জরুরি ফোনে খবর পেয়েছে রাহুল। সোর্স বলছে, পোস্টমাস্টার ভোরে স্টেশন যাবে। ট্রেন ধরবে। রাহুল এবার কড়া। যথেষ্ট হয়েছে। ওকে আটকাতে হবে। কড়া নির্দেশ, আটক করো। পালাতে গেলে গুলি চালাও। রাহুলের নির্দেশ পেয়ে পুলিশ তড়িঘড়ি ছুটল স্টেশনের দিকে।
৩০.
রেশমি সহ্য করছে পারছে না এই বোকা বনে যাওয়াটা। যত ভাবছে তত লজ্জায় পড়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে ঘুরে বেরাল সুমিত। রেশমি যাকে ভীতু, স্বার্থপর ভাবত। কতটা ডেডিকেশন থাকলে এভাবে এই চাকরি করেও মাওবাদী রাজনীতির অ্যাকশন স্কোয়াডে থাকা যায়। সে চিনতে পারেনি মানুষটাকে। নিজেকে ছোট লাগছে রেশমির। সে শুধু ভালোলাগা, ভালোবাসা দিয়ে দেখতে গিয়েছে। আর মানুষটা তার থেকেও কত বড় আকাশে কত দায়িত্ব, কত ঝুঁকি নিয়ে খেলে বেড়াচ্ছে।
সুমিতই ব্রহ্মা, এটা জানার পর কি নিজের আবেগে লাগাম টানবে রেশমি? এই ঝুঁকির জীবনের সঙ্গে সেতুবন্ধন নিয়ে কোনওরকম ভাবনাকে প্রশ্রয় দেওয়ার বাস্তবতা থাকে কি? কিন্তু রেশমির ভেতরটা যে ভেঙেচুরে আরও দুর্বল হয়ে পড়ছে। আবার চমকে উঠছে রাহুলের একটা কথা মনে পড়লে। পুলিশ অফিসার কথায় কথায় কিছু না জেনেই বলেছিল, ‘যে-ই হোক ব্রহ্মা, যেদিন ধরব, হয় সারা জীবন জেলে পচবে, না হলে ওসব ঝামেলায় না গিয়ে একেবারে লাশ বানিয়ে খবর করাব।’ রেশমি আঁতকে উঠছে এসব কথা মনে পড়লে। ভাবছে, তার কী করা উচিত? সুমিতের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা বা না রাখা। সুমিতকে তার নিজের জগতে ছেড়ে দেওয়া। নাকি সুমিতের নিরাপত্তা আর ভবিষ্যতে ভালোর জন্য ওকে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার করিয়ে দেওয়া। কোনটা সঠিক পথ? রেশমি বিভ্রান্ত।
একইভাবে চিন্তায় সুমিত। কোনটা পথ? রেশমির মন সে বোঝে। কিন্তু এই ভাবনাকে বাড়তে দেওয়া বাস্তব নয়। এখন কথা হল, সে এই পোস্টমাস্টার অবতারেই থেকে যাবে, নাকি পুরো অ্যাকশন স্কোয়াডে চলে যাবে? সমাজের বহু শাখায় তাদের কমরেডরা প্রতিষ্ঠিত। শহুরে মাওবাদী তকমা আছে অনেকের। সুমিতের দু’দিকই চলল বহুদিন, আর চলছে না। আজ না হলে কাল জানাজানি হবেই। রেশমির পেটে ক’দিন কথাটা চাপা থাকবে জানা নেই। তাছাড়া রাহুলের জেরায় বিষ্ণু আর সুনেত্রা কতক্ষণ মুখ বন্ধ রাখবে, তারও ঠিক নেই। যদি মুখ খুলে ফেলে, এখনই গ্রেপ্তার হবে সে। তবে একটা বড় ভরসা, সুমিত আর ব্রহ্মা যে একই লোক, কোর্টে প্রমাণ হওয়া মুশকিল। রেশমি তো আর সাক্ষী দেবে না। তবু, অপেক্ষা করাটা ঝুঁকির হয়ে যাবে। একবার গ্রেপ্তার মানে বহুদিনের হয়রানি, মামলা মোকদ্দমার চক্কর। সুমিত গভীর ভাবনায়।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
সুমিতের কি একবার রেশমিকে বলে যেতে ইচ্ছে করছে? আর দেখা হবে কি না, অনিশ্চিত। মেয়েটির যে তার প্রতি টান, সেটা সুমিত জানে, বোঝে। কিন্তু প্রশ্রয় দেয় না, দিতে পারে না। তাদের অভিযানে এই দুর্বলতা চলে না। তবু কমরেডদের জীবনে প্রেম আসে, অনেকে গ্রহণ করেন।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
অন্যদিকে রাহুলের ফোন সক্রিয়। তার কাছে পাক্কা খবর, তার সোর্স পরিষ্কার বলছে এক মুখঢাকা বন্দুকধারীকে সে ওই ঝুপড়িতে ঢুকতে দেখেছে। কিন্তু বেরিয়ে এসেছে দুই মহিলা আর পোস্টমাস্টার। সুমিতের গতিবিধি নিয়ে সন্দেহ ছিলই। এবার সেটা বাড়ল। রাহুল কড়া নির্দেশ দিয়ে রাখল সুমিতের ওপর নজর রাখার। সে ফেরা না পর্যন্ত সুমিত যেন এলাকা ছাড়তে না পারে। বিষ্ণু আর সুনেত্রার কাছ থেকেও ব্রহ্মার বিষয়টা কনফার্ম করে নিতে হবে।
সুমিত সিদ্ধান্ত নিল আপাতত জরুরি কারণ দেখিয়ে ছুটিতে যাবে। এখনই এলাকা ছাড়বে। পুলিশের গতিবিধি বুঝে তারপর আবার কাজে যোগ। এখন আত্মগোপন। ঝুঁকি নেওয়া যাবে না।
সুমিতের কি একবার রেশমিকে বলে যেতে ইচ্ছে করছে? আর দেখা হবে কি না, অনিশ্চিত। মেয়েটির যে তার প্রতি টান, সেটা সুমিত জানে, বোঝে। কিন্তু প্রশ্রয় দেয় না, দিতে পারে না। তাদের অভিযানে এই দুর্বলতা চলে না। তবু কমরেডদের জীবনে প্রেম আসে, অনেকে গ্রহণ করেন। রেশমি আরামের জীবন থেকে এসব জীবনে মানিয়ে নিতে পারবে না। এখন, তাকে সুমিত শুধু বলে যাবে, চললাম। পরে যোগাযোগ হবে।
পরদিন ভোররাত।
ট্রেন ধরবে সুমিত। মায়ের হঠাৎ অসুখ, তাই যেতে হচ্ছে।
রেশমিকে খবর পাঠিয়েছিল। চুপচাপ স্টেশনের দিকে যাচ্ছে রেশমিও।
জরুরি ফোনে খবর পেয়েছে রাহুল। সোর্স বলছে, পোস্টমাস্টার ভোরে স্টেশন যাবে। ট্রেন ধরবে।
রাহুল এবার কড়া। যথেষ্ট হয়েছে। ওকে আটকাতে হবে। কড়া নির্দেশ, আটক করো। পালাতে গেলে গুলি চালাও। রাহুলের নির্দেশ পেয়ে পুলিশ তড়িঘড়ি ছুটল স্টেশনের দিকে।
–এইভাবে চলে যাবেন? রেশমি বলল সুমিতকে।
দিনের আলো ফুটছে ফাঁকা স্টেশন। ট্রেন আসতে আর কিছুক্ষণ।
–যেতে হচ্ছে। ঝুঁকি নিতে পারছি না। ভালো থাকবেন। পরিস্থিতি হলে আবার যোগাযোগ হবে।
রেশমির চোখে জল।
সুমিত রসিকতা করে বলল, ‘আমি কিন্তু ভীতু, অপদার্থ টাইপ।’
রেশমি কৃত্রিম কড়া চোখে দৃষ্টিপাত করল, হালকা ঠোঁট বেঁকাল।
একটু থেমে বলল, ‘এখন কোথায় যাবেন জিজ্ঞাসা করব না। শুধু এইটুকু বলব, সাবধানে থাকবেন।’
–আমি আপনার খবর রাখব রেশমি। হয়তো এখন ফোনটোন করব না। কিন্তু কখনও কোনও এক এরকমই ভোরবেলা হয়তো বাড়ির দরজা খুলে দেখবেন আমি এসেছি। হয়তো আপনাকে সঙ্গে নিতে, না হলে পুরোপুরি বিদায় নিতে।
ট্রেনের ঘণ্টা পড়ল। দু’একজন করে মানুষ প্ল্যাটফর্মে। ওপাশটায় গাছগাছালি।
ভোরের আলোমাখা সুমিতের মুখের দিকে তাকিয়ে রেশমি বলল, ‘আমি অপেক্ষা করব।’
দূর থেকে ট্রেনের বাঁশি শোনা গেল। আসছে।
আচমকাই স্টেশন প্ল্যাটফর্মে পুলিশ। অফিসার জনাকতক কনেস্টবল-সহ এগিয়ে আসতে আসতে চিৎকার করে বললেন, ‘সুমিতবাবু, কোথাও যাওয়ার চেষ্টা করবেন না। আমাদের সঙ্গে আসুন।’
হতচকিত সুমিত, রেশমি।
সুমিত একবার বিস্মিত চোখে দেখল রেশমিকে। এই সকালে স্টেশনে আসা তো শুধু রেশমি জানত।
সুমিতের চোখে সন্দেহ আর অবিশ্বাসের ভাষা দেখে বিধ্বস্ত মুখে রেশমি বলল, ‘আমি কাউকে বলিনি। বিশ্বাস করুন।’
সুমিতের হাত ধরল রেশমি।
ট্রেনটা প্ল্যাটফর্মে ঢুকছে।
দ্রুত এগিয়ে আসছে পুলিশ।
সুমিত দেখে নিয়েছে ট্রেনের পজিশন। ট্রেনে উঠে পড়তে পারলে তাকে খুঁজতে সময় লাগবে পুলিশের। তার মধ্যে ট্রেন ছেড়ে দিলে ভালো। নইলে উল্টোদিক থেকে নেমে ওপাশের জঙ্গলে ঢুকে যাবে। ধরা দেওয়ার প্রশ্ন নেই। রেশমির হাত ছাড়িয়ে দৌড়ের প্রস্তুতি নিল সুমিত।
এবার বন্দুক তুলল পুলিশ, ‘দাঁড়ান সুমিতবাবু, নড়বেন না।’
ট্রেন ঢুকে গিয়েছে স্টেশন চত্বরে।
রেশমি মরিয়া হয়ে দু’হাত ছড়িয়ে সুমিতকে আড়াল করে চিৎকার করল, ‘গুলি চালাবেন না প্লিজ।’
ট্রেন প্ল্যাটফর্মে পুরো ঢুকে এসেছে। চালক দৃশ্য দেখে বিভ্রান্ত। ট্রেনের গতি কমে এলেও দাঁড় করাবেন কি না ভাবছেন, নাকি টেনে বেরিয়ে পরের স্টেশনে দাঁড়িয়ে এখানে কিছু ঘটছে বলে জানাবেন।
সুমিত আর সময় নষ্ট না করে কম গতির ট্রেনের দিকে ঘুরে দৌড়ল।
পরপর দুটো গুলির শব্দ।
চিৎকার করে পড়ে গেল রেশমি।
ছুটে গেল পুলিশ।
কম গতির ট্রেনে উঠেই পাল্টা গুলি চালাল সুমিত, রিভলবারের নিখুঁত লক্ষ্যভেদ। একজন কনস্টেবলের গুলি লাগল। পুলিশকে থমকে যেতে হল।
গুলি চলতেই ট্রেনচালক আরও উদ্বিগ্ন হয়ে ট্রেন না দাঁড় করিয়ে ফের গতি বাড়িয়ে দিলেন।
রাহুল খবরের অপেক্ষায় ফোন হাতে নিয়ে বসেছিল।
খবর এল, কুসুমডিহার পোস্টমাস্টারের ছদ্মমোড়কে থাকা কমরেড ব্রহ্মাকে প্রায় ধরে ফেলেছিল পুলিশ। তিনি গুলি চালাতে চালাতে ট্রেনে উঠে পালিয়ে গিয়েছেন। একজন পুলিশ জখম। চারপাশের স্টেশন আর এলাকায় খবর দেওয়া হয়েছে। ব্রহ্মার খোঁজে বাহিনী নামছে।
আর স্টেশনে ব্রহ্মাকে আড়াল করতে গিয়ে এক মহিলা পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছেন। মৃতদেহ শনাক্ত করে ময়নাতদন্তে পাঠানো হচ্ছে।
…পড়ুন কুসুমডিহার কাব্য-এর অন্যান্য পর্ব…
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২৯: এবার কি সময় আসছে সিস্টেমের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য যুদ্ধের?
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২৮: নিজেদের তৈরি ফাঁদে নিজেরাই আটকে সুনেত্রা ও বিষ্ণু
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২৭: কুসুমডিহার চারপাশে পুলিশি তৎপরতা শিথিল, এই সময়েই আক্রমণ করতে হবে
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২৬: যদি ওই মহিলা সত্যিই সুনেত্রা হয়, তাহলে অবশেষে তাকে দেখা গিয়েছে
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২৫: ছায়ার মৃত্যুর খবর গেল শঙ্করের কাছে
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২৪: মলিন চেহারার এই মহিলাকে ধরতে এত পুলিশ?
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২৩: শঙ্কর বারিকের স্ত্রী ছায়া মাহাতো ধরা পড়েছে পুলিশের হাতে
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২২: গুন্ডাবাহিনীর বিরুদ্ধে মাওবাদীরা, কুসুমডিহায় মনোবল বাড়ছে মানুষের
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২১: কুসুমডিহা এক বুক আশঙ্কা নিয়ে দিন কাটায়
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২০: মানুষকে একজোট করতে চায় রেশমি
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৯: দূত এবং দূতের দূত মারফত খবর গিয়েছে কুসুমডিহায়
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৮: টিলার ওপরের মহিলাদের নিয়ে পুলিশের কৌতূহল প্রবল
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৭: পল্টু জবার পিছনে খরচ বাড়িয়ে ইদানীং এদিক-ওদিক হাত পেতে ফেলছে
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৬: কমরেড ব্রহ্মা কতদিন পালিয়ে বেড়াবে?
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৫: প্রতিমাকে পাওয়া গেল কুসুমডিহায়, মিথ্যে ধর্ষণের মামলায় ফাঁসি হয়েছে তাঁর বরের
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৪: এখন খবরের শীর্ষে কুসুমডিহায় মাওবাদী হামলা আর কমরেড ব্রহ্মা
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৩: কমরেড ব্রহ্মা তাহলে যেখানেই থাকুন, কুসুমডিহার ওপর নজর রেখেছেন
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১২: থমথমে কুসুমডিহাতে টহল দিচ্ছে পুলিশ
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১১: ছদ্মপরিচয়ে কুসুমডিহাতে প্রবেশ পুলিশ ফোর্সের
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১০: শান্ত কুসুমডিহা এখন হিংস্র হয়ে ফুঁসছে
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৯: কুসুমডিহাতে পুলিশ, নেতা, বুদ্ধিজীবী, মহিলা কমিশন, মিডিয়ার ভিড়
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৮: জঙ্গলমহলের তল্লাট থেকে উত্তাপ ছড়াল কলকাতার মিডিয়াগুলির স্টুডিওতেও
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৭: কুসুমডিহাতেই দেখিয়ে দেব আমরা মরে যাইনি
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৬: পরিচয় যত বাড়ছে, সুমিত অনুভব করছে এলাকা গরম হচ্ছে
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৫: পশ্চিমগড়ের মৃতদেহর খবর এখনও কলকাতা সংস্করণে জায়গা পায়নি
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৪: সভা আর প্রচার মানেই বন্দুক ধরা নয়
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৩: ‘বন্দুক হাতে নেওয়া প্রত্যেকটা মেয়েকে সমর্থন করি’
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২: সিস্টেমের দোষেই কুসমডিহাতে ফের অমঙ্গলের পদধ্বনি, সুমিতকে বোঝাল রেশমি
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১: জঙ্গলমহলের কুসুমডিহার নতুন পোস্টমাস্টার সুমিত, জলে থেকে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করে পারবে!