‘All fiction is metaphor. Science fiction is metaphor.’ এই ছিল উরসুলার কথা। সমস্ত কাহিনিই আসলে রূপক। আর সাই-ফাইও রূপক। শুধু পুরনো কাহিনির সঙ্গে তুলনা করলে এই রূপক কেবলমাত্র বর্তমানের উপাদানে গঠিত হয় না, তা ভবিষ্যতের উপাদানকেও ব্যবহার করে। আজকের বিজ্ঞানপ্রযুক্তির ওপরে দাঁড়িয়ে, এই রূপক ঐতিহাসিকতার নিয়মকে সূক্ষ্মভাবে লক্ষ করে, পর্যবেক্ষণ করে। রূপক কোনগুলো? মহাকাশযাত্রা একটি রূপক, ভিন্ন প্রজাতির ইটি একটি রূপক, ভিন্ন জীবজন্তু, আশ্চর্জন্তুর দল রূপক। সবচেয়ে বড় রূপক সাই-ফাইয়ের ক্ষেত্রে হল, ভবিষ্যৎ। ভবিষ্যৎকালটি কীসের রূপক? বর্তমানের।
৭.
কল্পলোকের গল্পগাথা– এই নামে কি ডাকা যায় ইংরেজিতে ফ্যান্টাসি বলে কথিত জঁরের কাহিনিকে? যদি তাই যায়, তার সঙ্গে কী সম্পর্ক কল্পবিজ্ঞানের? আদৌ আছে কি? ক্যাম্বেল সায়েব বলবেন নেই। কারণ, কল্পবিজ্ঞান হল হার্ড ফ্যাক্টস ও নিখাদ বিজ্ঞান আধারিত পৌরুষময় এক আখ্যান।
কিন্তু উরসুলা লেগুইন কি বলবেন তা? না, বহুবার মার্কিন কল্পবিজ্ঞান জগতের বাঘা বাঘা পুরস্কার তাঁর ঝুলিতে। কিন্তু তাঁর কাহিনি কেবল শুষ্ক বিজ্ঞান তত্ত্বের চর্বিত চর্বণ নয়। তাঁর মতে, একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ হল সায়েন্স ফিকশন আর ফ্যান্টাসি ফিকশন। আর এখানেই তাঁকে জুড়ে দেওয়া চলে কল্পনাজগতের অধীশ্বরী মেরি শেলি বা গিলম্যানের ধারাবাহিকতার সঙ্গে। যদিও তিনি ছয় ও সাতের দশক থেকে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন মার্কিন সাই-ফাই পত্রিকাগুলিতে। আজকেও তাঁকে এক বিপুল পরিমাণ পাঠক প্রায় প্রাতঃস্মরণীয়ের মতো মনে রেখেছে। কেননা তাঁর লেখা প্রতিরোধের, দর্শনের। তাঁর লেখা পরিপূর্ণভাবে স্পর্শ করে আমাদের এই সময়কে। যখন শুষ্ক বিজ্ঞান-প্রযুক্তি পরিবেশ ধ্বংস করছে, যখন প্রতিরোধ জারি থাকছে মানববিরোধী, পশুপাখি-মনুষ্যেতর জগতের পক্ষে ক্ষতিকর প্রযুক্তির তীব্র ঔদাসীন্যের প্রতি।
কী ছিল জন ডব্লিউ ক্যাম্বেল জুনিয়রের থিওরি? ওই ঔদাসীন্যটাই ছিল। যা নারীসত্তাকে ক্রমশ নস্যাৎ করে দেয়।
‘To be science fiction, not fantasy, an honest effort at prophetic extrapolation from the known must be made.’ যতটুকু বিজ্ঞান জানা গিয়েছে, তাকে ভিত্তি করে দূরদর্শিতাপূর্ণ মসিহার মতো এগিয়ে ভাবতে হবে, বিজ্ঞান কোথায় যেতে পারে। এখানে ফ্যান্টাসি বা কল্পগল্পের স্থান নেই। ‘Scientific methodology involves the proposition that a well-constructed theory will not only explain every known phenomenon, but will also predict new and still undiscovered phenomena. Science-fiction tries to do much the same.’ যন্ত্রজগৎকে বুঝবেন সাই-ফাই লেখক, এবং সেই যান্ত্রিক নীতিকেই অ্যাপ্লাই করবেন মানবসভ্যতার ওপরও। .
উরসুলা লেগুইন ক্যাম্পবেলিয়ান থিওরির বিরোধিতা করলেন। কাম্পবেলের মত ছিল, পৃথিবীর যে কোনও সমস্যার সমাধান হতে পারে প্রযুক্তি দিয়ে। ক্যাম্পবেলের বিশ্বে নারীর স্থান প্রান্তিক৷ তাকে মূল ভূমি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। নারীকে যুক্তিবিবর্জিত আবেগসর্বস্ব ভাবার পিতৃতান্ত্রিক দর্শনে ক্যাম্পবেল পুরোপুরি প্রোথিত থাকেন। নারী যুক্তিবাদী? অথবা ‘the machine does not care’– এই কথাটিই একমাত্র প্রাধান্যের জায়গায় ছিল (টম গডউইনের ‘দ্য কোল্ড ইকুয়েশন্স’-এর বিখ্যাত বাক্য।) এই লেখা, মার্কিন কল্পবিজ্ঞান লেখালেখির পুরুষপ্রাধান্যের তুলকালাম সময়ে, পাঁচের দশকের গোড়ায় লেখা। ‘অ্যামেজিং স্টোরি’র পাঠিকা উরসুলা নিশ্চিত সে গল্প পড়েছিলেন, যেখানে শুষ্ক, কঠোর বিজ্ঞানের বাস্তব ভূমিতে বিচরণ করে মানুষ। আবেগের স্থান নগণ্য। তাই জ্বালানি নেওয়ার জন্য একটি মেয়ে মহাকাশচারীকে স্বেচ্ছায় আত্মবলিদান দিতে হয়। ‘কোল্ড হার্ড ফ্যাক্টস’-এর ক্যাম্পবেলীয় দুনিয়া তখন সাই-ফাই-এর দুনিয়া।
আগেই আমরা দেখিয়েছি, ‘হারল্যান্ড’-এর কাহিনির মতো একাধিক কাহিনিতে, ইউটোপিয়া কল্পনার প্রাচীন এক ধারা সতেরো বা আঠেরো শতকের লেখাতে ছিলই। যার অনেকটাই মেয়েদের লেখা। সেই ধারাটিকে মুছে দিয়ে কল্পবিজ্ঞানের ইতিহাস ক্যাম্পবেলের মতো সম্পাদক আলোচকরা নতুন করে সাই-ফাই-কে সংজ্ঞায়িত করলেন, জুল ভার্ন বা এইচ. জি. ওয়েলস-এর মতো অনেক পরে আসা পুরুষদের নাম প্রতিষ্ঠিত হল, কেননা তাঁদের গল্পের ভিত্তি ছিল ‘হার্ড ফ্যাক্টস’ ও শুষ্ক বিজ্ঞান!
উরসুলা রেজিস্টেন্স বা প্রতিরোধের গল্প বললেন। একইসঙ্গে বললেন দু’টি ধারার গল্প। একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ! লিখলেন, ‘দ্য আর্থসি ট্রিলজি’, ‘দ্য উইজার্ড অফ আর্থসি’ ( ১৯৬৮)। ‘দ্য ফারদেস্ট শোর’ (১৯৭২), ‘দ্য টুম্বস অফ অ্যাটুয়ান’ ( ১৯৭০)। এই তিন মিলে তাঁর ফ্যান্টাসি জয়যাত্রা। আবার সায়েন্স ফিকশনের শক্তভূমিতে, বিজ্ঞানের প্রয়োগে লিখলেন ‘দ্য লেফট হ্যান্ড অফ ডার্কনেস’ ( ১৯৬৯), ‘দ্য লেদ অফ হেভেন’ (১৯৭১), ‘দ্য ডিস্পোসেসড’ ( ১৯৭৪)। এই বইগুলি তাঁকে সাই-ফাই রাইটারের তকমা দিয়েছিল। হুগো ও নেবুলা পুরস্কার এনে দিয়েছিল।
‘All fiction is metaphor. Science fiction is metaphor.’ এই ছিল উরসুলার কথা। সমস্ত কাহিনিই আসলে রূপক। আর সাই-ফাইও রূপকই। শুধু পুরনো কাহিনির সঙ্গে তুলনা করলে এই রূপক কেবলমাত্র বর্তমানের উপাদানে গঠিত হয় না, তা ভবিষ্যতের উপাদানকেও ব্যবহার করে। আজকের বিজ্ঞানপ্রযুক্তির ওপরে দাঁড়িয়ে, এই রূপক ঐতিহাসিকতার নিয়মকে সূক্ষ্মভাবে লক্ষ করে, পর্যবেক্ষণ করে। রূপক কোনগুলো? মহাকাশযাত্রা একটি রূপক, ভিন্ন প্রজাতির ইটি একটি রূপক, ভিন্ন জীবজন্তু, আশ্চর্জন্তুর দল রূপক। সবচেয়ে বড় রূপক সাই-ফাইয়ের ক্ষেত্রে হল, ভবিষ্যৎ। ভবিষ্যৎকালটি কীসের রূপক? বর্তমানের।
আজকের পর্ব শেষ করব উরসুলার একটি সুবিখ্যাত গল্প দিয়ে। ‘দ্য ওয়ান্স হু ওয়াক অ্যাওয়ে ফ্রম ওমেলাস’, ১৯৭৩ সালে লেখা এ কাহিনি ওমেলাস নামে এক কাল্পনিক শহরকে নিয়ে। ইউটোপিয়া এটি, তাই এখানে নেই কোনও দুঃখ। সর্বদা মানুষ হাস্যোচ্ছ্বল, নৃত্যরত, আনন্দময়। গল্প শুরু হচ্ছে গ্রীষ্মের প্রথম দিনে, যেদিন সংক্রান্তি, সকলে উৎসবে মাতোয়ারা। ওমেলাস কেমন ইউটোপিয়া? যেখানে নেই রাজা, নেই দাস, নেই পুরোহিত, নেই সৈন্য। কিন্তু এই যে যতরকমভাবে ভেবে নেওয়া যায় সুখ ও আমোদের কারখানাটি, সেই ওমেলাসের সুখের চাবিকাঠি আছে এক জায়গায়। তার প্রাণ ভোমরার মতো। সে হল, সে শহরে বা দেশে একটি শিশুকে চিরতরে বন্দিদশায় থাকতে হবে, জঘন্য নোংরা আর কষ্টদায়ক কারাগারে। এত সুখ কি আর এমনি এসেছে? ওমেলাস জানে ওই শিশুটিই বহন করবে তাদের সবার দুঃখভার। তাই ওর কষ্ট পাওয়া বাধ্যতামূলক।
গল্পের ‘সব পেয়েছির দেশ’টির সব মানুষই একদিন জন্মায়, বড় হয়, সুখে শান্তিতে। এবং জানতে পারে, একটি মানুষের বেদনার বিনিময়ে তারা পেয়েছে এই সুখের রাজ্য। তা জেনেও তারা মেনে নেয়, কেননা নিজের সুখকে তো বলি দিতে পারে না কেউ! পারে কি? স্বার্থপর সুখের এই রাজ্যে শুধু কিছু মানুষ বলে বসে, আমি এই ওমেলাস-এ থাকব না। আমাকে চলে যেতেই হবে এই স্বার্থপর নিষ্ঠুর সদাসুখের সাম্রাজ্য ছেড়ে। এবং তারা হাঁটা দেয়। অজানা কোন গন্তব্যের দিকে। ‘The place they go towards is a place even less imaginable to most of us than the city of happiness. I cannot describe it at all. It is possible it does not exist. But they seem to know where they are going, the ones who walk away from Omelas.’ এইভাবেই শেষ হয় গল্পটি।
ওমেলাস নামটি নাকি লেগুইন পেয়েছিলেন, গাড়ির আয়নায় একটি শহরের নাম উল্টো করে পড়ে। salem. O, ওরিগন প্রদেশের শহর সালেম। সেই সূত্রে তিনি বিখ্যাত সেই কথাটি বলেন। ‘আমাকে সবাই প্রশ্ন করে, মিসেস লেগুইন আপনার গল্পের আইডিয়া আপনি পান কোথা থেকে? আমি বলি, স্বাভাবিকভাবেই পাই, গাড়িতে যেতে যেতে, স্ট্রিট সাইনগুলো উল্টো করে পড়তে পড়তে!’
…পড়ুন সায়েন্স ফিকশনারী-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৬। কেবলমাত্র নারীরচিত সমাজ কেমন হবে– সে বিষয়ে পুরুষের অনুমান সামান্য
পর্ব ৫। একমাত্র মানুষের মাংসই সহ্য হত ভিনগ্রহী শিশুটির!
পর্ব ৪। পাল্প ম্যাগাজিনের প্রথম লেখিকা
পর্ব ৩। রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ কি কল্পবিজ্ঞান সংজ্ঞার সবগুলো শর্তই পূরণ করতে পেরেছিল?
পর্ব ২। সুলতানার স্বপ্নেই বিশ্বের প্রথম নারীবাদী ইউটোপিয়ার অবকাশ
পর্ব ১। চ্যালেঞ্জের বশেই লেখা হয়েছিল পৃথিবী প্রথম কল্পবিজ্ঞান কাহিনি, লিখেছিলেন একজন নারীই
গল্পগাছায় বুঝতে পারতাম তাঁর বোধ ছিল প্রখর, অত্যন্ত ভালো পড়ুয়া, এবং প্রচুর ইউরোপিয়ান সিনেমা দেখেছেন। এবং এমনভাবেই দেখেছেন যে সেসব সিনেমার রেফারেন্স মনে অটুট থাকত। আমার কোনও ছবি দেখে বলে দিতে পারতেন, কোন দৃশ্যে বুনুয়েলের ছাপ, আর কোন দৃশ্যে চ্যাপলিন। প্রয়াত শ্যাম বেনেগাল, রইল একটি স্মৃতিলিখন।