রথীন্দ্রনাথ আশ্রমে তাঁর সহপাঠীদের সঙ্গে একইরকম সংযম ও কৃচ্ছ্রসাধনের মধ্যে সেখানে বড় হয়ে উঠছিলেন। ছুটির দিনে তাই মৃণালিনী দেবী নিজের হাতে রেঁধে পুত্র-সহ আশ্রমের ছাত্রদের খাইয়ে তিনি পরিতৃপ্তি বোধ করতেন। এই মৃণালিনী দেবীকে আশ্রমকন্যা নয়, আশ্রমমাতা বলতে ইচ্ছে হয়। শিক্ষাপ্রণালী ও পল্লি পুনর্গঠন নিয়ে রবীন্দ্রনাথের যে চিন্তা তথা পরীক্ষানিরীক্ষার বিপুল জাহাজ বয়ে চলছিল, তার হাল যাঁরা নিষ্ঠার সঙ্গে ধরে বসেছিলেন– বলা যায়, তাঁদের প্রধান ছিলেন আশ্রমলক্ষ্মী প্রতিমা। এটাই আশ্রমকন্যার শেষ পর্ব।
৮.
গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের পত্নী মৃণালিনী দেবী তাঁর স্বল্পজীবনের মধ্যে কিছুদিন শান্তিনিকেতনে বাস করেছিলেন এবং স্বামীর স্বপ্নপূরণের কর্মে সম্পূর্ণ সাথী হয়েছিলেন। তপোবনের আদর্শে প্রতিষ্ঠিত এই আশ্রম-বিদ্যালয়ে শিক্ষা ও থাকা-খাওয়ার জন্য ছাত্রদের কাছ থেকে কোনও অর্থ নেওয়া হত না। শান্তিনিকেতন ট্রাস্ট থেকে বরাদ্দ দুশো টাকা ব্রহ্মাচর্যাশ্রমকে দেওয়া হত। কিন্তু এর অতিরিক্ত সব খরচ জোগাতে হত রবীন্দ্রনাথকে, যাঁর সম্বল বিশেষ কিছুই ছিল না। আশ্রমের ছাত্র তথা গুরুদেব-পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর মা মৃণালিনী সম্পর্কে লিখেছেন, ‘যখনই বিশেষ প্রয়োজন হয়েছে নিজের অলংকার একে একে বিক্রি করে বাবাকে টাকা দিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত হাতে সামান্য কয়েক গাছা চুরি ও গলায় একটি চেন ছাড়া তার কোন গয়না অবশিষ্ট ছিল না। মা পেয়েছিলেন প্রচুর। বিবাহের যৌতুক ছাড়াও শাশুড়ির পুরনো আমলের ভারী গয়না ছিল অনেক। শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয়ের খরচ যোগাতে সব অন্তর্ধান হল। বাবার নিজের যা কিছু মূল্যবান সম্পত্তি ছিল তা আগেই তিনি বেচে দিয়েছিলেন।’
সেই সময় ব্রহ্মচর্যাশ্রমে নিরামিষ ভোজন ছিল ছাত্রাবাসে। খাওয়া-পরার কঠোরতাও ছিল। রথীন্দ্রনাথ তাঁর সহপাঠীদের সঙ্গে একইরকম সংযম ও কৃচ্ছ্রসাধনের মধ্যে সেখানে বড় হয়ে উঠছিলেন। এতে মৃণালিনীর মাতৃহৃদয় খুবই পীড়িত হত। সে-কারণে ছুটির দিনে নিজের হাতে রেঁধে পুত্র-সহ আশ্রমের ছাত্রদের খাইয়ে তিনি পরিতৃপ্তি বোধ করতেন।
এই মৃণালিনী দেবীকে আশ্রমকন্যা নয়, আশ্রমমাতা বলতে ইচ্ছে হয়।
আর একজন আশ্রমপালিকা হলেন রবীন্দ্রনাথের পুত্রবধূ, রথীন্দ্রনাথের স্ত্রী প্রতিমা দেবী– যিনি তাঁর সমগ্র জীবন আশ্রমের সেবায় দান করে গিয়েছেন। বিয়ের ১৫-২০ দিন পরই বাবামশাই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নতুন বউ প্রতিমা শান্তিনিকেতনে এলেন। তাঁর আসাকে সম্মান দিতে সেদিন বিকেলে আশ্রম মাঠে ফুটবল ম্যাচ হল। লটারি হল। সবাইকে নিজের হাতে প্রতিমা কমলালেবু দিলেন। হয়ে উঠলেন সকলের ‘বউঠান’।
প্রথম যুগের আশ্রমকন্যাদের সম্পর্কে প্রতিমা লিখেছেন, ‘দেহলিতে বিদ্যালয়ের মেয়েরা থাকত। মেয়ে ছিল অল্প কয়েকটি। ঠাকুরঝিও (মীরা দেবী) তাদের সঙ্গে থাকতেন। বিদ্যালয়ের মেয়েদের নিজের মেয়ের মতো করে মানুষ করবেন এই তাঁর ইচ্ছা ছিল। সেই যে শান্তিনিকেতনে এলাম তারপর থেকে অধিকাংশ সময়ে এখানে কাটত।’ শান্তিনিকেতনের আশ্রমের লোকেদেরও তিনি আচরণে, বাচনে, দুর্লভ আতিথেয়তায় সারাজীবন সেবা করে গিয়েছেন। অসুস্থ মানুষদের জন্য পথ্য তৈরি করেছেন, নাটকের পর শিল্পীরা তাঁর কাছেই নিমন্ত্রণ পেয়েছে। আশ্রমিকদের মধ্যে কারও বিয়ে হলে তাঁর কাছে আতিথ্য লাভ করেছে। সব ব্যাপারেই বউঠানের স্নেহদৃষ্টি ছিল। আশ্রমের বৃহৎ সংসারের তিনি এক প্রকার অভিভাবক ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি আশ্রম পরিচালনার ভারও নিয়েছিলেন। শ্রীভবনের তত্ত্বাবধানের জন্য পরিদর্শিকা আছেন, তবুও রবীন্দ্রনাথ প্রতিমা দেবীকেই প্রণেত্রী পদে নিযুক্ত করেন।
প্রতিমা দেবী শিল্পী পরিবারের মেয়ে ছিলেন। অবনীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ, সমরেন্দ্রনাথ তার মামা ছিলেন; মাসি সুনয়নী দেবীও শিল্পী ছিলেন। প্রতিমাও শিল্পের উত্তরাধিকার নিয়েই জন্মেছিলেন। অবনীন্দ্রনাথ ও নন্দলালের কাছে ছোটবেলায় ছবি আঁকা শিখেছিলেন। তিনি নিজেও চিত্রশিল্পী ছিলেন। কিন্তু এটাই তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয় নয়, আশ্রমবিদ্যালয়ের কারুশিল্প বিকাশে, রবীন্দ্রভাবনা বিচ্ছুরণে অভিভাবকের দায় অনেকখানি তিনি গ্রহণ করেছিলেন।
শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতনের শিক্ষাকে কোনও দ্বীপবদ্ধ আভিজাত্য দিয়ে আগলে রাখতে চাননি রবীন্দ্রনাথ। সমাজজীবনের সামগ্রিক উন্নয়ন তাঁর সাধনা ছিল। ছাত্র-ছাত্রীদের তিনি গ্রামোন্নয়নের সৈনিক করে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। প্রতিমা গুরুদেবের এই ভাবনাটিকে নিজের সমগ্র জীবন দিয়ে গ্রহণ করেছিলেন। প্রতিমা লিখেছেন, ‘মনে পড়ে ১৯৩০ সালে গ্রামের এই মহিলা সমিতির যথার্থ আরম্ভ হয়। কিন্তু আন্দাজ ১৯২৭ সাল থেকেই গুরুদেবের উৎসাহে গ্রামের জীবনযাত্রার উপর মনোযোগী হয়েছিলাম।… গ্রামের সামাজিক জীবনের উন্নতি সাধন তাঁর আরেকটি অভিপ্রায় ছিল। আমরা এই শান্তিনিকেতন -শ্রীনিকেতনের মেয়েরা যাতে গ্রাম্য জীবনের প্রতি অনুরাগী হই এবং গ্রামের সামাজিক জীবনের উন্নতিতে সহযোগিতা করতে পারি তার জন্য তিনি সর্বদাই আমাদের উপদেশ দিতেন।’
রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন, শান্তিনিকেতনে আশ্রমের শিক্ষা লাভ করে আশ্রমবাসীদের চিত্ত যেভাবে বিকশিত হচ্ছে, তা কৃপণের মতো ভোগ না করে, সে-শিক্ষার সুরুচি ও সৌন্দর্যের আনন্দকে সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে। সেই ভাবনা থেকেই প্রতিমাদের গ্রামে কাজ করতে যাওয়া, গ্রামের ভেতরে শক্তিকে পুনর্জাগরিত করা । রবীন্দ্রনাথ আশ্রমের নারীশক্তির উপর জোর দিয়েছিলেন। প্রতিমা সেই ব্রত গ্রহণ করেছিলেন।
প্রতিমা দেবী লিখেছেন, ‘আজ মনে পড়ে, গ্রামের মেয়েদের মধ্যে শিল্পকর্ম প্রচারের ইচ্ছায় যখন গৌরী দেবী ও সুকুমারী দেবীকে নিয়ে গোয়ালপাড়ায় যেতে শুরু করেছিলাম, তখন দেখেছি কী করে সুঁচ ধরতে হয় এখানকার পল্লী মহিলারা তাও ভালো করে জানতেন না। তারপর সনাতন গোঁড়ামি আমাদের উভয় পক্ষের মাঝখানে একটা আদান-প্রধানের বাধা স্বরূপ হয়ে ছিল। আমরা জাতি বিচার মানি না বলে আমাদিগকে ঘরে ঢুকতে দিতেও গ্রামবাসিনীরা বোধহয় সংকোচবোধ করতেন। সেই সময় প্রতি ঘরে ঘরে মেয়েদের ডেকে নিয়ে ক্লাস বসাতে হত। গৌরী দেবী ও তার সহপাঠী বাসন্তী দেবী তরুণ হলেও এই শিক্ষাকর্মে প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন। তাঁদের মত উৎসাহী ছাত্রী সেই রকম কাজের পক্ষে আমি খুব কম দেখেছি। ক্রমে এইভাবে পল্লী মহিলাদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় যতই ঘনীভূত হতে লাগল, সংকোচের পর্দা ততই গেল সরে। ক্রমে তাঁরা আমাদের সঙ্গে আত্মীয়তার সহজ বন্ধনে যোগযুক্ত হলেন। পূর্বে যেমন আমাদের দাওয়ায় বসে সেলাইয়ের কাপড় হাতে নিয়ে ভয়ে ভয়ে দূরে থেকে আলগোছে সেলাই শিখতেন, ক্রমশ তাঁদের মনের সে সংকোচ কাটতে আরম্ভ হল। মানুষের সঙ্গে মানুষের সহযোগ যখন আমরা অন্তরের মধ্যে অনুভব করলুম, তখনই সত্যিকার সম্বন্ধটা হল দৃঢ়।
… এর কিছু কাল পরে ম্যাডাম কারপেলেস যখন আমার সঙ্গে মেয়েদিগকে কারুকার্য শিক্ষা দেবার জন্য আশ্রমে এসে একটি ক্লাস খোলেন– তখন তাঁকে সঙ্গে নিয়ে এখানকার অনেক গ্রাম ঘুরে দেখবার সুযোগ আমার হয়েছিল। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল গ্রামের দৈন্য, অভাব এবং লুপ্ত শিল্পের অভাব অনুসন্ধান করে ফেরা। এই সূত্র অবলম্বন করে গ্রাম্য জীবনের কাছাকাছি আসতে প্রয়াস পেয়েছিলাম। দেখেছিলাম তাঁদের মধ্যে এমন মানুষ প্রায়ই পাওয়া যায়, উপযুক্ত শিক্ষা পেলে যাঁরা অল্প সময়ের মধ্যে নিজেদের গুণে বিকশিত হতে পারেন।’
ফরাসি চিত্রকর আন্দ্রে কারপেলেসের সঙ্গে প্রতিমার খুবই বন্ধুত্ব হয়। ১৯২১ সাল নাগাদ তিনি প্যারিসে তাঁর আতিথ্য নেন এবং চিত্রশিল্পের সঙ্গে ক্রাফটের কাজেও প্রতিমা পুরোপুরি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এই সময় বাটিক শিল্পের করণকৌশলও তিনি আয়ত্ত করেন। শিল্প ইতিহাসিক সুশোভন অধিকারী জানাচ্ছেন, ১৯২১ সালে প্রতিমা দেবী প্যারিসে বাটিকের টেকনিক শিখছেন ফরাসি শিল্পী মউ মিয়েক্স (Mou Mieux)-এর কাছে। তারপর প্যারিস থেকে এক সেট উপকরণ সংগ্রহ করে শান্তিনিকেতনে নিয়ে এসে বাটিক শিক্ষার কর্মশালার তিনি উদ্যোগ নিচ্ছেন। পরবর্তীকালে শান্তিনিকেতনের বাটিকের যে এত জনপ্রিয়তা তার মূলেও ছিলেন– এই নিভৃতচারিণী প্রতিমা দেবী।
প্যারিস থেকে প্রতিমা দেবী আধুনিক পদ্ধতির ফ্রেসকোর কাজ শিখে এসেছিলেন। সুশোভন অধিকারী জানাচ্ছেন, ‘ইউরোপীয় পদ্ধতির সঙ্গে জয়পুর পদ্ধতির মিশ্রণে, ক্রমে কলাভবনে ফ্রেশকো চিত্রের ঘরানা গড়ে উঠেছে। দেখা যাচ্ছে বাটিক শিল্পের মতো শান্তিনিকেতন ভিত্তিচিত্রের ইতিহাসের নেপথ্যেও রয়ে গেছে এই প্রতিমার প্রচ্ছন্ন ভূমিকা।’
আন্দ্রে কার্পেলেসের মতো নিপুণ কারু ও চারুশিল্পীর সঙ্গে সখ্য প্রতিমার কর্মকাণ্ডকে শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতনের কাজে প্রসারিত করেছিল। তাঁর কাছেই প্রতিমা পটারির কাজ শেখেন। শান্তিনিকেতনের কারুসংঘে তিনি তা নিয়মিত চর্চা করতেন, এবং শ্রীনিকেতনে রথীন্দ্রনাথ ও তাঁর আগ্রহে পটারি শিল্পশিক্ষা ও চর্চা শুরু হয়। কারুশিল্প ও চারুশিল্পের মিলনের যে কাজ শ্রীনিকেতনে শুরু হয়, তার ধাত্রী ও মাতৃ উভয়ই ছিলেন প্রতিমা দেবী। প্রতিমা দেবী লিখেছেন, ‘চারুশিল্প হল আর্টিস্টের নিজের জিনিস। সে কেবল চিত্রকরের নিজের আনন্দ থেকেই উদ্ভূত। আর কেউ তার সমঝদার থাক বা না থাক আর্টিস্টদের তাতে কিছু এসে যায় না।… কারুশিল্প সর্বসাধারণের শিল্প। তার উদ্দেশ্য অন্যরূপ। তার একটি প্রধান কাজ রুচি তৈরি করা। আর একটি হচ্ছে দৈনিক জীবনযাত্রার মধ্যে বৈচিত্র আনয়ন।
‘প্রতিমা এই দুইয়ের মধ্যে সার্থক সংযোগ তৈরি করে আশ্রমের তথা দেশের শিল্পের উন্নতি সাধন করেন। শান্তিনিকেতনের শিল্পচর্চা কীভাবে চারপাশের কারুশিল্প শিক্ষাদানকে প্রভাবিত করতে পারে তা নিয়ে বিশেষ ভাবনা ছিল তাঁর। নানাবিধ হস্তশিল্পের মধ্যে দিয়ে মেয়েরা সংসারধর্ম পালন করবে এবং তার মাধ্যমে স্বাধীনভাবে রোজগার করবে– এই ছিল প্রতিমার আকাঙ্ক্ষা বা উদ্দেশ্য। এই কারণেই তাঁরা পল্লি কারুকারী কেন্দ্র খুলেছিলেন। এখানে প্রণেত্রী প্রতিমা জানাচ্ছেন, বিশ্বভারতী শ্রীনিকেতনে পল্লী উন্নয়ন পরিকল্পনা অনুসারে যে সকল গ্রামে শিল্পশিক্ষা প্রচার হইতেছে, সেই সকল গ্রামের অপেক্ষাকৃত শিল্পকুশলী কয়েকজন ছাত্রী এই কারুকারী কেন্দ্রে যোগ দিয়া হাতের কাজের দ্বারা অর্থ উপার্জন করিতেছেন।… কারুকারী কেন্দ্রের মহিলাদের হস্তের কারুকার্য দিল্লি সরকারি এম্পোরিয়াম প্রভৃতি স্থানে আগ্রহের সহিত গৃহীত হইতেছে।’ সাধে কী আর রানী চন্দ তাঁকে বলেছেন ‘আশ্রমের কেন্দ্রস্থলে এক অধিষ্ঠাত্রী দেবী!’
শান্তিনিকেতন আশ্রমে রবীন্দ্রনাথের বাণীরূপের নৃত্যভাবনাকে প্রতিষ্ঠিত ও প্রসারিত করেছেন প্রতিমা দেবী। বলা যায় ‘রবীন্দ্রনৃত্য’ নামে আজ যে বিশেষ নৃত্যধারা প্রচলিত, তার প্রণেত্রী হলেন প্রতিমা। গুরুদেব যে গান-কাব্য -নাট্য তৈরি করেন, তার অভিনয় ও নৃত্য-কাঠামো প্রতিমা তৈরি করে দেন। ১৯১২ সালে লন্ডনে রাশিয়ান নৃত্যনাট্যে পাভলোভার নাচ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন প্রতিমা দেবী। শান্তিদেব ঘোষের লেখা থেকে জানতে পারি, ১৯৩০ সালে গুরুদেবের সঙ্গে প্রতিমা যখন ইউরোপে যান তখন এল্মহার্স্ট প্রতিষ্ঠিত ড্যার্টিংটন হল বিদ্যালয়ে প্রতিমা দেবী নৃত্যবিভাগের শিক্ষাপ্রণালী যথেষ্ট আগ্রহের সঙ্গে অনুশীলন করেছিলেন। জার্মানির সুবিখ্যাত নর্তক লাবাসের শিষ্য মিস্টার ইয়সের কাছে উপস্থিত থেকে ইউরোপীয় নৃত্যকলা সযত্নে অনুধাবন করেন। কোনও গল্পকে অবলম্বন করে কীভাবে তাকে সাজাতে হয়, তার সঙ্গে যন্ত্রসংগীত কীভাবে রচিত হয়, সেই সংগীতের সঙ্গে নর্তক ও নর্তকীদের নৃত্যাভিনয়ের জন্য তৈরি করেন– তার সবই ভালো করে দেখানোর সুযোগ তিনি সেখানে পেয়েছিলেন। এরপরই তিনি চিত্রাঙ্গদার জন্য নৃত্য ও মূকাভিনয়ের পরিকল্পনা তৈরি করতে থাকেন। রবীন্দ্রনাথ এতে উৎসাহী হয়ে গান রচনা করেন। ‘পরিশোধ’ কাব্যটিকে চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্যে সর্বাঙ্গ রূপ দেন। ১৯৩৫ সালে শান্তিনিকেতনে প্রতিমা দেবী পরিকল্পিত গুরুদেবের ‘সামান্য ক্ষতি’ কবিতার ভাব অবলম্বনে নৃত্যযুক্ত মূকাভিনয় দেখানো হয়। সেখানে স্নান করতে যাওয়ার দৃশ্যে জলক্রীড়ার নৃত্যভঙ্গিও দেখানো হয়।
যে-সমাজে মেয়েদের নাচ গর্হিত অপরাধ, সেখানে প্রতিমা তার হাল ধরেছেন। যেখানে ‘বাল্মিকীপ্রতিভা’ প্রভৃতি গীতিনাট্যে শুধুই অল্প হাত নাড়ানো হত, সেখানে প্রতিমা সাহসিনী হয়ে নৃত্য যুক্ত করলেন।
রবীন্দ্রনৃত্য নিয়ে প্রতিমার আগ্রহ, গবেষণার শেষ ছিল না। নানাবিধ মিশ্র নৃত্য নিয়ে তিনি রবীন্দ্রনৃত্যের সম্ভার সাজাতেন। সবকিছু করে কবিকে দেখাতেন এবং তাঁর অনুমোদন না পাওয়া পর্যন্ত সন্তুষ্ট থাকতেন না। প্রতিমা নিজে ছাত্রদের নাচের মুদ্রা দেখিয়ে দিতেন। স্বরলিপির মতো তিনি নাচের মুদ্রালিপি তৈরির কথাও ভাবতেন। ছাত্রীদের দিয়ে সেসব মুদ্রা লিখে রাখতেন। কলাভবনের ছাত্র-ছাত্রীদের দিয়ে মুদ্রাগুলি আঁকিয়েও রাখতেন। এমনকী, যাঁরা নাচতেন তাঁদের সাজসজ্জার ব্যাপারেও প্রতিমার নজর থাকত। রবীন্দ্রনাথ এইসব ব্যাপারে প্রতিমার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল ছিলেন। প্রতিমা মঞ্চে উঠতেন খুব কম, কিন্তু নেপথ্য থেকে সব কিছু পরিচালনা করতেন।
‘নৃত্য’, ‘নির্বাণ’, ‘চিত্রলেখা’ ও ‘স্মৃতিচিত্র’ নামে চারটি গ্রন্থ প্রতিমা দেবী রচনা করেন। নৃত্য সম্পর্কেও ভাবনার কথা আছে ‘নৃত্য’ গ্রন্থে, আর ‘চিত্রলেখা’য় আছে তাঁর লেখা কবিতা ও গল্প। ‘নির্বাণ’ বইয়ে আছে রবীন্দ্রনাথের নির্বাণলাভের অবিস্মরণীয় বর্ণনা এবং স্মৃতিচিত্রে জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের কথা অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে তিনি বলে গিয়েছেন।
শান্তিনিকেতনে প্রতিমা মহিলাদের নিজস্ব সংঘ ‘আলাপিনী’ মহিলা সমিতি তৈরি করলেন। তিনি যখন নববধূরূপে শান্তিনিকেতনে প্রবেশ করেন, তার কিছুদিন পর তাঁর উৎসাহে ও উদ্যোগে এই সমিতির কাজ আরম্ভ হয়। প্রতিমা এখানে মেয়েদের আনন্দমেলাও প্রবর্তন করেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি আলাপিনীর যুগ্ম সভানেত্রী ছিলেন।
উন্মুক্ত প্রান্তরবেষ্টিত জনবিরল প্রকৃতির কোলে শান্তিনিকেতনের আশ্রম গড়ে উঠেছিল, যাকে কেন্দ্র করে নতুন ধরনের শিক্ষাপ্রণালী ও পল্লি পুনর্গঠনকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের যে ভাবনাচিন্তা তথা পরীক্ষানিরীক্ষার বিপুল জাহাজ বয়ে চলছিল, তার হাল যাঁরা নিষ্ঠার সঙ্গে ধরে বসেছিলেন– বলা যায়, তাঁদের প্রধান ছিলেন আশ্রমলক্ষ্মী প্রতিমা। তিনি প্রচ্ছন্ন থেকে সমস্ত পরিচালনা করেছেন, একবিন্দু যশোপ্রার্থী হননি। শান্তিনিকেতনের আশ্রমে সবরকম মঙ্গল ও সৌন্দর্যের উপাসনায় তিনি নিজেকে নিবেদন করেছিলেন। তিনি আশ্রমের সঙ্গে এমন সহজভাবে মিশেছিলেন যে তাঁর ধী ও শ্রী নিয়ে সেভাবে আলোচনাও হয়নি। আমার ভাবনায় সর্বশ্রেষ্ঠ আশ্রমদুহিতা যদি কাউকে বলতে পারি, তবে তিনি নিঃসন্দেহে আশ্রমের সকলের বউঠান এই প্রতিমা দেবী।