এক শালিখ। দেখলেই মুখ ফিরিয়ে নেওয়া। দেখলেই ‘গেল গেল’ রব। দিন খারাপ যাবে! একরত্তি পাখি, তার নাকি ব্যাপক দুর্ভাগ্যবল। আসলে এসবই তো প্রবাদের ফিকির, সংস্কারের শঙ্কা ও দুলুনি! তবু কেউ কেউ ভালোবাসে এমন, যে এক শালিখও রেখে দিয়েছিল বাড়িতে। তারপর কী হল, সেই শালিখ-বৃত্তান্ত আজকের অপয়ার ছন্দে।
৫.
যার হাতখানি পুড়ে গেল বঁধূ আঁচলে তাহারে ঢাকো, আজও ডানা ভাঙা একটি শালিখ হৃদয়ের দাবি রাখো
সঞ্জীব চৌধুরির এই গানটা প্রথম শুনেছিলাম কলেজে উঠে। তার আগে অবধি জানতাম ONE FOR SORROW, TWO FOR JOY, সুতরাং, নজরে এক শালিখ পড়লেই নিশ্চুপে সরিয়ে নিতে হবে চোখ। মাথার মধ্যে ইমেজটা ছাপ ফেলার আগেই তুমি তাকে অস্বীকার করো নয়তো SORROW। কবিতাটা ইংরেজি বলে কি না জানি না, এক শালিখ যে ‘অপয়া’ বা নিদেনপক্ষে এক শালিখ দেখলে খুশি হওয়ার মতো কিছু নেই– এ ব্যাপারটা আমি নাস্তিকদের মধ্যেও লক্ষ করেছি। নিজের মধ্যেও। দিদিদের মধ্যে। দাদাদের মধ্যে। বড়মার মধ্যে, ছোটদাদু, পুপলু মাসি, ন’ মামা, সেজ জেঠু, প্রতিবেশী, সহযাত্রী প্রায় প্রত্যেকের মধ্যেই। যাদের মধ্যে অনেকেই ইংরেজি মাধ্যমে পড়েনি। সরকারি বাংলা মিডিয়াম, তাও ONE FOR SORROW কবিতার সারমর্ম কিন্তু জেনে গিয়েছিল।
সাউথ সিটি হওয়ার আগে ওখানে উষা কোম্পানির জায়গা ছিল। আমরা বলতাম, ‘উষার মাঠ’। তখনও জানতাম না কারখানার অনেকেই অনেকের অলক্ষ্যেই মাঠে মারা যাবে। শূন্য দশকে কারখানা ‘লকআউট’ শব্দটা একেবারে আউট-ডেটেড হয়নি। স্তালিনের বাবারও চাকরি গেল। স্তালিন বসু আমার বন্ধু ছিল পাড়ার, মূলত খেলার মাঠের। নামটা খুব বাড়াবাড়ি। ওর দাদু রেখেছিলেন। ভদ্রলোক ছিলেন বামপন্থী পার্টির একনিষ্ঠ কর্মী। তাই চোখ বুজে বিশ্বাস করতেন উষা কারখানার কর্মীরা চাকরি পাবেই সাউথ সিটিতে। ওঁর ছেলেও। স্তালিনের বাবা সে অপেক্ষা না করে একটা বিজনেস শুরু করল। পাখির বিজনেস। ওদের ছাদের ঘরে খাঁচার র্যাকে কত নাম না জানা পাখি দেখেছি। স্তালিনের বাবা ওগুলো ঠিকঠাক দামে বিক্রি করতে পারলে স্তালিনের স্কুলের মাইনে, টিফিন, নতুন মোজা– এসব হবে।
বাবার সঙ্গে থেকে থেকে স্তালিনও পাখিদের সামলাতে শিখে ফেলল। ও বলত, ও নাকি বুঝতে পারে কখন কোন পাখির খিদে পেয়েছে, কার শরীর খারাপ করছে। চিকিৎসা না হোক ওকে ওষুধ-টষুদ খাইয়ে দিতে কত দেখেছি। একদিন ওদের বাড়ি গিয়ে দেখলাম হুলস্থুল অবস্থা! ছাদের কার্নিশ থেকে স্তালিন একটা ডানা-ভাঙা শালিখ পাখি উদ্ধার করেছে, এখন তার শেল্টার চাই। স্তালিনের মা রেগে কাঁই! মায়ের বক্তব্য: ‘এক শালিখ অপয়ার ডিপো, এমনিতেই সময় খারাপ চলছে এখন নতুন করে আর বিপদ ডেকে এনো না’, স্তালিনের বাবারও যা অবস্থা মাকে অগ্রাহ্য করার সাহস পাচ্ছে না। শেল্টারের দাবিতে স্তালিন তাই বামপন্থী দাদুর কাছে গেল। যিনি নাতির নাম রাখেন ‘স্তালিন’ তিনি এই কুসংস্কারের বিহিত করবেন না? তা হয় কখনও? দাদু সবটা শুনে মিটিমিটি হেসে বলল, ‘তোমার ঠাকুমা যখন সত্যনারায়ণ পুজোর সিন্নি দেয় আমায় না করতে দেখেছ কখনও, সব মানুষকে একসঙ্গে নিয়ে চলতে হলে আমাদের অনেক সময় অনেক কিছুই মানিয়ে নিতে হয়।’ স্তালিন কিন্তু প্রশ্নটা স্ট্রেট ফরওয়ার্ড করেছিল। এই ডানা-ভাঙা শালিখ পাখিটার পাশে দাঁড়ানো উচিত কি উচিত নয়? দাদু বলেছিলেন, আগে মিলাবে মানবজাত তারপর পশুপাখির কথা ভাবা যাবে। উনি কনক্লুড করেছিলেন চিরন্তন প্রশ্ন দিয়ে: ‘রাস্তায় যে ভিখারিরা থাকে তাদেরও কি তুমি শেল্টার দিতে পারবে দাদুভাই?’ দাদুভাইয়েরও নাম স্তালিন, ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়, পাখির ঘরের কোনায় একটা বাতিল ড্রামের ভিতর শেল্টার দিল বুলবুলকে। ডানা ভাঙা শালিখটার নাম কেন যে ‘বুলবুল’ রেখেছিল স্তালিন আমায় পরিষ্কার করে কখনও বলেনি। ময়না, টিয়ে– ওর বাবার কালেকশনে ছিল বোধহয়। দুপুরে ওর বাবা যখন নেই, মা যখন একবেলার জোগাড় সেরে ক্লান্ত আর দাদু ভাতঘুমে, তখন স্তালিন ড্রামের ভেতর অর্ধেক বডি ঢুকিয়ে একহাত দিয়ে তুলে আনত বুলবুলকে। চলত ওর খাওয়া-দাওয়া, চিকিৎসা। আর প্রথম অঘটনটা ওই এক শালিখটার জন্যই ঘটল।
……………………………………..
এক শালিখকে প্রাচীন ইউরোপে ‘অপয়া’ শুধু বলা হত না, ধরে নেওয়া হত নিশ্চয়ই কোনও বিপদ ডেকে এনেছে। মূলত ইংরেজি আর স্কটিশ লোকগাথায় এর উল্লেখ পাওয়া যায়। ১৭৪০ সালে শালিখ পাখিকে নিয়ে কুসংস্কারাচ্ছন্ন প্রবাদের উল্লেখ ইংরেজি সাহিত্যে পাওয়া যায়। ১৮৪৬-এ একটি লোকগাথার বইয়ে ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ল্যাঙ্কিনশায়ার শহরে প্রথম হদিশ মেলে সেই বিখ্যাত কবিতার– ONE FOR SORROW TWO FOR MIRTH THREE FOR WEDDING FOUR FOR BIRTH
…………………………………….
স্তালিনের বাবার দুটো দামি পাখি মরে গেল। রোগে। আর্থিক ক্ষতি তো হলই, ব্যাপারটা স্তালিনেরও মনে ভয় ঢুকিয়ে দিল। ও বলল, ‘শালিখটার কোনও ছোঁয়াচে রোগ নেই তো? পাখিদের তো কত হয়।’ এটা মাথায় আসেনি কারও আগে। উপায় হল ওকে আলাদা করে রাখা। কিন্তু সে হওয়ারও জো নেই। একে তো সবাইকে লুকিয়ে অপয়া এক শালিখকে শেল্টার দেওয়া হয়েছে তার ওপর সদ্য দুটো পাখি মারা গিয়েছে! এই অবস্থায় বুলবুলকে বাড়ির কেউ আবিষ্কার করলে ম্যাসিভ ঝামেলা হতে পারে। তাই ওকে আর সরানো গেল না, কিন্তু কর্পোরেশন ইলেকশনে স্তালিনের দাদুর পার্টি ওদের ওয়ার্ডে গোহারা হেরে গেল।
এক শালিখকে প্রাচীন ইউরোপে ‘অপয়া’ শুধু বলা হত না, ধরে নেওয়া হত নিশ্চয়ই কোনও বিপদ ডেকে এনেছে। মূলত ইংরেজি আর স্কটিশ লোকগাথায় এর উল্লেখ পাওয়া যায়। ১৭৪০ সালে শালিখ পাখিকে নিয়ে কুসংস্কারাচ্ছন্ন প্রবাদের উল্লেখ ইংরেজি সাহিত্যে পাওয়া যায়। ১৮৪৬-এ একটি লোকগাথার বইয়ে ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ল্যাঙ্কিনশায়ার শহরে প্রথম হদিশ মেলে সেই বিখ্যাত কবিতার–
ONE FOR SORROW TWO FOR MIRTH THREE FOR WEDDING FOUR FOR BIRTH
আরও ১০০ বছর পর ভিক্টোরিয়ান কলোনিতে এই কবিতা আর একটু বদলে হয়ে যায়।
TWO FOR JOY
THREE FOR GIRL
FOUR FOR BOY
মূলত পারিবারিক স্বপ্নের কথা।
কিন্তু প্রথম লাইনটার কোন পরিবর্তন হয়নি, ONE FOR SORROW। তার মানে আমরা যে স্কুলে শিখেছি,
ONE FOR SORROW
TWO FOR JOY
THREE FOR LETTER
FOUR FOR TOY
এটা আরও বেশি করে বাচ্চাদের ইমোশানগুলোকে ভেবে লেখা। মানে ছোটদের শিশুকাল থেকেই মনে যাতে গোঁথে যায় এক শালিখ ‘অপয়া’। একের বেশি হলেই আনন্দ, চিঠি, খেলনা ইত্যাদি। অডিয়েন্স অনুযায়ী ‘মার্কেটিং টেকনিক’ বদলে একই কথা কী করে দেগে দেওয়া যায় সেটা সাহেবদের থেকে শেখার। এ বিষয়ে তাদের কাছে আমরা বড় একটা পাত্তা পাই না। অবশ্য খ্রিস্টান লোকগল্পে এর একটা কারণ দেওয়া হয়েছে। শোনা যায়, যিশুর ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার দিন একটা শালিখ পাখি নাকি কাঁদেনি। তাই খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করে শালিখ একা থাকলে আজও আমাদের অনিষ্ট হবেই। আর ইংরেজরা চলে গেলেও ইংরেজি প্রবাদের মোহ আমাদের তো চলে যায়নি। তাই একটি বাচ্চাকে ‘ঘর পোড়া গরু’ বা ‘সিঁদুরে মেঘ’ না বুঝলেও ‘ONE FOR SORROW’ পরিষ্কার বলতে শুনেছি।
স্তালিনের শালিখটাও আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে গেল, ওর ভাঙা ডানায় জোর এল আর একদিন উড়েও গেল। ও উড়ে যাওয়ার পর পরই স্তালিনের বাবা একটা ফ্রিজের কারখানার চাকরিও পায়। অন্য লোকে হলে বলত ‘অপয়া’ চলে যাওয়ার পরেই ভালো খবর এসেছে। কিন্তু স্তালিন আমায় বলেছিল বুলবুল যাওয়ার আগে ওদের বাড়িকে আশীর্বাদ করে গিয়েছে। শেল্টার দেওয়ার জন্য।
দুটোর মধ্যে দুটোই যদি মিথ্যে হয়, যেটা সত্যি, তা হল লোকগাথা আর সাহেবদের পাকা মাথার কারণেই বাংলা মিডিয়ামে পড়া স্তালিনের মা-ও একই ফাঁদে পড়ল। যার ঝক্কি পোহাতে হল ওই ডানা-ভাঙা শালিখটাকে। লোহার ড্রামে লুকিয়ে থাকতে হয়তো ওর কষ্ট হত, কিন্তু ও যদি জানত মানুষরা ওকে নিয়ে খোলা আকাশেও কী ভাবে– তাহলে হয়তো মাথা হেঁট হয়ে যেত লজ্জায়। স্তালিনের কথামতো ডানা-ভাঙা শালিখটা যাওয়ার আগে স্তালিনদের কোনও আশীর্বাদ করে গিয়েছিল কি না জানি না, কিন্তু চিরন্তন একটা হৃদয়ের দাবি রেখে গিয়েছিল।
……………..অপয়ার ছন্দ অন্যান্য পর্ব……………..
পর্ব ৪। জন্মগত দুর্দশা যাদের নিত্যসঙ্গী, ভাঙা আয়নায় ভাগ্যবদল তাদের কাছে বিলাসিতা
পর্ব ৩। পশ্চিম যা বলে বলুক, আমাদের দেশে ১৩ কিন্তু মৃত্যু নয়, বরং জীবনের কথা বলে
পর্ব ২। শনি ঠাকুর কি মেহনতি জনতার দেবতা?
পর্ব ১। পান্নার মতো চোখ, কান্নার মতো নরম, একা