যাদবজি হাত জোর করে সকলের বাড়ি গিয়ে নেমন্তন্ন করে এলেন– ‘আইয়েগা জরুর, আপনারাই ভরোসা, অনাথ বাচ্চা, বাপ মা ফেলে চলে গেছিলো বিশ বরস পহিলে, একবার খবর তক নেহি লিয়া, হমারি জিম্মেদারি।’ জীবনে সেই প্রথম টেকো কনের বিয়েতে পেট পুরে খাওয়া– যাদবজি ফেলে যাওয়া ছেলের বিয়েতে কার্পণ্য করেননি। নিজেরা নিরামিষাশি হওয়া সত্ত্বেও বাজারের একপাশে প্যান্ডেল খাটিয়ে মাছ-মাংস সব গুছিয়ে বাঙালিদের মতো বিয়ের ভোজ খাইয়েছিলেন, মিষ্টি এসেছিল জলপাইগুড়ি থেকে।
২১.
যাদবজির শকুনের মতো ধারালো দৃষ্টি সত্ত্বেও তিন-চার পিস দেশওয়ালি ভাই কীভাবে যেন ওর রুটি-কারখানায় রয়ে গেছিল। এরা ময়দা মাখা, কাঠ কাটা, চুল্লিতে পাউরুটি, কেকের টিন ঢোকানো-নামানো, বাজার থেকে সাইকেলে চাপানো মাল ঠেলে আনা, জল তোলা, কাপড় কাচা, বাসন মাজা ইত্যাদি সব করত। তাছাড়া বাঙালি-দোলের ১৫ দিন আগে থেকে ৭ দিন পর অবধি রেল কলোনির বিহারিদের সঙ্গে যখনই সময় পেত উদ্দাম ক্যালাকেলিতে ওদের সমকক্ষ কাউকে দেখিনি। কারখানার একপাশে চ্যালা কাঠের স্তূপ, যাকে বলে আনলিমিটেড সোর্স অফ আর্মস অ্যান্ড অ্যাম্যুনিশন– রেললাইনের প্রায় এক মাপের পাথরও তাই। অতএব পাল ডাক্তারের ডিসপেনসারিতে সন্ধের পর ভিড় মন্দ জমত না। একবারই কেবল যাদবজির বউ ফেলে আসা চ্যালাকাঠ কুড়িয়ে আনতে গেলে রেল কলোনির মহিলারা ওকে আচ্ছাসে পিটিয়ে মাথার চুল ঘাড় থেকে মুড়িয়ে কেটে দিয়েছিল। বেকারির ছেলেরা এরপর একটি রেল কলোনির মেয়ের মাথা মুড়িয়ে-নেড়িয়ে প্রতিশোধ নেয়। মেয়েটির নাকি সে বছরই বিয়ে, ছেলে রেলের ক্লার্ক এবং পূর্ণিয়ার দিকে বিস্তর জমিজমার মালিক– অতএব ওদের বাড়ি থেকে দলবেঁধে থানায় যাওয়ার, এবং দেশ থেকে পহেলওয়ান আনিয়ে হেস্তনেস্তর আলোচনা শুরু হতেই বিহারি ছাড়াও এলাকার বাকিরা নড়েচড়ে বসে। সোজা লাঠি হাতে মারতে দৌড়নোর বদলে বিহারিরা যুক্তিপরামর্শ বসালে বিষয়টি আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে ধরে নেওয়া হত। সেবার কোনও মতে বড় বিপর্যয় এড়ানো গেল। নেড়িমুন্ডিকে এরপর প্রায় রোজই রেলগুদামের একপাশে সেপাইদের ঘোড়ার আস্তাবলের জন্য টাল করে রাখা খড়ের আড়ালে অদৃশ্য হতে দেখতাম। পিছন পিছন বেকারির সেই মনোজ নামক ‘নেড়া করাদের’ প্রধান দুর্বৃত্তটিকেও এদিক-ওদিক চেয়ে স্যাট করে সেঁধিয়ে যেতেও আমরাই প্রথম দেখি। তারপর শিলিগুড়ি জংশন থেকে একদিন ওদের সুটকেস সমেত পাকড়ে এনে বিয়ে দেওয়া অবধি তুমুল হুলুস্থুল কাণ্ড!
যাদবজি হাতজোড় করে সকলের বাড়ি গিয়ে নেমন্তন্ন করে এলেন– ‘আইয়েগা জরুর, আপনারাই ভরোসা, অনাথ বাচ্চা, বাপ মা ফেলে চলে গেছিলো বিশ বরস পহিলে, একবার খবর তক নেহি লিয়া, হমারি জিম্মেদারি।’ জীবনে সেই প্রথম টেকো কনের বিয়েতে পেট পুরে খাওয়া– যাদবজি ফেলে যাওয়া ছেলের বিয়েতে কার্পণ্য করেননি। নিজেরা নিরামিষাশি হওয়া সত্ত্বেও বাজারের একপাশে প্যান্ডেল খাটিয়ে মাছ-মাংস সব গুছিয়ে বাঙালিদের মতো বিয়ের ভোজ খাইয়েছিলেন, মিষ্টি এসেছিল জলপাইগুড়ি থেকে। তার ফলে যমদূতেরা ড্যাঙস হাতে ওর স্বর্গের পথ অবরোধ করে দাঁড়ানোর মতলব এঁটেছে, এমন আশঙ্কা কারও মনেই স্থান পায়নি। রেল কলোনির ছেলেরা যেভাবে বেকারির কর্মচারীদের সেবাযত্ন আপ্যায়নে ‘আইয়ে বৈঠিয়ে’ কল্লে, কে বলবে কিছুদিন আগেই এরা পরস্পরের কণ্ঠ পাকরি ধরিল আকরি করে ছেড়েছিল!
মনোজের পর নেড়িমুন্ডির সঙ্গে তেলিপাড়ার দিকে পাতি কলোনিতে ঘরভাড়া নিয়ে চলে যায়। সকালে ব্যবসায়ী সমিতির ফুটবলের প্র্যাকটিসে অবিশ্যি কামাই দেয়নি কখনও। নেড়িবউ দুধ বিক্রি শুরু করত। বিহার মোড়ের একপাশে বড় ক্যানেস্তারা নিয়ে অন্য মেয়ে-বউদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে সে কী গল্প নেড়া মাথায় ঘোমটা টেনে! সবুজ শাড়ি পরে লিপস্টিক লাগিয়ে একবার বিশ্বকর্মা পুজোয় হেবি নাচল– পাড়ায় নামই হয়ে গেল টিয়াপাখি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
খটকা বেঁধেছিল ভটচাজ জেঠুর শ্যালকটিকে নিয়ে। আমাদের ক্লাস ফাইভে সেই যে ‘প্যানঅ্যাম’ লেখা প্রায় তিনকোনা লাল-সাদা ব্যাগ কাঁধে বাস থেকে নেমে ব্যাক পকেট থেকে ফোল্ডিং চিরুনি টেনে খোট্টার দোকানের আয়নায় চুল আঁচড়ানো ধরল, তারপর আর অন্য কোনও পজিশনে দেখিনি। বুলিদি নাকি তাতেই মুগ্ধ। আমরা হতবাক। বুলিদি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করে, স্কলারশিপ পায়, সংসার টানে– সে কিনা এই লাফড়াবাজের প্রেমে হাবুডুবু?
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
বেকারির অন্যরা গর্মির রাতে আগের মতোই উঠোনে খাটিয়া পেতে ঘুমত। শীতে বর্ষায় ঘরের ভিতরে সার সার বিছানা পড়ত আটটার পর। তারপর বারান্দার কোণে রান্না চাপিয়ে একজন তদারকির দায়িত্বে বসলে বাকিরা গভীর রাত অবধি খোল-কত্তাল বাজিয়ে ভয়ানক ‘রামা হো’ টাইপের কেত্তন গাইত– দোলের সময় নানা জায়গা থেকে দেশওয়ালিরা আসতেন এবং দিনভর ক্যালাকেলি চুকিয়ে রাতে সবাই একে-অপরকে জড়িয়ে একই রামনামের পুষ্কুরিণীতে সে কী ডুবসাঁতার মাইরি! একেবারে বাহ্যজ্ঞানশূন্য অবস্থা! ঠিক তল পেতাম বলা যাবে না। তবে বিষয়টা আমাদের কাছে রসিকতাই ছিল, অস্বাভাবিক নয়।
খটকা বেঁধেছিল ভটচাজ জেঠুর শ্যালকটিকে নিয়ে। আমাদের ক্লাস ফাইভে সেই যে ‘প্যানঅ্যাম’ লেখা প্রায় তিনকোনা লাল-সাদা ব্যাগ কাঁধে বাস থেকে নেমে ব্যাক পকেট থেকে ফোল্ডিং চিরুনি টেনে খোট্টার দোকানের আয়নায় চুল আঁচড়ানো ধরল, তারপর আর অন্য কোনও পজিশনে দেখিনি। বুলিদি নাকি তাতেই মুগ্ধ। আমরা হতবাক। বুলিদি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করে, স্কলারশিপ পায়, সংসার টানে– সে কিনা এই লাফড়াবাজের প্রেমে হাবুডুবু? ভটচাজ জেঠির কানে সে কথা গেলে সে কী তম্বি– ‘কেন, আমাদের খোকোন কি কুড়িয়ে পাওয়া?’ ততদিনে অবিশ্যি জেঠুর আশ্রয়ে তিন-চার বছর পার হয়েছে খোকোন সোনার। বছর বারোর বড়দিদি আর কুড়ি-বাইশ বছরের সিনিয়ার জামাইবাবুর বাড়ির আসনে পাকা ঠাঁই। নিঃসন্তান দম্পতির বিন্দুমাত্র আপত্তি ছিল না। গোড়ার দিকে সন্তানস্নেহে পালন, এবং পরের দিকে বিকেলের পর একসঙ্গে সামান্য বিলিতি খাওয়া শুরু হলে জেঠিমা প্রতিদিনই নানারকম মুখরোচক চাটের বন্দোবস্ত দেখতেন। আমাদের ক্ষুদ্র জীবনে সে খবর চাপার উপায় ছিল না। বুলিদি নাকি তাতেও আপত্তি জানায়নি। মেয়েদের মন নিয়ে বিভ্রান্তির সেই শুরু।
তা আরও খানিকটা বেড়েছিল বুলিদির মায়ের জন্যই। বুড়ি একটা ফিচেল টাইপের গুরু জুটিয়েছিল শেষ বয়সে। মালটাকে বিধান মার্কেটে লুঙ্গি, স্যান্ডোগেঞ্জি গায়ে বাজার করতে দেখেছি। আশপাশের কোনও একটা চা-বাগানে নাকি একসময় মালবাবু বা ওইরকম পদে ছিল, চুরি করে ধরা পড়লে চাকরি যায়। কিছুকাল সাইকেলে চেপে দাদ হাজা চুলকানির মলম বিক্রির পর গেরুয়া প্যান্ট-শার্ট বানিয়ে হাত দেখে বেড়াত ফি রোববার– এক গলা রুদ্রাক্ষ এবং ঝুটো পাথরের মালা ছাড়াও বর্ষাকালে গামবুট পরলে এমন খোলতাই চেহারা হত যে, ঘোর লাগা গরিব গ্রামবাসীরা ঢপবাজির বাকতাল্লা অবিশ্বাস করার সুযোগই পেত না। যাই হোক, চিটিংবাজটা মাসে একবার বুড়ির বাড়িতে এসে থানা গাড়ত, এবং তিন-চারদিন একটানা থেকে গেলে বোঝা যেত পাড়ায় ফিরলে এলাকার লোক ক্যালাবে– সন্দেহটি অমূলক নয়। বাড়ি থেকে বেড়িয়ে বিড়ি সিগারেট বা বেকারির উল্টোদিকের গুমটি থেকে গাঁজা কিনতে গেলে পাড়ায় আমাদের সিনিয়ার গ্রুপের ছেলেরা মালটাকে এন্তার ক্যালাত। সাধনায় গাঁজা লাগে শুনে ব্যায়াম সমিতির কুবের সিং বেশ কয়েকটা কিল মেরে বলেছিল এক্সারসাইজ করলেও কিলোনোর পিঠ লাগে। একে তো বুলিদির বাড়িতে থাকে তাতে সকলের গাত্রদাহ, তার ওপর, লোকটার ছিল প্রচণ্ড টাকার খাই। মেয়ের সামান্য ট্যুইশানি আর স্কলারশিপের আয়ে সংসার চলে জানা সত্ত্বেও নানা অছিলায় বুড়িকে ঠকিয়ে পয়সা হাতানোই ছিল ওর সেঁটে থাকার দ্বিতীয় মহৎ কারণ।
বুলিদির বাড়িতে এই ফেরেব্বাজ, এবং গবেষণার পর চাকরি পেলে বাইরে থেকে আর একটি শিগ্গির আমদানি হওয়ার আশঙ্কায় এলাকার সকলে তটস্থ হয়ে থাকলেও পরিত্রাণের মতলব কারও মাথাতেই ছিল না। বুলিদি পাড়ার ছেলেদের ডেকে একদিন হেবি ধমকাল– ‘ওর গায়ে হাত দিলে পুলিশ ডেকে গাট্টা খাওয়াব।’ শুনে লোকটার সে কী হাউমাউ– ঝোলা থেকে পট করে একটা শাঁখ, বড় পেতলের ঘণ্টা, দুটো কাঁসার থালা, আর কয়েকটা শার্ট-প্যান্ট বের করে দিলে। ‘তোমরা কথায় কথায় এমন পুলিশ ডাকো কেন?’ ফোঁপানি আর থামতেই চায় না।
…ভয়বাংলা-র অন্যান্য পর্ব…
ভয়বাংলা পর্ব ২০: ‘মালদা এলে ডেকে দেবেন দাদা, আমার আবার ভোরবেলাতেই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা ওব্বেস’
ভয়বাংলা পর্ব ১৯: দর্শকরা দ্রুত ঐতিহাসিক থেকে পৌরাণিকে সুইচ করতে পারত
ভয়বাংলা পর্ব ১৮: বাঙালি কি আদৌ জানে তালেগোলে সে কী হারাইয়াছে?
ভয়বাংলা পর্ব ১৭: বাঙালি জীবনের ভেজিটেরিয়ান হওয়ার ভয়
ভয়বাংলা পর্ব ১৬: বাঙাল হওয়া সত্ত্বেও যারা রাবীন্দ্রিক বাংলায় কথা কইত, তারা মুসলমানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে না
ভয়বাংলা পর্ব ১৫: গুষ্টিসুখের প্লেজারই অর্জি-নাল সিন
ভয়বাংলা পর্ব ১৪: কৈশোরে জাতের খোঁজ কেউ কখনও নিয়েছে বলে মনে পড়ে না
ভয়বাংলা পর্ব ১৩: নবনাৎসিগুলোর কাছে আর একটু সফিস্টিকেশন এক্সপেক্ট করেছিলাম মশাই
ভয়বাংলা পর্ব ১২: রাজসভায়, থুড়ি, লোকসভায় কেবল পাশা-খেলাটুকু হবে
ভয়বাংলা পর্ব ১১: আমাগো জয়ার বরের ফিগারটা দ্যাখোনের মতো হইসে
ভয়বাংলা পর্ব ১০: ভূতেরাও ঢিল ছোড়ে, মানুষও রেডি রাখে পাথরের স্টক
ভয়বাংলা পর্ব ৯: চ্যাপলিনের ‘দ্য কিড’-এর খুদে স্টোনম্যান জানলার শার্শি ভেঙেছিল খাবার জুটবে বলেই
ভয়বাংলা পর্ব ৮: ভয়ে ভ্যাবাচ্যাকা লোকেদের সংখ্যা আশ্চর্যরকম বৃদ্ধি পেল
ভয়বাংলা পর্ব ৭: প্রত্যেকেরই মনে হতে থাকে সে-ই অদৃশ্য ঘাতকের একমাত্র টার্গেট
ভয়বাংলা পর্ব ৬: হাতের নাগালে একখানা জলজ্যান্ত বন্দুক চালানো লোকই ছিল সহায়
ভয়বাংলা পর্ব ৫: স্টোনম্যানের একটুকরো খুনে স্টোন বাড়িতে থাকলেই সর্বরোগ থেকে মুক্তি!
ভয়বাংলা পর্ব ৪: ঝেঁটিয়ে বিদেয় কর
ভয়বাংলা পর্ব ৩: বাঙালি ভূত-পেতনিরাও ভারি শুচিবায়ুগ্রস্ত!
ভয়বাংলা পর্ব ২: তবু সে দেখিল কোন ডাইনোসর!
ভয়বাংলা পর্ব ১: বাঙালির ভূতের ভয় যেন উত্তম-সুচিত্রার মতোই সাংস্কৃতিক