Robbar

স্বল্পখ্যাত কিংবা পারিবারিক পত্রিকা ছাড়া মহিলা সাংবাদিকরা ব্রাত্য ছিলেন দীর্ঘকাল

Published by: Robbar Digital
  • Posted:May 29, 2025 2:40 pm
  • Updated:May 29, 2025 8:27 pm  
choukath periye episode 9। Robbar

সাংবাদিকতা বিভাগের নিয়ম ছিল, ডিপ্লোমা কোর্স চলাকালীন ছাত্রদের কোনও সংবাদসংস্থায় শিক্ষানবিশ হিসাবে হাতেকলমে কাজ শিখতে হবে। আলপনা ঘোষের কথায়, ছেলেদের সেই কাজ চটপট জুটে যেত। মেয়েরা কেউ কেউ পারিবারিক খবরের কাগজে কাজ করতেন। তবে সেই শিক্ষানবিশি জোগাড় করতে কালঘাম ছুটে গিয়েছিল আলপনা আর রত্না (সেন)-এর। আনন্দবাজার পত্রিকার সন্তোষকুমার ঘোষ রুক্ষভাবে জানিয়েছিলেন তাঁর অপারগতার কথা। তাঁর দফতরে মহিলা কর্মীদের জন্য আলাদা শৌচালয় নেই। তা ছাড়া মেয়েদের কাজে নিয়ে পুরুষ সাংবাদিককুলের চিত্তচাঞ্চল্য ঘটানোর মতো দুর্বিপাক সামলানোর ক্ষমতা তাঁর নেই। 

অন্বেষা সেনগুপ্ত

সীমন্তিনী মুখোপাধ্যায়

সুপূর্ণা ব্যানার্জি

৯.

‘আমাদের দেশে এখনও পূরাপূরি সাংবাদিকরূপে কোনও নারী দেখা দেননি, যদিও সাহিত্য পত্র ও সাময়িক পত্র পরিচালনায় এবং বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত রচনা প্রকাশে অগ্রণী হয়েছেন শিক্ষিত নারী সমাজের বৃহৎ একটি অংশ এবং তা হয়েছেন বেশ কিছুদিন আগে থেকেই। বিশুদ্ধ সংবাদপত্রের কাজে দায়িত্ব ও গুরুত্ব বেশি বলেই হোক, আর সংবাদপত্রের কাজ দিবারাত্রি অবিচ্ছিন্ন ভাবে চলে বলেই হোক, মহিলা সমাজ নিজেরাও এই মুল্লুকটির দিকে পা বাড়াতে সাহসী হননি, পরিচালকরাও তাঁদের ভেতর থেকে কর্মী নির্বাচনে উৎসাহী হননি।’

মেয়েদের সাংবাদিকতা, পারুল ঘোষ,  যুগান্তর, ২৫ জুন, ১৯৫০  

অবলাবান্ধব, বামাবোধিনী, হেমলতা, বঙ্গবালা, সাবিত্রী– ব্রিটিশ আমলে স্ত্রীশিক্ষার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের জন্য এমন অনেক পত্রিকা চালু হয়। সেসব পত্রিকার উদ্দেশ্য মূলত মেয়েদের নীতিশিক্ষাদান। সম্পাদক মশাইয়েরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুরুষ, ‘মহিলাদের রচনা’ নামের বিশেষ বিভাগে মেয়েদের লেখা ছাপা হত। মেয়েদের সম্পাদিত পত্রিকাও ছিল, যেমন বঙ্গমহিলা, হিন্দুললনা, অনাথিনী, পরিচারিকা। তবে পারুল ঘোষ যাঁকে ‘পূরাপূরি সাংবাদিক’ বলেছেন, বাংলায় তেমন মেয়ের দেখা পাওয়া মেলে এর অনেক বছর পরে। আমরা দেখেছি, পড়ানো, নার্সিং, টাইপ-শর্টহ্যান্ড বা কেরানিগিরির কাজে দলে দলে বাঙালি মেয়েরা যোগ দিতে শুরু করেন দেশভাগের পরে। তবে মূল ধারার সাংবাদিকতায় মেয়েদের ঢোকাটা ছিল আরও অনেক কঠিন। সে সময়ের সিনেমা-সাহিত্যেও তাই ‘পূরাপূরি সাংবাদিক’ মেয়ে চোখে পড়ে না। ১৯৬৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘নায়ক’ ছবির মিস সেনগুপ্তা (শর্মিলা ঠাকুর) মেয়েদের স্বল্পখ্যাত পত্রিকা ‘আধুনিকা’র সম্পাদক। ১৯৭২-এর ‘মেমসাহেব’-এ উত্তমকুমার নিজেই সাংবাদিক। খুব খুঁটিয়ে দেখেও তাঁর কাগজের অফিসে কোনও মেয়ে চোখে পড়ে না, একজন টেলিফোন অপারেটর ছাড়া।

‘নায়ক’ ছবির একটি দৃশ্য

সেই নারী-বিবর্জিত পথে হাঁটার জেদ আর সাহস দেখিয়েছিলেন প্রথম যে মহিলা, এই রাজ্যেই ছিল তাঁর কর্মক্ষেত্র। স্কুল-শেষের পরীক্ষায় প্রথম হয়ে বিদ্যা কানুনগো ডাক্তারি পড়ার উদ্দেশ্যে ১৯৩৮ সালে পাড়ি দেন বিলেতে। সেখানে বামপন্থী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে ডাক্তারি পড়ায় ইতি টানেন। ঠিক করেন সাংবাদিকতা করবেন, তা-ও আবার তদন্তমূলক সাংবাদিকতা বা ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম। ইংল্যান্ড থেকে কলকাতায় ফিরে ভূগোলের অধ্যাপক সুনীল মুন্সীকে বিয়ে করে তিনি হন বিদ্যা মুন্সী। সুনীল তখন ‘দ্য স্টুডেন্ট’ নামের একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন। এই পত্রিকার কাজ করতে করতেই বিদ্যা নিজেকে প্রস্তুত করেন মূল ধারার সাংবাদিকতার জন্য। হঠাৎ ‘চলার পথে’ নামের একটি বাংলা পত্রিকা সম্পাদনা করার দায়িত্ব পেয়ে জন্মসূত্রে গুজরাতি বিদ্যা চটপট বাংলা লিখতে পড়তে শিখে নেন। ১৯৫২ সালে যোগ দেন ‘ব্লিৎজ উইকলি’ পত্রিকায়, কাজ করেন দশ বছর। দু’জন ক্যানেডিয়ান পাইলট সুন্দরবনের এক প্রত্যন্ত গ্রামে চোরাই সোনা ফেলে আকাশপথে পালিয়ে যাচ্ছিল। সেই সোনা তারপর ছোট ছোট নৌকা করে নদীপথে চোরাচালান হয়ে চলে আসত কলকাতায়। সেই খবরটি ‘ব্রেক’ করে চতুর্দিকে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন বিদ্যা। রানিগঞ্জের চিনাকুড়ি কয়লাখনিতে মর্মান্তিক এক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন ১৮৩ জন শ্রমিক। সেই খবরের খুঁটিনাটি বিবরণ লিখেছিলেন বিদ্যা। এই ঘটনা নিয়েই ‘অঙ্গার’ নাটকটি রচনা করেন উৎপল দত্ত।

বিদ্যা মুন্সী (ডানদিকে), এস্থার কুপার (বাঁদিকে)

মেয়েদের পক্ষে কলকাতার কাগজের অফিসের সিংহদরজা পেরোনো বোধহয় ছিল আরও কঠিন। ব্যতিক্রম যে একেবারে ছিল না, তা নয়। ১৯৫০ সালের যুগান্তর পত্রিকায় দেখছি একটি অর্থনৈতিক কাগজের জন্য মহিলা সাংবাদিক চাওয়া হচ্ছে বিজ্ঞাপন দিয়ে (২১ জুন)।  তবে কাগজটির নাম নেই, এবং নির্বাচিত মেয়েটিকে শেষমেশ ‘পূরাপূরি সাংবাদিক’ হওয়ার সুযোগ কতখানি দেওয়া হয়েছিল, তা-ও জানার কোনও উপায় নেই। পথ যে ছিল অতি বন্ধুর, তা জানান দেয় আলপনা ঘোষের স্মৃতিচারণা। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আশির আলপনা আমাদের বলেন, ছোটবেলা থেকেই তিনি সাংবাদিক হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। তাই পরিবারের আপত্তি সত্ত্বেও ১৯৬৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতায় পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমার ক্লাসে ভর্তি হন। দ্বারভাঙা বিল্ডিংয়ের দোতলার ক্লাসরুমে মেয়েদের তুলনায় ছেলেরা সংখ্যায় অনেক বেশি হলেও মেয়েদের যে একেবারেই দেখা যেত না, তা কিন্তু নয়। শকুন্তলা দাশগুপ্ত, রত্না ভট্টাচার্য, রত্না সেন, বাচ্চি কাঙা ছিলেন তাঁর সহপাঠিনী। এই বাচ্চিই পরে বাচ্চি কারকারিয়া নামে বিখ্যাত হন সাংবাদিক হিসাবে। ক্লাসের মেয়েদের অনেকেরই বাবা-কাকারা সাংবাদিক, যাঁদের প্রতি মুগ্ধতাই এই পেশার প্রতি তাঁদের টানের উৎস।

বাচ্চি কারকারিয়া

সাংবাদিকতা বিভাগের নিয়ম ছিল, ডিপ্লোমা কোর্স চলাকালীন ছাত্রদের কোনও সংবাদসংস্থায় শিক্ষানবিশ হিসাবে হাতেকলমে কাজ শিখতে হবে। আলপনার কথায়, ছেলেদের সেই কাজ চটপট জুটে যেত। মেয়েরা কেউ কেউ পারিবারিক খবরের কাগজে কাজ করতেন। তবে সেই শিক্ষানবিশি জোগাড় করতে কালঘাম ছুটে গিয়েছিল আলপনা আর রত্না (সেন)-এর। আনন্দবাজার পত্রিকার সন্তোষকুমার ঘোষ রুক্ষভাবে জানিয়েছিলেন তাঁর অপারগতার কথা। তাঁর দফতরে মহিলা কর্মীদের জন্য আলাদা শৌচালয় নেই। তা ছাড়া মেয়েদের কাজে নিয়ে পুরুষ সাংবাদিককুলের চিত্তচাঞ্চল্য ঘটানোর মতো দুর্বিপাক সামলানোর ক্ষমতা তাঁর নেই। এর পরে আরও অনেক খবরের কাগজের অফিসের দরজায় দরজায় ঘুরে হা-ক্লান্ত হয়ে শেষে আলপনা ঢুকলেন দৈনিক বসুমতীতে আর রত্না ইউএনআই-তে।

রোজ দুপুর বারোটা নাগাদ দশ নম্বর বাসে চেপে বসুমতীর অফিসে যেতেন। কাজ সেরেই ছুটতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্ধ্য ক্লাসে। বসুমতীর দুই সাংবাদিক অধীর চক্রবতী আর কুমুদ দাশগুপ্ত আলপনাকে প্রভূত উৎসাহ দিতেন। মহাকরণ, বিধানসভা সর্বত্রই গিয়েছেন আলপনা, তবে বেশিরভাগ সময়ে সঙ্গে কোনও পুরুষ সহকর্মীকে পাঠানো হত।

আলপনার বিশেষ ভাবে মনে আছে একটি অ্যাসাইনমেন্টের কথা। পৌষমেলার সময়ে বিশ্বভারতীর সমাবর্তন উৎসব। আচার্য হিসাবে আসবেন ইন্দিরা গান্ধী। বসুমতীর প্রবীণ সাংবাদিক কুমুদ দাশগুপ্তের সঙ্গে সেই ঘটনা কভার করতে যাওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আলপনাকে। উৎসাহে টগবগ করতে করতে বাড়িতে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বিভিন্ন কাগজের এক দল সাংবাদিকের সঙ্গে ট্রেনে উঠলেন নির্দিষ্ট দিনে। তিনিই একমাত্র মহিলা, এবং বয়সে সবার চেয়ে ছোট। প্রায় সকলের কাছেই উষ্ণ ব্যবহার পেয়েছিলেন সেবার। মেলার মাঠে জিলিপি আর তেলেভাজা খাওয়া, উপহার আদানপ্রদানও হল। ঠিক ছিল মূল কপিটি লিখবেন কুমুদবাবু। আলপনা লিখবেন কালার কপি, মঞ্চে হাজির অতিথিদের কথা, মিসেস গান্ধীর ব্যক্তিত্ব, সৌন্দর্য আর পোশাকের কথা, মেলার ভিড়ের গল্প। সে কাজ অত্যন্ত সফল ভাবেই করেছিলেন তিনি।

শান্তিনিকেতনে একটি মজার অভিজ্ঞতার কথা মনে আছে তাঁর। হোটেলে রাখা খাবার নিজেদের বেড়ে নিয়ে খেতে হত তাঁদের । সেখানে একা মেয়ে তিনি, বাড়িতে সংসারের কোনও কাজ না করলেও সেদিন মনে হল সকলকে খাবার পরিবেশন করার গুরুদায়িত্বটি নিজের কাঁধে তুলে নেওয়া উচিত। ভাত বাড়তে গিয়ে চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে একাকার। দেখে টাইমস অফ ইন্ডিয়ার নামকরা সাংবাদিক শংকর ঘোষ এগিয়ে এলেন। মুচকি হেসে বললেন, ‘বোঝাই গেছে তুমি কত কাজের মেয়ে। এখন গিয়ে চুপটি করে বোস। আমিই বেড়ে দিচ্ছি সবাইকে।’ বয়সে পঁচিশ বছরের বড় এই শংকর ঘোষের সঙ্গেই পরে সুখী বিবাহিত জীবন কাটান আলপনা।

বসুমতীর সময়ের অভিজ্ঞতা সবটুকুই কি এমন অমলিন, ক্লেদহীন? শান্তিনিকেতন থেকে ফিরে তাঁর রিপোর্টিংয়ের প্রশংসায় ভাসতে ভাসতেই আলপনা দেখলেন অকারণে মেজাজ বিগড়ে থাকে তৎকালীন চিফ রিপোর্টারের। বাইরে রিপোর্টিং বন্ধ করে দিয়ে তাঁকে ডেস্কে বসিয়ে রাখতে লাগলেন। শুধু তা-ই নয়, তাঁর অসহযোগিতায় ক্লাসে যেতেও দেরি হয়ে যেত আলপনার। শান্তিনিকেতনে এক পুরুষ সাংবাদিকের অশিষ্ট ব্যবহারও বিব্রত করেছিল তাঁকে।

এর পর কালান্তরের চিফ রিপোর্টার চিত্তপ্রিয় রায় তাঁকে বলেন বসুমতী ছেড়ে কালান্তরে যোগ দিতে। বসুমতীতে বিনা মাইনের ট্রেনি ছিলেন, কালান্তর বেতন দেবে ১০০ টাকা। আলপনা তো এক কথায় রাজি। কালান্তরে এক বছর কাজ করেছেন, বহু গুরুত্বপূর্ণ অ্যাসাইনমেন্ট সামলেছেন মনের আনন্দে। কিন্তু এই তৃপ্তি দীর্ঘস্থায়ী হয় না। হঠাৎ জটিল এক অসুখে আক্রান্ত হন তিনি। বোঝেন ‘পূরাপূরি সাংবাদিকতা’র ধকল, বেয়াড়া রুটিন তাঁর শরীরে সইবে না। অতএব সাংবাদিকতার পাট চুকিয়ে সাউথ পয়েন্ট স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি নেন। পত্রপত্রিকায় লেখালেখির অভ্যাস অবশ্য ছাড়েননি। মজার কথা, যিনি এক সময়ে রান্নাবান্নার কিছুই জানতেন না, তিনিই লিখে ফেলেছেন একাধিক বহুপঠিত রান্নার বই।

আলপনা মাঝপথে কাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেও আজীবন ‘পূরাপূরি সাংবাদিক’-এর কাজ করেছেন স্বপ্না দেব। তাঁরও শিক্ষানবিশ সাংবাদিক হিসাবে হাতেখড়ি দৈনিক বসুমতী পত্রিকায়, বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়ের অধীনে। ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৭ এই দু’বছর তিনি সাংবাদিকতা করেন বসুমতীতে। পরবর্তী কালে তিনি প্রতিক্ষণে সাংবাদিক হিসাবে কাজ করেন। সম্পাদকের আসনে বসেও হলেও নিজের পরিচয় দিতে ভালবাসতেন ‘রাজনৈতিক প্রতিবেদক’ হিসাবে। শ্রীনগর উপত্যকা থেকে অন্ধ্রপ্রদেশের জঙ্গল, গণধর্ষিতা দলিত নারীদের গ্রাম পারারিয়া, অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির, গ্যাস দুর্ঘটনার ভোপাল, সমস্ত জায়গায় ঘুরে ঘুরে অসমসাহসিকতায় ‘খুঁড়ে এনেছেন’ খবর। যে সব বিপদসঙ্কুল জায়গায় আলোকচিত্রীরাও যেতে অস্বীকার করেছেন, খবরের টানে সে সব জায়গায় চলে গিয়েছেন একাই। তাঁর বই ‘খবর খোঁড়ার দিনলিপি’-তে রয়েছে সেই সব ঘটনার অসাধারণ বিবরণ। বইটির আরও অনেক মানুষের হাতে পৌঁছনো উচিত।

সে সময়ের সাংবাদিকতার মেয়েদের গল্পগুলো বেশিরভাগই হারিয়ে গেছে। ১৯৪৭-এর ঠিক পরপর নীলা দত্ত থাকতেন বিবেকানন্দ রোডের পিজি হোস্টেলে। তাঁর স্মৃতিকথামূলক বই ‘ছিন্নমূলের ডাইরি’-তে পাই সন্ধ্যা সেনের কথা। সন্ধ্যা ছিলেন দর্শনশাস্ত্রের ছাত্রী, গান, শিল্পকলায় দারুণ আগ্রহ। নীলা লিখছেন, ‘ওর (সন্ধ্যার) নাম তো বিভিন্ন কাগজে পরে প্রায়ই দেখতে পেতাম।’ এইটুকু বিবরণ থেকে অবশ্য বোঝা সম্ভব নয়, সন্ধ্যা ‘পূরাপূরি সাংবাদিক’ ছিলেন কি না।

This may contain: someone typing on an old fashioned typewriter with their hands in front of the keyboard
ছবিটি প্রতীকী

এর বেশ কয়েক বছর পরে বাংলায় ‘পূরাপূরি সাংবাদিক’ হয়েছিলেন অরুন্ধতী মুখোপাধ্যায়। ১৯৭২-’৭৩ সালে স্কুল শেষের মুখেই দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকায় চিঠি লিখে বিভিন্ন বিষয়ে নিজের মতামত জানাতেন অরুন্ধতী মুখোপাধ্যায়। স্বপ্ন দেখতেন সাংবাদিক হবেন। আকাশবাণীতে ইংরেজি ও বাংলা অডিও ফিচার লিখতে শুরু করেন এর পর। ১৯৭৮ সালে অমৃতবাজারে লেখা জমা দেন, সে লেখা ছাপাও হয়।  সে কাগজে নিয়মিত লিখতে শুরু করেন এবং কিছু দিন পর সেখানে চাকরি চান। নিউজ এডিটর প্রদীপ্ত সেন তাঁকে বলেন, অমৃতবাজারে মেয়েদের জন্য শৌচালয় নেই, তাই তাঁকে চাকরি দেওয়ার উপায় নেই। যেমন বলেছিলেন সন্তোষকুমার ঘোষ, এক যুগ আগে আলপনা ঘোষকে। হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ডের নিউজ এডিটর সৌরীন বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, কোম্পানির ম্যানেজমেন্টের নীতি মেয়েদের সাংবাদিকতায় প্রবেশাধিকার না দেওয়া। ১৯৮১ সালে গৌরকিশোর ঘোষ আজকাল পত্রিকায় তাঁকে সাংবাদিকের চাকরি দেন। জানতে চান, “আপনি কি নাইট ডিউটি করতে পারবেন?” ‘না’ বলার জন্য এ পেশায় ঢুকতে চাননি অরুন্ধতী। যদিও সেই নাইট ডিউটির কারণেই অনেক কটূক্তির মুখে পড়তে হয় তাঁকে। সমস্ত বাঁকা কথার জবাব তিনি দিয়েছেন তাঁর কাজের মাধ্যমে। খবর খুঁড়ে আনার কাজে তিনিও দিনে ষোলো থেকে আঠেরো ঘণ্টা পরিশ্রম করতেন। ওয়ারাঙ্গলে নকশালদের ঘাঁটি, ভিয়েতনামে হো চি মিনের শতবর্ষ পালনের উৎসব, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন বা পাকিস্তানের মহেঞ্জোদারো, সমস্ত জায়গায় গিয়েছেন রিপোর্টার হিসাবে।

অরুন্ধতীর কথায় জানা যায় সেকালের সাংবাদিকতায় আরও যেসব মেয়ে ছিলেন তাঁদের কথা। একজন বিমানবন্দরের মহিলা প্রতিবেদক ছিলেন। অন্য দু’জন মেয়ে রাইটার্স বিল্ডিংয়ের খবর সংগ্রহ করতেন। তিনি চান আজকের সাংবাদিক মেয়েরা গৌরকিশোর ঘোষের কাছে তাঁদের ঋণ স্বীকার করুন। বস্তুত, আজও সাংবাদিকতায় মেয়েদের সংখ্যা ছেলেদের তুলনায় কম, বিশেষত নেতৃত্বের আসনে। একটি হিসাব অনুযায়ী এ দেশে ২০২০ সালে ১০০ জন সাংবাদিকের মধ্যে মাত্র ১৪ জন মহিলা ছিলেন। কারণ হিসাবে উঠে আসে বেয়াড়া কাজের সময় এবং কাজের অতিরিক্ত চাপ। সংবাদসংস্থাগুলির তাই বেশি সংখ্যায় মেয়েদের নিতে অনীহা। মেয়েরাও অনেকে এই মুল্লুকটির দিকে পা বাড়াতে সাহস করেন না। যেমন লিখেছিলেন পারুল ঘোষ, ১৯৫০ সালে ‘যুগান্তর’ পত্রিকায়।

 

তথ্যসূত্র

‘Women’s presence in Indian journalism declining: Study’, Shemin Joy, Deccan Herald, 21 October, 2021 https://www.deccanherald.com/india/womens-presence-in-indian-journalism-declining-study-1042772.html 

অরুন্ধতী মুখার্জীর বক্তব্য, Josh Talks Bangla, https://youtu.be/qeanN8cCU-o?si=Kwehq4IxVj3r9x8V

 

… পড়ুন চৌকাঠ পেরিয়ে কলামের অন্যান্য পর্ব …

পর্ব ৮: অভিভাবকহীন উদ্বাস্তু মেয়েদের ‘চিরকালীন বোঝা’র তকমা দিয়েছিল সরকার

পর্ব ৭: মেয়েদের স্কুলের চাকরি প্রতিযোগিতা বেড়েছিল উদ্বাস্তুরা এদেশে আসার পর

 পর্ব ৬: স্বাধীনতার পর মহিলা পুলিশকে কেরানি হিসাবেই দেখা হত, সেই পরিস্থিতি কি আজ বদলেছে?

পর্ব ৫: প্রেম-বিবাহের গড়পড়তা কল্পকাহিনি নয়, বাস্তবের লেডি ডাক্তাররা স্বাধীনতার নিজস্ব ছন্দ পেয়েছিলেন

পর্ব ৪ : নার্সের ছদ্মবেশে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কেও যৌন হেনস্তার কবলে পড়তে হয়েছিল

পর্ব ৩ : উদ্বাস্তু মেয়েদের রোজগারের সুযোগ মিলেছিল টাইপ-শর্টহ্যান্ডের কাজে

পর্ব ২ : পিতৃতন্ত্রের কাঠামোয় কিছু ফাটল নিশ্চয়ই ধরিয়েছিলেন সে যুগের মহিলা টেলিফোন অপারেটররা

পর্ব ১ : দেশভাগের পর ‘চঞ্চল চক্ষুময়’ অফিসে চাকুরিরত মেয়েরা কীভাবে মানিয়ে নিলেন?