ঔপনিবেশিক আমল থেকেই বাংলার নগরায়ন বড় বেশি কলকাতা-কেন্দ্রিক। রেল ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর দ্রুত যাতায়াতের যে বন্দোবস্ত হয়, তাতে একদিকে যেমন কলকাতা আসা-যাওয়া সহজ হয়েছিল, অন্যদিকে যেন কলকাতার সঙ্গে ব্যবধান বেড়ে গিয়েছিল এই ছোট শহরগুলির। যা কিছু প্রয়োজন কলকাতা শহরে গেলেই মিটবে। এতে বড় শহরের ওপর চাপ বাড়ে বই কমে না। আর ছোট শহরের অভাবগুলিরও সুরাহা হয় না। সেই সূত্র ধরেই বড়-ছোট শহরের বৈশিষ্ট্যের ভাগ-বাঁটোয়ারাও হয়ে যায়। উনিশ, বিশ পেরিয়ে একুশ শতকেও কলকাতা শহরের দৈনন্দিনতায় নিত্যযাত্রীদের বড় অংশের উপস্থিতি রেলপথ বাহিত।
১৮.
পৃথিবীর যে কোনও আধুনিক বড় শহরেই প্রতিদিন যাতায়াত করেন, এমন মানুষের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। প্রাগাধুনিক শহরের থেকে শিল্পায়ন-পরবর্তী উনিশ শতকের শহরের একটা মূল পার্থক্য ছিল এই নিত্যযাত্রীদের উপস্থিতি। স্বাভাবিকভাবেই যে কোনও শহরের চরিত্র নির্মাণে বড় ভূমিকা নেন এই ভ্রাম্যমাণ মানুষজন। বাষ্পীয় ইঞ্জিনের আবিষ্কারের ফলে যানবাহন চলাচলে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে যায়। ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের আগেই ভারতে রেলপথ চালু করার পরিকল্পনা করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। রেল ব্যবস্থার হাত ধরে দেশের অভ্যন্তরে যেমন ব্যবসা-বাণিজ্যের খুব দ্রুত প্রসার ঘটে, তেমনই ভারতের বন্দর শহরগুলির চরিত্রও বদলে যায়।
১৮৫৪ সালে হাওড়া থেকে রানিগঞ্জ অবধি রেল চালু হয়। সাধারণ মানুষের কাছে সে ছিল এক আজব জিনিস। ১৮৬৩-তে মুন্সী আজিমদ্দীন লিখছেন যে ‘কলের গাড়ি’ দেখার জন্য বাড়ির মেয়ে-বউরা ভিড় জমাতে শুরু করেছে লাইনের ধারে:
‘বানিয়েছে রেল, রোডের গাড়ি ধন্য সাহেব কারিকর।
এখন বিশ্বকর্ম্মার পূজা ছেড়ে ঐ সাহেবকে পূজা কর।।
কত সব বউরী ঝিউরী, কি ছুঁড়ী কি যুবা বুড়ী,
দেখতে যায় তাড়াতাড়ি, ঐ গো দিদি কলের গাড়ি।’
সামাজিক জীবনেও বড় পরিবর্তন নিয়ে আসে এই কলের গাড়ি। মফসসল থেকে কলকাতায় চাকরি করতে গিয়ে দিনে-দিনে নিজের বাড়ি ফিরে আসা সম্ভব হল রেল চালু হওয়ার পর। এর ফলে একদিকে কলকাতার বাইরের এই অঞ্চলগুলিতে নানা পরিবর্তন আসে, আর অন্যদিকে শহরের চারিত্রিক বিন্যাসও বেশ বদলে যায়। হাওড়া অবধি ট্রেনে এসে পায়ে হেঁটে বা ভাড়ার গাড়ি চেপে হাওড়ার পোল পেরিয়ে অফিস পাড়ায় যাতায়াতের নির্দিষ্ট ‘রুট’ তৈরি হয়ে যায়। কলকাতায় চড়া দামে বাড়ি ভাড়ার হাত থেকে বাঁচলেন চাকুরিজীবীরা। ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিত, ‘live in the suburbs and save house rent; buy a Rail cum Tram ticket’। অন্যদিকে, আজিমদ্দীনের লেখায় দেখি বুড়ি দিদিমা যুবতী বউদের সঙ্গে মশকরা করছেন:
‘‘আই বুড়ী: …এখন তোদের অদৃষ্টক্রমে ইংরাজ বাহাদুরেরা কল বানিয়েছেন, সেই কলেতেই সকল কল চলছে।
বয়েরা: হাঁ গা আই, সকল কল চলছে কি গা, আরো কি কল আছে।
আই: (হাস্যরূপে) সে কি লো, তাও কি আর বুঝতে পারিসনি নিত্তি২ তোদের কত্তা বাড়ীতে আসছে, এর চেয়ে কি আর সুখ আছে।
বয়েরা: ওরে বুড়ী বড় রসিক এক বলতে আর বলে বসে, তোমার কি আর কত্তা বাড়ীতে আসতো না।
বুড়ী: তা তো আসতো, কিন্তু ঐ ন মাসে ছ মাসে তা আবার পথ চলতেই ছেলের বয়েশ যেতো…’
তবে শুরু থেকেই রেলে যাতায়াত নিয়ে নানা আশঙ্কা, ভয় ভীতি ছিল মানুষের মনে। যে বছর হাওড়া থেকে চালু হল ট্রেন, সেই ১৮৫৪ সালেই, অক্ষয় কুমার দত্ত ‘বাষ্পীয় রথারোহীদিগের প্রতি উপদেশ, অর্থাৎ যাঁহারা কলের গাড়ী আরোহণ করিয়া গমন করেন, তাঁহাদের তৎ-সংক্রান্ত বিঘ্ন নিবারণের উপায় প্রদর্শন’ নামে এক পুস্তিকা ছাপান। ইংরেজী একটা শিরোনামও ছিল– ‘ডিরেকশন্স ফর এ রেলওয়ে ট্র্যাভেলার’। নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে বইয়ের উদ্দেশ্য। মোট তেরোটি ‘নিয়ম’ উল্লেখ করেন অক্ষয় দত্ত। যেমন:
‘প্রথম নিয়ম
যে সময়ে বাষ্পীয় রথ গমন করিতে থাকে, সে সময়ে তাহাতে আরোহণ ও তাহা হইতে অবতরণ করা কর্ত্তব্য নহে।…
দ্বিতীয় নিয়ম
বাষ্পীয় রথের অবৈধ স্থানে অবৈধ প্রকারে অবস্থান করা কর্ত্তব্য নহে। পশ্চাল্লিখিত কয়েকটি উদাহরণ দৃষ্টি করিলেই, এ নিয়মের তাৎপর্য্যার্থ হৃদয়ঙ্গম হইবে।
যে সময়ে বাষ্পীয় রথ চলিয়া যায়, সে সময়ে রথের জালক অর্থাৎ জানালা দিয়া হস্ত, পদ ও মস্তক প্রসারিত করিয়া দেওয়াতে, অনেক ব্যক্তি বস্তু-বিশেষে আহত হইয়া হত হইয়াছে। অনেক ব্যক্তি, চঞ্চল স্বভাব প্রযুক্ত, এক গাড়ী হইতে অন্য গাড়ীতে লম্ফ দিয়া গমন করিবার সময়ে, পতিত ও আহত হইয়া প্রাণ-ত্যাগ করিয়াছে।’
এ ছাড়াও হাওড়া থেকে রানিগঞ্জ যাতায়াতের একটা ধারণা করা যায় এই পুস্তিকা থেকে। মোট ১২১ মাইল যাত্রাপথে ১৯টি স্টেশন ছিল। হাওড়া থেকে তাঁর পরের স্টেশন বালি যেতে ১৫ মিনিট সময় লাগত। এক ঘণ্টার মধ্যে কোন্নগর, শ্রীরামপুর, ভদ্রেশ্বর পৌঁছনো সম্ভব হল। দিনে দিনে যাতায়াতের সুবিধের কথাও উল্লেখ করলেন অক্ষয় কুমার:
“যিনি কলের গাড়ী আরোহণ করিয়া এক দিনের মধ্যে কোন আড্ডায় [‘স্টেশন’] গমন ও তথা হইতে আগমন করিবার বাসনা করেন, তিনি তদর্থে একেবারে একখান টিকিট ক্রয় করিতে পারেন। সে টিকিটকে ইংরেজিতে ‘ডবল-জর্নি-টিকিট’ কহে। কিন্তু যাঁহারা তৃতীয় শ্রেণীর গাড়ীতে গমন করিবেন, তাঁহারা এক্ষণে সে টিকিট পাইবেন না।”
এই রেল চালু হওয়ার দু’-দশকের মধ্যেই হুগলি নদীর ধার ধরে এই অঞ্চলগুলিতে বেশ কিছু পাটকল শুরু হয়ে যায়। আলাদা আলাদা পুরসভা তৈরি হয় দ্রুত বাড়তে থাকা জনসংখ্যার নাগরিক পরিষেবার প্রয়োজনে। হুগলির অন্য পারে নৈহাটি, ব্যারাকপুর, জগদ্দল, টিটাগড়ের মতো এলাকাগুলিও জমজমাট মফসলস হয়ে ওঠে। কলকাতার শহরতলির বেড়ে ওঠার ইতিহাসের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে রয়েছে রেলগাড়ি। মফসসল শহরগুলি উনিশ শতক থেকে এক নতুন নগর-জীবনের স্বাদ পেয়েছিল। প্রাচীন জনপদগুলির পাশাপাশি নতুন শহর-গঞ্জ তৈরি হয়েছিল ইংরেজ আমলে। রেল বা সড়ক পথে কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ার ফলে আদান প্রদানের নতুন জায়গাও তৈরি হয়েছিল।
তবে ঔপনিবেশিক আমল থেকেই বাংলার নগরায়ন বড় বেশি কলকাতা-কেন্দ্রিক। রেল ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর দ্রুত যাতায়াতের যে বন্দোবস্ত হয়, তাতে একদিকে যেমন কলকাতা আসা-যাওয়া সহজ হয়েছিল, অন্যদিকে যেন কলকাতার সঙ্গে ব্যবধান বেড়ে গিয়েছিল এই ছোট শহরগুলির। যা কিছু প্রয়োজন কলকাতা শহরে গেলেই মিটবে। এতে বড় শহরের উপর চাপ বাড়ে বই কমে না। আর ছোট শহরের অভাবগুলিরও সুরাহা হয় না। সেই সূত্র ধরেই বড়-ছোট শহরের বৈশিষ্ট্যের ভাগ-বাঁটোয়ারাও হয়ে যায়। উনিশ, বিশ পেরিয়ে একুশ শতকেও কলকাতা শহরের দৈনন্দিনতায় নিত্যযাত্রীদের বড় অংশের উপস্থিতি রেলপথ বাহিত। চাকরি, পড়াশোনা, বিনোদন– সব কিছুরই কেন্দ্রভূমি কলকাতা। সুধীর চক্রবর্তীর ভাষায় সদর-মফসসলের দেওয়া-নেওয়া স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে অনেক বেশি একমুখী যাত্রা হয়ে উঠেছে। তাঁর লেখা মফসসল রেল স্টেশনের বর্ণনা দিয়ে শেষ করি:
“সকাল সাড়ে ছটা নাগাদ এখানে কলকাতার গন্ধ মেখে প্রথম ট্রেন আসে। সঙ্গে সঙ্গে খবরের কাগজের হকাররা ঝাঁপিয়ে পড়ে “কাগজ কাগজ, টাটকা খবর।” ভাগ্যবাদী একদল মানুষ কাগজ খুলেই আগে পড়ে নেয় লটারির ফলাফল।…
একই ট্রেন থেকে নামে অনভ্যস্ত টাই প’রে একদল উন্নয়নশীল বালক-বালিকা। সঙ্গে তাদের ঝি কিংবা সর্বস্বত্যাগিনী গর্ভধারিণীর দল। কাছাকাছি গ্রাম থেকে এরা আসছে ইংলিশ মিডিয়ামের হাতছানিতে। দেখলেই আমার সেই সার্কাসের হাতিদের কথা মনে পড়ে। প্রথম হাতির লেজ শুঁড় দিয়ে ধরেছে দ্বিতীয় হাতি, তার লেজ ধরেছে তৃতীয় হাতির শুঁড়। এমনই হাতির পরে হাতি। তেমনই গ্রাম থেকে সদর শহরের ইংলিশ মিডিয়াম, সেখান থেকে অক্সিলিয়াম কিংবা সেন্টজনস্, সেখান থেকে লরেটো-কারমেল-সাউথ পয়েন্ট। চলেছে হাতির দল।”
…কলিকথা–র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১৭: বাবুদের শহর যেভাবে বদলে গেল আবেগের শহরে
পর্ব ১৬: ঘর-বন্দি হয়েও নাগরিক কলকাতার স্বাদ
পর্ব ১৫: গৃহভৃত্যর বেশিরভাগই ছিলেন পুরুষ, দু’দশকে বদলে যায় পরিস্থিতি
পর্ব ১৪: স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা সিনেমায় চাকরির ইন্টারভিউয়ের দৃশ্য সেই সময়ের আয়না
পর্ব ১৩: দাঙ্গা ও দেশভাগ বদলে দিয়েছে কলকাতার পাড়া-বেপাড়ার ধারণা
পর্ব ১২: প্রাচীন কলকাতার বোর্ডিং হাউস
পর্ব ১১: সারা বিশ্বে শ্রমিক পাঠানোর ডিপো ছিল এই কলকাতায়
পর্ব ১০: কলকাতার যানবাহনের ভোলবদল ও অবুঝ পথচারী
পর্ব ৯: বৃষ্টি নিয়ে জুয়া খেলা আইন করে বন্ধ করতে হয়েছিল উনিশ শতকের কলকাতায়
পর্ব ৮: ধর্মতলা নয়, ময়দানই ছিল নিউ মার্কেট গড়ে তোলার প্রথম পছন্দ
পর্ব ৭: সেকালের কলকাতায় বাঙালি বড়মানুষের ঠাঁটবাটের নিদর্শন ছিল নিজের নামে বাজার প্রতিষ্ঠা করা
পর্ব ৬: কলকাতার বহিরঙ্গ একুশ শতকের, কিন্তু উনিশ-বিশ শতকের অসহিষ্ণুতা আমরা কি এড়াতে পেরেছি?
পর্ব ৫: কলকাতা শহর পরিকল্পনাহীনভাবে বেড়ে উঠেছে, একথার কোনও বিশেষ ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই
পর্ব ৪: ঔপনিবেশিক নগর পরিকল্পনার বিরুদ্ধ মত প্রকাশ পেয়েছিল যখন প্লেগ ছড়াচ্ছিল কলকাতায়
পর্ব ৩: ঔপনিবেশিক কলকাতায় হোয়াইট টাউন-ব্ল্যাক টাউনের মধ্যে কোনও অলঙ্ঘনীয় সীমানা
পর্ব ২: ‘জল’ যেভাবে ‘জমি’ হল এ কলকাতায়
পর্ব ১: চেনা কলকাতাকে না পাল্টেই বদল সম্ভব, পথ দেখাতে পারে একটি বাতিল রিপোর্ট