চোখের কোন অংশ নাচছে, তাও আবার একটি জটিল বিষয়। অপ্রত্যাশিত লটারির টিকিটের মতো কখনও কখনও নেচে ওঠে ওপরের পাতা। আর নিচের পাতা নাচলে কান্নার দৃশ্য বা পকেট ফাঁকা হওয়ার ট্র্যাজেডি। দিনের সময় বা চন্দ্রপক্ষও কিন্তু এই নাটকের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। শুক্লপক্ষে কাঁপুনি যেন মা দুর্গার হাসির দৃশ্য, কৃষ্ণপক্ষে যেন গণেশের দুষ্টুমি ভরা সতর্কতা।
৯.
শ্যামবাজারের বাড়ির বারান্দায় বসেছিলেন বুবাইয়ের দিদা, হঠাৎ, বাঁ-চোখের পাতাটা নেচে উঠল! দিদিমা হাসেন, কী কারণ? ‘এ তো মা লক্ষ্মীর টেলিগ্রাম! তোর মনে হয় বিয়ের প্রস্তাব আসছে!’ বুবাই আকাশ থেকে পড়ল। আজ অফিসে অ্যাপ্রাইজাল জানার দিনে বিয়ের খোঁটাটা না দিলে হত না? ওর মাথায় নর্মালিই উল্টো প্রশ্নটা এল– ‘কিন্তু যদি ডান চোখ নাচে?’ দিদিমার মুখে মেঘের ছায়া, ‘সে তো অপয়ার ইঙ্গিত রে বাবু! শিগগির তাহলে কালীঘাটে গিয়ে পুজো দিয়ে আসতে হবে!’ বুবাই নাছোড়– ‘নাহলে কী হবে?’ ‘বসের ঝাড় খাবি! আবার কি হবে? প্রোমোশনের বদলে ডিমোশনও হয়ে যেতে পারে।’ এই পয়া-অপয়ার ক্লাসের ফলে যেটা হল, বুবাই বেচারা অফিস যাওয়ার গোটা রাস্তাটা, খালি খেয়াল করে গেল ওর কোন চোখটা নাচছে। আদৌ কি নাচছে?
চোখের নাচন তো শুধু পেশির ক্ষুদ্র নাচ নয়– এ হল মহাবিশ্বের নিজস্ব ছবির ট্রেলার, যেখানে দেবতারা ক্যামেরা ধরেন, আর আমরা সবাই অভিনেতা, কখনও হাসি, কখনও কাঁদি আর বাকি সময় দিন গুনি লাভ-ক্ষতির। এই নাচনের ইতিহাস, সভতার এক কৌতুক নাটক, যেখানে শুভ আর অশুভ শকুনও একই তালে নাচে। চোখের পাতা হয়ে ওঠে ভাগ্যের স্ক্রিন। শকুন শাস্ত্র বলে, চোখের এই নাচের অর্থ মূলত লিঙ্গ আর কোন চোখ কাঁপছে তার উপর নির্ভর করে।
ছেলেদের যখন ডান চোখ কেঁপে ওঠে, সে বলে, ‘অফিসে বোনাস পাবি, পান্তুয়া কিনে ফেল!’ এটি সাফল্যের ঢাক বাজায়– হয়তো চাকরিতে পদোন্নতি, ব্যবসায় লাভ বা দিদিমার পছন্দের নাতবৌয়ের সম্বন্ধ। বাঙালিবাবু তখন হাসেন, যেন দুর্গাপূজার প্যান্ডেলে মা দুর্গা তাকে উৎসবের টিকিট দিয়েছেন।
বাঁ-চোখ কেঁপে উঠলে, দুর্ভাগ্যের টিজার– হয়তো বসের ঝাড়, পকেটে টান, বা শ্বশুরবাড়ির ঝগড়া। বুবাইয়ের দিদিমা তখন আশ্বাস দিয়ে বলেন, ‘শিবের নাম নে, আর একটা রসগোল্লা খা, মন ভালো হয়ে যাবে!’ তবু মন কি আর ভাল হওয়ার পাত্র? হাসির মাঝেও একটা অপয়া ভয়ের টনটনে ব্যাথা জানান দিতে থাকে।
মেয়েদের বাঁ-চোখ কেঁপে উঠলে আবার মা লক্ষ্মী হেসে বলেন, ‘তোর জন্য শাড়ির দোকানে সেল চলছে!’ এটি সমৃদ্ধির কমেডি– বিবাহের প্রস্তাব, পুনর্মিলন, বা দূরের মামার কাছ থেকে উপহার। কিন্তু ডান চোখ কেঁপে উঠলে, কোনও ভিলেন পর্দায় ঢুকে পড়ে। এটি মানসিক অশান্তি, পারিবারিক ঝঞ্ঝাট বা দুঃসংবাদের ছায়া। মা হয়তো তখন মেয়েকে বলেন, ‘মা কালীর পূজা কর, আর একটু মিষ্টি দই খা, সব ঠিক হয়ে যাবে!’ এই কৌতুকের মাঝে এ হল নিষ্পাপ একটা ভারতীয় সেন্টিমেন্ট।
চোখের কোন অংশ নাচছে, তাও আবার একটি জটিল বিষয়। অপ্রত্যাশিত লটারির টিকিটের মতো কখনও কখনও নেচে ওঠে ওপরের পাতা। আর নিচের পাতা নাচলে কান্নার দৃশ্য বা পকেট ফাঁকা হওয়ার ট্র্যাজেডি। দিনের সময় বা চন্দ্রপক্ষও কিন্তু এই নাটকের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। শুক্লপক্ষে কাঁপুনি যেন মা দুর্গার হাসির দৃশ্য, কৃষ্ণপক্ষে যেন গণেশের দুষ্টুমি ভরা সতর্কতা।
মাওবাদী সরকার আসার অনেক আগে চিনের তাওবাদী পাহাড়ে, বাঁ-চোখ কাঁপলে এটি ধন, অতিথি বা সৌভাগ্যের ক্লু রেখে যেত। কিন্তু ডান চোখ কাঁপলে কোনও ড্রাগন ধোঁয়া ছেড়ে বলত, ‘সাবধান, তিব্বতিদের স্বাধীনতার বাপবাপান্ত করতে, লামাদের আছড়ে আছড়ে কচুকাটা করতে একদিন জন্মাবে এক মহামানব, মাও জে দং!’
এক তাইওয়ানি নারী তার লটারি জেতাকে বাঁ-চোখের কাঁপুনির কৃতিত্ব দিয়েছিলেন, যেন মহাবিশ্ব তাকে একটা জ্যাকপটের ইমোজি পাঠিয়েছে। সে সব জানতে পেরেই জি পিং তাইওয়ানকেও তিব্বতি সবক শেখানোর জন্য মনস্থির করেছেন কি না কে জানে?
প্রাচীন রোমে, চোখের কাঁপুনি ছিল জুপিটারের হাসির। যেকোনও চোখ কাঁপলে রোমানরা ভাবত, ‘বুঝি ব্যবসায় লাভ, বা প্রেমের চিঠি আসছে!’ অশুভ ব্যাখ্যা ছিল বিরল, রোমানরা হয়তো বলত, ‘আরে, সবটাতে এত নেগেটিভ ভাবিস না, ওয়াইন খা, জীবন বাঁচ, কেয়া পাতা কাল হো না হো!’
আফ্রিকার গ্রামে, চোখের ওপরের পাতা নাচলে পূর্বপুরুষের ভূত এসে বলে, ‘অতিথি আসছে, মিষ্টি তৈরি কর!’ নিচের পাতা কাঁপলে, সর্বনাশের মাথায় বাড়ি! ক্যারিবিয়ানে, ত্রিনিদাদের ‘চোখ নাচা’ ডানে সুসংবাদ, বামে গসিপের কমেডি।
হাওয়াইয়ের সমুদ্রতীরে, ডান চোখ কাঁপলে একটি শিশুর জন্মের হাসি শোনা যায়, বাঁ-চোখ কাঁপলে হয়তো অপরিচিতের আগমন বা ক্ষতির ছায়া। এই গল্পগুলো, অনেকটা শকুনের কৌতুকের সমান্তরাল, তবু মানুষের হৃদয়ের সর্বজনীন স্ক্রিপ্ট।
চোখের কাঁপুনির শকুন যেন একটি প্রাচীন বটগাছ, যার ডালপালা আধুনিক মনের ইনস্টাগ্রাম রিল অবধি বিস্তৃত। শকুন শাস্ত্রে, এই কাঁপুনি ছিল মহাবিশ্বের কোড, যেখানে ঠাকুমার গল্প আর পঞ্চাঙ্গের পাতা জীবনের দিশা দেয়। চোখের নাচন তাই একটি লাইভ কমেডি শো। কলকাতার কফিশপে হয়তো এক তরুণী হাসে, ‘বাঁ-চোখ নাচছে, বুঝি নতুন প্রেম হবে!’ গ্রামের কৃষক বলেন, ‘ডান চোখ নাচছে, এবার বুঝি বাজারে মাছের দাম কমবে!’ আর সমাজমাধ্যমে নেটিজেনরা লিখবে, ‘চোখ কাঁপছে, কী হবে? হ্যাশট্যাগ সুপারস্টিশন!’
চিকিৎসাবিজ্ঞান বলে, চোখের কাঁপুনি হল পেশির এক ক্ষুদ্র কৌতুক– স্ট্রেস, ক্লান্তি, নির্ঘুম বা এক কাপ বেশি কফির দোষ। কখনও কখনও, অবিরাম কাঁপুনি ডাক্তারের দরজায় পৌঁছে দেয়। প্রেসক্রিপশন বলে, ‘আরে, এটা কোনও শকুন নয়, ম্যাগনেসিয়াম খা!’ কিন্তু গড়পরতা মানুষের মনে, বিজ্ঞান কখনও কখনও একটা বিরক্তিকর ক্রিটিক, যে মাঝেমধ্যে এসে বলে, ‘এ তো শুধু ফিজিওলজিকাল ট্রিক!’ যদিও যখন ডান চোখ কেঁপে ওঠে, মা বলেন না, ‘এটা স্ট্রেস!’ তিনি বলেন, ‘বিষ্ণু ঠাকুরের আশীর্বাদ, পূজার থালা সাজা!’ বিজ্ঞান যদিও হাসতে হাসতে বলে, ‘আরে, এ তো শুধু পেশির নাচ!’ তবু, মানুষের হৃদয় বলে, ‘নাচ হলেও, এটা ভাগ্যের নাচ!’
চোখের নাচন– কখনও কমেডি, কখনও ট্র্যাজেডি, কিন্তু সবসময় হৃদয়ের ছোঁয়া। এটি রামায়ণের সীতার বাম চোখের হাসি, কালীঘাটের পটচিত্রে দেবীর দুষ্টু দৃষ্টি। শুভ শকুন যেমন দুর্গাপুজোর ধুনুচির ধোঁয়া। অশুভ শকুন যখন উড়ে আসে তখন সে বর্ষার জলভরা গলি। চিন, রোম, বা ক্যারিবিয়ান যেখানেই চোখ নাচুক না কেন, তার গল্প কৌতুকের সমান্তরাল। কিন্তু ভাগ্যের নামে জীবন চালায় যারা তাদের জন্য, এটি একটি সিরিয়াস ব্যাপার, নির্ভেজাল পয়া আর অপয়ার গল্প।
আপনারও চোখ কি কাঁপছে? কোন পাতা, কোন চোখ? কোন কমেডি শুনতে চান? নাকি আইড্রপই ভরসা?
……………..অপয়ার ছন্দ অন্যান্য পর্ব……………..
পর্ব ৮। জুতো উল্টো অবস্থায় আবিষ্কার হলে অনেক বাড়িতেই রক্ষে নেই!
পর্ব ৭। জগৎ-সংসার অন্ধ করা ভালোবাসার ম্যাজিক অপয়া কেন হবে!
পর্ব ৬। প্রেম সেই ম্যাজিক, যেখানে পিছুডাক অপয়া নয়
পর্ব ৫। ডানা ভাঙা একটি শালিখ হৃদয়ের দাবি রাখো
পর্ব ৪। জন্মগত দুর্দশা যাদের নিত্যসঙ্গী, ভাঙা আয়নায় ভাগ্যবদল তাদের কাছে বিলাসিতা
পর্ব ৩। পশ্চিম যা বলে বলুক, আমাদের দেশে ১৩ কিন্তু মৃত্যু নয়, বরং জীবনের কথা বলে
পর্ব ২। শনি ঠাকুর কি মেহনতি জনতার দেবতা?
পর্ব ১। পান্নার মতো চোখ, কান্নার মতো নরম, একা
সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের পর থেকে সে-দেশের প্রাক্তন ও বর্তমান রাষ্ট্রনেতা ও জননেতা, গুপ্তচর বিভাগের প্রাক্তন প্রধান, এককালের মার্কসীয় তাত্ত্বিক ও পার্টি নেতাদের মধ্যে স্মৃতিকথা লেখা ধুম পড়ে যায়। বিশেষত ১৯৯১ সালের আগস্টের ঘটনার পর।