এই ছবির সংগীত দিয়েছেন বিশ শতকের সিনেমার শেষ কিংবদন্তিদের একজন, এনিও মরিকোনে, আমার কাছে যাঁর অবস্থান হিচকক, জন ফোর্ড, বার্গম্যান, তারকভস্কিদের কাছাকাছি। আমি যে দৃশ্যটি নিয়ে কথা বলছি, তা আদতে সংগীতের ওপর নির্ভরশীল, অর্থাৎ এখানে সংগীত সংযোজিত কোনও অলংকার নয়, সংগীত এই দৃশ্যটির কাঠামো তৈরি করে দেয়– ক্যামেরার চলন, শটের স্কেল– সবকিছুই যে সংগীতের ওপর নির্ভরশীল শুধু তাই-ই নয়– সবকিছুই সংগীতকে অবলম্বন করে হয়ে ওঠে ছবির নিরিখে এক্সপ্রেসিভ এবং অর্থবহ। শোনা যায় সের্জিও শুটিংয়ের সময়ে এনিও মরিকোনের সংগীত চালিয়ে রাখতেন আক্ষরিক অর্থেই আবহ তৈরি করার জন্যে।
৪.
আমার এবং অজস্র চলচ্চিত্রপ্রেমীর হৃদয়ের কাছাকাছি থাকা একটি ছবির দৃশ্য, সের্জিও লিওনের ‘ওয়ান্স আপন আ টাইম ইন দ্য ওয়েস্ট’। এই দৃশ্যটি আগে দেখুন, তারপর বাকিটা পড়ুন।
আমি এই বিশেষ দৃশ্য বেছে নিচ্ছি আজকের কিস্তির জন্য, কারণ তার ফলে চলচ্চিত্রের এমন এক গুরুদেবকে প্রণাম জানানো যাবে, যার ক্ষেত্রটি অনেক সময়েই ফিল্মের আলোচনায় আসে না।
আমি সংগীতের কথা বলছি। এই ছবির সংগীত দিয়েছেন বিশ শতকের সিনেমার শেষ কিংবদন্তিদের একজন, এনিও মরিকোনে, আমার কাছে যাঁর অবস্থান হিচকক, জন ফোর্ড, বার্গম্যান, তারকভস্কিদের কাছাকাছি। আমি যে দৃশ্যটি নিয়ে কথা বলছি, তা আদতে সংগীতের ওপর নির্ভরশীল, অর্থাৎ এখানে সংগীত সংযোজিত কোনও অলংকার নয়, সংগীত এই দৃশ্যটির কাঠামো তৈরি করে দেয়– ক্যামেরার চলন, শটের স্কেল– সবকিছুই যে সংগীতের ওপর নির্ভরশীল শুধু তাই-ই নয়– সবকিছুই সংগীতকে অবলম্বন করে হয়ে ওঠে ছবির নিরিখে এক্সপ্রেসিভ এবং অর্থবহ। শোনা যায় সের্জিও শুটিংয়ের সময়ে এনিও মরিকোনের সংগীত চালিয়ে রাখতেন আক্ষরিক অর্থেই আবহ তৈরি করার জন্যে।
দৃশ্যটি ছবির তৃতীয় সিকোয়েন্সের অন্তর্গত। এর আগের দৃশ্যেই আমরা একটি ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড দেখেছি, একটি পরিবারের প্রতিটি সদস্য যেখানে ভাড়াটে খুনিদের গুলিতে প্রাণ হারায়। পরিবারটি আমেরিকার পশ্চিম প্রান্তে একটি জনমানবশূন্য কোনায় বাসা বেঁধেছিল। ছবি যত এগোয়, বোঝা যায় যে এই পরিবারের পাগলাটে কর্তা আসলে দূরদর্শী ছিল, কারণ তার বাড়ির চৌহদ্দিতেই এই রুক্ষ অঞ্চলের একমাত্র জলের উৎস, সেখানে একটি কুয়ো খুঁড়েছে সে। অতএব অদূর ভবিষ্যতে যখন রেললাইন এই অঞ্চলের ওপর দিয়ে যাবে, তখন এখানেই স্টেশন হওয়ার সম্ভাবনা, জমির দাম বাড়বে, সে এখনকার দারিদ্র কাটিয়ে হয়ে উঠবে সুইটওয়াটার টাউনের প্রতিষ্ঠাতা পুরুষ। বস্তুত সেই জন্যেই রেলমালিকদের ভাড়াটে গুণ্ডারা পরিবারটিকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিল, যাতে জমি পেয়ে যাওয়া যায় বিনামূল্যে।
আবার এই দিনেই এই পরিবারের এক নতুন সদস্যর আগমন হওয়ার কথা ছিল, পরিবারের বিপত্নীক কর্তাটি কয়েক মাস আগে শহরে যায়, সেখানে প্রেমে পড়ে এক যৌনকর্মীর। তারা বিবাহ করবে স্থির করে। আজই সেই মহিলার– যার নাম জিল– নিকটবর্তী একটি রেলস্টেশনে পৌঁছনোর কথা, মাতৃহীন পরিবারের নতুন মাতার আগমনের দিন ছিল আজ। সে এলও, কিন্তু অবাক হয়ে দেখল যে তাকে নিতে কেউ আসেনি, আমাদের দৃশ্যটি এই মুহূর্তেরই। স্থান একটি সদ্য গজিয়ে ওঠা রেলস্টেশন, যার পাশে গড়ে উঠছে আমেরিকার পশ্চিম প্রান্তের একটি নতুন টাউন। ছবিটি ওয়েস্টার্ন জঁরের, ১৯৬৮ সালে নির্মিত।
চিত্রনাট্যে কী ছিল জানি না। এরকম কিছু থাকার কথা–
ট্রেন আসার পর ব্যস্ততা কাটে। একে একে মানুষ চলে গেলে স্টেশন প্রায় জনমানবশূন্য হয়ে যায় প্রায়। কিন্তু এখনও জিলকে নিতে ম্যাকবেইন পরিবারের কেউ আসেনি। জিল চিন্তিত হয়ে পড়ল। তাহলে কি শহরের জীবন ছেড়ে দিয়ে এসে সে এক ঠগের পাল্লায় পড়ল? সে তো ভেবেছিল জীবন নতুন করে শুরু হবে, তারও পরিবার হবে। তবে কি এই জনমানবশূন্য প্রান্তরে এসে দেখতে হবে যে সেই প্রতিশ্রুতি, স্বপ্ন সব মিথ্যে? জিল নিজের ঘড়ির দিকে তাকাল, স্টেশনের ঘড়িও বলছে যে সময় এগিয়ে চলেছে, যাদের বা যার আসার কথা ছিল– আসেনি।
……………………………………….
স্টেশনের বাইরে তখন একটি ক্ষুদ্র শহর গড়ে তোলার প্রস্তুতি, কাজের ঘনঘটা। বাড়ি-ঘর-দোকান তৈরি হচ্ছে, কত মানুষ আমেরিকার পুবদিক থেকে, হয়তো ইউরোপ থেকে এসেছে জীবন আবার নতুন করে শুরু করবে বলে, এমন জায়গায় শুরু করবে যেখানে উচ্চ-নীচ ভেদাভেদ এখনও তেমন পোক্ত নয়, যেখানে অনন্ত প্রকৃতির মাঝে, উদার আকাশের নিচে, সভ্যতার ইতিহাসের অনুপস্থিতিতে সবার সুযোগ সত্যিই সমান।
……………………………………….
একসময়ে জিল ঠিক করল যে পিছিয়ে যাওয়ার উপায় নেই, ফের শহরের সেই পঙ্কিল জীবনে ফিরে যাওয়ার মানে হয় না, যদিও বা সামনে এগিয়ে লাভ নেই, তাও সুইটওয়াটারে ম্যাকবেইন পরিবারের হদিশের দিকেই এগোতে হবে। সে স্টেশনমাস্টারের ঘরে গিয়ে খোঁজ নিল সুইটওয়াটারে যাওয়ার যান-বাহন পাওয়া যাবে নাকি। স্টেশনমাস্টার বলল নিশ্চয়ই ঘোড়ার গাড়ি পাওয়া যাবে, কিন্তু একজন একা মহিলার এরকম দূরত্ব একা পার করা উচিত হবে কি? জিলকে নিরস্ত করা গেল না। সে স্টেশনমাস্টারের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল ধন্যবাদ দিয়ে।
স্টেশনের বাইরে তখন একটি ক্ষুদ্র শহর গড়ে তোলার প্রস্তুতি, কাজের ঘনঘটা। বাড়ি-ঘর-দোকান তৈরি হচ্ছে, কত মানুষ আমেরিকার পুবদিক থেকে, হয়তো ইউরোপ থেকে এসেছে জীবন আবার নতুন করে শুরু করবে বলে, এমন জায়গায় শুরু করবে যেখানে উচ্চ-নীচ ভেদাভেদ এখনও তেমন পোক্ত নয়, যেখানে অনন্ত প্রকৃতির মাঝে, উদার আকাশের নিচে, সভ্যতার ইতিহাসের অনুপস্থিতিতে সবার সুযোগ সত্যিই সমান। সেই সদ্য জন্মানো সভ্যতার মধ্যে একটি ঘোড়ার গাড়ির সন্ধানে চলেছে আরেকজন শহর ছেড়ে আসা মানুষ, নতুন জীবনের সন্ধানে। তফাত এইটুকুই, এরকম মানুষ যারা আসে, তাদের প্রায় প্রত্যেকেই পুরুষ। নারীরা যখন আসে কারও স্ত্রী-কন্যা-মাতা-ভগিনী হিসেবেই আসে; জিলেরও সেভাবেই এসে পৌঁছনোর কথা ছিল, কিন্তু কপালফেরে সে এখন সেই বিরল নারী, এই ওয়েস্টে যে একা, অতীত ছেড়ে ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে এসেছে অবলম্বনহীন।
আমার মতো অতিরিক্ত বাড়াবাড়িভাবে লিখলে বড়জোর এরকমই হত চিত্রনাট্যটি। এইবার দেখা যাক সের্জিও লিওনের ক্রাফট এবং এনিও মরিকোনের সংগীত কীভাবে এই দৃশ্য, এই অর্থ উপস্থাপন করছেন।
ঠিক ২ মিনিট ২৭ সেকেন্ডের মাথায় একটি ঘড়ির শট আছে। ঘড়ি, তারপর জিলের ভূমিকায় ক্লদিয়া কার্দিনালের চিন্তান্বিত মুখ, সে নিজের হাতঘড়ির সঙ্গে মেলাল সময়, তার ঘড়ির শট। কাট টু লং শট– ফাঁকা স্টেশনে জিল একা, এবং কী অদ্ভুত দ্যোতনাময়, পাশে দু’টি কৃষ্ণাঙ্গ ছেলে– একজন নারী, দু’জন কৃষ্ণাঙ্গ, ওয়েস্টের শ্বেতাঙ্গ-পুরুষপ্রধান পৃথিবীতে যারা নেহাতই পার্শ্বচরিত্র। চারিদিকে ট্রেন থেকে নামানো মালপত্রের ভিড়, পরে লোকে এসে নিয়ে যাবে নিশ্চয়ই, এখন তাড়া নেই, তাই কেউ নেই।
সেই ২ মিনিট ২৭ সেকেন্ড থেকে ৩ মিনিট ১১ সেকেন্ডে অবধি একটি মেলোডি লাইন বাজতে থাকে। আমার বাদ্যযন্ত্র আন্দাজ করার ক্ষমতা খুবই সামান্য, কিন্তু একটি যন্ত্রে একটি মন উদাস করা মেলোডি লাইন, সেই যন্ত্রের একাকিত্ব যেন জিলের একাকিত্বের বিষাদ বহন করছে।
৩ মিনিট ১১ সেকেন্ড নাগাদ জিল হাঁটতে আরম্ভ করে স্টেশনমাস্টারের ঘরের দিকে। লক্ষ করবেন, এইবার আমরা যতদূর যাব কোনও কাট নেই, একটি শট চলতে থাকবে।
একটি ক্রেন শট– ক্যামেরা পিছতে থাকে, জিল এগিয়ে আসে। জিল স্টেশনমাস্টারের ঘরে প্রবেশ করে, ক্যামেরা করে না। ক্যামেরা প্যান করে একটি জানালার কাছে থামে, বাইরে থেকে দেখে দৃশ্যটি। আমি আমার কল্পিত চিত্রনাট্যে যে কথোপকথনের আন্দাজ দিয়েছিলাম, তা আর শোনানোর প্রয়োজন নেই, না-শুনতে পেলেও বুঝতে পারছি যে সেই কথোপকথনই হচ্ছে। ঘরের এক কোনায় ওয়েস্টার্ন ছবির একটি জরুরি প্রপ রাখা, টেলিগ্রাফ মেশিন, তাতে কর্মরত কোনও রেলকরণিক। জিল স্টেশনের দরজা খুলে বেরিয়ে যায় কথা শেষ করে। আমাদের ক্লিপের ৩ মিনিট ৫০ সেকেন্ড নাগাদ।
আর আমরা কী শুনছি? সেই একাকী যন্ত্রের মেলোডি লাইনের পরে এল কণ্ঠ। এবার যাকে বলে সংগীত জেন্ডারড হল– একজন মহিলার অপেরাধর্মী কণ্ঠ, যে ধরনের কণ্ঠ তারসপ্তকে উর্দ্ধে উঠতে পারে। এই লিঙ্গচিহ্ন প্রয়োজনীয় ছিল, কারণ অন্য ওয়েস্টার্ন জঁরের ছবিতে একজন পুরুষ এভাবে এসে পড়ে টাউনে, এই ছবির গল্প অন্য পার্সপেক্টিভ থেকে শুরু হয়। এই গল্পের নায়ক একজন নারী, যাকে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ বলে পতিতা। সেই নারীর কণ্ঠকে প্রেক্ষিত দিচ্ছে হালকা, অনুচ্চ অর্কেস্ট্রাল কর্ড– একাকী নারী এবং ইতিহাসের প্রেক্ষিতের জমি তৈরি হচ্ছে।
এই অংশটি শেষ হয় ৩ মিনিট ৫০ সেকেন্ডের মাথায়, ঠিক যখন দরজা খুলে বেরিয়ে যায় জিল আর ক্যামেরা এই অবস্থান ছেড়ে উঠতে থাকে।
এবার ঠিক আট সেকেন্ডের একটি উইন্ড ইনসট্রুমেন্টের আগের মেলোডি লাইন ভেঙে দেয়। ট্রাম্পেট জাতীয় উইন্ড ইন্সট্রুমেন্ট, যা অনেক সময়ে ব্যবহৃত হয় আগমনকে স্বাগত জানানোর জন্য। ক্যামেরা উঠছে, দৃশ্যে প্রায় কিছুই নেই, স্টেশনের টালির ছাদ। এবং এই স্বাগতবাদ্য জিলের আগমনকে দিচ্ছে এপিক মাত্রা, যে তার গল্প একটি সভ্যতার অ্যালিগরিসম গল্প হয়ে উঠবে।
এই উইন্ড ইন্সট্রুমেন্টে বাজানো লাইনটি শেষ যেই হয়, সেই এপিক প্রান্তর প্রান্তর জুড়ে বেজে ওঠে অর্কেস্ট্রায়, ফুলে ফেপে ওঠে, যার উর্দ্ধমুখী চলনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ক্যামেরার উত্থান। দৃশ্যও খুলে যায়, টালির ছাদ যেন পর্দা, সেই পর্দা সরে গেলে আমরা বিশাল স্কেলে দেখি ইতিহাসের পরিসর। ক্যামেরা সামনে তখন খোলা প্রান্তর, একটি গড়ে ওঠা টাউন, যেখান দিয়ে এক্সট্রিম লং শটে হেঁটে চলেছেন জিল। তাই সেই এপিক অর্কেস্ট্রাল উদ্ভাসের শেষে আবার আসে সেই ইতিহাসের প্রান্তরে এসে পড়া একাকী নারীর কণ্ঠে ফলসেটোয় শেষ কিছু নোট।
৪ মিনিট ১৩ সেকেন্ড নাগাদ শুরুর মেলোডি লাইন আবার বেজে উঠবে। ৩ মিনিট ১০ সেকেন্ড নাগাদ যে শটটি শুরু হয়েছিল তা শেষ হয় এবার। একটি কাটের পর শুরুর মেলোডি লাইন ফের শুরু হয়, এবার সাউন্ডট্র্যাক ছাপিয়ে আসে নবজন্মা ব্যস্ত শহরের আওয়াজ। জিল তার গাড়ি পেয়ে গেছে, এইবার কিছু সংলাপে মৃত এড ম্যাকবেইনের পান্ডববর্জিত অঞ্চলে বসত গড়ার কথা আমরা শুনব। জিল ওয়েস্টে এসে গেছে।
মজার কথা হল, ‘ওয়ান্স আপন আ টাইম ইন দ্য ওয়েস্ট’– যা কিনা আমেরিকার ইতিহাস এবং পুঁজিবাদের ওপর অন্যতম কড়া রাজনৈতিক মন্তব্য, আবার আমেরিকান ছবির প্রতি নিবেদিত প্রেমপত্রও– আমেরিকান নয়, ইতালিয়ান প্রযোজনা।
…পড়ুন এই কলামের অন্যান্য পর্ব…
৩. জঁরের ফর্দ– দৃশ্য, শব্দ, প্রেক্ষাপট
২. ট্যাক্সি ড্রাইভার এবং তার পূর্বসূরি দুই নায়ক ও একটি ছদ্মবেশী জঁর
১. ভাঙনের শহরে এক নামহীন আগন্তুক এবং চারখানি গল্পের গোত্র
যখন আমরা, তথা সকল ব্যতিক্রমী লিঙ্গ-যৌনমানস ঠিক করব কোন ধরনের স্বাধীন সিদ্ধান্ত আমরা নেব, কিংবা জড়বৎ বাঁচা থেকে নিজেদের বের করে নিয়ে এসে, অপরের সিদ্ধান্তকে নিজের বলে প্রচার করা বন্ধ করব, তখন-ই আমাদের এই জড়বৎ অস্তিত্ব, অপরের শর্তে তৈরি করা জগৎ থেকে মুক্ত পাব।