সল্টলেক-পার্কস্ট্রিটের ভুঁইফোঁড় ‘বার’-এ বসে কখনও লতা মঙ্গেশকর যে বিলের পিছনে গান লেখেননি। ‘চাংওয়া’-য় লিখেছেন! দু’শো টাকা ট্যাক্সিভাড়া না-দিতে পেরে আটক হওয়া শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে (পকেটে পরে পাঁচশো পাওয়া গিয়েছিল, যা তিনি রেখেছিলেন মদ্যপান করবেন বলে। কিন্তু ট্যাক্সিভাড়া পরের পয়সায় দেবেন ঠিক করেছিলেন!) ছাড়াতে চাঁদা তোলার সরস গল্পও বন্ধুদের সুনীলবাবু বলেছিলেন ‘চাংওয়া’-য় বসে! পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় গান লিখেছেন এখানে। তরুণ কুমার-সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়রা এককালে নিত্য আসতেন লাঞ্চ করতে।
৩.
কেবিন বস্তুটি, আমাদের আটের দশকের ছেলেপিলের কাছে অনেকটা আলেয়ার মতো। একটা হাতছানি, একটা চৌখুপি ঘর, তেলচিটে পর্দার ফাঁক, হুট করে বড় হয়ে যাওয়ার পাসওয়ার্ড।
আমার বড় হওয়া, বাড়াবাড়ি, সমস্ত গড়িয়ায়। তা, গড়িয়ার ছ’নম্বর বাসস্ট্যান্ডের গায়ে একখানা রেস্তোরাঁ ছিল। নাম আজ ভুলে গিয়েছি। কিন্তু তার অন্দরমহলে কেবিনের সার, মনে আছে চমৎকার। বয়ঃসন্ধির ফি বিকেলবেলা আরও জনা দুই অলপ্পেয়েকে নিয়ে উপস্থিত হতাম যে! নাহ্, ভেতরে প্রবেশের সাহস হত না। কিংবা বলা ভালো, উপায় হত না। আরে ভায়া, পর্দার গোপনীয়তায় যেতে গেলে গোপন-সঙ্গীনী লাগে! প্যাঁকাটির সিক্স প্যাক আর শিঙি মাছের ঝোল সাঁটিয়ে ও সমস্ত জোটে না। তবে আমরা দস্তুরমতো পাহারা দিতাম, রেস্তোরাঁর বাইরে তদারকি করতাম, একদম যাকে বলে ইংরেজ আমলের ‘ছা-ও-খি-ডা-র’! তিন দু’গুণে ছ’জোড়া চোখ ঠায় তাকিয়ে থাকত আমাদের। জুলজুলে দৃষ্টিতে, এক বুক ব্যাকুলতা নিয়ে, হাইস্কুলের দাদা-দিদিদের আগমন পথের দিকে। হাতে হাত ধরে যারা হারিয়ে যেত সেই চৌখুপি ঘরে, পর্দার অন্তরালে, একান্ত আপন এক সময়কে সঙ্গী করে। আর আমরা, ভবঘুরের দল, রাশি-রাশি দীর্ঘশ্বাস ফেলে, বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বাড়িয়ে, সন্ধে শেষে উপলব্ধি করতাম, কেবিনই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাসরঘর! ভালোবাসার সবচেয়ে ভালো ‘বাসা’!
যে ভালোবাসার নাম কখনও নারী। কখনও সুরা।
দ্বিতীয়টা বুঝেছি, পরে। অনেক পরে। মধ্য তিরিশে। ‘চাংওয়া’-য় ঢুকে।
লেখক সুস্নাত চৌধুরী ‘শুঁড়ির সাক্ষী’ বইয়ে লিখে গিয়েছেন যে, বাস্তব আর স্বপ্নের ঠিক মাঝখানে যে ফাঁকা ইজিচেয়ার আপনার জন্য অপেক্ষা করে, তা পানশালা। আলবাত। পানশালার অর্থ হল গিয়ে, ঝিলমিল হাওয়া। বৃষ্টির টুপটাপ। শীতের আলোয়ান। নেশাকাতুরের শান্তিনিকেতন! মুশকিল হল, সেখানে সবসময় যে দু’টো ‘সিক্সটি এমএল’ নিয়ে জমিদারি আয়েশ করবেন, এ শহরে তার বিশেষ উপায় নেই। অধিকাংশ ‘বার’-ই ‘দিওয়ান-ই-খাস’। খোলা। টানা বসার জায়গা। টেবিলের পাশে টেবিল। তার পাশে ফের টেবিল! হাজারো লোকের হ্যা-হ্যা-হি-হি-হো-হো। বেয়ারাদের ফালতু গজল্লা। ম্যানেজারবাবুর হাঁকডাক। রামোঃ! কী জানেন, সঙ্গে আপনি যাকে নিয়েই বসুন– বেলা বোস বা বাকার্ডি হোয়াইট– নিভৃত একটা স্থান লাগে, নিজের দু’টো কথা বলতে। ১২০ বছরের অশীতিপর ‘চাংওয়া’কে সেখানে হারাবে কে?
অশীতিপর, ‘চাংওয়া’ অশীতিপরই! যার টকটকে লাল কাঠের দরজা ঠেলে ঢুকলে, এক লহমায় এক শতক পিছিয়ে যাওয়া যায়।
প্রথমেই টিমটিমে বার কাউন্টার। ভেতরের মরা আলোয় মরমে আরও মরে আছে! বার কাউন্টারের লাগোয়া দেওয়ালে তিনটে বস্তু দোদুল্যমান। একখানি লাল কোট (বোধহয় কোনও কর্মচারীর)। আর দু’টো ছবি। যার একটা চিনে সায়েবের। উনিই প্রতিষ্ঠাতা। কিন্তু ভদ্রলোকের নাম নিয়ে বিস্তর মতানৈক্য। ডানদিকের অঞ্চলটা ফাঁকা, ঊষরভূমি প্রায়। ওখানেই নাকি প্রখ্যাত যোগেন চৌধুরী বসে ছবি এঁকেছিলেন। যার নিলাম হয়েছিল। খবরের কাগজে বেরিয়েছিল সে খবর। মাঝখানের জায়গাটা টানা বারান্দার মতো। বিষুবরেখার কায়দায় অজান্তে ‘বার’-কে দু’ভাগে ভাগ করে দিয়েছে । সেখানে সচরাচর বসেন উকিলপাড়ার কালো কোট কিংবা অফিস ফেরতরা। তার দু’পাশে সেই বিখ্যাত কেবিনের দল! এ পাশে দশ। ও পাশে দশ।
শেষের কবিতা। হঠাৎ নীরার জন্য। বনলতা সেন। প্রথম প্রেম। নেশা।
নাম, এ সমস্ত নাম! ‘চাংওয়া’র কুড়িটা কেবিনের গোটা পাঁচেকের নাম! যার কোথাও রবীন্দ্রনাথ, কোথাও সুনীল, কোথাও জীবনানন্দ। শুধু কুড়িখানা নামের মধ্যে সাযুজ্য এক, ভাষাও এক।
ভালোবাসা!
লেখার তাড়নাতেই গত সপ্তাহে গিয়েছিলাম ‘চাংওয়া’। পাকড়াও করেছিলাম এক বর্ষীয়ান মুরুব্বিকে। অবসরের পরেও যাঁর বছর পাঁচেক হয়ে গিয়েছে। তা, তিনি আবার সোৎসাহে নিয়ে গেলেন যাঁর কাছে, সে ভদ্রলোক ‘চাংওয়া’র সিধু জ্যাঠা! ঘোলাটে চোখ। নাম সম্পদ ঘোষ। যাঁর সম্পদ এখন বিস্মৃত স্মৃতি! চাকরির বয়সের গাছ-পাথর নেই। ভদ্রলোক আজ আর মনে করতে পারেন না, ‘চাংওয়া’য় কাজ করছেন কবে থেকে? উৎসাহী সাংবাদিকের প্রশ্নে বিরক্তও হন ঈষৎ। যখন জিজ্ঞাসা করি, কেন, ‘বার’-এর মধ্যে আপনাদের কেবিন কেন? এ জিনিস আর কোথাও তো দেখিনি!
–‘অতশত জানি না বাপু। এখন কিছু মনে নেই আমার।’
–‘ঠিক আছে। এমনি দু’-একটা ঘটনা বলুন না। কিছুই মনে নেই নাকি?’
–‘কী শুনবেন? জানেন, চাংওয়া থেকে উত্তমকুমারের জন্য স্যুপ যেত! জানেন, এখানে ভি বালসারার শেষ জন্মদিন পালন হয়েছে! জানেন, এখানে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কবিতা পাঠের আসর বসাতেন?’
–‘সুনীল আসতেন শুনেছি। শক্তি চট্টোপাধ্যায় তো বোধহয় চাংওয়া বেশি আসতেন না। ডিউকে যেতেন বেশি।’
–‘কে বলেছে?’
–‘ডিউকে গিয়েই শুনেছি।’
‘হুঁ’ বলে গুম মেরে যান ভদ্রলোক। আঁতে লাগে বুঝি! পাশ থেকে আর একজন সামাল দেন। শুনিয়ে রাখেন, দুয়ার এঁটে সকালে ঘুমিয়ে থাকার সময়, ‘চাংওয়া’-র কড়া নেড়ে যেতেন শক্তি! কিন্তু তার পরেও সম্পদবাবুর ঘোলাটে দু’চোখে হেরে যাওয়ার ভাষা এড়িয়ে যাওয়া যায় না। শুনলাম, মালিকপক্ষের ব্যবসাপাতি নিয়ে বিশেষ গা নেই। তাঁরা আসেন কালেভদ্রে। দীক্ষাগ্রহণ করে নাকি ব্যবসায়িক লাভ-ক্ষতির ঊর্ধ্বে চলে গিয়েছেন। যা দেখার, কর্মচারীরাই দেখেন। এবং তাঁরা মেনেও নেন, সাত বা আটের দশকে ‘চাংওয়া’ যেমন ডিসট্যান্ট এক নম্বর ছিল, আজ আর নেই। তা সে যতই ‘চাংওয়া’র চিলি পর্ক সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের অতীব প্রিয় হোক না কেন। তা সে যতই চিলি চিকেন উইথ বোনের সঙ্গে হুইস্কিতে চুমুক, স্বর্গীয় লাগুক না কেন। তা সে যতই বার কাউন্টার থেকে বোতল নিয়ে এসে খরিদ্দারের সামনে ‘পেগ’ ঢালার ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য থাকুক না কেন।
‘চাংওয়া’র বিখ্যাত কেবিন আজ প্রকৃতার্থেই “আঙ্কল গন’স কেবিন”! সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-সহ পুরাতন আনন্দবাজারের গ্রুপটা পূর্বে যেখানে বসতেন, বহুদিন উৎকট গানবাজনার জিম্মায় ছেড়ে দিতে হয়েছে সে জায়গাটা। ইদানীং তো রেস্তোরাঁ রিভিউয়েও দশ জনের মধ্যে পাঁচ জন মন্দ লেখে!
কিন্তু তারপরেও দু’টো অবিনশ্বর শব্দ থাকে। ‘আভিজাত্য’ আর ‘বনেদিয়ানা’। ‘জলসাঘর’-এর বিশ্বম্ভর রায়ের মতো! সল্টলেক বা পার্কস্ট্রিটের পানশালার নামে গজিয়ে ওঠা ‘ফড়ে’-দের গালে যা সজোর দুটো থাপ্পড় কষিয়ে দেয়! আহা, আভিজাত্যের সঙ্গে কখনও পাঞ্জায় পেরেছে নাকি অর্থ? বনেদিয়ানার সঙ্গে লড়ার হিম্মতও বা দেখিয়েছে কোন পালোয়ান? উত্তর কলকাতার রোয়াক আর দক্ষিণের দুর্মূল্য ফ্ল্যাটবাড়ির চিলতে বারান্দা এক হল?
কী করা যাবে, সল্টলেক-পার্কস্ট্রিটের ভুঁইফোঁড় ‘বার’-এ বসে কখনও লতা মঙ্গেশকর যে বিলের পিছনে গান লেখেননি। ‘চাংওয়া’-য় লিখেছেন! দুশো টাকা ট্যাক্সিভাড়া না-দিতে পেরে আটক হওয়া শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে (পকেটে পরে ৫০০ পাওয়া গিয়েছিল, যা তিনি রেখেছিলেন মদ্যপান করবেন বলে। কিন্তু ট্যাক্সিভাড়া পরের পয়সায় দেবেন ঠিক করেছিলেন!) ছাড়াতে চাঁদা তোলার সরস গল্পও বন্ধুদের সুনীলবাবু বলেছিলেন ‘চাংওয়া’-য় বসে!
পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় গান লিখেছেন এখানে। তরুণ কুমার-সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়রা এককালে নিত্য আসতেন লাঞ্চ করতে। লেখকরা (যাঁদের মধ্যে শ্রদ্ধেয় রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় একজন) এখনও আসেন ‘চাংওয়া’-য়। লেখালেখি করেন। নিয়মিত সিনেমার স্ক্রিপ্ট পড়া চলে। দাম নেই তার? মূল্য নেই এ-সমস্তের? দর নেই সেই ম্যান্ডোলিন বাদকের– বহু যুগ আগে ঠিক যে জায়গায় যিনি নিজের প্রিয় বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন, সেখানে পরে ছবি এঁকে গিয়েছেন যোগেন ছবিওয়ালা!
মানুষ দাম দিলে দেবে। না-দিলে দেবে না। মনে রাখলে রাখবে। না-রাখলে রাখবে না। অসুবিধে নেই। কেউ জানে না আজ থেকে ১২০ বছর পর ‘চাংওয়া’ থাকবে কি না? থাকলেও হয়তো থেকে যাবে ‘শেষের কবিতা’ হয়ে, তারই এক কেবিনের নামের মতো! কিন্তু থাকবে যত দিন, মধ্যবিত্ত সুরা-সেবক ঠিকই খুঁজে নেবে ‘চাংওয়া’-কে। খুঁজে নেবে তার স্বল্প পরিসরের কেবিন-ঘরকে। ইতিহাসের ধুলোবালিতে কাশির দমক চেপে সে বসবে দু’দণ্ড। দু’কোটি টাকার স্বপ্ন দেখতে দেখতে অর্ডার করবে ২০০ টাকার ব্লেন্ডার্স প্রাইডের পেগ। নেশার ঘোরে ভুলবশত ছুঁয়ে ফেলবে প্রিয়তমার ঠোঁট!
…………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………….
আর শেষে, সবশেষে সে টেনে নেবে পাশে রাখা ছাইদান। পকেট থেকে টেনে বের করবে সিগারেট। পরের পর ধোঁয়ার ‘রিং’ ছেড়ে ভাববে– এক ঘণ্টার জন্য হলেও আজ আমিই মহানায়ক, আমিই উত্তমকুমার!
চিত্রগ্রাহক: কৌশিক দত্ত
… পড়ুন বারবেলা-র অন্যান্য পর্ব…
২. মহীনের ঘোড়াগুলির প্রথম ‘আস্তাবল’ ডিউক
১. তেতাল্লিশের মন্বন্তরে ‘বার’ থেকে ‘রেশন সেন্টার’ হয়ে উঠেছিল ব্রডওয়ে