এরা কেউ কিন্তু মানুষের ক্ষতি করে না। সবাই নিজের জগতে, নিজের খেয়ালে থাকতে চেয়েছে, প্রত্যেকেরই আলাদা আলাদা জীবনবোধও আছে। কিছু পাগলা মাস্টারমশাইকে দেখেছি, কোনও ছাত্রের মাথায় যতক্ষণ পর্যন্ত বিষয়টা না ঢুকছে, ততক্ষণ ছাড়তেন না। ভূগোল পড়াবার জন্য বাড়ি থেকে গ্লোব নিয়ে আসছেন, ব্যাগে করে পাথর নিয়ে আসছেন, ‘এই যে গ্রানাইট, এই যে ব্যাসাল্ট, এটা কোয়ার্টাজ…’। পাগলা ডাক্তারও দেখেছি। পাগল রাজনৈতিক নেতাও কি ছিল না? নতুন ভাবধারার তুরস্কের জন্মদাতা আতাতুর্ক কামালকে কাজী নজরুল ‘কামাল পাশা’ কবিতায় পাগল বিশেষণে সম্বোধিত করেছেন। সত্যজিৎ রায়ের শঙ্কু, কিংবা হুমায়ুন আহমেদের মিশির আলিও পাগল।
১৬.
‘ব্রহ্মা পাগল, বিষ্ণু পাগল, চৈতন্য পাগলের গোড়া… মনের মতো পাগল পাইলাম না।’ এটা একটা লোকগান। লোকগানগুলোতে পাগলদের মোটেই হেলাফেরা করা হয়নি, বরং গড় মানুষের উচ্চতর আসনে বসানো হয়েছে। বলা হয়েছে ‘নকল পাগল সকল দেশে আসল পাগল কয়জনা?’ যে আসল পাগল, সে থাকবে স্বার্থবুদ্ধিহীন, সে হবে উদার প্রকৃতির। রামকৃষ্ণকে তাঁর ভক্তরা ‘পাগল ঠাকুর’ বলত। এরপর স্বঘোষিত অনেক পাগল দেখেছি। টিভির কিছু চ্যানেলে কিছু মুশকিল আসান বাবা আছেন, তাঁরা একটা ‘পাগলা’ বা ‘খ্যাপা’ বিশেষণ জুড়ে দেন। যেমন আচার্য গৌরাঙ্গ ক্ষ্যাপা, জীবন পাগলা ইত্যাদি। ‘পাগল’ শব্দটিকেও কমোডিটি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। ‘পাগল’ কনসেপ্টটা বিক্রয়যোগ্য।
পাগলরা নানা রকমের হয়ে থাকেন। নিজস্ব উদাসীনতাই বোধহয় পাগলত্বের প্রধান চিহ্ন। এজন্যই গানে বলা হয়েছে,
‘কেউ পাগল পিরিতির রসে কেউ ধনের জন্য
যশের পাগল সবদেশে পাগল বিষয় লালসে
শিবের মতো পাগল পাওয়া ভার
সুধাত্যাগে গরল যার আহার
বলদ বাহন চর্ম আসন সর্প অলংকার।’
আমাদের দেশীয় যাত্রাপালায় ‘বিবেক’ নামের যে চরিত্রটিকে দেখি, যে সর্বদা শুভ বোধের প্রতীক, তারও একটা পাগল পাগল ভাব আছে। ‘রক্তকরবী’র বিশু পাগলের কথা একবার ভাবুন।
পাগলের কোনও সংজ্ঞা হয় না। এটা একটা কনসেপ্ট। অভিধানে আছে– পাগল মানে উন্মাদ, খ্যাপা, মাথা খারাপ, মত্ত ইত্যাদি। একটা অভিধানে ‘হিতাহিত জ্ঞান হারা’ও আছে দেখলাম। এটা অনেকটা ঠিক। অনেকটা প্রশ্রয়ের সুরেই ‘পাগল’ শব্দটা উচ্চারণ করা হয়। যেমন ‘পাগলা ছেলেটা আমার’, ‘সে তো রবীন্দ্রসংগীতে পাগল’, ‘সে পাগলের মতো বেড়াতে ভালোবাসে’ ইত্যাদি। কখনও শুনবেন না–‘পাগলার মতো ঘুষ নেয় লোকটা’, কিংবা ‘পাগলার মতো চুরি করে’ বা ‘পাগলার মতো খায়’ ইত্যাদি।
সে যাই হোক, আমি কয়েকজন পাগলের কথা বলব। বিদ্যাসাগর মশাই অনেক দিন আগেই আমাদের শিখিয়েছিলেন– ‘কানাকে কানা, খোঁড়াকে খোঁড়া বলিও না।’ আমরা সেই শিক্ষা আজ গ্রহণ করেছি। বলি না। মোটাকেও মোটা বলি না, স্থূলকায় বলি। কিন্তু রোগাকে সবসময় শীর্ণকায় বলি না। পাগলদেরও অন্য শব্দে প্রতিস্থাপিত করছি না।
আমার শৈশব ও বাল্যকালে রাস্তাঘাটে প্রচুর পাগলের দেখা মিলত। আমি উত্তর কলকাতার বাগবাজার অঞ্চলে বাল্যকাল কাটিয়েছি। এখন যাঁরা ষাটোর্ধ্ব আছেন তাঁদের স্মৃতিভাণ্ডারে একটু ঝাঁকুনি দিচ্ছি– কাঁচি পাগলা, খগেন পাগলা, সত্য পাগলা, পাঁচি পাগলি, উত্তম পাগলা– এদের মনে করতে পারবেন?
কাঁচি পাগলার এই নামের কারণ আমরা জানতাম না। খুব নোংরা লুঙ্গি পরে রাস্তায় ঘুরত, খালি গা, একমুখ দাড়িগোঁফ, সারা গায়ে কালো ছোপ। কেউ যদি বলত– ‘ও কাঁচি পাগলা, স্নান করো না কেন?’ কাঁচি পাগলা বলত, ‘ছ্যানে কি ময়লা যায়? ময়লা তো চামড়ার তলায়।’ কেউ বলল, ‘ও পাগলা, তোমার গায়ে গন্ধ!’ উত্তর আসত, ‘তোর নাক ঠিক কর।’ কখনও ‘পুষ্প বিষ্ঠায় সমভাব, ক্ষতি নাই সব লাভ’– এরকম সব দার্শনিক কথা বলত সে।
খগেন পাগলা বিখ্যাত ছিল ওর গানের জন্য। সে নিজেই তার গানের নামকরণ করেছিল খগেন্দ্রসংগীত। খগেন্দ্রসংগীতগুলি ছিল নানা স্বাদের। খ্যামটা সুর, পুরাতনী ঢং, শ্যামাসসংগীত, আধুনিক এবং আধুনিক গানের প্যারোডি। খ্যামটা গানের দু’এক কলি এরকম–
‘সখী তোর ওই রসের গাছে গোটা দুই ডালিম হয়েছে
ইচ্ছে করে আমার মনে, মালী হই তোর বাগানে
যত্ন করে জল ঢালিব তোর ওই রসের ডালিম গাছে।’
‘কাজলা নদীর জলে ভরা ঢেউ ছলছলে’, এই জনপ্রিয় আধুনিক গানের সুরে গাইত–
‘আজ আমি বেকার বলে,
কাকিমা যে ঝাঁটা তোলে,
গালাগালি দেয় প্রাণ ভরিয়া।
সকালেতে জল তুলে,
মশলা বাটিয়া দিলে,
সারাদেহ ওঠে ঘামে ভিজিয়া।’
শ্যামাসংগীত:
‘ও শ্যামা মা
মহাদেবের বুকে চেপেছিস
দমবন্ধ হয়ে মরে গেলে বেধবা হবি
তা কি ভেবে দেখেছিস…।’
খগেন পাগলা নাকি কোনও বড় ঘরের ছেলে। দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায় বা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো ধুতি আর ফুল শার্ট পরে ঘুরত। কেউ গান গাইতে বললেই হল। গেয়ে দিত। অবশ্যই তার আগে জিজ্ঞাসা করত কী গান? তারপর কোনও রোয়াক বা গাছতলার বেদিতে বসে গেয়ে দিতেন।
পাঁচি পাগলিকে দেখেছি লালপেড়ে শাড়ি পরতে। কপালে অনেকটা সিঁদুর। খুব পান খেত। লোকের বিশ্বাস ছিল পাঁচি পাগলির আশীর্বাদ ফলে যায়। কোনও সন্তানহীনা বড়লোকের গিন্নি নাকি অনেক মাদুলি গায়ে নিয়েছিল বাচ্চা হওয়ার আশায়, তারকেশ্বরে হত্যেও দিয়েছিল। লাভ হয়নি। গাইনি-টাইনি তো আগেই সারা।
পাঁচি পাগলির চিবিয়ে খাওয়া পানপ্রসাদ ভিক্ষা করলেন ওই গিন্নী। পাঁচির মুখ থেকে একটু চিবোনো পান খেয়ে নিলেন এবং শোনা যায় এক বছরের মধ্যেই উনি এক সুস্থ পুত্রসন্তান প্রসব করলেন। এরপর থেকে পাঁচি পাগলির খ্যাতি। ওর সঙ্গে থাকত অনেকগুলো পুঁটুলি। পুঁটুলিগুলোতে কী থাকত, আমি জানতাম না। তবে দেখতাম সে সর্বদাই পান চিবুচ্ছে। ভক্তরাই ওকে পান দান করত। পাঁচি কথা কম বলত, চিবোত বেশি। কোনও রোয়াকে বসে থাকলে লোকজন জুটে যেত। কেউ বলত, ‘ও পিসি, পিসি গো, বল না, আমার হবে কি না…’ পিসি প্রায়শই মৌনী থাকত। যদি মুখটা সামান্য ওপরের দিকে তুলে একবার উচ্চারণ করত, ‘টোর হবে, চিনটা নেই…’ মানুষ খুশি হয়ে পাঁচি পাগলিকে প্রণাম করত। পাঁচি পাগলি নির্বিকার। এইসব প্রণাম-অপ্রণামে কিচ্ছু যা আসে না যেন।
উত্তম পাগলার আসল নাম জানতাম না। সে ফুলপ্যান্ট-ফুল শার্ট পরত, প্রায়ই ঠোঁটে সিগারেট কথা বলার সময় সিগারেট নাচত। চুলে উত্তম-ছাঁট, সামনের দিকটায় এক খাবলা ফুলোচুল। সিনেমার উত্তমকুমারের সংলাপ বলায় দক্ষ। কেউ বলত, ‘সাগরিকা’ হয়ে যাক, কেউ ‘শিল্পী’ হয়ে যাক, কেউ ‘ঝিন্দের বন্দী’ হোক, উত্তম পাগলা নির্ভুল সংলাপ বলে দিত। শুধু সংলাপই নয়, কিছুটা অভিনয়ও করে দেখাত। একবার কেউ বলেছিল– ‘রাজদ্রোহী’ হয়ে যাক, উত্তম সাগ্রহে রাজদ্রোহীর শেষ দৃশ্যটি দেখাতে লাগল। সেখানে আহত নায়িকাকে আলিঙ্গন করতে করতে সংলাপ বলার সিন ছিল। সামনের একটা ল্যাম্পপোস্টে পাঁজি ছেলেরা গোবর মাখিয়ে রেখেছিল। উত্তম পাগলাকে ল্যাম্পপোস্ট দেখিয়ে বলা হল– ‘ওই ল্যাম্পপোস্টটা বেশ অঞ্জনা ভৌমিক (রাজদ্রোহীর নায়িকা), কেমন?’ উত্তম ‘ওকে, অলরাইট’ বলে ল্যাম্প পোস্টটার দিকে ছুটে গিয়ে– ‘চিন্তা, আমার চিন্তা এ অন্যায় সইব না আমি…’ বলতে বলতে ল্যাম্পপোস্ট জড়িয়ে ধরল, তখন গোবর ইত্যাদি ওর হাতে মুখে…!
সত্য? ‘ইহা কি সত্য সেদিন সন্ধ্যায় এই ব্যক্তি অকুস্থলে গিয়েছিল। ধর্মাবতার এই বিষয়ে আমি নির্দিষ্ট সাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থিত করছি’– এই ধরনের কথা বলতে সে রাস্তা দিয়ে হাঁটত। ভাবতাম সে হয়তো কোনও উকিল ছিল। তাঁর সংলাপের মধ্যে ‘সত্য? ইহা কি সত্য?’ শব্দবন্ধটি প্রায়শই থাকতো, তাই ওকে ‘সত্য পাগলা’ বলতাম।
এঁরা ছাড়াও আরও কিছু ‘পাগল’দের মনে পড়ে। একজন নাটকের সংলাপ বলতে বলতে পথ চলত, কারও-র টিটকিরি বা মন্তব্যে কর্ণপাত করতো না। ‘বাংলার ভাগ্যাকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা’, ‘বাংলার সৌভাগ্য সূর্য আজ অস্তাচলগামী…’। কিংবা ‘আমার সাজানো বাগান শুকিয়ে গেল….’, ‘জাহানারা, আমিও তোরই মতো বেচারি….’ ইত্যাদি বলতে বলতে পথ চলত। একজন ছিল মোহনবাগান ক্লাবের ভীষণ ভক্ত, যেটা পাগলামি। কেউ যদি পিছন থেকে বলত, ‘মোহন বাগান হে…রে…ছে…এ…এ….।’ সে জবাব দিত, ‘তোর বাপ ম… রে… ছে…।’ এই ধরনের। একজন কেন জানি না সারা গায়ে মগ বেঁধে ঘুরত। কোমরে চারপাঁচ রকম মগ দড়ি দিয়ে বাঁধা, কাঁধে মগ, গলায় মগ… সারা শরীরটাই মগের মুলুক।
আসলে এরা কেউ কিন্তু মানুষের ক্ষতি করে না। সবাই নিজের জগতে, নিজের খেয়ালে থাকতে চেয়েছে, প্রত্যেকেরই আলাদা আলাদা জীবনবোধও আছে। যে শরীরটাকে ‘মগ’ দিয়ে সাজিয়েছে, তারও একটা নিজস্ব যুক্তি আছে। কিছু পাগলা মাস্টারমশাইকেও দেখেছি, কোনও ছাত্রের মাথায় যতক্ষণ পর্যন্ত বিষয়টা না ঢুকছে, ততক্ষণ ছাড়তেন না। ভূগোল পড়াবার জন্য বাড়ি থেকে গ্লোব নিয়ে আসছেন, ব্যাগে করে পাথর নিয়ে আসছেন, ‘এই যে গ্রানাইট, এই যে ব্যাসাল্ট, এটা কোয়ার্টাজ…’। প্রজাপতির পিছনে ছোটা মানুষ দেখেছি, ঘাড়ে করে স্কুলে স্কুলে ঘুরে মহাকাশের রহস্য বোঝাবার দায় নেওয়া মানুষকে দেখেছি, পাগলা ডাক্তারও দেখেছি। পাগল রাজনৈতিক নেতাও কি ছিল না? নতুন ভাবধারার তুরস্কের জন্মদাতা আতাতুর্ক কামালকে কাজী নজরুল ‘কামাল পাশা’ কবিতায় পাগল বিশেষণে সম্বোধিত করেছেন। সত্যজিৎ রায়ের শঙ্কু, কিংবা হুমায়ুন আহমেদের মিশির আলিও পাগল।
এইসব পাগলগুলো হারিয়ে গেল। এখন দেখি– ক্ষমতা পাগল, যশ পাগল, ধনপাগল… পাগল বলে মনে হয় না।
…পড়ুন ব্লটিং পেপার-এর অন্যান্য পর্ব…
১৫. ধূমপান নিষেধের নিয়ম বদলান, আকাশবাণীর স্টেশন ডিরেক্টরকে বলেছিলেন ঋত্বিক ঘটক
১৪. এমএলএ, এমপি-র টিকিট ফ্রি, আর কবির বেলা?
১২. ‘গাঁধী ভগোয়ান’ নাকি ‘বিরসা ভগোয়ানের পহেলা অবতার’
১১. কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্টের চক্করে বাঙালি আর ভোরবেলা হোটেল থেকে রওনা দেয় না
৫. তিনটে-ছ’টা-ন’টা মানেই সিঙ্গল স্ক্রিন, দশটা-পাঁচটা যেমন অফিসবাবু
৪. রাধার কাছে যেতে যে শরম লাগে কৃষ্ণের, তা তো রঙেরই জন্য
৩. ফেরিওয়ালা শব্দটা এসেছে ফার্সি শব্দ ‘ফির’ থেকে, কিন্তু কিছু ফেরিওয়ালা চিরতরে হারিয়ে গেল
২. নাইলন শাড়ি পাইলট পেন/ উত্তমের পকেটে সুচিত্রা সেন
১. যে গান ট্রেনের ভিখারি গায়কদের গলায় চলে আসে, বুঝতে হবে সেই গানই কালজয়ী