জ্ঞানদা নিশ্চিত, ওই কালো ডিগডিগে নিরক্ষর ন’বছরের মেয়েটাকে কিছুতেই বউ বলে মেনে নিতে পারবে না উনিশ বছরের ফুটন্ত, টগবগে সুন্দর, বাংলা, সংস্কৃত, ফরাসি জানা, পিয়ানো আর এস্রাজে তুখড়, কথাবার্তায় চমক লাগানো যুবক জ্যোতিরিন্দ্র। রবি বরং তার একটা খেলার সঙ্গী পাবে। আর তার নতুন তারই থাকবে। এ-ব্যাপারে আর কোনও সংশয় নেই জ্ঞানদার মনে।
২২.
জ্ঞানদা তার নতুনকে আশ্বাস দিয়েছে বটে যে, নতুনের বিয়ে হবে না, কারণ নতুনকে ছাড়া সে বাঁচবে না, জ্ঞানদা ক্রমেই বুঝতে পারছে, নতুনের বিয়ে হবেই হবে। এবং নির্ধারিত দিনেই হবে। বাবামশায়ের কথার নড়চড় হওয়ার জো নেই। তিনি তাঁর কর্মচারী, বাজার সরকার শ্যামলাল গাঙ্গুলিকে কথা দিয়েছেন, তাঁর ১৯ বছরের পুত্র জ্যোতিরিন্দ্রর সঙ্গে শ্যামলালের ন’বছরের তৃতীয় কন্যা কাদম্বরীর বিয়ে দেবেনই দেবেন। বিয়ের দিন নির্ধারিত হয়েছে ২৩ আষাঢ় ১২৭৫ বঙ্গাব্দ। জ্ঞানদা ইংরেজি ক্যালেন্ডারে তারিখটা দাগ দিয়ে রেখেছে, ৫ জুলাই ১৮৬৮, রবিবার। নিচে ছোট্ট করে লিখেছে, নতুনের বিয়ে হচ্ছেই। বউ একেবারে নিরক্ষর।
কেন এই কথাটা খুদে খুদে অক্ষরে লিখেছে জ্ঞানদা? কারণ, বাবামশায় শ্যামলালকেই নাকি জিজ্ঞেস করেন, শ্যামলাল, তোমার মেয়েকে লেখাপড়া শেখাচ্ছ তো?
শ্যামলাল ভয়ে ভয়ে উত্তর দিয়েছে, মেয়ের এখনও অক্ষর পরিচয় হয়নি কর্তামশায়।
–সে কী! বিস্মিত দেবেন্দ্রনাথ।
–কর্তামশায়, তাহলে কি এ-বিয়ে হবে নি?
–কথা যখন দিয়েছি, বিয়ে হবেই। এক কাজ করো। বাজার থেকে তুমি বিদ্যাসাগরমশায়ের প্রথম ভাগ, আর দ্বিতীয়ভাগ কিনে আনো। তার সঙ্গে একটা ধারাপাতও এনো। ভালই হল। নতুনের বউকে লেখাপড়া শেখাবে রবি। ওদের তো কাছাকাছি বয়েস।
–আজ্ঞে, রবিবাবু তো মাত্র সাত। উনি কি পারবেন?
দেবেন্দ্রনাথ অবাক হয়ে তাকান তাঁর বাজার সরকারের দিকে। তারপর বলেন, রবি স্কুলে যেতে চায় না, আমি জানি। কিন্তু সাত বছরের রবির হাতের লেখা দেখেছ? এই বয়সে ছড়া লিখতে পারে। আমি রবির লেখাপড়ার সব খোঁজ রাখি। নতুনের বউকে ওই পারবে নতুনের যোগ্য করে তুলতে।
এসব কথা শ্যাম গাঙ্গুলির মুখে শুনে হঠাৎ কেমন যেন মনটা ভাল হয়ে গেল জ্ঞানদার। সে নিশ্চিত, ওই কালো ডিগডিগে নিরক্ষর ন’বছরের মেয়েটাকে কিছুতেই বউ বলে মেনে নিতে পারবে না উনিশ বছরের ফুটন্ত, টগবগে সুন্দর, বাংলা, সংস্কৃত, ফরাসি জানা, পিয়ানো আর এস্রাজে তুখড়, কথাবার্তায় চমক লাগানো যুবক জ্যোতিরিন্দ্র। রবি বরং তার একটা খেলার সঙ্গী পাবে। আর তার নতুন তারই থাকবে। এ-ব্যাপারে আর কোনও সংশয় নেই জ্ঞানদার মনে।
………………………………………………………………………………………………………………………………..
অবিবাহিত অবস্থায় পাত্রপাত্রীর শেষ অন্নগ্রহণ অনুষ্ঠান! ভাবলে হাসি পায়, আশ্চর্যও হই, বাঙালির আরামদায়ক ঘরোয়া অশিক্ষা কী অবলীলায় ‘অব্যূঢ়’-কে পরিণত করেছে ‘আইবুড়ো’-তে!
……………………………………………………………………………………………………………………………….
দেখতে-দেখতে এসে গেল সেইদিন। নতুনের আইবুড়ো ভাত। আজও ভোরবেলা নতুনের মিঠে পিয়ানোর শব্দে ঘুম ভাঙল জ্ঞানদার। কোনওদিন তো এই সুর বাজায় না নতুন। আজ কেন তার পিয়ানোতে ভর করেছে যেন কোন দিগন্তবিস্তৃত তেপান্তরের উদাসীন বাউল? জ্ঞানদার মনে হল, তার নতুন কাঁদছে। আর একই সঙ্গে পালাতে চাইছে। কিন্তু জ্ঞানদা থাকতে তার পালানো সব পথ বন্ধ। স্বামী সত্যেন তখনও ঘুমিয়ে তার পাশে। চাকরিতে দু’-চারদিনের ছুটি নিয়ে কলকাতায় ফিরেছে ভাইয়ের বিয়েতে। এবং শ্যামলালের মেয়ের সঙ্গে নতুনের বিয়েটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না বলে মনে মনে বাবামশায়ের বিরুদ্ধে ফুঁসছে। ঠিক করেছে নতুনের বিয়ের পরে সে এ-বাড়ি ছেড়ে পার্কস্ট্রিটের সাহেবপাড়ায় সাহেব আইসিএস-দের মতো স্ত্রীকে নিয়ে একার সংসারে থাকবে, যখন অবিশ্যি কলকাতায় আসবে বদলি হয়ে। সে তো অনেক দূরের পথ, এখনও স্বপ্ন– কোনও দিন কি সত্যিই বাস্তব হয়ে দেখা দেবে?
জ্ঞানদা চুপিচুপি বিছানা ছাড়ে। এক বিপন্ন বিষণ্ণতা মেঘলা আকাশের মতো তার সারা মন জুড়ে বিছিয়ে। আজকের পরে নতুন কি আর তার থাকবে?
জ্ঞানদা ঢোকে নতুনের ঘরে। এ-ঘরের সব জানলা খোলা। নতুন জানলার বাইরে আষাঢ় মাসের মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে পিয়ানোয় বাজাচ্ছে বাউলের মেঠো সুর। জ্ঞানদার মনে হয়, এক আকাশ কান্না ভেঙে পড়ছে এক-মাঠ অপেক্ষার ওপর।
–বেশ আছ তুমি নতুন, সকালবেলা বসে বসে পিয়ানো বাজাচ্ছ। আর তোমার আইবুড়োভাতের সব দায়দায়িত্ব পড়েছে আমার ওপর। সারাদিন কত কাজ জানো?
জ্ঞানদার কথা শুনে জ্যোতি পিয়ানো থামায়। জানলা থেকে মুখ ফিরিয়ে তাকায় তার মেজবউঠানের দিকে। হেসে বলে, মেজবউঠান, তুমি আইবুড়োভাতের সংস্কৃত জানো?
–আইবুড়োভাতের সংস্কৃত?
–ঠিক তাই। কোন সংস্কৃত শব্দ থেকে এই নিদারুণ অশিক্ষিত অমার্জিত বাংলা শব্দটি জন্মেছে, জানো তুমি?
–না তো ঠাকুরপো!
–অব্যূঢ়ান্ন!
–কী অদ্ভুত একটা শব্দ। তবে ভাতের গন্ধটা পাচ্ছি।
–কিন্তু ভাতের স্বাদটা আটকে দিচ্ছে ওই ‘অব্যূঢ়’ শব্দটা? তাই তো? ‘অব্যূঢ়’ মানে হল, যার বিয়ে হয়নি। সরি, একটু ভুল হল, যে-পুরুষের এখনও বিয়ে হয়নি। যেমন আমি।
–আর যে এক চিলতে কালো মেয়েটার এখনও বিয়ে হয়নি, যে তোমার বউ হয়ে এ-বাড়িতে আসবে কাল, তার জন্যে কোনও সংস্কৃত নেই?
–সে তো ‘অব্যূঢ়া!’ আর আজ দু’জনেরই ‘অব্যূঢ়ান্ন’। অবিবাহিত অবস্থায় পাত্রপাত্রীর শেষ অন্নগ্রহণ অনুষ্ঠান! ভাবলে হাসি পায়, আশ্চর্যও হই, বাঙালির আরামদায়ক ঘরোয়া অশিক্ষা কী অবলীলায় ‘অব্যূঢ়’-কে পরিণত করেছে ‘আইবুড়ো’-তে!
–আর তার সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে ‘অন্ন’ শব্দটির বাংলা ভাত, তাই না?
–এই তো মেজবউঠান, ঠিক ধরে ফেলেছ!
–কিন্তু এতদিনে হঠাৎ বাবামশায়ের টনক নড়েছে, আচমকা বলে জ্ঞানদা।
–কী ব্যাপারে তাঁর টনকের এই নড়ন? একেবারে নিজস্ব ভঙ্গিতে প্রশ্ন তোলে জ্যোতিরিন্দ্র।
–তোমার সঙ্গে কাদম্বরীর এই অসম অন্যায় বিয়ের ব্যাপারে।
কথাটা বলে জ্ঞানদা জ্যোতির খুব কাছে এসে দাঁড়ায়। তারপর তার বুকের উপর আলতো হাত রেখে মৃদু কণ্ঠে বলে, শ্যামলালের কাছেই বাবামশায় জানতে পেরেছেন তার এই তিন নম্বর মেয়েটি ন’বছর বয়সেও সম্পূর্ণ নিরক্ষর। না পারে বাংলা পড়তে, না পারে বাংলা লিখতে। তার অক্ষর-পরিচয় পর্যন্ত হয়নি। বাবামশায় সঙ্গে সঙ্গে তাঁর হবু বউমাটির জন্য শ্যামবাবুকে বলেছেন, বিদ্যাসাগরমশায়ের প্রথমভাগ আর দ্বিতীয়ভাগ কিনে আনতে। এবং সঙ্গে ধারাপাত।
–কিন্তু মাস্টারমশাইটি কে? তুমি না তো মেজবউঠান?
– না গো। কাদম্বরীর মাস্টারমশাই রবি। বলেছেন স্বয়ং বাবামশায়। সাত বছরের রবি পড়াবে ন’বছরের কাদম্বরীকে। কাদম্বরী মানবে ওকে? জ্যোতি অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে, বাবামশায় বিচক্ষণ ও দূরদ্রষ্টা। উনি একেবারে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। রবির বাংলা পড়ে আমি চমকে যাই। সেদিন ইশকুলে এক কাণ্ড ঘটিয়েছে রবি।
–কী কাণ্ড?
–ওকে মাস্টারমশাই ঈষৎ বিদ্রুপ করে বলেছেন, রবি, তুই নাকি আজকাল লেখাপড়া ছেড়ে ছড়াটড়া লেখায় বিশেষ ব্যস্ত? তা আমি একটা লাইন বলছি, তুই পরের লাইনটা বলতে পারবি? চেষ্টা করে দ্যাখ, কোনও যুৎসই লাইন মাথায় আসে কি না।
রবি নীরবে উঠে দাঁড়ায়।
মাস্টারমশায় একটিপ নস্য নাকে গুঁজে বলেন, ‘রবি করে জ্বালাতন আছিল সবাই, বরষা ভরসা দিল, আর ভয় নাই।’
–তারপর? জ্ঞানদা উদ্গ্রীব।
–রবি তখুনি বলল, মীনগণহীন হয়েছিল সরোবরে, এখন তাহারা সুখে জলক্রীড়া করে!
–আমাদের রবি! ও তো সারাদিন চুপচাপ। কথাই বলে না।
–রবি ডুবে থাকে নিজের মধ্যে। বড্ড একা। ছেলেটা বড় হচ্ছে বাড়ির কাজের লোকেদের মধ্যে। বাবামশায়কে কতটুকু পায় ও! আর মা তো থেকেও নেই। আমার বিয়েটা রবির পক্ষে অন্তত ভালো হল। রবি একটা বন্ধু পাবে। এবং সেই বন্ধুকে রবি নিজের মনের মতো করে গড়েও নেবে। তুমি দেখো মেজবউঠান।
হঠাৎ জ্ঞানদা জ্যোতির মাথাটা নিজের বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে বলে, কাল থেকে আমিও রবির মতো একা হয়ে যাব না তো ঠাকুরপো?
জ্ঞানদা তার বুকের মধ্যে অনুভব করে জ্যোতিরিন্দ্রর তপ্ত দীর্ঘশ্বাস!
(চলবে)
…মেজবউঠাকরুণ-এর অন্যান্য পর্ব…
মেজবউঠাকরুণ ২১: জ্ঞানদার মধ্যে ফুটে উঠেছে তীব্র ঈর্ষা!
মেজবউঠাকরুণ ২০: স্বামী সম্বন্ধে জ্ঞানদার মনের ভিতর থেকে উঠে এল একটি শব্দ: অপদার্থ
মেজবউঠাকরুণ ১৯: কাদম্বরী ঠাকুরবাড়িতে তোলপাড় নিয়ে আসছে
মেজবউঠাকরুণ ১৮: নতুনকে কি বিলেত পাঠানো হচ্ছে?
মেজবউঠাকরুণ ১৭: চাঁদের আলো ছাড়া পরনে পোশাক নেই কোনও
মেজবউঠাকরুণ ১৬: সত্যেন্দ্র ভাবছে জ্ঞানদার মনটি এ-বাড়ির কোন কারিগর তৈরি করছে
মেজবউঠাকরুণ ১৫: জ্ঞানদার কাছে ‘নতুন’ শব্দটা নতুন ঠাকুরপোর জন্যই পুরনো হবে না
মেজবউঠাকরুণ ১৪: জ্যোতিরিন্দ্রর মোম-শরীরের আলোয় মিশেছে বুদ্ধির দীপ্তি, নতুন ঠাকুরপোর আবছা প্রেমে আচ্ছন্ন জ্ঞানদা
মেজবউঠাকরুণ ১৩: বিলেতে মেয়েদের গায়ে কী মাখিয়ে দিতে, জ্ঞানদার প্রশ্ন সত্যেন্দ্রকে
মেজবউঠাকরুণ ১২: ঠাকুরবাড়ির দেওয়ালেরও কান আছে
মেজবউঠাকরুণ ১১: ঠাকুর পরিবারে গাঢ় হবে একমাত্র যাঁর দ্রোহের কণ্ঠ, তিনি জ্ঞানদানন্দিনী
মেজবউঠাকরুণ ১০: অসুস্থ হলেই এই ঠাকুরবাড়িতে নিজেকে একা লাগে জ্ঞানদানন্দিনীর
মেজবউঠাকরুণ ৯: রোজ সকালে বেহালা বাজিয়ে জ্ঞানদার ঘুম ভাঙান জ্যোতিঠাকুর
মেজবউঠাকরুণ ৮: অপ্রত্যাশিত অথচ অমোঘ পরিবর্তনের সে নিশ্চিত নায়িকা
মেজবউঠাকরুণ ৭: রবীন্দ্রনাথের মায়ের নিষ্ঠুরতা টের পেয়েছিলেন জ্ঞানদানন্দিনী
মেজবউঠাকরুণ ৬: পেশোয়াজ অন্দরমহল আর বারমহলের মাঝখানের পাঁচিলটা ভেঙে দিল
মেজবউঠাকরুণ ৫: বাঙালি নারীশরীর যেন এই প্রথম পেল তার যোগ্য সম্মান
মেজবউঠাকরুণ ৪: বৈঠকখানায় দেখে এলেম নবজাগরণ
মেজবউঠাকরুণ ৩: চোদ্দোতম সন্তানকে কি ভুল আশীর্বাদ করলেন দেবেন্দ্রনাথ?
মেজবউঠাকরুণ ২: তোমার পিঠটা কি বিচ্ছিরি যে তুমি দেখাবে না বউঠান?
মেজবউঠাকরুণ ১: ঠাকুরবাড়ির বউ জ্ঞানদাকে ঘোমটা দিতে বারণ দেওর হেমেন্দ্রর