আর কাল বিলম্ব নয়। যা করার জ্ঞানদাকে এখুনি করতে হবে। শুধু এই চিঠি নয়, অন্তত ৫ জুলাই, ওই তারিখে, এই বিয়ে বন্ধ করার আরও এক অব্যর্থ অস্ত্র তার হাতে এসেছে বলে জ্ঞানদা নিশ্চিত। সবকিছু মনের মধ্যে গুছিয়ে নিয়ে জ্ঞানদা জ্যোতিরিন্দ্রর ঘরে হাসতে-হাসতে ঢুকে তার পড়ার টেবিলে হুমড়ি খেয়ে বলল, কী কাণ্ড বলো তো তোমার মেজদাদার! ঠাকুরবাড়ি থেকে পালিয়ে তবে সে তোমার বিয়ে নিয়ে ঝেড়ে কেশেছে গো! বলিহারি এ বাড়ির পুরুষদের!
২০.
ক’দিনের মধ্যে কাজের জায়গায় ফিরে গেলেন সত্যেন্দ্র। এবং জ্ঞানদাকে চিঠি লিখে জানালেন কেন তিনি কিছুতেই চান না কাদম্বরীর সঙ্গে জ্যোতির বিয়ে হোক। কোনও ঢাকঢাক গুড়গুড় নেই। একেবারে চাঁচাছোলা ভাষায় জানিয়েছেন সত্যেন্দ্র: ‘শ্যাম গাঙ্গুলীর আট বৎসরের মেয়ে– আমি যদি নতুন হইতাম, তবে কখনওই এ বিবাহে সম্মত হইতাম না। কোন হিসাবে যে এ কন্যা নতুনের উপযুক্ত হইয়াছে জানি না। শ্যামবাবুর মেয়ে মনে করিয়া আমার কখনওই মনে হয় না যে ভাল মেয়ে হইবে– কোনও অংশেই জ্যোতির উপযুক্ত তাহাকে মনে হয় না।’
কথাগুলো পড়েই জ্ঞানদার মুখে খুশির বাঁকা হাসি ফুটে উঠল। যাক, তার হাতে একটা জলজ্যান্ত লিখিত প্রমাণ, তার আইসিএস স্বামী সত্যেন্দ্র কী ভাবছে, জ্যোতির আসন্ন বিয়েটা নিয়ে। কিন্তু আইসিএস হও আর যাই হও, চিঠিটা তো লিখলে সেই বউকে! মুরোদ তো হল না বাবামশায়কে এই চিঠি পাঠাতে! জ্ঞানদার মনে একথাটাও এল না, তা নয়। এবং তার স্বামী সম্বন্ধে মনের ভিতর থেকে তখুনি উঠে এল একটিই শব্দ: অপদার্থ!
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
জ্যোতি তাকায় জ্ঞানদার চোখের দিকে। জ্ঞানদা ঝুঁকে রয়েছে তার লেখার টেবিলে। জ্যোতি এমনভাবে তাকায়, তার জানার কোনও ইচ্ছে নেই মেজদাদা কী লিখে থাকতে পারে। সে যেন মেনে নিয়েছে তার নিয়তি, জ্ঞানদার মনে হয়।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আর কাল বিলম্ব নয়। যা করার তাকে এখুনি করতে হবে। শুধু এই চিঠি নয়, অন্তত ৫ জুলাই, ওই তারিখে, এই বিয়ে বন্ধ করার আরও এক অব্যর্থ অস্ত্র তার হাতে এসেছে বলে জ্ঞানদা নিশ্চিত। সবকিছু মনের মধ্যে গুছিয়ে নিয়ে জ্ঞানদা জ্যোতিরিন্দ্রর ঘরে হাসতে-হাসতে ঢুকে তার পড়ার টেবিলে হুমড়ি খেয়ে বলল, কী কাণ্ড বলো তো তোমার মেজদাদার! ঠাকুরবাড়ি থেকে পালিয়ে তবে সে তোমার বিয়ে নিয়ে ঝেড়ে কেশেছে গো! বলিহারি এ বাড়ির পুরুষদের!
–এ বাড়ির পুরুষ বলতে তো একজনকেই বোঝায়। বাবামশায়। ঠান্ডা গলায় বলে জ্যোতিরিন্দ্র। এবং জ্যোতিরিন্দ্রর হিম উচ্চারণ অনেকটাই মিইয়ে দেয় জ্ঞানদার উৎসাহ।
তবু জ্ঞানদা বলে, চিঠিটা বাবামশায়ের কাছে কোনওভাবে পৌঁছে দিতে পারা যায় না?
–বাকি চিঠিতে মেজদাদা তোমাকে এমন একটি বাক্যও কি লেখেনি, যা বাবামশায়কে দেখানো যায় না? জ্যোতির এই প্রশ্নে যেন সত্যিই কেঁচোর মুখে নুন পড়ে। সে ভিতর থেকে নিথর হয়ে যায়। সত্যেন্দ্র চিঠির শেষে যেসব সোহাগের কথা লিখেছে, সেগুলো কি জ্যোতিকেও দেখাতে পারবে জ্ঞানদা? জ্ঞানদা তাড়াতাড়ি চিঠিটা পাট করে তার ব্লাউজের মধ্যে চালান করে জ্যোতিকে বলে, তোমার দাদা কিন্তু এই চিঠিতে পেরেকের মাথায় হাতুড়ি মেরেছে গো!
জ্যোতি তাকায় জ্ঞানদার চোখের দিকে। জ্ঞানদা ঝুঁকে রয়েছে তার লেখার টেবিলে। জ্যোতি এমনভাবে তাকায়, তার জানার কোনও ইচ্ছে নেই মেজদাদা কী লিখে থাকতে পারে। সে যেন মেনে নিয়েছে তার নিয়তি, জ্ঞানদার মনে হয়।
–তোমার মেজদাদা লিখেছে, শ্যাম গাঙ্গুলীর ওই খুকির সঙ্গে তোমার বিয়ে হোক, সে একেবারেই চায় না। কারণ, এই বিয়ে থেকে তোমার কিচ্ছু পাওয়ার থাকবে না। কোন হিসেবে এই মেয়ে তোমার উপযুক্ত, সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না। তা-ই এই বিয়েতে তার একেবারেই মত নেই।
–মেজদাদা যদি অবিশ্বাস্য দুঃসাহসে এই চিঠি বাবামশায়কে লিখতেও পারত, তাহলেও বাবামশায়ের সিদ্ধান্তে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হত না। বাবামশায়ের আদেশ, প্রাচীন গ্রিক নাটকে অরেকল্-এর মতো, দৈবপ্রত্যাদেশ, লঙ্ঘন করা যায় না বউঠান।
–সব মানলাম নতুন। তোমরা কেউ বাবামশায়ের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করবে না, এই তো। কিংবা করতে পারবে না। কিন্তু তোমার মেজদাদা যে চিঠিতে পেরেকের মাথায় হাতুড়ি মেরেছে একটিমাত্র বাক্যে, তা তো এখনও শোনাইনি।
–শোনাও তাহলে, নিরাসক্ত কণ্ঠে বলে জ্যোতি। বেশ কিছুটা দমে যায় জ্ঞানদা। তবু একটু দম নিয়ে বলে, তোমার মেজদাদা স্পষ্ট লিখেছে, যেহেতু এ-মেয়ে শ্যাম গাঙ্গুলীর মেয়ে, এ-মেয়ে কখনওই ভালো মেয়ে হতে পারে না। এ-মেয়েকে বিয়ে করলে তোমার জীবন নষ্ট হবে। এই মেয়ে থেকে কোনও সুখ পাবে না তুমি! আমার কথা হল, এ-বাড়ির বাজার করার লোক বাবামশায়ের বাবার সরকার হতে চলেছে! এতে কি বাবামশায়ের মানসম্মানে লাগবে না? ব্যাপারটা কোথায় গড়াতে চলেছে, ভাবতে পারো?
–বাবামশায় যে ভাবেননি, তা নয়। তুমি-আমি যা ভাবতে পারি, বাবামশায় তা ভাবতে পারেননি, তা তো নয়। ব্যাপারটা হল, আমার বিয়েটা এখন বিশেষ জরুরি। বেশিদিন আমাকে আইবুড়ো রাখাটা ঠিক হচ্ছে না, বাবামশায়ের মাথায় কথাটা কেউ ঢুকিয়ে দিয়েছে।
–মানে? জ্ঞানদা আকাশ থেকে পড়ার ভান করে।
–মানে খুউব সহজ। তোমার আমার মধুর সম্পর্কের আঁচ পাননি বাবামশায়, তা কি সম্ভব? হিমালয়ের পাদদেশে আধ্যাত্মিক চর্চার মাঝে তিনি যেমন জমিদারির সব হিসেব নির্ভুল রাখেন, জোড়াসাঁকোর বাড়ির আনাচেকানাচে কী হচ্ছে, তা-ও ওঁর নখদর্পণে।
জ্ঞানদা এবার সত্যি ভীত এবং বিস্মিত, এক সঙ্গে। ‘কী বলছ তুমি নতুন?’ প্রথমে আঁতকে ওঠে জ্ঞানদা। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, ‘তা বলে বাড়ির বাজার করার লোকের সঙ্গে ছেলের বিয়ে দিয়ে তার সর্বনাশ করবেন? হতে পারে? লোকনিন্দা?’
–ওসব সাধারণ মানুষের সমস্যা। বাবামশায় দেবেন্দ্রনাথ এই সমস্যা তুড়ি মেরে ওড়াবেন।
–কী করে নতুন? জ্ঞানদা ফ্যালফ্যাল চোখে প্রশ্ন করে।
–আমার বিয়ের ক’দিনের মধ্যেই দেখবে আমাদের দারোয়ান জগমোহন আর বাবার সরকার শ্যাম এ-বাড়ি থেকে উধাও। কোনও চিহ্ন নেই কোথাও। পুববাংলায় আমাদের জমিদারির কোন কাজে কোথায় চালান হয়ে গেছে, ভাবতেই পারবে না। ওদের মেয়ে এ-বাড়ির বউ হওয়ার পর, এ-বাড়িতে ওদের আর কোনও জায়গা থাকবে না। ব্যস, সমস্যার সমাধান।
–নতুন বউ তার বাপ-ঠাকুর্দাকে খুঁজবে না?
–সাহস হবে? জ্যোতি ঝলকে তাকায় জ্ঞানদার দিকে। জ্যোতির চোখে এই ঝলক আগে কি দেখেছে কখনও? জ্যোতি বলে, শোনো বউঠান। এ-বাড়িতে এমন ঘটনা এই প্রথম নয়। আমাদের সবার বড়দাদা, দ্বিজেন্দ্রনাথ, তাঁর বিয়ে কোন তলানিতে দিলেন বাবামশায়? বড় বউঠান সর্বসুন্দরী যশোরের অজপাড়া গাঁ নরেন্দ্রপুরের মেয়ে। তাঁর বাবা তো আমাদের প্রজা। আমাদের বাড়িতে তাঁর কোনও পরিচয় আছে?
জ্যোতিরিন্দ্রর এ-কথা শুনে জ্ঞানদা বুঝতে পারে, এবার জ্যোতি নিশ্চয় বলবে, মেজদার বিয়েও কি অসম বিয়ে নয়? তুমিও কি নও বাবার আর এক প্রজার মেয়ে? কিন্তু জ্যোতি সেকথা তোলে না। সে হঠাৎ চুপ করে যায়। এই সুযোগ। জ্ঞানদা এবার আর অপেক্ষা করে না। তার হাতে মোক্ষম অস্ত্রটি ছাড়ে।
–ঠাকুরপো, তুমি কাদম্বরীর মাকে কোনও দিন দেখেছ? কাদম্বরী এই বাড়িতে বড় হল। তার বাপ-ঠাকুরদাকে আমরা রোজ দেখতে পাই। কিন্তু তার মা-কে কেউ কখনও দেখেছে কি?
জ্যোতি চমকে তাকায়। ছোট্ট একটি প্রশ্ন তার, ‘তুমিও দেখনি বউঠান?’
–কক্ষনও না।
জ্যোতি যে-কাজটি কখনও করে না, সেই কাজটি করল। সে দাঁত দিয়ে নখ কাটল।
সেই অপ্রত্যাশিত দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে জ্ঞানদা আরও এক পা ফেলল সন্তর্পণে। ‘তোমার শাশুড়ি ভাগ্যে যদিও হেঁয়ালি, কিন্তু শালিকা ভাগ্যটি মন্দ নয়। তিন তিনটি শালি গো তোমার। কাদম্বরীর দুই দিদি, বরোদা আর মনোরমা। আর এক ছোটবোন। শ্বেতাম্বরী।’
–ওদের দেখেছ?
–দু’-একবার কিলবিল করতে দেখেছি। কে কোনজন, জানি না। কিন্তু ত্রৈলোক্যসুন্দরীর কোনও পাত্তা নেই। সাপের খোলসের মতো নামটা পড়ে আছে।
–ত্রৈলোক্যসুন্দরী, তিনি কে? দাঁতে নখ কাটতে কাটতে জ্যোতিরিন্দ্রর প্রশ্ন।
–কে আবার! তোমার বেপাত্তা শাশুড়ি। কাদম্বরীর মা। আহারে, তোমার সঙ্গে বিয়ের পরে বাপ-ঠাকুরদাকেও হারাবে ওই মেয়ে।
(চলবে)
তথ্যসূত্র: রবিজীবন: প্রশান্তকুমার পাল
…মেজবউঠাকরুণ-এর অন্যান্য পর্ব…
মেজবউঠাকরুণ ১৯: কাদম্বরী ঠাকুরবাড়িতে তোলপাড় নিয়ে আসছে
মেজবউঠাকরুণ ১৮: নতুনকে কি বিলেত পাঠানো হচ্ছে?
মেজবউঠাকরুণ ১৭: চাঁদের আলো ছাড়া পরনে পোশাক নেই কোনও
মেজবউঠাকরুণ ১৬: সত্যেন্দ্র ভাবছে জ্ঞানদার মনটি এ-বাড়ির কোন কারিগর তৈরি করছে
মেজবউঠাকরুণ ১৫: জ্ঞানদার কাছে ‘নতুন’ শব্দটা নতুন ঠাকুরপোর জন্যই পুরনো হবে না
মেজবউঠাকরুণ ১৪: জ্যোতিরিন্দ্রর মোম-শরীরের আলোয় মিশেছে বুদ্ধির দীপ্তি, নতুন ঠাকুরপোর আবছা প্রেমে আচ্ছন্ন জ্ঞানদা
মেজবউঠাকরুণ ১৩: বিলেতে মেয়েদের গায়ে কী মাখিয়ে দিতে, জ্ঞানদার প্রশ্ন সত্যেন্দ্রকে
মেজবউঠাকরুণ ১২: ঠাকুরবাড়ির দেওয়ালেরও কান আছে
মেজবউঠাকরুণ ১১: ঠাকুর পরিবারে গাঢ় হবে একমাত্র যাঁর দ্রোহের কণ্ঠ, তিনি জ্ঞানদানন্দিনী
মেজবউঠাকরুণ ১০: অসুস্থ হলেই এই ঠাকুরবাড়িতে নিজেকে একা লাগে জ্ঞানদানন্দিনীর
মেজবউঠাকরুণ ৯: রোজ সকালে বেহালা বাজিয়ে জ্ঞানদার ঘুম ভাঙান জ্যোতিঠাকুর
মেজবউঠাকরুণ ৮: অপ্রত্যাশিত অথচ অমোঘ পরিবর্তনের সে নিশ্চিত নায়িকা
মেজবউঠাকরুণ ৭: রবীন্দ্রনাথের মায়ের নিষ্ঠুরতা টের পেয়েছিলেন জ্ঞানদানন্দিনী
মেজবউঠাকরুণ ৬: পেশোয়াজ অন্দরমহল আর বারমহলের মাঝখানের পাঁচিলটা ভেঙে দিল
মেজবউঠাকরুণ ৫: বাঙালি নারীশরীর যেন এই প্রথম পেল তার যোগ্য সম্মান
মেজবউঠাকরুণ ৪: বৈঠকখানায় দেখে এলেম নবজাগরণ
মেজবউঠাকরুণ ৩: চোদ্দোতম সন্তানকে কি ভুল আশীর্বাদ করলেন দেবেন্দ্রনাথ?
মেজবউঠাকরুণ ২: তোমার পিঠটা কি বিচ্ছিরি যে তুমি দেখাবে না বউঠান?
মেজবউঠাকরুণ ১: ঠাকুরবাড়ির বউ জ্ঞানদাকে ঘোমটা দিতে বারণ দেওর হেমেন্দ্রর