মিলার সপ্তপদীর প্রিমিয়ারে এসেছিলেন। তাঁকে মনে রেখেছিলেন সিনেমার প্রযোজক, পরিচালক, সুরকার– সবাই। মিলারের মনেও কি থেকে গিয়েছিলেন কেউ! প্রিমিয়ারে সুজি মিলার এসেছিলেন শাড়ি পরে। সুজি আর সুচিত্রার মিলনে সিনেমার পর্দায় উজ্জ্বল হয়ে ছিলেন রিনা ব্রাউন। বহু বক্ষ কাঁপিয়ে বেজে উঠেছিল ‘মেরি গো রাউন্ড’। সময় নেচে উঠছিল প্রাণোচ্ছল তরুণীর মতো।
২.
যতদিন প্রাণ আছে, গান আছে। আমার কাছে গান শুধুই সুর আর কথার কাঠামো নয়। অনেক অনেক গল্প থাকে এক-একটা গানের গভীরে। সেই সব গল্প, যাঁদের থেকে শুনেছি সেই গল্প– সব চোখের সামনে ভেসে ওঠে কোনও কোনও গান শুনলে। সেই মানুষগুলো হয়তো আজ নেই; গল্পগুলো আছে। থেকে যাবে তারা। ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’– খুব ভালো হয়। আচ্ছা, এই লাইনটা বললে কোন বাঙালির মনে আসবে না ‘সপ্তপদী’ ছবির কথা! এসব সাদা-কালো ছবি চিরকালের মতো রঙিন হয়ে আছে আমাদের মনে। কীসব প্রাণবন্ত দৃশ্য! ওই যে ‘মেরি গো রাউন্ড’ গানটি; কী অদ্ভুত সিকোয়েন্স! মনে পড়ে যায় কত কথা…
এই ‘মেরি গো রাউন্ড’ গান নিয়ে কত গল্প শুনেছিলাম টোপাদার মুখে। টোপা দার একটা ভালো নাম ছিল– অমর দত্ত। কিন্তু ‘টোপাদা’ নামটাই আমাদের মধ্যে অমর হয়ে গিয়েছে। পাঁচের বা ছয়ের দশকে এমন কোনও মিউজিশিয়ান ছিলেন না, যাঁকে টোপাদা চিনতেন না। এইসব মিউজিশিয়ানদের আত্মীয় ছিলেন সুরশ্রী অর্কেস্ট্রার অন্যতম কর্ণধার, রসিক মানুষ টোপাদা। সেই সময়কার সব বাংলা সিনেমায় চোখ রাখলেই সুরশ্রী অর্কেস্ট্রা আর অমর দত্তের নাম চোখে পড়বেই। টোপাদার মুখ থেকে টুপটাপ ঝরে পড়ত সে-সময়ের গান নিয়ে কত গল্প। আমি ভাগ্যবান, এমন মুগ্ধতার স্বাদ পেয়েছি অনেকবার।
‘মেরি গো রাউন্ড’ গানটা শুনলে, বিশ্বাস করুন, সুচিত্রা সেনের আগে আমার মনে পড়ে টোপাদার মুখ এবং অবশ্যই তার কাছে শোনো এ-গান নিয়ে টানটান গল্প। স্মৃতিরা স্বরলিপি খুলে বসে।
বিদেশি পাড়ার বারে গিয়ে তিনি যেমন স্বচ্ছন্দ, তেমনই স্টুডিওর রেকর্ডিং ফ্লোরেও। কল্পনা করুন তো– টোপাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরে ঢুকে পড়েছেন সাহেবপাড়ার কোনও হোটেলে। ওয়েটাররা অবাক-চোখে তাকিয়ে আছে। কেউ ভাবে উনি হয়তো কোনও বড় ব্যবসায়ী, কেউ ভাবে হয়তো গানের মাস্টারমশাই। আর টোপাদা হেসে বলছেন– ‘এক পাত্তর দাও দেখি মদওয়ালা’। এটা কিন্তু কল্পনা নয়। নিজের কানে শোনা। তাঁর মুখ থেকে অলৌকিক এসব কথা শুনেছিলাম সলিল চৌধুরীর সঙ্গে একদিন মোক্যাম্বো বারে।
সপ্তপদীর একটা সিকোয়েন্সের জন্য ইংরেজি গান দরকার। কে লিখবে সে গান? ‘লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন’– এই প্রবাদের মতোই হয়ে দাঁড়াল ব্যাপারটা। লাগে গান, লিখবে গৌরীপ্রসন্ন। হ্যাঁ, গান লিখেছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। ঘটনাচক্রে ইংরেজিতে এম.এ. করেছিলেন। তাঁর পড়াশোনা নিয়ে প্রশ্ন ছিল না কারওর। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় নিজেই বলেছিলেন– ‘গৌরীই তো লিখবে।’ আর সত্যিই, তিনি এমন সাবলীলভাবে ইংরেজি লিখলেন, যেন তিনি গোটা জীবন বিলেতে কাটিয়েছেন। গান পেয়ে গেল কথা–
‘মেরি গো রাউন্ড’। সুরও এসে গেল বিলিতি ঝরনার মতো। এবার পরের স্টেশন। এ-গান গাইবে কে?
কলকাতার বুকে তখনও বেঁচে আছে একচিলতে বিলেত পাড়া। বেশ কিছু অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পরিবার। পার্ক-স্ট্রিটের রঙিন হোটেল-রেস্তোরাঁয় শোনা যায় তাদের গলা। খুঁজে খুঁজে ‘মেরি গো রাউন্ড’-এর জন্য গায়িকা ঠিক হল– সুজি মিলার। তার তখন হোটেলগুলোয় গাইয়ে হিসেবে বেশ নাম। স্কাই রুমে তাকে গান শিখিয়ে এসেছেন টনি মানেজেস। ববি ব্যাঙ্কসও ছিলেন সঙ্গে। সব ঠিকঠাক। গান রেডি।
রেকর্ডিং ফ্লোর সেজে উঠেছে। প্রস্তুতি চরমে। সেখানে সেদিন হাজির হয়েছেন স্বয়ং সুচিত্রা সেন। সাধারণত তিনি রেকর্ডিং দেখতে আসতেন না। কিন্তু এই গানটা অন্যরকম– নাচ আছে, বিদেশি ছোঁয়া, মানে রক অ্যান্ড রোল আছে। তিনি তাই নিজেই এলেন। শুধু তাই নয়– পিটার দে-কে টেনে আনলেন, যেন কোরিওগ্রাফির সঙ্গে গান মিলিয়ে দেখা যায়।
ফ্লোরে সব প্রস্তুত। ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছাড়াল, একটার ঘণ্টা বাজল, তারপর দেড়টা। যাঁর দিকে হাঁ-করে চেয়ে থাকে বাঙালি, সেই সুচিত্রা সেন স্থির চেয়ে আছেন ঘড়ির দিকে। লাঞ্চ পর্যন্ত শেষ! কিন্তু সুজি মিলার এলেন কোথায়! এবার একটা হুলস্থুল ঘটবে বোধহয়।
মিউজিশিয়ানদের চোখে চিন্তা। কপালে ঘাম। সুচিত্রা সেন কিন্তু বসেই রইলেন। গম্ভীর মুখ– যেমন তাঁর অভ্যাস। তিনি নাছোড়বান্দা, গান না শোনা পর্যন্ত যাবেন না। বারবার বললেন, ‘কেউ গিয়ে ডেকে আনুন।’ গায়িকা যখন গাইবেন তখনই তিনি বুঝবেন– কেমন হবে নাচ, কেমন হবে ভঙ্গি।
এমন আবহে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মনে পড়ল টোপাদার কথা। অতএব ডাক পড়ল তাঁর– ‘টোপা, একবার দেখে এসো।’ সঙ্গে গেলেন ববি ব্যাঙ্কস আর অ্যান্টো।
লেনিন সরণীর ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ। সুজি নেই। এরপর শুরু হল খোঁজা– পার্ক স্ট্রিটের হোটেল, বার– যেখানে যেখানে সম্ভব সব জায়গা খুঁজে দেখা হল। কিন্তু সুজির দেখা নেই। টোপাদাদের কপালে ঘাম…
এরপরের অংশটা আমার শোনা গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কাছ থেকে। গৌরীদা হেসে বলেছিলেন, ‘ওই যে মেয়েটা, ডাকসাইটে গায়িকা, তাকে গ্র্যান্ড ওবেরয় তখন নিজেদের এক্সক্লুসিভ করতে চাইছে। মানে, হোটেল-সিঙ্গার হবে। গান গাইবে শুধু তাদেরই হোটেলে। খাওয়া-দাওয়া, থাকা– সব বন্দোবস্ত পাকা হয়ে গিয়েছিল। এখন ভাবো তো, এত বড় প্রস্তাব কে ছাড়ে?’
কিন্তু পরিচালক অজয় কর এত সহজে হাল ছাড়ার পাত্র নন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে গিয়ে হোটেলের ম্যানেজারের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন। ভাবুন একবার দৃশ্যটা! অনেক বোঝাপড়া শেষে, অবশেষে সেদিনের রেকর্ডিংয়ের পারমিশন মেলে।
স্টুডিওতে তখন এক অদ্ভুত দৃশ্য। সুচিত্রা সেন– যাঁর মেজাজ দেখতে গোটা ইন্ডাস্ট্রি অভ্যস্ত, সেই মিসেস সেন কিনা অদ্ভুতভাবে ধৈর্য ধরে বসে আছেন! যেন জেদ চেপে গেছে তাঁর– গানটা হতেই হবে!
ঠিক তখনই ঢুকলেন সুজি মিলার। কত লোক তাঁর অপেক্ষায়! টেকনিশিয়ান, মিউজিশিয়ান, এমনকী স্বয়ং সুচিত্রা সেন। মিলার ভদ্রভাবে ক্ষমা চাইলেন। গৌরীদার কথায়– ‘মেয়েটার মুখে ক্ষমা চাইতে শুনে মনে হচ্ছিল, খুব ইনোসেন্ট। না-হলে এত সহজে এতটা বিনয়ী হতে পারে না।’
এরপর শুরু হল গান। জো পেরেরা, টনি মেনেজেস, লরি ডিসুজা, ববি ব্যাঙ্কস– সবাই মেতে উঠলেন রক অ্যান্ড রোলের ছন্দে। স্টুডিও যেন এক মুহূর্তে কলকাতার পার্ক স্ট্রিটের নাইট ক্লাব হয়ে গেল। তালে তালে নেচে উঠল সুচিত্রা সেনের ভ্রূ যুগল। সুচিত্রা সেন যেন হয়ে উঠলেন সত্যিকারের রিনা ব্রাউন। গানটা নিজেই হয়ে উঠল কোরিওগ্রাফার। সুজি মিলার যেন হয়ে গিয়েছেন সুচিত্রার পুরু ঠোঁট। পারফেক্ট ‘মেরি গো রাউন্ড’। মিলার সপ্তপদীর প্রিমিয়ারে এসেছিলেন। তাঁকে মনে রেখেছিলেন সিনেমার প্রযোজক, পরিচালক, সুরকার– সবাই। মিলারের মনেও কি থেকে গিয়েছিলেন কেউ! প্রিমিয়ারে সুজি মিলার এসেছিলেন শাড়ি পরে। সুজি আর সুচিত্রার মিলনে সিনেমার পর্দায় উজ্জ্বল হয়ে ছিলেন রিনা ব্রাউন। বহু বক্ষ কাঁপিয়ে বেজে উঠেছিল ‘মেরি গো রাউন্ড’। সময় নেচে উঠছিল প্রাণোচ্ছল তরুণীর মতো।
আমার স্মৃতিরাও নেচে ওঠে এমন গানের গল্পে। ‘মেরি গো রাউন্ড’ গানটির সঙ্গে সুচিত্রা সেনের স্ক্রিন প্রেজেন্স ভোলার নয়। ভোলার নয়, কীভাবে ‘মেরি গো রাউন্ড’-এর মতো বিলেতি নদী মিশে যাচ্ছে বাংলা সুরের সমুদ্রে। বেজে উঠছে ‘এবার কালী তোমায় খাব’-র মতো গান।
এইসব গান হয়ে ওঠার পিছনের গল্পগুলো আমাকে পিছনে টেনে নিয়ে যায় সেসব দিনে যখন সংগীতকেই জীবনসঙ্গী করার সিঁড়ি দেখিয়ে দিতেন টোপাদারা এবং আরও অনেকে। যেমন ধরুন নির্মল বিশ্বাস। বিশ্বাস করুন, তার গল্পও হবে একদিন। অফুরান এই গল্পগুলো না বললে আমার শান্তি নেই। জীবনের এই গল্পগুলোই তো আমার গান। মাঝে মাঝেই তাই ফিরে যাই স্মৃতিদের কাছে। স্মৃতিরা নেচে ওঠে– ‘মেরি গো রাউন্ড’।
পড়ুন অফ দ্য রেকর্ড কলামের অন্যান্য পর্ব
পর্ব ১ : প্রণব রায় না থাকলে ‘আমি যামিনী তুমি শশী হে’ ইতিহাস হত না
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved