প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের কাছে গান এসেছে নদীর জলের মতো, হাওয়ার মতো, রোদের মতো বৃষ্টির ধারার মতো, চাঁদের আলোর মতো, বড়ো কচুপাতায় টলমল করা জলের মতো, পাখির ডাকের মতো, ফেরিওয়ালার হাঁকের মতো। সারা প্রাণ জুড়েই যেন ছিল গান। ফুঁ দিলেই শাঁখের মতো বেজে উঠত। গান ব্যাপারটা প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের কাছে তিন সাড়ে মিনিটের সুখানুভূতি নয়। গান হল একটা ভয়ঙ্কর অস্ত্রের মতো। অস্ত্র নিক্ষেপ করার আগে কেমন করে এটা একটা বল্লমের মতো আর একটি হৃদয়ে বিদ্ধ করতে পারে, তার থেকে আর একটি হৃদয়। এইভাবে হৃদয় থেকে হৃদয়ে বিদ্ধ করে চলে প্রতুলের গান।
৪.
ফাগুনের দুপুর। চারদিক সবুজ, শান্ত। গ্রাম জুড়ে বিরাজ করছে শান্তি, সৌন্দর্য। যে গ্রামের নামের সঙ্গে মিল আছে ফুলের নাম। যে গ্রামের পথের ধারে ফুটে আছে ‘হাতিশুঁড়’ ফুল। সেই গ্রামেই ১৯৪২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর অমাবস্যার রাতে জন্ম নেন প্রতুল মুখোপাধ্যায়। গ্রামের নাম হস্তিশুণ্ড। বরিশাল জেলার উজিরপুর উপজেলার বাবরাইল ইউনিয়নের হস্তিশুণ্ড (হাশসুঁড়) গ্রাম।
প্রমত্ত পদ্মা নদীতে সেতু হওয়ায় বাংলাদেশের সবগুলো গ্রাম সময়ের হিসেবে কাছাকাছি চলে এসেছে। ঢাকা থেকে সানুহারের দূরত্ব আড়াই ঘণ্টার। সানুহার থেকে বরিশাল শহরের দূরত্ব এক ঘণ্টার। ঢাকা থেকে বরিশাল যাওয়ার পথে সানুহার বাসস্ট্যান্ডে নেমে হস্তিশুণ্ড গ্রামের পথ ধরতে হয়।
হস্তিশুণ্ড গ্রামে খুব বেশি খোঁজাখুঁজি করতে হয়নি প্রতুল মুখোপাধ্যায় বাড়ির। গ্রামের চক্রবর্তী বাড়ির প্রবীণ জুটি ভবতোষ চক্রবর্তী ও রীতা চক্রবর্তীর বাড়ির উঠোনে খোঁজ করতেই বললেন– “আমি বাংলায় গান গাই…’ এই গানের শিল্পীর বাড়ি তো আমাগো চেনা। খুব মায়ার, খুব আদরের এই গান করেন। তাগোর বাড়িতে বড় একটা পুকুর আছে, বাঁধানো ঘাট আছে আর কোনও চিহ্ন নাই। অহন এই বাড়িতে বাস করেন মুনসুর আলী খলিফার পরিবার।”
হায় দেশভাগ! যে মাটির পরিচয় ছিল ‘মুখোপাধ্যায় বাড়ি’-র নামে। সেই মাটির পরিচয় এখন খলিফা বাড়ি নামে! এই গ্রাম নিয়ে প্রতুল মুখোপাধ্যায় ‘আমার ছেলেবেলা’য় লিখেছেন–
“জন্মেছিলাম ঢেঁকি-ঘরের কোণে। মা বীণাপাণি, বাবা প্রভাতচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। বাবা ছিলেন স্কুলের শিক্ষক। আমরা পাঁচ ভাই তিন বোন। আমি তৃতীয় ছেলে আর পঞ্চম সন্তান। এখনকার দিন হলে তো আমি জন্মাতামই না! ভাবতে কেমন লাগে।
অনেক ভেবে ভেবেও এখনকার বাংলাদেশে আমার শৈশবের কথা তেমন মনে করতে পারি না। আবছা আবছা কিছু ছবি ভেসে আসে। বিরাট মাঠ। সুপারি গাছ। বড় পুকুর। পুকুরে বড়রা সাঁতার কাটছে। তাদের মধ্যে একজন রতনদা। রতনদার পিঠের ওপর আমি– সপাটে ধরে আছি তাকে– রতনদা মাঝ-পুকুরে চলে যাচ্ছে তার পিঠে চড়ে আমিও। পাড়ে ফিরে এসে কী আহ্লাদ! ওই পুকুরের মাঝখানে চলে গিয়েছিলাম আমি? কী আশ্চর্য! মনে পড়ে নদী। কীর্তনখোলা নদী। নদীর বুকে নৌকো আর স্টিমার। স্টিমারের ভোঁ। নদী দেখে একবার বাড়িতে খাতায় লিখেছিলাম মনে আছে। ‘নদী দেখিয়াছি। নৌকা দেখিয়াছি। ইস্টিমার দেখিয়াছি। ইস্টিমারে ভোঁ বাজে। নৌকায় বাজে না। নৌকা কখনও কখনও ডুবিয়া যায়। ইস্টিমার ডোবে না।’ ‘ইস্টিমার’ও যে ডোবে তা জানতে সময় লেগেছিল।”
হস্তিশুণ্ড গ্রাম থেকে বরিশাল শহরে যাওয়ার সেই সময়ে বাহন বলতে গয়নার নৌকা ও ইস্টিমার। গ্রামের ভেতরে সানুহার খাল থেকে নৌকায় সন্ধ্যা নদীর পার শিকারপুর ইস্টিমার ঘাট। সন্ধ্যা, সুগন্ধা, আড়িয়াল খাঁ হয়ে কীর্তনখোলা নদীর তীরে বরিশাল সদর। প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের পিতা প্রভাতচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ছিলেন ব্রজমোহন বিদ্যালয়ের শিক্ষক। এই স্কুলে একসময় সহকারী শিক্ষক ছিলেন জীবনানন্দ দাশের পিতা সত্যানন্দ দাশ। এবং এই স্কুল থেকেই কবি জীবনানন্দ দাশ ম্যাট্রিক পাশ করেন। প্রতুল মুখোপাধ্যায় প্রিয় কবির নাম তাঁর গানেও এসেছে– ‘বাংলা আমার জীবনানন্দ, বাংলা প্রাণের সুর…।’
দেশভাগের পূর্বের বছর পূর্ববঙ্গ জুড়ে দাঙ্গা শুরু হয়। ’৪৬-এর দাঙ্গা দেশভাগকে আরও দ্রুততর করে তোলে। ’৪৭-এর আগস্ট মাসের পরপরই প্রতুল মুখোপাধ্যায়রা চলে যান ভারতের খড়গপুরে। শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেন বড় কাকার বাড়ি। বড়কাকা ছোট্ট প্রতুলকে সাবধান করে দেন কথা বলার সময় যেন ‘বাঙাল দ্যাশ’-এর কথার টান না থাকে। তাহলে লোক হাসবে। চারপাশের লোকজন বুঝে ফেলবে তোরা বাঙাল, তোরা শরণার্থী। ছোটবেলার এই ঘটনাই হয়তো বড় বেলায় ‘দুইজনাই বাঙালি ছিলাম’… গান হয়ে আসে, গান হয়ে ভেসে বেড়ায় ঢাকা আর কলকাতায়।
শরণার্থী পরিবারের মাথার ওপরে সহজে আকাশ মিললেও ঘর মেলে না সহজে। একবার দেশ বদলে জীবনের সবকিছু বদলাতে যায়। প্রতিকূল পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে খড়গপুর থেকে চলে যান চুঁচুঁড়ায়। চুঁচুঁড়ায়–আমতলায় এক তুলোর গুদামে থাকতে শুরু করে মুখোপাধ্যায় পরিবার। এক ঘরে তুলো অন্য ঘরে মা-বাবা-ভাই-বোনসহ প্রতুল মুখোপাধ্যায়! বাবা প্রভাতচন্দ্র মুখোপাধ্যায় হুগলী মাদ্রাসায় সামান্য বেতনে শিক্ষকতা করেন। এমন পারিবারিক অবস্থায় বাড়িতে একটাও রেডিও ছিল না। হারমোনিয়াম চোখেই দেখেনি। এর ওর বাড়িতে রেডিও, জলসায়, মাইকে গান শোনা, শেখা।
এইসব পরিস্থিতি পার করে প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের কাছে গান এসেছে নদীর জলের মতো, হাওয়ার মতো, রোদের মতো বৃষ্টির ধারার মতো, চাঁদের আলোর মতো, বড়ো কচুপাতায় টলমল করা জলের মতো, পাখির ডাকের মতো, ফেরিওয়ালার হাঁকের মতো। সারা প্রাণ জুড়েই যেন ছিল গান। ফুঁ দিলেই শাঁখের মতো বেজে উঠত। গান ব্যাপারটা প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের কাছে তিন সাড়ে মিনিটের সুখানুভূতি নয়। গান হল একটা ভয়ঙ্কর অস্ত্রের মতো। অস্ত্র নিক্ষেপ করার আগে কেমন করে এটা একটা বল্লমের মতো আর একটি হৃদয়ে বিদ্ধ করতে পারে, তার থেকে আর একটি হৃদয়। এইভাবে হৃদয় থেকে হৃদয়ে বিদ্ধ করে চলে প্রতুলের গান।
দেশভাগের বছর গেলেন আর ফিরলেন বাংলাদেশ হওয়ার পর নিজের পিতৃভূমিতে। ২০১০ সালের মার্চ মাসে ঢাকায় আসেন সত্যেন সেন গণসংগীত উৎসবে। শিল্পকলা একাডেমির উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে গান করেন। দ্বিতীয়বার আসেন ২০১৬ সালের মার্চ মাসে ‘বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী)’ ছাত্র ফ্রন্টের সম্মেলনে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সম্মুখে মঞ্চ তৈরি হয় এই মঞ্চে গান করেন প্রতুল মুখোপাধ্যায়।
সম্মেলনের পরের দিন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের একটি হলরুমে প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গান শোনার আয়োজন হয়। এর আগে একবার জাতীয় জাদুঘরের হলরুমে একক সংগীত সন্ধ্যার আয়োজন করে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পগোষ্ঠী। উদীচীর হয়ে ঢাকার বাইরে যশোর শহরের টাউন হল মাঠে প্রতুলের গানের আয়োজন হয়। এই অনুষ্ঠানের পরের দিন যশোর রোড ধরে কাঁটাতার পেরিয়ে কলকাতায় ফিরে যান। এই পথে দেশভাগের সময় বরিশাল থেকে যশোর রোড ধরে নিজের পিতৃভূমি ছেড়ে গিয়েছিলেন চিরকালের জন্য।
যশোর রোড ধরে যারা যায়, কেউ কেউ ফেরে আর অনেকেরই ফেরা হয় না এই বাংলায়, এই বাংলাদেশে।
……………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………
ছবি: লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে