আমাদের বসতে হত একটা কাঠের ব্লকে আর তার সামনে একটা ত্যারছা স্ট্যান্ড, যার ওপরে থাকত নিজেদের হাতে লেখা অ্যানাউন্সমেন্টয়ের কাগজ, যতটা পারি না দেখে বলার চেষ্টা করতাম, তবে কাগজ একটা সামনে অবশ্যই থাকত, থাকাটা জরুরিও ছিল, কিছু ভুলে গেলে দেখে বলতে পারব তাই। একদিন ঘোষণা করতে করতে কাগজটা গেল পড়ে, আমি তো প্রমাদ গুনছি, এমন সময় দেখি স্বপন প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে ক্যামেরার তলা দিয়ে সন্তর্পণে এসে আমার হাতে কাগজটা ধরিয়ে দিল। আমার চোখ ক্যামেরার দিকে, বলেও চলেছি কথা কিন্তু আড়চোখে কাণ্ডটা দেখে হাসি পায়।
৪.
‘নমস্কার। কলকাতা টেলিভিশনের শুভ উদ্বোধনের মুহূর্তে আমাদের সাদর সম্ভাষণ গ্রহণ করুন’– এই ভাবে শর্মিষ্ঠাদির ঘোষণায় শুরু হয়েছিল প্রথম দিন ৯ অগাস্ট।
তারপর বছর এগোল।
‘দূরদর্শন’ শব্দটি আমরা প্রথম বলতে শুরু করলাম ১৯৭৬ থেকে, যখন সারা ভারতের টেলিভিশন চ্যানেলে এই নাম কার্যকর হল। তখন থেকে আমরা অধিবেশন শুরু করতাম এইভাবে, ‘নমস্কার। দূরদর্শন কেন্দ্র কলকাতা। আমাদের অধিবেশন প্রচলিত হচ্ছে ব্যান্ড ১ চ্যানেল ৪-এ।’ আমরা, অ্যানাউন্সাররা স্ক্রিনে আসার আগে সিগনেচার ইমেজ (signature image) অর্থাৎ ‘সত্যম্ শিবম্ সুন্দরম্’ এর যে ছবিটা ঘুরে ঘুরে আসত আর সিগনেচার টিউন (signature tune) অর্থাৎ ওই ছবির সঙ্গে সঙ্গে পণ্ডিত রবিশঙ্করের করা সেই বিখ্যাত সুর রোল করা হত। এখনও সেই সুর স্বপ্নের মধ্যে কখনও ভেসে আসে, যেন এক্ষুনি স্ট্যান্ড বাই হতে হবে। টার্মগুলোর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল সেই এক বছর আগের ১৪ জুলাই রেকর্ডিং-এর দিন, ‘silence on the floor’, ‘stand by’, ‘10 to 1 count down’, ‘que’, তারপরেই ‘tele-light on’ হলেই নমস্কার করে কথা বলা শুরু। পরিচয় হলে হবে কী, ধাতস্থ হতে সময় লেগেছে স্টুডিও ফ্লোরের রীতিনীতির সঙ্গে।
ফ্লোর ম্যানেজারদের মধ্যে ধ্রুব মিত্রের কথা আমি আগেই বলেছি। আমার প্রথম রেকর্ডিংয়ের দিন যেমন উনি ছিলেন, তেমনই ছিলেন ৯ অগাস্ট শুরুর দিনেও। ছিল আদিত্য সর্বাধিকারী, স্বপন পাঁজা, পরে যোগ দিয়েছিলেন সারনাথ ভট্টাচার্য। এক-এক জনের ধরন এক-এক রকম। সারনাথদাকে ফ্লোরে কখনও বসতে দেখিনি, সব সময় দাঁড়িয়ে থাকতেন। আদিত্য আমাদের অর্থাৎ অ্যানাউন্সার এবং নিউজরিডারদের কিউ ইত্যাদি দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে পুরনো ‘que sheet’ (ট্রান্সমিশনের বিষয়ে বিস্তারিত যার মধ্যে লেখা থাকে, এটা দেখেই আমরা নিজেদের অ্যানাউন্সমেন্ট লিখতাম) এর পিছনের সাদা পাতায় বসে বসে কবিতা লিখত, ছবি আঁকত।
স্বপন পাঁজার কিউ দেওয়াটাই খুব উচ্চকিত, মজা লাগত ওর ঝাঁকড়া চুল নেড়ে কথা বলার ভঙ্গী। ওর কথা বলতে গিয়ে দুটো ঘটনা মনে পড়ল, যদিও সেগুলো অনেক পরের কথা, তাও এখানেই বলি। আমাদের বসতে হত একটা কাঠের ব্লকে আর তার সামনে একটা ত্যারছা স্ট্যান্ড, যার ওপরে থাকত নিজেদের হাতে লেখা অ্যানাউন্সমেন্টয়ের কাগজ, যতটা পারি না দেখে বলার চেষ্টা করতাম, তবে কাগজ একটা সামনে অবশ্যই থাকত, থাকাটা জরুরিও ছিল, কিছু ভুলে গেলে দেখে বলতে পারব তাই। একদিন ঘোষণা করতে করতে কাগজটা গেল পড়ে, আমি তো প্রমাদ গুনছি, এমন সময় দেখি স্বপন প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে ক্যামেরার তলা দিয়ে সন্তর্পণে এসে আমার হাতে কাগজটা ধরিয়ে দিল। আমার চোখ ক্যামেরার দিকে, বলেও চলেছি কথা কিন্তু আড়চোখে কাণ্ডটা দেখে হাসি পায়। আমিও সে যাত্রা বেঁচে যাই ভুলভাল বলার থেকে।
…………………………………………………..
‘দূরদর্শন‘ শব্দটি আমরা প্রথম বলতে শুরু করলাম ১৯৭৬ থেকে, যখন সারা ভারতের টেলিভিশন চ্যানেলে এই নাম কার্যকর হল। তখন থেকে আমরা অধিবেশন শুরু করতাম এইভাবে, ‘নমস্কার। দূরদর্শন কেন্দ্র কলকাতা। আমাদের অধিবেশন প্রচলিত হচ্ছে ব্যান্ড ১ চ্যানেল ৪-এ।’ আমরা, অ্যানাউন্সাররা স্ক্রিনে আসার আগে সিগনেচার ইমেজ (signature image) অর্থাৎ ‘সত্যম্ শিবম্ সুন্দরম্’ এর যে ছবিটা ঘুরে ঘুরে আসত আর সিগনেচার টিউন (signature tune) অর্থাৎ ওই ছবির সঙ্গে সঙ্গে পণ্ডিত রবিশঙ্করের করা সেই বিখ্যাত সুর রোল করা হত। এখনও সেই সুর স্বপ্নের মধ্যে কখনও ভেসে আসে, যেন এক্ষুনি স্ট্যান্ড বাই হতে হবে।
…………………………………………………..
আরেকবারের কথা। ‘চিচিং ফাঁক’-এ মাসে একদিন বসত মাইকেলের আসর। ওইটুকু স্টুডিও, তার মধ্যে ২০-৩০টা বাচ্চা, তার পাশে প্রবীর বসেছে তার কথা বলা পুতুল মাইকেলকে নিয়ে। ট্রান্সমিশন শুরু হলেই আমার ঘোষণা, তারপরে ৬টা বেজে ৩২ মিনিটে ‘চিচিং ফাঁক’। হঠাৎ একটা বাচ্চা কেঁদে উঠল, তাকে থামানো যায় না, স্বপন পাঁজার ঝাঁকড়া চুল দেখে সে আরও ভয় পাচ্ছে, এদিকে সময় হয়ে যাচ্ছে, কী খেয়াল হল আমার ঝোলা ব্যাগে লজেন্স জাতীয় কিছু থাকতে পারে, তখন আমার লো-প্রেসার ছিল তাই সঙ্গে রাখতাম, ব্যাগ হাতড়ে সেটা খুঁজে পেয়েই ছুড়ে দিই বাচ্চাটার দিকে, ততক্ষণে সিগনেচার ইমেজ রোল করছে, লজেন্স পেয়ে বাচ্চাটা এবার চুপ, আমিও হাত তুলে নমস্কার করে বলি ‘নমস্কার দূরদর্শন কেন্দ্র কলকাতা’।
অল্প বয়সি কয়েকটি ছেলে ছিল ফ্লোর অ্যাসিস্ট্যান্ট। সবাই যথেষ্ট তৎপর। এবার বলব আমার ক্যামেরাম্যান বন্ধুদের কথা। বয়সে আমার চেয়ে সবাই অনেক বড়, তবু বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। সবচেয়ে বড় সুব্রতদা, সুব্রত কর– ৯ অগাস্ট উদ্বোধনের দিনের যে সাদা-কালো ফুটেজ দেখা যায়, সেখানে দাড়িওলা যে ক্যামেরাম্যানকে দেখতে পাওয়া যায় তিনিই সুব্রতদা। আমার প্রথম দিনের রেকর্ডিংয়ে যে তিনজনকে পেয়েছিলাম উনি তাঁদের একজন। পরবর্তীকালে আমার পরিচালিত দু’টি তথ্যচিত্রের ক্যামেরা করেছিলেন তিনি। শাক্যসিংহ ধর, সবাই ‘ধর’ বলে ডাকত, যে গুটি কয়েক লোক ওকে ডাকনামে ডাকত আমিও তাদের মধ্যে শামিল হলাম। ডাকনাম ‘পান্না’। ও ক্রমশ আমাদের পারিবারিক বন্ধু হয়ে উঠল। পাহাড়ী, বনবিহারী পাহাড়ী, মোটাসোটা, হাসিখুশি, মুখের মধ্যে একরাশ সারল্য। পাহাড়ী আর পান্না দূরদর্শনে আসার আগে একসঙ্গে সম্ভবত ফিল্মস ডিভিশনে কাজ করেছে, সেই সময় থেকে পাহাড়ীকে ‘মামু’ বলে ডাকত, কেন তা জানি না কিন্তু আমিও তাই বলে ডাকতে শুরু করলাম, কিছুদিনের মধ্যে আমরা ‘তুই’-তে চলে এলাম। ছিলেন বেণুদা, বেণু সেন, ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি থেকে এসে যোগ দিয়েছিলেন এখানে, দীনেন গুপ্তকে ক্যামেরায় অ্যাসিস্ট করতেন। হয়তো অনেকেই জানেন বা জানেন না, পরিচালনায় আসার আগে দীনেন গুপ্ত ক্যামেরাম্যান ছিলেন। লুইস আর রণবীর ভট্টাচার্য ছিল জুনিয়রদের মধ্যে।
……………………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার.ইন
……………………………………………………..
এছাড়াও অনেকে ছিলেন যাঁরা মূলত আউটডোর কভারেজ করতেন, তপন গুহঠাকুরতা, বিমান সিনহা, রণজিৎ রায় ও আরও অনেকে। এঁদের সবার বস ছিলেন অবিনাশজি, তবে তাঁকে ক্যামেরা ধরতে খুবই কম দেখেছি, প্রয়োজন পড়লে ফ্লোরে এসে শট নিতেন আমাদের।
অনেকক্ষণ ফ্লোরে আটকে আছি, এবার বেরতে হবে।
……………………………. পড়ুন কেয়ার অফ দূরদর্শন-এর অন্যান্য পর্ব …………………………….
পর্ব ৩: অডিশনের দিনই শাঁওলী মিত্রের সাক্ষাৎকার নিতে হয়েছিল শাশ্বতীকে!
পর্ব ২: স্টুডিওর প্রবল আলোয় বর্ষার গান গেয়ে অন্ধকার নামিয়ে ছিলেন নীলিমা সেন
পর্ব ১: খবর পেলাম, কলকাতায় টেলিভিশন আসছে রাধা ফিল্ম স্টুডিওতে
২০২৪ সালে সাহিত্যে নোবেল পেলেন কোরিয়ান সাহিত্যিক হান কাং। অস্তিত্বের অতীন্দ্রিয় অস্বস্তি ধরা পড়ে তাঁর লেখায়। উত্তরাধুনিক সমাজে আমাদের প্রত্যেকেরই বুকের ভিতর রক্তক্ষরণ চলছে অবিরত। আমরা চেপে যাচ্ছি রোজ। লোকলজ্জার ভয়ে, মানহানির ভয়, গড্ডলিকা প্রবাহের বিপরীতে একা হওয়ার ভয়ে। কাং সেসব টেনে খুলে ফেলেন।