Robbar

পাবনার হলে জীবনের প্রথম সিনেমা দেখেছিলেন সুচিত্রা সেন

Published by: Robbar Digital
  • Posted:August 1, 2025 8:55 pm
  • Updated:August 2, 2025 3:23 pm  
Desher bari episode 14 on suchitra sen's home at pabna

পাবনা– সুচিত্রা সেনের শৈশবের শহর। প্রথম যৌবনের শহর। প্রথম সিনেমা দেখার শহর। প্রথম সিনেমা দেখেন পাবনা ‘আরোরা টকিজ’-এ (বাণী সিনেমা হল)। পাবনা শহরের গোপালপুর মহল্লার হেমসাগর লেনে সুচিত্রাদের বাড়ি। বাবা করুণাময় দাশগুপ্ত ছিলেন পাবনা পৌরসভার স্যানিটারি ইন্সপেক্টর পরবর্তী সময়ে পদোন্নতি পেয়ে হেডক্লার্ক হয়েছিলেন। সুচিত্রা সেনের আদি বাড়ি যশোর। মামাবাড়ি পাটনা। সুচিত্রা সেনের আদি নাম রমা দাশগুপ্ত। দাদা জগবন্ধু দাশগুপ্ত ডাকতেন ‘কৃষ্ণা’ নামে। বিয়ের পর ‘রমা সেন’। সিনেমায় ‘সুচিত্রা সেন’। চলচ্চিত্রের মানুষেরা ডাকতেন ‘মিসেস সেন’। সুচিত্রার ছোট ভাই-বোনরা তাঁকে ‘রাঙাদি’ বলে ডাকতেন।

কামরুল হাসান মিথুন

১৪.

সুচিত্রা সেনের স্মৃতিময় শহর অবিভক্ত বাংলার যশোর, পাবনা, পাটনা, শান্তিনিকেতন ও কলকাতা। পাবনা– সুচিত্রা সেনের শৈশবের শহর। প্রথম যৌবনের শহর। প্রথম সিনেমা দেখার শহর। প্রথম সিনেমা দেখেন পাবনা ‘আরোরা টকিজ’-এ (বাণী সিনেমা হল)। পাবনা শহরের গোপালপুর মহল্লার হেমসাগর লেনে সুচিত্রাদের বাড়ি। বাবা করুণাময় দাশগুপ্ত ছিলেন পাবনা পৌরসভার স্যানিটারি ইন্সপেক্টর, পরবর্তী সময়ে পদোন্নতি পেয়ে হেডক্লার্ক হয়েছিলেন। সুচিত্রা সেনের আদি বাড়ি যশোর। মামাবাড়ি পাটনা। সুচিত্রা সেনের আদি নাম রমা দাশগুপ্ত। দাদা জগবন্ধু দাশগুপ্ত ডাকতেন ‘কৃষ্ণা’ নামে। বিয়ের পর ‘রমা সেন’। সিনেমায় ‘সুচিত্রা সেন’। চলচ্চিত্রের মানুষেরা ডাকতেন ‘মিসেস সেন’। সুচিত্রার ছোট ভাই-বোনরা তাঁকে ‘রাঙাদি’ বলে ডাকতেন।

ভুবন ভোলানো হাসিতে সুচিত্রা সেন। এই ছবির সংগ্রাহক ‘সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংসদ’-এর সাধারণ সম্পাদক নরেশ মধু

১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল সুচিত্রার জন্ম পাটনার মামা বাড়িতে। তাঁর মায়ের নাম ইন্দিরা দাশগুপ্ত। তিন ভাই (নিতাই, নিমাই ও গৌতম) ও পাঁচ বোনের (উমা, রমা, হেনা, লীনা ও রুণা) মধ্যে সুচিত্রা পঞ্চম।

সুচিত্রা সেনের পাবনার বাড়ির পাশেই পদ্মা নদী। শহরের ভেতরে ইছামতী নদী। পাবনা– রাজশাহী বিভাগের অন্যতম একটি জেলা এবং পদ্মা-যমুনা নদীর মিলনস্থলে অবস্থিত। এই জেলার উত্তরে নাটোর, সিরাজগঞ্জ জেলা। দক্ষিণে কুষ্টিয়া, রাজবাড়ি জেলা। পূর্বে মানিকগঞ্জ জেলা ও যমুনা নদী। পশ্চিমে পদ্মা নদী। পাবনার আরও যে গুরুত্বপূর্ণ নদী– আত্রাই ও বড়াল। একদা পাবনা ছিল রুপোলি ইলিশের এক অফুরন্ত ভাণ্ডার।

মহানায়িকার বাড়ির পথ
সুচিত্রা সেনের পাবনার বাড়ি। বর্তমানে এটি স্মৃতি সংগ্রহশালা। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে। টিকিটের মূল্য ২০টাকা। সোমবার সাপ্তাহিক বন্ধ

১৯৪৭ সালের শুরুর দিকে কলকাতার ধনী ব্যবসায়ী আদিনাথ সেনের বড় পুত্র দিবানাথ সেনের সঙ্গে রমা দাশগুপ্ত’র বিয়ে হয়। বিয়ের পরের বছর কন্যা মুনমুন সেনের জন্ম। এরপর সুচিত্রা সেনের এক পুত্রসন্তান হয়। শিশুপুত্রের আকস্মিক মৃত্যুতে সুচিত্রার কোল খালি হয়ে যায়। সুচিত্রা সেন কোনও দিন পুত্রশোক ভুলতে পারেননি।

আদিনাথ সেনের কনিষ্ঠ পুত্র নরনাথ সেনের সঙ্গে বিয়ে হয় হীরালাল সেনের কন্যা প্রতিভার। আদিনাথ সেনদের আদি বাড়ি ঢাকার মানিকগঞ্জে। বলা যায়, সুচিত্রা সেনের আদি শ্বশুরবাড়ি ঢাকা।

সুচিত্রা সেনের বিয়ের কিছু পর-ই ভারতবর্ষ ভাগ, মানে দেশভাগ। স্বাধীনতা। ভারত-পাকিস্তান আলাদা আলাদা রাষ্ট্র। করুণাময় দাশগুপ্ত তার বৃহৎ পরিবারের কথা চিন্তা করে পাবনার পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যান ভুবনডাঙা। চাকরি নেন বোলপুর পৌরসভায়। সুচিত্রা সেনের ছোট ভাই-বোন ভর্তি হন শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতীতে। রবীন্দ্র-জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের বাড়ির পাশেই ছিল সুচিত্রা সেনদের টিন ও মাটির দেওয়াল ঘেরা বাড়ি। শান্তিনিকেতনের সংগীত ভবনের ছাত্রী ছিলেন সুচিত্রা সেনের ছোট বোন রুণা দাশগুপ্ত। সেজবোন হেনা ভর্তি হন পাঠভবনে। ছোটভাই গৌতম পড়তেন বোলপুর কলেজে। বড় ভাই নিতাই কলাভবনে। পড়াশোনার পর বড় ভাই নিতাই সিনেমার স্ক্রিন আঁকার কাজ নিয়েছিলেন।

সুচিত্রা সেনের বাড়ির পাশেই তাঁর পিতার কর্মস্থল— পাবনা পৌরসভা। ১৯৫০ সালে মে মাস পর্যন্ত এখানে কর্মরত ছিলেন করুণাময় দাশগুপ্ত

সুচিত্রা সেনের শ্বশুর আদিনাথ সেনের পিতা ঢাকার খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব দীননাথ সেন। ঢাকা শহরের অভিজাত এলাকা গেন্ডারিয়ার একটি রাস্তার নামকরণ হয়েছে ‘দীননাথ সেন রোড’। উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্রকর হীরালাল সেন। তাঁর পিতা চন্দ্রমোহন সেনের বড় ভাই এই দীননাথ সেন। সুচিত্রা সেনের শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়স্বজনরা বাংলা ও হিন্দি সিনেমার স্মরণীয় মানুষ। শ্বশুর আদিনাথ সেনের অনুমতিতে ‘সাত নম্বর কয়েদী’ দিয়ে বাংলা সিনেমায় আত্মপ্রকাশ করেন তখন সুচিত্রা সেনের বয়স ২২ বছর।

সাত নম্বর কয়েদী
সুচিত্রা সেনের প্রথম বাংলা ছবি ‘সাত নম্বর কয়েদী’র বুকলেট

মামাশ্বশুর বিমল রায়ের উৎসাহে সুচিত্রা সেনের মুম্বই যাত্রা! সুচিত্রা সেনের প্রথম হিন্দি ছবি ‘দেবদাস’ এরপর ‘মুসাফির’, ‘চম্পাকলি’, ‘বোম্বাই কা বাবু’, ‘শারহাদ’, ‘মমতা’ এবং গুলজারের ‘আঁধি’ হয়ে হিন্দি সিনেমায় অভিনয় করার সমাপ্তি। সুচিত্রা সেন অভিনীত ১৯৭৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সর্বশেষ সিনেমা– ‘প্রণয় পাশা’। এই সিনেমার পরই দীর্ঘ সময় চলচ্চিত্রে অনুপস্থিত থাকেন এরপর চলে যান লোকচক্ষুর অন্তরালে।

Imprints and Images of Indian Film Music - Suchitra Sen during the shoot of Devdas (1955) | Facebook
‘দেবদাস’ (১৯৫৫) শুটিংয়ের সময় সুচিত্রা সেন

সুচিত্রা সেন রামকৃষ্ণ মিশনে দীক্ষা নিয়েছিলেন ভরত মহারাজের কাছে। ভরত মহারাজ মন্ত্রদীক্ষা নিয়েছিলেন সারদা মায়ের কাছে। ভরত মহারাজের আদি বাড়ি ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার আগলা ইউনিয়নের মাঝপাড়া গ্রামে। ভরত মহারাজের সন্ন্যাসজীবনের নাম ছিল ‘স্বামী অভয়ানন্দ’। সন্ন্যাস জীবনের আগে ছিলেন ঢাকার বিপ্লবী দলের সদস্য তখন তিনি অতুলচন্দ্র গুহ। সুচিত্রা সেন তাঁর বাবার কাছেই প্রথম ভরত মহারাজের পরিচয় জানতে পারেন।

This may contain: an old black and white photo of a man and woman sitting on the ground next to each other
উত্তম-সুচিত্রা

পাঁচের দশকে বাংলা সিনেমার দর্শকের কাছে সেরা রোম্যান্টিক জুটি উত্তম-সুচিত্রা। তাঁদের জুটির ম্যাজিক এখনও দর্শক-হৃদয় দখল করে আছে। সুচিত্রার আড়ালে রমা চলে যায়, সুচিত্রা সেন চলে আসেন রূপালি পর্দায়। অনেক বছর পর সুচিত্রাও চলে যান আড়ালে। তিনি স্বেচ্ছায় নিশ্ছিদ্র অন্তরালে চলে গিয়েছিলেন। এই নিভৃতবাসের অনুভূতি তিনি ব্যক্ত করেছেন– ‘আই মে বি অ্যালোন, বাট আই নেভার ফিল লোনলি।’ তবে অন্তরালে যাওয়ার আগে দর্শকের অন্তরে চিরস্থায়ী জায়গা করে নিয়েছিলেন। ১৯৩১-’২৪ দীর্ঘ সময়ের এই জীবন নিজের মতো উপভোগ করেছেন। ৮৩ বছর বয়সে জীবনাবসান। যে রূপে স্বনির্বাসনে গেলেন সেই রূপেই স্বর্গবাসী হলেন। তাঁকে কেউ বৃদ্ধা হতে দেখেনি। আড়াল নিয়েই তিনি চিরবিদায় নেন। কিন্তু ‘যাই’ বলেও চলে যাওয়া যায় না। এখনও তিনি বাংলা সিনেমার সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়িকা।

সংগ্রহশালায় সুচিত্রা সেনের আবক্ষ মূর্তি

পাবনা শহর ঘুরে দেখতে গেলে চোখ আটকে যায় বিভিন্ন জমিদার বাড়িতে। অনেকটাই পরিত্যক্ত, কিছুটা ব্যবহৃত হয়ে আছে প্রাসাদোপম বাড়িগুলো। সুচিত্রা সেনের বাড়ির একদিকে রায় বাহাদুর বনমালী রায়ের তাড়াশ রাজবাড়ি। আরেকদিকে শিতলাই জমিদার বাড়ি– এই বাড়িতে জন্ম দু’জন কৃতি মানুষের। একজন জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র যিনি পঞ্চাশের মন্বন্তরের মর্মান্তিক পরিস্থিতির অভিজ্ঞতায় লিখেন ‘নবজীবনের গান’। আরেকজন ‘ক্যালকাটা গ্রুপ’ শিল্পগোষ্ঠীর চিত্রশিল্পী রথীন মৈত্র।

This may contain: a woman laying on a bed reading a book

বৃহত্তর পাবনা জেলা স্বরণীয় এবং বরণীয় আরও অনেক গুণী মানুষের জন্য। রজনীকান্ত সেনের বাড়ি সিরাজগঞ্জের ভাঙাবাড়ি। যার রচিত গান ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই’– এই গান স্বদেশি আন্দোলনের সময় দেশাত্মবোধে দেশবাসীকে জাগিয়ে তোলে। প্রমথ চৌধুরীর বাড়ি চাটমোহরের হরিপুর গ্রাম। দেবেশ রায়ের বাড়ি বেড়া উপজেলায়। হিতেন চৌধুরী এই বেড়া উপজেলার নতুন ভাড়েঙ্গা গ্রামের কৃতি সন্তান, যিনি বোম্বে সিনেমার সফল চিত্র-প্রযোজক। পাবনার সন্তান সুধেন্দু রায় যিনি হিন্দি সিনেমার আর্ট ডিরেক্টর, পরিচালক এবং প্রোডাকশন ডিজাইনার হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। সুচিত্রা সেনের লিপে যে সকল কালজয়ী গান দর্শক হৃদয় জয় করেছে তার অধিকাংশ গানের রচয়িতা গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের বাড়ি পাবনা জেলার ফরিদপুর উপজেলার গোপালনগর গ্রামে।

১৯৫৮ সালে মেগাফোন কোম্পানির পুনর্জীবনের জন্য সুচিত্রা সেনের প্রথম একক একটি গানের রেকর্ড বেরিয়েছিল। গান দু’টির সুর ও সংগীত পরিচালক ছিলেন রবীন চট্টোপাধ্যায়। গান দু’টির রচয়িতা ছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। সুচিত্রা সেন সিনেমায় আসার আগে প্লে-ব্যাক সিঙ্গার হিসেবে কাজ পাওয়ার চেষ্টা করেন কিন্তু কাজ শুরু করেন নায়িকা হিসেবে, আর বাংলা সিনেমার দর্শক তাঁকে চিরস্থায়ীভাবে মহানায়িকার আসনে রেখে দিলেন।

ছবি: কামরুল হাসান মিথুন

দ্যাশের বাড়ি-র অন্যান্য পর্ব …

পর্ব ১৩নদীমাতৃক দেশকে শরীরে বহন করেছিলেন বলেই নীরদচন্দ্র চৌধুরী আমৃত্যু সজীব ছিলেন

পর্ব ১২: শচীন দেববর্মনের সংগীত শিক্ষার শুরু হয়েছিল কুমিল্লার বাড়ি থেকেই

পর্ব ১১বাহান্ন বছর পর ফিরে তপন রায়চৌধুরী খুঁজেছিলেন শৈশবের কীর্তনখোলাকে

পর্ব ১০: মৃণাল সেনের ফরিদপুরের বাড়িতে নেতাজির নিয়মিত যাতায়াত থেকেই তাঁর রাজনৈতিক চিন্তার জীবন শুরু

পর্ব ৯: শেষবার বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার আগে জানলায় নিজের আঁকা দুটো ছবি সেঁটে দিয়েছিলেন গণেশ হালুই

পর্ব ৮: শীর্ষেন্দুর শৈশবের ভিটেবাড়ি ‘দূরবীন’ ছাড়াও দেখা যায়

পর্ব ৭: হাতে লেখা বা ছাপা ‘প্রগতি’র ঠিকানাই ছিল বুদ্ধদেব বসুর পুরানা পল্টনের বাড়ি

পর্ব ৬ : জীবনের কালি-কলম-তুলিতে জিন্দাবাহারের পোর্ট্রেট এঁকেছিলেন পরিতোষ সেন

পর্ব ৫ : কলাতিয়ার প্রবীণরা এখনও নবেন্দু ঘোষকে ‘উকিল বাড়ির মুকুল’ হিসেবেই চেনেন

পর্ব ৪ : পুকুর আর বাঁধানো ঘাটই প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের দেশের বাড়ির একমাত্র অবশিষ্ট স্মৃতিচিহ্ন

পর্ব ৩ : ‘আরতি দাস’কে দেশভাগ নাম দিয়েছিল ‘মিস শেফালি’

পর্ব ২: সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় শৈশবের স্মৃতির নন্দা দিঘি চিরতরে হারিয়ে গেছে হাজীগঞ্জ থেকে

পর্ব ১: যোগেন চৌধুরীর প্রথম দিকের ছবিতে যে মাছ-গাছ-মুখ– তা বাংলাদেশের ভিটেমাটির