৌঁছে গিয়েছিল। সেখানে এগুলো শ্রদ্ধা পেয়েছিল একইরকম মর্যাদায়। চিনে, স্তরযুক্ত প্যারাসল সম্রাটদের সজ্জিত করত আর তার প্রতিটি স্তর ছিল তাদের মহিমার প্রমাণ। বৌদ্ধ ঐতিহ্যে, প্যারাসল ছিল আটটি শুভ প্রতীকের একটি– জীবনের ঝড় থেকে আশ্রয়ের প্রতীক যা আবাহন করত অন্তরীক্ষের নিঃশ্বাস। তাই ঘরের ভেতর, যেখানে কোনও সূর্য বা বৃষ্টি ছিল না সেখানে এটি খোলার অর্থ হল সেই পবিত্র প্রতিশ্রুতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। অন্তরীক্ষের প্রতি এই অমর্যাদা ছিল অন্তরের মধ্যে নিপাট এক অপরাধবোধের ঝাঁকুনি। একটা অপয়ার সংকেত।
খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ থেকে ১০০০ সাল পর্যন্ত সিল্ক রুটের বাণিজ্য পথের উত্থানে, ছাতাগুলো পারস্য, গ্রিস, আর রোমে পৌঁছে গেল তাদের রহস্যময় আকর্ষণ বহন করে। রোমে, ধনী মহিলারা তাদের সূক্ষ্ম ত্বক সূর্যরশ্মির হাত থেকে রক্ষা করতে প্যারাসল ব্যবহার করতেন। সে ব্যবহারের মধ্যে ছিল এক শ্রেণিচেতনা, এক প্রকার গর্বের ছোঁয়া। কিন্তু ঘরের ভেতর? এটি অস্বাভাবিক মনে হত। যারা শকুনের তত্ত্বে বিশ্বাস করত তাদের মনে একটা অস্থিরতা জাগত। ছাতা যে সুরক্ষার প্রতীক ছিল সেই ধারণা টিকে ছিল শুরু থেকেই, আর এটির ভুল ব্যবহার মানে হিসেব উল্টো। অর্থাৎ দুর্ভাগ্য ডেকে আনা।
মধ্যযুগীয় ইউরোপে, ১০০০ থেকে ১৫০০ সাল পর্যন্ত, ছাতা ছিল দুর্লভ, কাপড় আর টুপির ব্যবহারেই আবহাওয়ার বিরুদ্ধে সুরক্ষা ছিল দস্তুর । ইতালি আর স্পেনে, অভিজাতরা প্যারাসল ব্যবহার করতেন, আর ক্যাথলিক চার্চ ‘ওমব্রেলিনো’ ব্যবহার করত, যা ইউখারিস্টের জন্য ছিল একমাত্র পবিত্র ছাউনি। ঘরের ভেতর এমন একটা জিনিস খোলা স্বভাবতই ছিল অপবিত্রতার মতো। একটা শীতল আতঙ্ক যা ঐশ্বরিক তিরস্কার ডেকে আনার ব্যাপারে সুপটু । এই ভয় যদিও সূক্ষ্ম কুসংস্কারের শিকড় আরও গভীরে ছড়িয়ে দিয়েছিল, যখন মানুষ অনিশ্চিত বিশ্বে নিয়মের জন্য আচারের ওপর নির্ভর করত বেশি।
রেনেসাঁর যুগে, ১৫০০ থেকে ১৭০০ সাল পর্যন্ত, ছাতা এশিয়া থেকে ইউরোপীয় রাজদরবারে এল। রেশম বা তেলযুক্ত কাগজের তৈরি এ জিনিসগুলো ছিল পরিশীলনের প্রতীক। তাদের সূক্ষ্মতা ছিল বিস্ময় জাগানো। ইংল্যান্ডের পিউরিটানরা, তাদের কঠোর ধৌতিকতায় ছাদের তলায় ছাতা খোলাকে ঐশ্বরিক ক্রোধের আমন্ত্রণ হিসেবে দেখতেন, তাদের হৃদয় অদৃশ্য কোনও পাপের ভারে ভারী হয়ে যেত। এই সময়টা ছিল লোককথা উত্থানের, যখন লবণ ছড়ানো বা আয়না ভাঙার মতো ঘটনা আত্মাকে আঁকড়ে ধরত, আর ছাতাও এই ভয়ের তালিকায় যোগ দিতে প্রস্তুত ছিল।
১৮০০ শতক নাগাদ এই কুসংস্কারের ইতিহাসে একটা বাঁক এল যখন আধুনিক ছাতা বৃষ্টির বিরুদ্ধে লড়াই করতে উদ্ভূত হল। ১৭৫০-এর দশকে, জোনাস হ্যানওয়ে, একজন উৎসাহী লন্ডনবাসী, জলরোধী ছাতাকে জনপ্রিয় করে তুললেন। ভারী তিমির হাড় বা ধাতব পাঁজর ছিল সে ছাতার উদ্ভাবনের একটা বিস্ময়। কিন্তু জর্জিয়ান বাড়ির অন্দরে তাকে খোলা ছিল একটা বিশৃঙ্খলার রেসিপি– চায়ের কাপ ভাঙত, হৃদয় দ্রুত লাফাত, আর ‘দুর্ভাগ্য!’ বলে চিৎকার উঠত অধিবাসীরা। দুর্ঘটনার বাস্তব ভয় গভীর উদ্বেগের সঙ্গে মিশে গেল। এটা ছিল প্রকৃতিকে নিজের থেকেই খামোখা উত্যক্ত করে কুসংস্কারাচ্ছন্ন আত্মায় নীরবে খানিকটা ভয় জাগানো। ১৭০০-এর শেষের দিকে, এই বিশ্বাস ফ্রান্স আর উপনিবেশিক আমেরিকায়ও ছড়িয়ে পড়ে মূলত ব্রিটিশ ভ্রমণকারীদের দ্বারা। অপয়ার কুসংস্কার হয়ে ওঠে একটা ফিসফিস যা টান দিত তাদের হৃদয়ে যারা ভয় পেত ভাগ্যের সঙ্গে খেলতে অনিশ্চয়তার দড়ি টানাটানি।
১৯ শতাব্দীর ভিক্টোরিয়ান যুগে এই কুসংস্কার আরও দৃঢ় হয়ে উঠল। মানুষের আবেগের সঙ্গে মিশে গেল তা। উৎপাদনের অগ্রগতির জন্য ছাতা সাশ্রয়ী হয়ে উঠল। তাছাড়া তার ইস্পাতের দেহ আর সুপরিকল্পিত নকশা ব্রিটেনবাসীর বৃষ্টি প্রতিরোধের অস্ত্র হয়ে উঠতে লাগল। কিন্তু অদ্ভুতভাবে ঘরে ভেজা-ছাতা আনা হলে মনে করা হত দুর্ভাগ্য চুঁয়ে পড়ছে। ভিক্টোরিয়ান শিষ্টাচারের বই মানেই গোঁয়ারপনা আর কঠোরতার পরাকাষ্ঠা। এমন কাজের বিরুদ্ধে তারা সতর্ক করল সাহেবকুলকে– ‘যদি ঘরে ঢুকে ছাতা খুললেই নেমে আসে দুর্ভাগ্য– চাকরি হারানো বা সন্তানের অসুস্থতা– তবে বুঝতে হবে, ছাতার পাঁজরের শব্দই কু গেয়েছে দেওয়ালের কানে কানে।’
পূর্ব ইউরোপে, ছাতা শবযাত্রার সঙ্গে যুক্ত ছিল, বৃষ্টি থেকে শোকার্তদের রক্ষা করত। ঘরে তা খোলা মানে ছিল মৃত্যুকে আমন্ত্রণ জানানো; হাড় হিম করা শীতলতার আবাহন করা। ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলোতে, যেখানে ছাতা ছিল সূর্যের ছায়া, সেখানে কুসংস্কারটা কম হলেও উপস্থিত ছিল উত্তরের ভয়ের একটা ম্লান প্রতিধ্বনি হিসেবে। ঔপনিবেশিক শক্তি তাদের প্রভাব ছড়িয়ে দিলে, এই কুসংস্কার এশিয়া, আফ্রিকা, আর আমেরিকায় পৌঁছে যায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, বিজ্ঞান যখন বিশ্বকে আলোকিত করল, এই কুসংস্কারের মতো বিশ্বাসগুলো ম্লান হতে শুরু করল ধীরে ধীরে। তবু নস্টালজিক হৃদয় কাঁহাতক ভুলতে পারে অপয়ার ছন্দ। বিশ্বায়ন এই কুসংস্কারকে নিয়ে গেল নতুন দেশে। প্রেমের দেশে। যেখানে খোলা আকাশের নিচেও এক পক্ষের কৌতূহল আর অন্যপক্ষের শরীর বিনিময়ের মধ্যে দিয়ে জিনিসটা অবতরণ করল নতুনভাবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াও ছাতা খোলা প্রয়োজন হয়ে পড়ল প্রাকৃতিক চাহিদায়। লেকে বা সেন্ট্রাল পার্কে, দিবালোকে বা সাঁঝের আলো-আঁধারিতে খোলা ছাতা রোদ বা বৃষ্টির চাইতেও বিষ দৃষ্টি এড়ানোর ঢাল হিসেবে উঠে এল প্রেমিক-প্রেমিকার হাতে হাতে। প্রিন্সেপ ঘাটের ভিক্টোরিয়ান স্থাপত্যের তলায় আজও কত খোলা ছাতা আবাহন করে গোপনীয়তা। না, তাদের জন্য অবশ্য ভেঙে পড়েনি কোনও ইমারত। শুধু ভেঙেছে পাব্লিক প্লেস-এ চুমু খেতে না-পারার প্রাগৈতিহাসিক আইন।
……………..অপয়ার ছন্দ অন্যান্য পর্ব……………..
পর্ব ১৩। দলবদলু নেতার মতো ধূমকেতু ছুটে চলে অনবরত
পর্ব ১২। কখনও ভয়ংকর, কখনও পবিত্র: দাঁড়কাক নিয়ে দোদুল্যমান চিন্তা!
পর্ব ১১। শুধু একটা হ্যাঁচ্চো– বলে দেবে কীভাবে বাঁচছ
পর্ব ১০। অপয়ার ছেলে কাঁচকলা পেলে
পর্ব ৯। চোখের নাচন– কখনও কমেডি, কখনও ট্র্যাজেডি!
পর্ব ৮। জুতো উল্টো অবস্থায় আবিষ্কার হলে অনেক বাড়িতেই রক্ষে নেই!
পর্ব ৭। জগৎ-সংসার অন্ধ করা ভালোবাসার ম্যাজিক অপয়া কেন হবে!
পর্ব ৬। প্রেম সেই ম্যাজিক, যেখানে পিছুডাক অপয়া নয়
পর্ব ৫। ডানা ভাঙা একটি শালিখ হৃদয়ের দাবি রাখো
পর্ব ৪। জন্মগত দুর্দশা যাদের নিত্যসঙ্গী, ভাঙা আয়নায় ভাগ্যবদল তাদের কাছে বিলাসিতা
পর্ব ৩। পশ্চিম যা বলে বলুক, আমাদের দেশে ১৩ কিন্তু মৃত্যু নয়, বরং জীবনের কথা বলে
পর্ব ২। শনি ঠাকুর কি মেহনতি জনতার দেবতা?
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved