আমার স্ত্রী ল্যুদ্মিলা মস্কোর স্থায়ী বাসিন্দা ছিল না। তার আদি নিবাস কুইবিশেভ (অধুনা সামারা), সেখানেই স্থায়ী বাসস্থানের ঠিকানায় তার রেজিস্ট্রেশন। আমার সঙ্গে পরিণয়সূত্রে মস্কোয় বসবাসের অনুমতি পায়। কিন্তু মস্কোয় বসবাসের জন্য তাকে কুইবিশেভের রেজিস্ট্রেশন খারিজ করে দিয়ে আসতে হয়। অথচ আমি বিদেশি হওয়ায় মস্কোয় আমার রেজিস্ট্রেশন যেহেতু অস্থায়ী, সেই কারণে তার রেজিস্ট্রেশনও অস্থায়ী হয়ে গেল– পরবর্তীকালে সেই সূত্রে সোভিয়েত নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও আমার কন্যাদ্বয়েরও। আর আমি যখন পাকাপাকিভাবে সোভিয়েত দেশ ছেড়ে চলে আসছি তখন থেকে আমার রেজিস্ট্রেশন বাতিল হয়ে যাওয়ায় তাদেরও রেজিস্ট্রেশন বাতিল হয়ে যায়, তারা বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়ে।
৩১.
সোভিয়েত সমাজ-ব্যবস্থা ও সংবিধানের মাহাত্ম্য
ব্রেজনভের আমলের শেষদিকে, ১৯৮৪ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের যে নতুন সংবিধান গৃহীত হয়, তাতে সে দেশে বসবাসকারী বিদেশিদের জন্য অনেক সুযোগ-সুবিধার স্বীকৃতি ছিল; কিন্তু সেটাও নেহাতই নীতিগতভাবে– অনেকটা মস্কোর হোটেল-রেস্তোরাঁর মেনুকার্ডের মতো– সবই আছে, কিন্তু অর্ডার দিতে গেলে দেখা যাবে ওর মধ্যে থেকে যেটা যেটা চাই, তার কোনওটাই নেই। এমনিতেও সোভিয়েত সংবিধানের মতো মানবিক সংবিধান আর দু’টি হয় না, কিন্তু তার মধ্যে এত ‘যদি’ আর ‘কিন্তু’ আছে যে, সেগুলির নাগপাশ কাটিয়ে কিছু উদ্ধার করা দুষ্কর। পরন্তু এদেশে বসবাসকারী বিদেশিদের যে বিশেষ পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছিল, নতুন সংবিধান প্রকাশিত হওয়ার পর পরই তা তুলে নিয়ে পাসপোর্টে শুধু প্রয়োজনে মেয়াদ বৃদ্ধির উপযোগী সাময়িক রেজিস্ট্রেশন নম্বর সিল মেরে দিতে লাগল, যার ফলে আমরা বিদেশিরা আর আইনত সে দেশে বসবাসকারী বিদেশি নাগরিকরূপে গণ্য না হয়ে পরিযায়ী হয়ে গেলাম।
তবে ‘স্থায়ী বসবাসকারী’ বিদেশির শংসাপত্র দেওয়ার একটি সংস্থান সংবিধানে থাকল, সেই ধারাটি আজও, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পরে নতুন রাশিয়ার সংবিধানেও আছে– সেক্ষেত্রে বিদেশিকে তার নিজের দেশের পাসপোর্ট খারিজ করতে হয়। অথচ, সে যে স্বাভাবিকভাবেই নতুন দেশের নাগরিক হয়ে গেল, এমন কিন্তু নয়। তাকে ত্রিশঙ্কু অবস্থাতেও থাকতে হতে পারে।
সোভিয়েত সংবিধানের ‘যদি’, ‘কিন্তু’-র ফেরে পড়ে আমার স্ত্রী সোভিয়েত নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও বিদেশির সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হওযার ফলে স্থায়ী বাসস্থানের মৌলিক অধিকার পর্যন্ত হারিয়ে ফেলে। শত চেষ্টাতেও সে অধিকার পুনরুদ্ধার করা সম্ভব না হতে তাকে আরও দুই সহ নাগরিক, আমাদের দুই নাবালিকা কন্যাকে নিয়ে, সোভিয়েত নাগরিকত্ব বজায় রেখেই দেশত্যাগ করতে হয়। তারা নিজভূমে পরবাসী হয়ে গিয়েছিল। সোভিয়েত সংবিধানের সে এক গোলকধাঁধা, আরেক ইতিহাস।
আমার স্ত্রী ল্যুদ্মিলা মস্কোর স্থায়ী বাসিন্দা ছিল না। তার আদি নিবাস কুইবিশেভ (অধুনা সামারা), সেখানেই স্থায়ী বাসস্থানের ঠিকানায় তার রেজিস্ট্রেশন। আমার সঙ্গে পরিণয়সূত্রে মস্কোয় বসবাসের অনুমতি পায়। কিন্তু মস্কোয় বসবাসের জন্য তাকে কুইবিশেভের রেজিস্ট্রেশন খারিজ করে দিয়ে আসতে হয়। অথচ আমি বিদেশি হওয়ায় মস্কোয় আমার রেজিস্ট্রেশন যেহেতু অস্থায়ী, সেই কারণে তার রেজিস্ট্রেশনও অস্থায়ী হয়ে গেল– পরবর্তীকালে সেই সূত্রে সোভিয়েত নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও আমার কন্যাদ্বয়েরও। আর আমি যখন পাকাপাকিভাবে সোভিয়েত দেশ ছেড়ে চলে আসছি তখন থেকে আমার রেজিস্ট্রেশন বাতিল হয়ে যাওয়ায় তাদেরও রেজিস্ট্রেশন বাতিল হয়ে যায়, তারা বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়ে। পেরেস্ত্রৈকা-পরবর্তী নতুন রাশিয়ার ডামাডোলের মধ্যে কোথায় কীভাবে এই সমস্যার সমাধান হতে পারে তার কোনও দিশা পাওয়া যায়নি। রেজিস্ট্রেশন না থাকলে বাসস্থান তো দূরের কথা, আমার স্ত্রীর পক্ষে তাঁর প্রাপ্য পেনশনও তো পাওয়া সম্ভব নয়।
রাষ্ট্রযন্ত্রের হাতে পড়ে ব্যক্তিমানুষের অনস্তিত্বে পরিণত হওয়ার এক কাহিনি অবশ্য আমরা বিগত শতাব্দীর তিনের দশকের পটভূমিকায় রুশ কথাশিল্পী মিখাইল বুলগাকভের লেখা ‘মাস্টার ও মার্গারিতা’ উপন্যাসের নায়ক মাস্টারের মুখে শুনেছি: ‘… প্রমাণপত্রে যখন নেই তখন মানুষটিও নেই। ঠিক এই কারণেই আমিও নেই, আমার কোনও প্রমাণপত্র নেই।’
অগত্যা দেশত্যাগ। এখনও ল্যুদমিলা রাশায়ার নাগরিক। নিজের দেশে যেতে পারে, কিন্তু নিজের প্রাপ্য পেনশনই তো পাবে না! আজকের রাশিয়ায়, গণতান্ত্রিক রাশিয়াতেও সেই একই ব্যবস্থা বজায় আছে। সেই ট্রাডিশন সমানে চলেছে। হ্যাঁ, তাই তো, রাশিয়ায় আজও, এমনকী সোভিয়েত আমলেও সর্বজনমান্য জার মহামতি পিয়োতরই তো এই ব্যবস্থার গোড়াপত্তন করেছিলেন!
এরপরও বলবেন, তাহলে সোভিয়েতে ভালোটা কী ছিল? কেন? সাধারণ মানুষ তো রাষ্ট্রের কাছ থেকে তার প্রাথমিক প্রয়োজনীয় সবই পেয়ে যাচ্ছিল; মাথার ওপর ছাদ ছিল, ছিল অবৈতনিক শিক্ষাব্যবস্থা, স্বাস্থ্য পরিষেবা, নিশ্চিত কর্মসংস্থান, পেনশন, ছিল না মুদ্রাস্ফীতি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ে উৎকণ্ঠা– এরপর আর কী চাই? রাষ্ট্রের কাছ থেকে এতসব সুরক্ষা পেতে গেলে কিছু স্বাধীনতা তো মানুষকে স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিতেই হয়।
না কি বলবেন, ‘not by bread alone’? কিন্তু তা-ই বা বলি কী করে? মনের খোরাকের কি অভাব ছিল? শিল্প, সংস্কৃতি, জ্ঞানবিজ্ঞান– কোথাও কি অগ্রগতি ব্যাহত হয়েছিল? তাহলে কি আমি নিজেই নিজের বিরোধিতা করছি? স্বাধীনতা কাকে বলে? নাকি প্রশ্ন স্বাধীনতা তুমি কার?
…পড়ুন রুশকথা-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৩০। শান্তিদা কান্ত রায়ের প্রিয় কাজ ছিল মস্কোয় ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের কমিউনিজম পড়ানো
পর্ব ২৯। পেরেস্ত্রৈকার শুরু থেকেই নিরাপত্তার অভাব বোধ করছিলেন গোপেনদা
পর্ব ২৮। দেশে ফেরার সময় সুরার ছবি সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি পাননি গোপেনদা
পর্ব ২৭। বিপ্লবের ভাঙা হাট ও একজন ভগ্নহৃদয় বিপ্লবী
পর্ব ২৬। ননী ভৌমিকের মস্কোর জীবনযাত্রা যেন দস্তইয়েভস্কির কোনও উপন্যাস
পর্ব ২৫। ননীদা বলেছিলেন, ডাল চচ্চড়ি না খেলে ‘ধুলোমাটি’র মতো উপন্যাস লেখা যায় না
পর্ব ২৪। মস্কোয় শেষের বছর দশেক ননীদা ছিলেন একেবারে নিঃসঙ্গ
পর্ব ২৩। শেষমেশ মস্কো রওনা দিলাম একটি মাত্র সুটকেস সম্বল করে
পর্ব ২২। ‘প্রগতি’-তে বইপুথি নির্বাচনের ব্যাপারে আমার সঙ্গে প্রায়ই খিটিমিটি বেধে যেত
পর্ব ২১। সোভিয়েতে অনুবাদকরা যে পরিমাণ অর্থ উপার্জন করত, সে দেশের কম মানুষই তা পারত
পর্ব ২০। প্রগতি-র বাংলা বিভাগে নিয়োগের ক্ষেত্রে ননীদাই শেষ কথা ছিলেন
পর্ব ১৯। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় নাকি খুব ভালো রুশভাষা জানতেন, প্রমথনাথ বিশী সাক্ষী
পর্ব ১৮। লেডি রাণু মুখার্জিকে বাড়ি গিয়ে রুশ ভাষা শেখানোর দায়িত্ব পড়েছিল আমার ওপর
পর্ব ১৭। একদিন হঠাৎ সুভাষদা আমাদের বাড়ি এসে উপস্থিত ফয়েজ আহমেদ ফয়েজকে নিয়ে
পর্ব ১৬। মুখের সেই পরিচিত হাসিটা না থাকলে কীসের সুভাষ মুখোপাধ্যায়!
পর্ব ১৫। রুশ ভাষা থেকেই সকলে অনুবাদ করতেন, এটা মিথ
পর্ব ১৪। মস্কোয় ননীদাকে দেখে মনে হয়েছিল কোনও বিদেশি, ভারতীয় নয়
পর্ব ১৩। যিনি কিংবদন্তি লেখক হতে পারতেন, তিনি হয়ে গেলেন কিংবদন্তি অনুবাদক
পর্ব ১২। ‘প্রগতি’ ও ‘রাদুগা’র অধঃপতনের বীজ কি গঠনপ্রকৃতির মধ্যেই নিহিত ছিল?
পর্ব ১১। সমর সেনকে দিয়ে কি রুশ কাব্যসংকলন অনুবাদ করানো যেত না?
পর্ব ১০। সমর সেনের মহুয়ার দেশ থেকে সোভিয়েত দেশে যাত্রা
পর্ব ৯। মস্কোয় অনুবাদচর্চার যখন রমরমা, ঠিক তখনই ঘটে গেল আকস্মিক অঘটন
পর্ব ৮: একজন কথা রেখেছিলেন, কিন্তু অনেকেই রাখেননি
পর্ব ৭: লেনিনকে তাঁর নিজের দেশের অনেকে ‘জার্মান চর’ বলেও অভিহিত করত
পর্ব ৬: যে-পতাকা বিজয়গর্বে রাইখস্টাগের মাথায় উড়েছিল, তা আজ ক্রেমলিনের মাথা থেকে নামানো হবে
পর্ব ৫: কোনটা বিপ্লব, কোনটা অভ্যুত্থান– দেশের মানুষ আজও তা স্থির করতে পারছে না
পর্ব ৪: আমার সাদা-কালোর স্বপ্নের মধ্যে ছিল সোভিয়েত দেশ
পর্ব ৩: ক্রেমলিনে যে বছর লেনিনের মূর্তি স্থাপিত হয়, সে বছরই ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার সূচনাকাল
পর্ব ২: যে দেশে সূর্য অস্ত যায় না– আজও যায় না
পর্ব ১: এক প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে রাশিয়ার খণ্ডচিত্র ও অতীতে উঁকিঝুঁকি