অনিতা অগ্নিহোত্রী ‘প্রমীলা কলমে কল্পবিজ্ঞান’ (সম্পাদনা তৃষ্ণা বসাক) নামের বইতে তিনি যে কল্পবিজ্ঞান তথা স্পেকুলেটিভ ফিকশনটি লেখেন, সেটির অভিমুখও তাই পরিবেশই। আমাদের বর্তমান সময়ের থেকে কিছুটা এগিয়ে নিয়ে গিয়ে অনাগত ভবিষ্যতের যে ছবি তিনি আঁকেন, তা প্রায় সবটাই বাস্তবোচিত। সম্ভাব্যও বটে।
২১.
অনিতা অগ্নিহোত্রী কল্পবিজ্ঞান না লিখলেও শিশু-কিশোর উপযোগী রূপকথা থেকে শুরু করে কল্পকাহিনি অজস্র লিখেছেন। কিন্তু তাঁর মেধা-মননের মূল অভিযাত্রা পরিবেশ ও মানুষের দিকে। এবং একেবারেই তথ্যচয়ী ফিল্ড ট্রিপ ভিত্তিক সংগ্রহের মাধ্যমে বিশাল মাপের উপন্যাস লেখাতেই তাঁর কুশলতা বলে আম পাঠক জানেন। ‘মহানদী’ বা ‘মহাকান্তার’-এর মতো লেখাগুলিতে বিশাল ভারতের প্রেক্ষিতে জনজাতিক শোষণ, প্রকৃতি-পরিবেশ ধ্বংসের কথা বারে বারে এসেছে। ঠিক সেভাবেই এসেছে ‘কাস্তে’-র মতো উপন্যাসে নানা ধরনের বিষয়, যার মূল অভিঘাত কৃষিজীবী জনগণ, পরিবেশ, এবং জন আন্দোলন। সম্প্রতি প্রমীলাকলমে ‘প্রমীলা কলমে কল্পবিজ্ঞান’ (সম্পাদনা তৃষ্ণা বসাক) নামের বইতে তিনি যে কল্পবিজ্ঞান তথা স্পেকুলেটিভ ফিকশনটি লেখেন, সেটির অভিমুখও তাই পরিবেশই। আমাদের বর্তমান সময়ের থেকে কিছুটা এগিয়ে নিয়ে গিয়ে অনাগত ভবিষ্যতের যে ছবি তিনি আঁকেন, তা প্রায় সবটাই বাস্তবোচিত। সম্ভাব্যও বটে।
‘হারিয়ে গেলেন আরও একজন। পরিবেশ বৈজ্ঞানিক বিঘ্নেশ দেশাই। দেশে যখন উন্নয়নের নামে একের পর এক আঘাত আসছে পরিবেশের ওপর, বিঘ্নেশ দেশাই তাঁর ল্যাব ছেড়ে পথে নেমেছিলেন। নর্মদার খাত ডায়নামাইট দিয়ে ফাটিয়ে সেখানে ‘সি প্লেন’ নামানোর জন্য স্টেশন বানানো, দক্ষিণের রেইন ফরেস্ট নষ্ট করে মাইনিং চালু করা– কর্পোরেটদের নজরদারিতে বানানো নীতি অনুযায়ী একের পর এক বিনিয়োগ বিপন্ন করে তুলছিল পরিবেশকে। উষ্ণায়নের প্রভাবে মাটির নীচের জলস্তর কমে যাচ্ছে, বৃষ্টি বিরল হয়ে পড়ছে, অসময়ে সাইক্লোন এসে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে কৃষি। সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন, অথচ কর্পোরেট গোষ্ঠী নিজেদের মুনাফা ছাড়া কিছুই জানে না। সাতপুরা অভয়ারণ্যকে ছিন্নভিন্ন করে যখন প্ল্যান করা হল এইট লেন হাইওয়ে, সরকারের সঙ্গে দেশাই-এর সংঘাত শেষ সীমায় পৌঁছল। সমুদ্রের জলতল বাড়ছে। বাণিজ্য রাজধানী মুম্বই ডুবে যাবে, নষ্ট হবে হাজার হাজার কোটি টাকা আর লাখ লাখ মানুষের জীবন। এখনো বলছি সংযত হও। দেশাই-এর সঙ্গে আরও অনেকে যোগ দিয়েছিল। তরুণ গবেষক, প্রযুক্তিবিদ, ছাত্রছাত্রী। বালুও ছিল সেই দলে। সরকারি গোয়েন্দারা জানতেন সরকার বিরোধিতার মূল স্তম্ভ একজনই। সেইজন্য দেশাই-এর উপর নজরদারি চলছিল। নিজের ল্যাবে আসার পথেই তিনি একদিন উধাও হয়ে যান। দেশদ্রোহ আর বেআইনি কার্যকলাপ বিরোধী আইনে গ্রেফতার হয়ে রাতারাতি উবে গেলেন প্রৌঢ় বিজ্ঞানী। নতুন আইনে অপরাধীকে কোর্টে তোলাও অত্যাবশ্যক নয়, দেশের কোন প্রান্তে তাকে নিয়ে যাওয়া হবে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সে বিষয়ে কাউকে জবাবদিহি করেনা। মুম্বই-এর জেলগুলো জলমগ্ন হতে থাকলে তাঁকে কি মধ্য ভারতের কোনও জেলে পাঠানো হয়? তিনি বেঁচে আছেন কি না সরকারের কাছেও সে তথ্য নেই। সারা শহর যখন এক মহানিষ্ক্রমণের দরজায়, তথ্য রাখার দায়িত্ব কে নেবে? নাসার যে গ্লোবাল ওয়ার্মিং প্রজেক্ট-এর সঙ্গে কাজ করছে দেশের পরিবেশ মন্ত্রক, তারাও জলতল ওঠার কারণ হিসেবে দুটো ব্যাপারকে গুরুত্ব দেয়। উত্তর মেরুর বরফ গলার হার আর ভূগর্ভস্থ জলের সমুদ্রে পড়ে তার উষ্ণতা বাড়িয়ে দেওয়া। স্থানীয় ভূমিক্ষয়, বনের বিনাশ, ভূগর্ভস্থ জল কমে যাওয়া, এইসব কারণও আছে, তবে তাদের ভূমিকা খুব বড় নয়। সেইজন্য সরকারও একনাগাড়ে বলে এসেছে দেশাই-এর উষ্ণায়ন অ্যাকটিভিজম-এর মধ্যে রাজনীতি মিশে আছে। উনি প্রকৃত বৈজ্ঞানিক নন। বিদেশে বসেও এই সব বিতর্ক শুনেছে অভি। আসলে এসব কিছুই প্রতিপাদ্য বিষয় নয়। একজন বিজ্ঞানী জীবন বিপন্ন করে কর্পোরেট চালিত রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। দেশের গোয়েন্দা বাহিনী তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল, তারা দেশাইকে ফেরায়নি। না ফেরানোর জন্য জবাবদিহি করেনি। এবং নানা কারণের সংযোগে আজ ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্য কেন্দ্র আজ সাগর জলে।
প্লাটফর্মটা নীচে নেমে এলে দেখে, বালু অপেক্ষা করছে। অভি বলল, এ কী তুমি চলে যাওনি? না, আমার হভার ক্রাফটা নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। তোমার মন ভালো নেই, অভি! আমি তো জানি। চলো, আমাদের ছোটবেলার স্কুলে যাবার পথটা, হারানো ক্যাম্পাসটা আর একবার দেখবেনা? দুদশকের ক্লাইমেট চেঞ্জ-এর পড়াশুনো, গবেষণা, কাজ, সারা পৃথিবীর সঙ্গে সংযোগ, তবু দিশেহারা লাগে। বুকের ভিতর থেকে ভলকে ভলকে উঠে আসে কান্নার মত রক্ত। জলের উপর যে বড় গাছের মাথা জেগে আছে, সেগুলি বিবর্ণ, নীরক্ত। ক্রমাগত লবণজলে ডুবে থেকে গাছগুলির চেহারা বদলে গেছে। মারা গেছে বহু পুরোনো গাছ, নতুন উদ্ভিদ প্রজন্ম আলো বাতাসের জন্য লড়াই করে চলেছে। এ জলমণ্ডলে কোনও ফুলের সুবাস নেই, কোনও প্রজাপতি নেই। শালিখ, চড়াই-এর ডাক নেই। যে সব ছোটো পাখির কূজন মাতিয়ে রাখত বনের মত বিজনতাকে, তারা কেউ নেই আজ। কেবল সমুদ্র চিলেরা ডাকতে ডাকতে মাথার উপর দিয়ে উড়ে যায়।’
অন্যদিকে একই সংকলনে দেখব, সংহিতা বন্দ্যোপাধ্যায়, পেশাগতভাবে যিনি ডাক্তার, তিনি লিখছেন ‘ভ্রূণরচনা’, শরীরী সমস্ত প্যারামিটারের ওপর যন্ত্র ও এআই-এর অধিকার নিয়ে কল্পগল্প।
‘ট্রু শেষ প্রজন্ম, যারা কেউ কেউ ভ্রুণের স্বত্বাধিকারি স্ত্রী ও পুরুষের সন্তান। ওর মায়ের ডিম্বানু থেকে শিশুর দুরারোগ্য বংশগত রোগের সম্ভাবনা থাকায়, ওর মা বাবা, ডিম্বানু দাত্রী, তৃতীয় ব্যক্তির সাহায্য নেন। তার সাইটোপ্লাসম প্রতিস্থাপনে, ট্রু জন্ম। বিখ্যাত ডক্টর ট্রেন্ডেলেনবার্গ এই প্রতিস্থাপন করেন। তাঁর কাছে নিয়মিত ওদের মতো সবার শরীরের সবকটা চিপের তথ্য ও পরিসংখ্যান থাকে। এই সব অসুখ, ট্রু-এর মত মানুষের পরবর্তী প্রজন্মে হয় কিনা, সেটাই ওনার গবেষণার বিষয় এখন। ট্রু জানে, এক সময় ওর সেই মা এবং তার মত অনেকে ওদের মত জাতকদের দ্বিতীয় মাতৃত্বের অধিকার দাবী করে। এই আন্দোলন আইনের দ্বারস্থ হলে ওর মা বাবা, ওকে মঙ্গলে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন। এরা মামলায় হেরে গেলে ওরা সুখী পৃথিবীতে আসেন। ট্রুর স্মৃতির চিপে, মঙ্গল গ্রহ মানে, লাল মাটির ছোট ছোট পাহাড় আর ভীষণ উষ্ণ বালির ঝড় রয়ে গেছে। শেষ উল্কাপাতের আগে, ওর বাবা মায়ের মত বর্ধিষ্ণু কিছু মানুষ, মঙ্গলে আর চাঁদে কিনে রাখা জমিতে পুনর্বাসন নেন। পরে পৃথিবী শান্ত হলে তারা ফিরে আসেন। তখনি ট্রুর পরিকল্পনা হয়। বড় হলে, ট্রেন্ডেলেনবার্গ তাকে, বিগ ডেটায়, আত্মপরিচয় খোঁজার পাসয়ার্ড দিলে, সে সব জানতে পারে। দ্বিতীয় মাকে সে কখনো দেখেনি। ট্রু ডিজিটাল আর্ট নিয়ে পড়ছে। একঘেয়েমি কাটাতে, বাইশ বছর বয়েসে, ট্রু , একাধিক যৌন সংসর্গ করেছে। দশ বছরে প্রথম পর্ন পার্লারে গিয়ে, ভার্চুয়াল সিমুলাশানের নেশা ধরে গিয়েছিল ওর। ট্রেন্ডেলেনবার্গ সতেরো বছর বয়সে, ডিজিটাল স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে, দেখেন, ট্রু লিবিডো হারাচ্ছে সেই সঙ্গে যৌনাঙ্গের দৃঢ়তা কমে যাচ্ছে। ঘিরে ধরছে অবসাদ। পড়াশোনায়ও পিছিয়ে পড়ছে। তার মস্তিষ্কের চিপে ঘুরে বেড়াচ্ছে পর্ণ সিমুলেশানের মুহূর্তেরা। লিম্বিক সিস্টেমে ক্ষণস্থায়ী উত্তেজনামূলক তরঙ্গ আর স্নায়বিক ক্ষরণ চলছে। এরপর, ট্রুকে জাগতিক যৌন সংসর্গ করার নির্দেশ দেন তিনি।
সেক্স শপ সাইটে নিজের পছন্দের গুণমান দিয়ে ট্রু প্রথমবার পেয়েছিল সিসিলকে। সিসিল বিষমকামী, কিশোর বয়েসি ছেলেদের সঙ্গেই কাজ করত। চ্যাট করতেই, ওর কাছে সিসিলের পারফরমেন্স ভিডিও এল। তাতে ওর ফোরপ্লে দেখে ভালো লেগেছিল। দেখা গেল, বিছানায় সিসিল ভীষণ আক্রমনাত্মক। ট্রু ওর সঙ্গে এঁটে উঠতে পারছিলনা।’
…পড়ুন সায়েন্স ফিকশনারী-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ২০। বাড়িকেই জামার মতো পরেছে মানুষ
পর্ব ১৯। আলো-অন্ধকারে হেঁটে যে কল্পবিজ্ঞান বলতে চেয়েছে দলিত কাহিনি
পর্ব ১৮। পৃথিবীর শেষ লড়াই পানীয় জলের দখলের জন্য
পর্ব ১৭। একটি সন্তান অজৈবিকভাবে জন্ম নিচ্ছে পৃথিবীতে
পর্ব ১৬। অজানা জগৎ ঘিরে যে মুগ্ধতা, বন্দনা সিংয়ের কল্পবিজ্ঞানের সেটাই চালিকাশক্তি
পর্ব ১৫। মানুষ খুন না করেও যুদ্ধে জেতা সম্ভব, দেখিয়েছে এলিজাবেথ বেয়ারের কল্পবিজ্ঞান
পর্ব ১৪। শরীরের খোলনলচে পাল্টে ফেলে দৌড়তে থাকে যারা
পর্ব ১৩। মানুষের বিরুদ্ধে গাছের ধর্মঘট কি কল্পবিজ্ঞান না বাস্তব?
পর্ব ১২। বাড়ির দরজা খুলে পৃথিবীর যে কোনও জায়গায় পৌঁছনো যায়, দেখিয়েছে কল্পবিজ্ঞান
পর্ব ১১। ধ্বংস ও বায়ুদূষণ পরবর্তী সভ্যতায় জয়ন্ত কি ফিরে পাবে তার রাকাকে?
পর্ব ১০। লীলা মজুমদারের কল্পবিজ্ঞানের মহাকাশযানে উঠে পড়েছিল বঞ্চিত মানুষও
পর্ব ৯। জরায়ুযন্ত্রে পরিণত হওয়া নারী শরীর কি ডিস্টোপিয়া, না বাস্তব?
পর্ব ৮। উরসুলার মতো সফল নারী লেখককেও সম্পাদক পাঠাতে চেয়েছিলেন পুরুষ ছদ্মবেশে
পর্ব ৭। উরসুলা লেগুইন কল্পকাহিনির আইডিয়া পান স্ট্রিট সাইনগুলো উল্টো করে পড়তে পড়তে
পর্ব ৬। কেবলমাত্র নারীরচিত সমাজ কেমন হবে– সে বিষয়ে পুরুষের অনুমান সামান্য
পর্ব ৫। একমাত্র মানুষের মাংসই সহ্য হত ভিনগ্রহী শিশুটির!
পর্ব ৪। পাল্প ম্যাগাজিনের প্রথম লেখিকা
পর্ব ৩। রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ কি কল্পবিজ্ঞান সংজ্ঞার সবগুলো শর্তই পূরণ করতে পেরেছিল?
পর্ব ২। সুলতানার স্বপ্নেই বিশ্বের প্রথম নারীবাদী ইউটোপিয়ার অবকাশ
পর্ব ১। চ্যালেঞ্জের বশেই লেখা হয়েছিল পৃথিবী প্রথম কল্পবিজ্ঞান কাহিনি, লিখেছিলেন একজন নারীই
খেলিফের প্রতি নেটিজেনের বিরুদ্ধতার কারণ তাই, আর যাই হোক, তা ‘মেয়েদের সমানাধিকারের’ দাবিতে নয়। সমস্যা অবশ্যই খেলিফের লম্বা, পেটানো পেশিবহুল চেহারা– যা বহু মানুষের মতে ‘নারীসুলভ’ নয়। অর্থাৎ, অলিম্পিক খেলার যোগ্যতা অর্জন করা ক্রীড়াবিদ পাশ করতে পারেননি আমাদের বিউটি প্যাজেন্টে। দুইক্ষেত্রেই লজ্জা আমাদের। তবুও খেলিফ জিতলেন, সোনা ছাড়া আর কীই বা পেতে পারতেন তিনি?
মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে যে মন্ত্রিত্বই তাঁর হাতে থাক, বুদ্ধদেব ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর কাছে অতি নির্ভরযোগ্য এক সেনাপতির মতো। ‘আপনারা বুদ্ধর কাছে যান, বুদ্ধ ওসব কালচার-ফালচার বোঝে’– জ্যোতিবাবুর এই উক্তি যথার্থ কি না জানি না, কিন্তু কথাটা মিথ্যে ছিল না।