মৃণাল সেনের ‘ইন্টারভিউ’ সিনেমায় মিঠু দুধের ডিপোয় কাজ করে। চান করে কপালে সিঁদুরের টিপ আর চোখে কাজল দিয়ে বিনুনি বাঁধতে বাঁধতে সে মাকে তাড়া দেয়, ভাইয়ের জন্য চা করে দিতে বলে। মা বলে, দেরি হলে কী আর হবে। যা সব কাণ্ডকারখানা চলছে, সে হয়তো গিয়ে দেখবে দুধের গাড়িই আসেনি। পরের শটেই অবশ্য দেখা যায় ‘কলকাতা দুগ্ধ সরবরাহ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার’ লেখা গাড়ি এগিয়ে আসছে। মিঠু কার্ড মিলিয়ে দুধের বোতল এগিয়ে দেয় ক্রেতাদের।
অন্বেষা সেনগুপ্ত
সীমন্তিনী মুখোপাধ্যায়
সুপূর্ণা ব্যানার্জি
১২.
‘কলিকাতা শহরে স্ত্রীলোকেরা নানা প্রকার ব্যবসা ও চাকরীতে নিযুক্ত হইতে পারে। তাহাতে গ্রাসাচ্ছদনের উপযুক্ত অর্থ উপার্জ্জন করা যায়।… পানওয়ালী, মেস বোর্ডিং বা গৃহস্থ বাড়ীর ঝি চাকরাণী, বাজারের মাছ তরকারী ফল মূল প্রভৃতি বিক্রয়কারিণী, রাঁধুনী, কারখানার মজুরনী, মশলা ঝাড়াই বাছাইওয়ালী, থিয়েটারের অভিনেত্রী, কীর্ত্তনওয়ালী, শুশ্রূষাকারিণী, সঙ্গীত-শিক্ষয়িত্রী, প্রসবকারিণী দাই, মেয়ে ডাক্তার, রেলের টিকিট অফিসে ও টেলিফোনের মেয়ে-কেরাণী– ইহারা সকলেই স্বীয় জীবীকা নির্ব্বাহের উপযুক্ত অর্থ উপার্জ্জন করিতে পারে…।’
শিক্ষিতা পতিতার আত্মচরিত, মানদা দেবী, ১৯২৭
‘চৌকাঠ পেরিয়ে’ সিরিজে আমরা এত দিন যেসব মেয়ের কথা বলেছি, তাঁরা প্রত্যেকেই সংগঠিত ক্ষেত্রে চাকরি করতেন বা যুক্ত ছিলেন অন্যান্য ‘সম্মানজনক’ পেশায়। ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত বিখ্যাত ‘টুওয়ার্ডস ইক্যুয়ালিটি’ রিপোর্টে এঁদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল ‘সার্ভিসেস অ্যান্ড প্রফেশনস’-এর আওতায়। আমরা বলেছি টেলিফোন অপারেটর, টাইপিস্ট, নার্স, ডাক্তার, শিক্ষিকা, পুলিশ, সাংবাদিক, সেলসগার্ল, ব্যাঙ্ক-কর্মী, প্রতিরক্ষা বিভাগের কর্মী আর সমাজকল্যাণ দফতরে চাকরি করা মেয়েদের কথা। বলাই বাহুল্য, ‘সার্ভিসেস অ্যান্ড প্রফেশনস’ আওতায় শুধু এঁরাই পড়তেন না। আজ বলব যাঁরা বাদ থেকে গিয়েছেন, তাঁদের কারও কারও কথা।
বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে পাশ করা প্রথম মহিলা ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন ইলা ঘোষ, পরে যিনি হন ইলা মজুমদার। ১২ বছরে সাইকেল আর ১৬ বছর বয়সে জিপ চালাতে শিখে ইলা পাড়ায় ডানপিটে মেয়ে হিসেবে নাম কিনেছিলেন। ১৯৪৭ সালে যখন বি ই কলেজের দরজা খুলে যায় মেয়েদের জন্য, তখন সেখানে পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হন ইলা আর একজন মেয়ে। দ্বিতীয় বর্ষে অবশ্য পড়া ছেড়ে দেন ইলার সহপাঠিনী। ৮০০-র বেশি ছেলে-পড়ুয়ার মাঝে তিনি একা মেয়ে। ১৯৫১ সালে মেকিনিকাল ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে বেরিয়ে দেরাদুনে যান চাকরি নিয়ে। এর পর দিল্লি পলিটেকনিকে শিক্ষকতার চাকরি নেন এবং অল্প দিনের মধ্যেই দু’টি বই লেখেন। তারপর বিয়ে এবং কলকাতায় ফেরা। ইনসটিউট অব জুট টেকনোলজিতে যোগ দেন এবং পরে গড়িয়াহাট রোডের উইমেনস পলিটেকনিকে প্রিন্সিপাল হিসাবে কাজ করেন। ইলা মজুমদার বলতেন, ‘মেয়ে হিসাবে বৈষম্যের মুখে পড়েছি বইকি! সিলেকশন বা প্রোমোশনের ক্ষেত্রে ঠুনকো অজুহাত দিয়ে মেয়েদের যোগ্য স্থান দেওয়া হয় না, দেখে কষ্ট হয়।’
শিক্ষাক্ষেত্রে কৃতী মহিলাদের নিয়ে লিখতে গিয়ে ১৯৫৩ সালে ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় বেলা দে লিখেছেন, ‘বাংলা দেশে তো বাঙালি মেয়ে পুলিশের মতোই প্রায় বাঙালি মেয়ে ইঞ্জিনিয়ার দেখবার জিনিস।’ সেদিনের সেই কলামেই ‘নিজের কথা’ লিখেছেন কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার মঞ্জুষা বসু (১৯ জুলাই)। তিনি লিখছেন, ‘অত্যন্ত সাধারণ ঘরের বাঙালি মেয়ে হয়েও আমরা কোনও কাজে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মেয়েদের থেকে পিছিয়ে থাকব না এটা প্রমাণ করবারও প্রবল বাসনা ছিল।’ আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, এমনকী, কলেজের অধ্যাপকরাও তাঁর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সিদ্ধান্তে জল ঢেলে দিতে চান। বলেন, ওতে ভীষণ পরিশ্রম করতে হয়, যা মেয়েদের উপযুক্ত নয়। ওসব মনগড়া কথায় পাত্তা না দিয়ে তিনি কেমিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে ভর্তি হন। মঞ্জুষা লিখছেন, একা মেয়ে বলেই সহপাঠী ও অধ্যাপকদের অকুণ্ঠ সাহায্য পেয়েছিলেন। তবে পড়াশোনা শেষ করে চাকরিতে ঢোকা সহজ ছিল না। সেসব বাধাও তাঁকে দমিয়ে ফেলতে পারেনি। সিন্দ্রি ফার্টিলাইজার অ্যান্ড কেমিকাল লিমিটেড-এ সম্মানের সঙ্গে চাকরি করেন মঞ্জুষা। ১৯৫১ সালের সেনসাসে দেখছি কলকাতা শিল্পাঞ্চলে পুরুষ ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন ৪,৪৫১ জন। মহিলা ইঞ্জিনিয়ার ১২৭ জন। আজও দেশে ইঞ্জিনিয়ারদের মধ্যে মোটে তিন শতাংশ মেয়ে। প্রযুক্তিক্ষেত্র পুরোটা ধরলে অনুপাতটা একটু বেড়ে দাঁড়ায় ১২ শতাংশে।
ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পেশার মতোই প্রশাসনিক চাকরিতেও মেয়েরা বরাবরই সংখ্যায় কম। ১৯৬৭-র ব্যাচের মহিলা আইএএস মঞ্জুলা গুপ্ত ছিলেন বেঙ্গল ক্যাডারের গোড়ার দিককার মহিলা অফিসার। রমা মজুমদার, রানু ঘোষ ছিলেন তাঁর সমসাময়িক। লীনা চক্রবর্তী বা কস্তুরী গুপ্ত মেনন এঁদের জুনিয়র ছিলেন।
১৯২৭ সালেই মানদা দেবী বলছেন রেলের টিকিট অফিসের মেয়েদের কথা। ১৯৫৮র ১৩ জুন হাওড়া স্টেশনে হারিয়ে গিয়েছিল ১৬ বছরের কনক মুখার্জী। খবরে প্রকাশ হাওড়া স্টেশনের মহিলা টিকিট চেকারেরা তাকে উদ্ধার করেন (আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৬ জুন, ১৯৫৮)। ১৯৫১ সালের সেনসাস অনুযায়ী, কলকাতা শিল্পাঞ্চলে তখন রেলে কাজ করতেন ৩৩৭ জন মেয়ে। গত শতাব্দীর আটের দশকের গোড়ায় স্টেশনে ঘোষকের কাজে মেয়েদের নিযুক্ত করে রেল কতৃপক্ষ।
আইনের পেশায় মেয়েদের উপস্থিতি আজও লক্ষণীয়ভাবে কম। বছরখানেক আগে চিফ জাস্টিস ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় বলেন, একটা সময় ছিল যখন সুপ্রিম কোর্ট বা হাই কোর্টে প্র্যাক্টিস করতেন হাতে গোনা কয়েক জন মেয়ে। আজ তেমন মেয়েদের সংখ্যা অনেকটা বাড়লেও বার অ্যাসোশিয়েশনগুলি যেন ‘ওল্ড বয়েজ ক্লাব’-এর মতোই রয়ে গিয়েছে। রেজিনা গুহ, সুধাংশুবালা হাজরা আর কর্নেলিয়া সোরাবজির ভীষণ লড়াইয়ের ফলে ঔপনিবেশিক আমলে এদেশের মেয়ে আইনজীবীরা আদালতে মামলা লড়ার অধিকার পান। সেই অধিকার কতখানি বুঝে নিলেন উত্তরকন্যারা? এ প্রশ্নের উত্তর খুব আশাব্যঞ্জক মনে হয় না যখন ১৯৫১ সালের সেনসাসে দেখি কলকাতা শিল্পাঞ্চলে মেয়ে উকিলের সংখ্যা ছিল মোটে ৫৫, পুরুষ উকিল যেখানে ৫,০৭৬ জন। ২০২২-এর একটি রিপোর্টে দেখি, আইনের পেশায় যুক্ত মানুষের ১৫ শতাংশ মহিলা। মহিলা বিচারকের সংখ্যা আজও কম। ১৯৭৪ সালের টুওয়ার্ডস ইক্যুয়ালিটি রিপোর্টে দেখছি দেশে মাত্র একজন মহিলা হাইকোর্টের বিচারপতি হয়েছিলেন।
জীবনবীমা কোম্পানির এজেন্ট হিসাবেও কাজ করতেন বাঙালি মেয়েরা। সে সময়ের কাগজে তেমন বিজ্ঞাপনও পাওয়া যায়। ১৯৫১ সালে কলকাতা শিল্পাঞ্চলে বীমাক্ষেত্রে কর্মরতার সংখ্যা ৬৩, পুরুষ কর্মী সেখানে ৬,৯৩৫ জন।
এছাড়া আর একটি পেশায় মেয়েদের, বিশেষত উদ্বাস্তু মেয়েদের দেখা মিলত। তা হল দুধের ডিপোর কাজ। মৃণাল সেনের ‘ইন্টারভিউ’ সিনেমায় মিঠু দুধের ডিপোয় কাজ করে। চান করে কপালে সিঁদুরের টিপ আর চোখে কাজল দিয়ে বিনুনি বাঁধতে বাঁধতে সে মাকে তাড়া দেয়, ভাইয়ের জন্য চা করে দিতে বলে। মা বলে, দেরি হলে কী আর হবে। যা সব কাণ্ডকারখানা চলছে, সে হয়তো গিয়ে দেখবে দুধের গাড়িই আসেনি। পরের শটেই অবশ্য দেখা যায় ‘কলকাতা দুগ্ধ সরবরাহ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার’ লেখা গাড়ি এগিয়ে আসছে।
মিঠু কার্ড মিলিয়ে দুধের বোতল এগিয়ে দেয় ক্রেতাদের। দুধের ডিপোয় তার মতো অনেক উদ্বাস্তু মেয়ের কাজ মিলেছিল। কলকাতা শিল্পাঞ্চলে ১৯৫১ সালে ভোজ্য তেল এবং দুগ্ধজাত খাদ্যের ব্যবসায় কাজ করতেন ৫২৫ জন মেয়ে।
১৯৫৮ সালের আনন্দবাজার পত্রিকায় দেখছি, ‘পৌরসভার অল্ডারম্যান শ্রীমতী প্রতিমা বসু এম এ’ রেডক্রস সোসাইটির একটি দুগ্ধ বিতরণ কেন্দ্র পরিদর্শন করতে গিয়েছেন (৬ জানুয়ারি)।
এঁদের বাইরেও সে সময়ে বাঙালি ঘরের বহু মেয়ে ছিলেন যাঁরা চাকরি খুঁজেও পাননি বা সংগঠিত ক্ষেত্রে কাজের অভাবে অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ খুঁজে নিয়েছিলেন। কেউ বা শখ আর রোজগার মেলাতে চেয়েছিলেন সেলাই, গান বা অভিনয়ের মাধ্যমে। তাঁদের কথা পরের কিস্তিতে।
তথ্যসূত্র
Census of India 1951 Volume VI–Part IV, The Calcutta Industrial Region Tables
First female engineer alumnus of BEC passes away. https://alltogether.swe.org/2024/06/inwed-women-engineers-in-india/
The current status and path forwars of women engineers in India https://alltogether.swe.org/2024/06/inwed-women-engineers-in-india/
https://www.millenniumpost.in/former-ias-officer-manjula-gupta-passes-away-at-72-176928
এক একটা আশ্রম হচ্ছে এক একটা ক্ষেত্র। প্রতিটি ক্ষেত্রের একটা সাধনশক্তি থাকে। আশ্রমের যৌথ জীবনযাপন আসলে সৎসঙ্গের মতো। আমরা বলি, স্বাধিষ্ঠানে আমাদের আধ্যাত্মিক অগ্নি থাকে, স্বাধিষ্ঠান হচ্ছে নাভি থেকে চার আঙুল নীচে, যদি এই স্থান খুলে না যায়, তাহলে তার পক্ষে আধ্যাত্মিক জীবনে এগিয়ে যাওয়া কঠিন।