ভারী ভারী কথা বলা বয়স্ক নামী মানুষেরাও ‘প্রায়শই’ সেই নামপাগল শিশুটির মতো হয়ে যান। শবযাত্রার গাড়িগুলো দেখুন, গাড়ির বুকে, পিঠে, ঘাড়ে কারেও নাম লেখা, যার ক্ষমতা বলে এই গাড়িটি শববহনে সক্ষম। যাত্রী প্রতীক্ষালয়ে আজকাল মনীষীদের ছবি বাণী-সহ অবস্থান করে। কিন্তু আরও বড় বড় অক্ষরে লেখা থাকে স্থানীয় অনুপ্রাণিত নেতার নাম। নাম উচ্চ-বাতিস্তম্ভের গোড়ায়, নাম গাছের আগায়, নাম পার্কের রেলিং-এ, নাম শৌচালয়ে, নাম মন্দিরের গায়ে।
১৮.
নাম হওয়া আর যশ হওয়া এক নয়, যদিও নামযশ একইসঙ্গে উচ্চারিত হয়। বৈষ্ণবরা বলেন ‘কলৌ হরিণামৈব কেবলম’। কলিতে কেবলমাত্র হরির নামই করতে হয়। রাজনীতির সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁরা আবার বলেন, ‘হরির নাম কেন। নিজের নামই করতে হয়। নানা অছিলায় নিজের নামটি ছড়িয়ে দাও। ইদ, নতুন বছর, দিওয়ালি, ছট– সবক্ষেত্রেই চটপট শুভেচ্ছাদির সঙ্গে নিজের নামটা ছড়াও।’ যাঁরা ক্রমশ ওপরে উঠবেন, এখনও ততটা নেতা হয়ে ওঠেননি, দেখবেন, হোর্ডিং বা ফ্লেক্স-এর তলায় ‘প্রচারে নাদান, ভুতো পচা, বল্টু, তপতী, শুভ্রা…’।
রবীন্দ্রনাথের ‘লিপিকা’ গ্রন্থে ‘নামের খেলা’ শীর্ষক লেখায় দেখি– কেদারনাথবাবুর শিশু ভগিনেয়টি বইয়ের মলাটে মামার নাম দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল। শিশুটিরও নামের নেশায় পেল। ছাপাখানা থেকে সিসের অক্ষর জুটিয়ে এনে কালি লাগিয়ে যেখানে পারল নিজের নাম ছাপাতে লাগল। মামা রচিত বইয়েও। মামাবাবু তখন তার সাধের ভাগ্নের হাত থেকে অক্ষরে বোনা নাম কেড়ে নিল। ভাগ্নের ফুঁপিয়ে কান্না। ক্ষীরপুলি, খেলনার রেলগাড়ি ছুড়ে ফেলে বলে– আগে আমার নাম।
ভারী ভারী কথা বলা বয়স্ক নামী মানুষেরাও ‘প্রায়শই’ সেই নামপাগল শিশুটির মতো হয়ে যান। শবযাত্রার গাড়িগুলো দেখুন, গাড়ির বুকে, পিঠে, ঘাড়ে, কারেও নাম লেখা, যার ক্ষমতা বলে এই গাড়িটি শববহনে সক্ষম। যাত্রী প্রতীক্ষালয়ে আজকাল মনীষীদের ছবি বাণী-সহ অবস্থান করে। কিন্তু আরও বড় বড় অক্ষরে লেখা থাকে স্থানীয় অনুপ্রাণিত নেতার নাম। নাম উচ্চ-বাতিস্তম্ভের গোড়ায়, নাম গাছের আগায়, নাম পার্কের রেলিং-এ, নাম শৌচালয়ে, নাম মন্দিরের গায়ে। কত পিতৃভক্ত-মাতৃভক্ত তাঁদের জন্মদাতা-দাত্রীর স্মৃতিতে ফলক লাগায় মন্দিরে, নিজের নামটাও বড় করে খোদাই করে রাখে অধম সেবক রূপে। গানে আছে– ‘পাথরে লেখো নাম পাথর ক্ষয়ে যাবে।’ মনস্তত্ত্বটা হচ্ছে, কতই বা খইবে! অনেক নাম দেখেছি বোটানিক্যাল গার্ডেনের মহাবৃক্ষের কাঠে, সেই সময়ে বান্ধবী-সহ নিজের নাম খোদাই করে রেখেছে। সম্ভবত পেরেক বা ছুরিকা যন্ত্রে মদন+পিঙ্কি। লম্বু+জবা। বৃক্ষ চওড়া হচ্ছে, নামও বড় হচ্ছে। ভীমবেট্কার প্রাগৈতিহাসিক গুহাচিত্রের পাশাপাশি ঘুরতে আসা যুগলের নামও দেখেছি।
ছোটবেলার কথা মনে পড়ে। আমরা যে ভাড়াবাড়িতে থাকতাম, আমাদের উঠোন মতো একটা জায়গা ছিল। ওখানকার সিমেন্ট নষ্ট হয়ে গিয়েছিল বলে নতুন সিমেন্ট করা হয়েছিল। কাঁচা সিমেন্টের ওপরে ঝাঁটার কাঠি দিয়ে ভাড়াবাড়ি-তুতো দাদা ওর নাম অক্ষয় করে রেখেছিল ‘বাবলু সাধুখাঁ’। কিন্তু জাগতিক পরিহাসে ওই জায়গাটিই আবর্জনা ফেলার যোগ্যস্থান বিবেচিত হল। বাবলু সাধুখাঁর ওপরই উপর্যপুরি ফেলা হতে লাগল মাছের আঁশ, তরকারির খোসা, শিশুর হিসু-সহ আরও কত!
‘বিবিধ ভারতী’ শোনেন কেউ আর? ওখানে ‘আপ কা ফরমাইশ’ নামে একটা অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। ওখানে যে গান, যিনি শুনতে চেয়েছেন– তার নাম বলা হত। এরপর অনুরোধের আসরেও নাম বলা শুরু হয়। আমি আকাশবাণীর চাকরির সূত্রেই কিছুদিন শ্রোতাদের বিভিন্ন অভিযোগের চিঠি পড়া এবং সেই অভিযোগের উত্তর দেওয়ার দায়িত্বে ছিলাম। সপ্তাহের একদিন অভিযোগের কৈফিয়ত দেওয়ার মাথা চুলকানিমূলক অনুষ্ঠানটির নাম ‘সবিনয়ে নিবেদন’। ওই অনুষ্ঠানটি এখনও হয়ে থাকে। আমি প্রায়শই এই ধরনের চিঠি পেতাম– ‘মহাশয়, অমুক গানটি অনুরোধ করিয়া আমি চিঠি দিয়াছিলাম, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমার নামটি ঘোষণা করা হয় নাই। হে আকাশবাণী, আমি কী অপরাধ করিলাম, যে গত সপ্তাহে একদিনও আমার নাম ঘোষণা করা হইল না? অথচ অমুক স্থানের তমুকচন্দ্র অমুকের নাম পরপর তিন দিন ঘোষণা করা হইয়াছে।’
একটা চিঠির বয়ান আজও মনে পড়ে। “বর্ষা কি ভূজঙ্গ ঘোষের বাবার? ‘রিমঝিম বরষায়, এলো যে বরষা, বৃষ্টি বৃষ্টি কী অপরূপ সৃষ্টি’ গানের সহিত ভূজঙ্গ সাহার নাম ঘোষণা করা হল কেন জবাব চাই।”
গত আটের দশকের শেষে ‘প্রাত্যহিকী’ নামে একটা অনুষ্ঠান শুরু হয়। প্রতিমাসে একটা নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর শ্রোতাদের চিঠি আহ্বান করা হত, এবং নির্বাচিত চিঠি পড়া হত। অবশ্যই শ্রোতাদের নাম বলা হত। এই অনুষ্ঠানটি এখনও চালু আছে। প্রাত্যহিকীও আমাকে কিছুদিন দেখতে হয়েছিল। যারা চিঠি লিখতেন, তাঁরা দাবি করলেন, ‘শুরুতেই শুধু কেন নাম বলা হবে? গান বা নাটকের ক্ষেত্রে তো আরম্ভ এবং শেষে নাম বলা হয়।’ সেরকমই চালু হল। শুরুতে ও শেষে।
প্রাত্যহিকীর পত্রলেখকদের একটা সমিতি আছে। ওরা মাঝে মাঝে প্রাত্যহিকীতে পড়া চিঠির সংকলন করেন। তাঁদের একজন আমাকে তাঁর একটি ভিজিটিং কার্ড দিয়েছিলেন– ‘অমুক কুমার তমুক। এ পর্যন্ত ৭১ বার প্রাত্যহিকীতে পত্র পঠিত ও এক সহস্রবারের অধিক নাম উচ্চারিত’!
এবার বৃন্দাবন গড়াইয়ের কথা বলি। নামটা একটু পালটে দিলাম।
ওর বাড়ির নাম বৃন্দাবন ধাম। ওর একটা লন্ড্রি আছে, সেটার নামও বৃন্দাবন লন্ড্রি। ওর সঙ্গে আলাপ হল। রেডিও শুনতে ভালোবাসে। বলেছিল– ‘কানে শুনি, আর বিল লিখি, মাল খুঁজি।’ আমি রেডিও-তে চাকরি করি জেনে আমায় বলল, ‘আমার স্যর ব্যাকিং-ট্যাকিং নেই, আপনি আমার নামটা বলিয়ে দিন না।’ সেটাও হল। এবার বললেন দেখুন, ‘নিজের নামটা পোচার করলেই হবে? স্ত্রীর প্রতি একটা কর্তব্য আছে কি না বলুন? আমার স্ত্রীর নাম জোস্না।’ জ্যোৎস্না গড়াই নামও গেল। উনি বললেন, ‘একবারে মেটে কি আশা? আপনাদের গানেই তো কয়েচে।’ আমি বলি, তা হলে হবে খনে মাঝে মাঝে। উনি বিগলিত। এবার ওর শ্যালিকার প্রতিও কর্তব্য করতে চান! আমি ওই দোকানটা এবার এড়িয়ে চলতে থাকি।
কিন্তু কোথায় পালাব? লন্ড্রির রসিদে ঠিকানা থাকে। উনি হাজির হয়ে গেলেন। সঙ্গে পান্তুয়া। বললেন, ‘দেশ থেকে আনলাম স্যর। ভালো পান্তুয়া করে। আপনি আসেন না অনেক দিন, চিন্তা হচ্ছিল, তাই এলাম। ভালো কথা স্যর, দেশের বাড়িতে আমি এখন খুব ফেমাস হয়ে গেছি। আপনার দয়ায়।’
হাঁড়ি নিয়ে হাত বাড়িয়েছেন। হাতে উল্কিতে লেখা বৃন্দাবন গড়াই, নিজেই ‘তা’ দিয়ে চলেছেন নিজের নামে। এটা আগে দেখিনি।
…পড়ুন ব্লটিং পেপার-এর অন্যান্য পর্ব…
১৭: টরে টক্কার শূন্য এবং ড্যাশের সমাহারে ব্যাঙের ‘গ্যাগর গ্যাং’ও অনুবাদ করে নিতে পারতাম
১৬: ছদ্মবেশী পাগলের ভিড়ে আসল পাগলরা হারিয়ে গেল
১৫. ধূমপান নিষেধের নিয়ম বদলান, আকাশবাণীর স্টেশন ডিরেক্টরকে বলেছিলেন ঋত্বিক ঘটক
১৪. এমএলএ, এমপি-র টিকিট ফ্রি, আর কবির বেলা?
১২. ‘গাঁধী ভগোয়ান’ নাকি ‘বিরসা ভগোয়ানের পহেলা অবতার’
১১. কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্টের চক্করে বাঙালি আর ভোরবেলা হোটেল থেকে রওনা দেয় না
৫. তিনটে-ছ’টা-ন’টা মানেই সিঙ্গল স্ক্রিন, দশটা-পাঁচটা যেমন অফিসবাবু
৪. রাধার কাছে যেতে যে শরম লাগে কৃষ্ণের, তা তো রঙেরই জন্য
৩. ফেরিওয়ালা শব্দটা এসেছে ফার্সি শব্দ ‘ফির’ থেকে, কিন্তু কিছু ফেরিওয়ালা চিরতরে হারিয়ে গেল
২. নাইলন শাড়ি পাইলট পেন/ উত্তমের পকেটে সুচিত্রা সেন
১. যে গান ট্রেনের ভিখারি গায়কদের গলায় চলে আসে, বুঝতে হবে সেই গানই কালজয়ী