সুনীলদের বাড়িটা ছিল পুরনো দিনের। বড় বড় কয়েকটি কবুতরের পটিময় থাম। জানলায় লোহার শিক, বাড়ির পিছনে শিবমন্দির লাগোয়া উঠান, উঠানে এক্কাদোক্কার ছক কাটা, ওখানে হুল্লারা। হুল্লার কয়েকজন বান্ধবীও আসত। সব মিলিয়েই একটা মায়া। একটা টান। একটা অভিলাষ। হুল্লার বয়স তখন কত? বছর ১৪ হবে। ওই বয়সের মেয়েদের তো ‘কিশোরী’ বলে। হুল্লারাই কিশোরী। ওর নাম জানলাম কীভাবে? ইলাটিং বিলাটিং শৈল খেলার সময় যখন ‘রাজা একটি বালিকা চাইল…. কোন বালিকা চাইল…’– হুল্লা বালিকা চাইল, তখনই তো জানতে পেরেছিলাম।
প্রচ্ছদ: শান্তনু দে
৬.
মেয়েটাকে চেনা চেনা লাগছিল। মেয়ে কেন বলছি? বুড়ি তো। চুল পাতলা, কিছুটা সাদা, চামড়া কুঁচকে গেছে… না, চামড়া বলে না, ত্বক। মেয়েদের চামড়া হয় না, ত্বক। গলার শিরা বেরিয়ে এসেছে। তবু কিন্তু সেই জেল্লাটা আছে। চোখের মণির রং একটু সবুজাভ। মেম সাহেবদের মতো। ওহ্, মনে পড়েছে। ও তো হুল্লা। সুনীলদের বাড়ির এক তলায় থাকতে। উঠোনে এক্কাদোক্কা খেলত, স্কিপিং লাফাত, ব্যাডমিন্টনও খেলত প্লাস্টিকের ফুল দিয়ে। সুনীলদের বাড়ির দোতলার বারান্দার রেলিংয়ে দাঁড়িয়ে হুল্লাদের হল্লা দেখতাম যখন সুনীলদের বাড়ি যেতে শুরু করি, তখন আমার ক্লাস নাইন-টেন হবে। সুনীল আমার ইশকুলের সহপাঠী ছিল।
সুনীলদের বাড়িটা ছিল পুরনো দিনের। বড় বড় কয়েকটি কবুতরের পটিময় থাম। জানলায় লোহার শিক, বাড়ির পিছনে শিবমন্দির লাগোয়া উঠান, উঠানে এক্কাদোক্কার ছক কাটা, ওখানে হুল্লারা। হুল্লার কয়েকজন বান্ধবীও আসত। সব মিলিয়েই একটা মায়া। একটা টান। একটা অভিলাষ। হুল্লার বয়স তখন কত? বছর ১৪ হবে। ওই বয়সের মেয়েদের তো ‘কিশোরী’ বলে। হুল্লারাই কিশোরী। ওর নাম জানলাম কীভাবে? ইলাটিং বিলাটিং শৈল খেলার সময় যখন ‘রাজা একটি বালিকা চাইল…. কোন বালিকা চাইল…’– হুল্লা বালিকা চাইল, তখনই তো জানতে পেরেছিলাম।
সুনীলের স্ত্রী মারা গেছে। একটি গৌড়ীয় মঠে সুনীলের স্ত্রীর পারলৌকিক কাজকর্ম হচ্ছে। এখানে সুনীলের আত্মীয়স্বজন-বন্ধুরা এসেছে। এখানেই ওই মেয়েটি, মানে বুড়িটি থুড়ি, ভদ্রমহিলাটি এসেছেন। ওর সত্যিকারের বয়স কত হবে, হতে পারে? আমি তখন প্রায় ৭০। ও তো ৬৭-৬৮ হবে। কিন্তু এখনও ওর মুখে লেগে আছে সেই কিশোরী কিশোরী ভাব।
ওর সঙ্গে আমার কথা হয়নি কোনও দিন। দোতলার রেলিংয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমি যে ওকে দেখতাম, এখনকার শুদ্ধ ভাষায় যাকে বলে ‘ঝাড়ি করা’ সেটা ভালোই বুঝতে পারত। অবরে সবরে গ্রীবা উঁচু করে উপরে তাকাত। মধুর চক্ষুমিলন হত। তাতেই আমার ভিতরে কেউ গান গাইত ‘ধন্য আমি ধন্য হে, পাগল তোমার জন্য হে…’।
ওর সঙ্গে কী করে কথা হবে? সুনীলদের সঙ্গে তো ওদের ঝগড়া ছিল। সুনীলরাও ওদেরই মতো ভাড়াটে ছিল। ঝগড়ার কারণ ছিল জল। বাড়ির একতলার চৌবাচ্চায় কলের জল আসত। একটা পাম্প বসিয়ে সুনীলরা ওদের জন্য হল তুলে নিত।
চৌবাচ্চার অনেকটা খালি হয়ে যেত। ওদের মধ্যে অলিখিত চুক্তি ছিল আধাআধি জল। কিন্তু পাম্প-চৌবাচ্চার অঙ্ক তো কেশব নাগের নল চৌবাচ্চার অঙ্ক মেনে চলে না। একতলা বলতে দোতলা বেশি জল টেনে নিচ্ছে। দোতলা বলত, মোটেই বেশি নিচ্ছি না। এভাবেই কথা বন্ধ। আমি যে রেলিংয়ের ধারে দাঁড়াতাম, সেটা সুনীলের পছন্দ ছিল না। ও বলত, আমারও তো দেখতে ইচ্ছে করে আমি তো দাঁড়াই না, চলে আয় ভিতরে, সবসময় ওর কথা মান্য করতে পারতাম না। অমোঘ টানে অবশ হতাম। কিন্তু বেশিক্ষণের জন্য নয়। সুনীলকে তো মান্য করতেই হয়। ওর জন্যই তো এই এক্কাদোক্কা, এই স্কিপিং লাফানোর আনন্দ লহরী দেখতে পাওয়া। সুনীলকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম একদিন, ওই হুল্লার সঙ্গে ‘এল’ করতে ইচ্ছে করে না তোর?
আমাদের সময় ‘এল’ করা মানে লাইন করা। সুনীল বলেছিল, ইচ্ছে হলে কী হবে? আমাদের সঙ্গে ঝগড়া যে। আমার মায়ের সঙ্গে ওর মায়ের, আমার বাবার সঙ্গে ওর বাবার, আমাকে দেখলে ও মুখ ঘুরিয়ে পিড়িং করে।
‘পিড়িং করা’ মানে মুখটা সামান্য বেঁকিয়ে দেওয়া। তাচ্ছিল্য করার জন্য মেয়েরা এরকম করত। ওই হুল্লাদের পরিবার ওই বাসাবাড়ি ছেড়ে বছর খানেকের মধ্যেই চলে যায়। ওই উঠানের এক্কাদোক্কার ছক নিশ্চুপ পড়ে থাকে। নতুন ভাড়াটে আসে। ওদের মধ্যে কোনও হুল্লা ছিল না। চকখড়িতে আঁকা এক্কাদোক্কার ছক ধূসর হতে হতে মুছে গেল।
সুনীলের মন থেকে হুল্লা মোছেনি নিশ্চয়ই, নইলে আজ, সুনীলের স্ত্রীর মৃত্যুতে, পারিবারিক অনুষ্ঠানে হুল্লাকে বলবে কেন? হুল্লারা চলে যাওয়ার পর আমি সুনীলকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম হুল্লারা কোথায় গেছে রে? সুনীল তেরছা স্বরে বলেছিল, জানি না কোন চুলোয় গেছে! তোর ওখানে খুব আঠা, তাই না? এই আঠা শব্দটা কলেজজীবনে ‘ব্যথা’য় পরিবর্তিত হয়, আরও পরবর্তীকালে ওটা ‘ক্রাশ’ ছিল বা আছে এখনও।
আমি কলেজের পর কলকাতার বাইরে চাকরি পেয়ে চলে যাই, সুনীলও তাই, যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায় প্রায়। দীর্ঘদিন পরে আবার যোগাযোগ হয়, আমরা ততদিনে ষাট পেরিয়েছি। সুনীল এখন নিজে বাড়ি করেছে গড়িয়ায়। আমি ফ্ল্যাট কিনেছি দমদমে। দু’-প্রান্তে থাকি। কিন্তু মোবাইল ফোন তো আছে!
সুনীলের ছেলে ক্রিয়াকর্ম করছে সুনীল ওখানেই। সুনীলের স্ত্রী শর্মিলার ছবিতে মালা, ধূপকাঠি। আমরা একটু দূরে, চেয়ারে শোক শোক মুখ করে বসে আছি। আমার আর তপনের দু’-তিনজন কমন বন্ধুও আছে। ওদের সঙ্গে কথা বলছি, আর বারবার ওই মেয়েটার, থুড়ি মহিলাটির দিকে দৃষ্টিসম্পাত করছি। যেমন স্লিম ছিল, তেমনই আছে। কই, হাতে শাঁখা-নোয়া নেই তো…। সিঁদুর কি আছে? আজকাল সিঁদুর থাকে গোপনে। দুই ভ্রু-র মাঝ বরাবর চুলের ভিতরে। ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
কী হবে বুঝে?
মন তবু মানে না মানা।
বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করার ফাঁকে ফাঁকে ওইদিকেই দৃষ্টি নিক্ষিপ্ত হতে থাকে। ওর সঙ্গে চোখাচোখি হয়নি একবারও। কিন্তু চোখ ছাড়াও মেয়েদের অন্য একটা রহস্যময় ইন্দ্রিয় থাকে, যা দিয়ে ওরা টের পায়। ঘাড় বেঁকিয়ে, থুড়ি, ঘাড় নয় গ্রীবা, আমার চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কিছু বলবেন?’
সেই সবুজাভ চোখের মণি। অকস্মাৎ আমার স্তম্ভিত মুখ থেকে বেরিয়ে এল– ‘হুল্লা না!’ মেয়েটির মুখে চন্দ্রমল্লিকা ফুটল। বলল, এই নামটা ধরে যাঁরা ডাকত তাঁদের দু’-চারজন মাত্র বেঁচে আছে। সুনীলদা একজন। আপনি কী করে জানলেন? সুনীলদা কিছু বলেছে?
তার মানে ও ভাবছে, সুনীলদাই ওকে নিয়ে বলতে পারে।
তার মানে সুনীলদার ক্রাশ আছে ওকে নিয়ে, ও জানে।
সুনীলকে আমার প্রতিযোগী মনে হল।
আমি রহস্য করি। আমি বলি, তাহলে ঠিকই বলেছি, আমি। তুমি, মানে আপনি হুল্লা-ই।
মেয়েটা হাত তুলে মাথা চুলকোল। হাত নয়, বাহু– বাহুবল্লরী। মাথার চুল একটু ছোট করে কাটা। তখন বিনুনি ছিল। মাথার দু’পাশে ঝুলত। কখনও তাতে থাকত লাল ফিতের ফুল। ফুল দুলত।
ওধারে মন্ত্র পড়ছে: ‘এতানি পুষ্পানি ইদং সমর্পয়ামি’। আর আমি ফুল দেখছি সেই পুরনো কালের, আমায় বলল– এই, বলুন না, কে আপনি? আমার হুল্লা নামটা কী করে জানলেন?
‘তুমি চিনতে পারছো না?’ মনে মনে বলি। আমি তো সেই আমিই। যে তোমাকে দিনের পর দিন…। তুমি তো স্বপ্নেও এসেছিলে। সেটা তো… তোমার জানার কথা নয়।
ও যখন বলল এই, বলুন না, তখন ‘এই’ শব্দটা ছ্যাঁক করে কারেন্ট মেরে দিল। যেন একটা হালকা কনুই-গুঁতোও অনুভব করলাম। আমি এত বয়স থেকে হঠাৎ কিশোর হয়ে গেলাম যেন। কিশোর কুমারই হয়ে গেলাম। ‘এক পলকে, একটু দেখা আর একটু বেশি হলে ক্ষতি কী’…গেয়ে উঠল ভিতরের কেউ।
আমি রহস্য করে বললাম, ‘আন্দাজ করো… মানে করুন…।’
‘‘ঠিক আছে, ‘করো’ ঠিক আছে, ‘করুন’ দরকার নেই। আসলে, আমার ও পাড়ার বন্ধুদের কারওর সঙ্গে যোগাযোগ নেই, যারা আমার এই নামটা জানত। বিয়ে হওয়ার পর শ্বশুরবাড়ির লোকজন অন্য একটা ডাকনাম রেখেছিল– কাকিমা, জেঠিমা, পিসিরা, কেউ নেই। মাসতুতো ভাই মামাতো ভাইরা আছে। কিন্তু আপনি কী করে জানলেন?’
আপনি সুনীলদার বন্ধু বা কোনও আত্মীয় সেটা বুঝতে পারছি। কিন্তু নামটা…।
আমি বলি, ‘হ্যাঁ, নামটা তো মনে আছে হুল্লা।’ আর মনে মনে বলি, এই নামটার সঙ্গে মিশে আছে হজমিওলা, কারেন্ট নুন, সব পেয়েছির আসর, উত্তরা-পূরবী-উজ্জ্বলা, দো-কা চার, ঘুড়ির মাঞ্জা, মাটির বেহালা…’
হ্যাঁ, সেই মাটির বেহালা বাজতেই থাকল। সেই বাজনার ব্যাকগ্রাউন্ডে বলি– ‘নামটা ভুলি কী করে? হৃদয়ে লিখেছিলাম যে…। পাথরে লেখো নাম সে নাম মুছে যাবে, কাগজে লেখো নাম, কাগজ ছিঁড়ে যাবে, হৃদয়ে লেখো নাম… সে নাম রয়ে যাবে…।’
মেয়েটা আমার দিকে তাকাল। চোখে চোখ। তক্ষুনি চোখ নিচু করল আহা, রাই কিশোরী লজ্জা পেয়েছে ও উঠে গেল, ওদিকে, যেখানে কাজকর্ম হচ্ছে।
ওর ফোন নম্বরটা চাইব?
কী হবে? কী কথা বলব আর। সব কথা তো বলা হয়েই গেছে। সেই রামধনু দিনগুলো আর তো ফিরিয়ে আনতে পারব না। হুল্লার সঙ্গে ওখানে আর কথা হল না কেন। একটু নিরামিষ আহারের ব্যবস্থা ছিল। ও এমন জায়গায় বসেছিল, যেখানে বসলে দেখা যায় না।
ও কি সত্যিই আমাকে চিনতে পারেনি? কতদিন আমি দোতলার বারান্দার রেলিং-এ দাঁড়িয়ে…। সে কি জানিত না হৃদয়ের অপচয় কৃপণের বাম মুঠি?
বেলা তিনটে বেজে গেল। একে একে চলে যাচ্ছে সব্বাই। হুল্লা একাই এসেছিল। ও এবার চলে যাবে। অনেককেই বিদায় জানাল।
আমাকে বিদায় জানাল না। যাচ্ছি, বা আসি কিছুই বলল না।
হাতটাও নাড়াল না। শুধু একবার সবুজাভ তাকাল। আর খুব মৃদু, ছোট্ট চন্দ্রমল্লিকার মতো হাসি ফুটে উঠল ওর মুখে।
শুধু দই দিয়ে বিচার করলে দক্ষিণ কলকাতাকে উত্তর কলকাতা ১০ গোল দেবে! শ্যামবাজার ছাড়িয়ে সিঁথি, বরানগর, ব্যারাকপুরের দিকে যত যাওয়া যায়, সেই পথেও চমৎকার সব মিষ্টির দোকান আছে। সেখানকার রসগোল্লা মোটেই ‘স্পঞ্জ’ নয়। এবং অরিজিনাল দই তৈরি হয় সেখানে– যাকে বলে ‘পয়োধি’!