অমিতাভ বচ্চন যেহেতু ভিআইপি এবং মুখ্য অতিথি, তাই পুলিশদের কাজ হল তাকে আগে নিরাপদে ভিতরে ঢোকানো এবং সেক্ষেত্রে বেশ ধস্তাধস্তি করেই কাজটা করতে হল, কারণ কলকাতার ভক্তবৃন্দ। গুরুকে নিয়ে উৎসাহের শেষ নেই, কখন কী করবে তার নিশ্চয়তা নেই। গ্যালারির সাইজটা বেশ ছোট, মোটামুটি একটা আইসক্রিম পার্লারের মতো। অতএব রাস্তায় ফুটপাতে বেড়া দিয়ে ছাউনি করে লোক বসার ব্যবস্থা। উপস্থিত ছিলেন হুসেন, যোগেন চৌধুরী, বিকাশ ভট্টাচার্য, শ্যামল দত্তরায়, পরিতোষ সেন প্রমুখ বিখ্যাত শিল্পীরা। এসেছিলেন সাহিত্যের সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, মঞ্চজগতের আনন্দশংকর, তনুশ্রীশংকর। শিল্প সমালোচক, সাংবাদিক এমন অনেক মানুষ।
২৭.
উচ্চতায় এবং ব্যক্তিত্বে সত্যিকারের একজন বড় মাপের মানুষ। অসাধারণ খ্যাতি এবং সাফল্য সত্ত্বেও, ভদ্রতা, নম্রতা, সারল্য ওঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। পেশাদারিত্ব, নিষ্ঠা, সময়ানুবর্তিতা, স্পষ্টভাষায় বক্তৃতা এবং চিন্তাশীল অন্তর্দৃষ্টির জন্য পরিচিত একজন জনসাধারণের ব্যক্তিত্ব হিসেবে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতীক। প্রায়শই ভারতীয় ঐতিহ্য এবং মূল্যবোধ প্রচারের জন্য ওঁর প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করেন। তিনি ‘বিগ বি’, তিনি ‘বলিউডের শাহেনশা’।
‘অমিতাভ বচ্চন’ সম্পর্কে এতগুলো ভারী ভারী বিশেষণ একদমে বলে গেলাম, তার কারণ এর পরে যা বলব তা খুব ভারী নয়, বরং কোমল এবং আন্তরিক। ওঁর কাছাকাছি গেলে তখন এই ধরনের কথা আর বলার সুযোগ হবে না। প্রথমবার হাতে হাত মিলিয়ে লম্বা মানুষটার সঙ্গে যেদিন আলাপ হল সেদিন ছিল ওঁর জন্মদিন। বিশেষ সংখ্যার নয়, সাধারণ জন্মদিন। ওঁর বাড়ির পারিবারিক অনুষ্ঠান বা যে কোনও আনন্দ অনুষ্ঠানগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঢাক পিটিয়ে করতে চাইতেন না। কিন্তু বিশেষ মানে ৬০ বছর, ৭০ বছর, এরকম জন্মদিনে বড় করে করেছেন। তার গল্প আছে, বলছি। তা সেদিনের সেই জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাতে হাতে (কাঁপা) হাত মিলিয়ে হ্যাপি বার্থডে-র জায়গায় বলেছিলাম ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার অমিতদা’। জিভ কাটতেই উনি বললেন, ঠিকই তো আছে, আর একটা নতুন বছরই তো শুরু হচ্ছে আমার।
কোনও অনুষ্ঠানে অমিতাভ বচ্চনের উপস্থিতি মানেই ঝড়। ভক্তদের মাথার মধ্যে হঠাৎ কেমন ভুতুড়ে কিছু ভর করে। একবার প্রীতিশ নন্দীর আঁকা কিছু রঙিন ড্রইং-এর প্রদর্শনী হবে জাহাঙ্গীর আর্ট গ্যালারিতে। শুরুর দিনে এলেন অমিতাভ বচ্চন। ভক্তদের ভক্তি আর ভালোবাসার চোটে গ্যালারির বিশাল বড় কাচের দরজাটা ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল! ক্ষয়ক্ষতি মানে, কাটাকুটি বা জখম হয়নি কেউ, সেটাই বাঁচোয়া। রাস্তার লোকরা খবর পেয়ে ঢুকে পড়েছে। মুম্বইয়ে যে কোনও সময় রাস্তায় শতশত লোক। জনপ্রিয়তার এই আর একটা বিপজ্জনক দিক।
মুম্বই শহরের চরিত্রে একটা অদ্ভুত দিক, যে কোনও রকম ছোট-বড় ঘটনা ঘটলেই মুহূর্তে পরিস্থিতি সামলে নিতে পারে। হলও তাই, অমিতাভ বচ্চনের নিজস্ব রক্ষী, জাহাঙ্গীরের লোকজন এবং কিছু পুলিশ দিয়ে গেট আটকে সামলানো হল। সেই ফাঁকে আমরা গ্যালারির মধ্যেকার রেস্তোরাঁ সামোভার-এ ঢুকে পড়লাম। ভিতরে নিশ্চিন্তে চা-সিঙ্গাড়া খেয়েছিলাম সেদিন। বাইরে যেন কিছুই হয়নি। একেবারে মুখোমুখি একই টেবিলে বসার সুযোগ। টেবিলে অমিতদা, জয়াদি, প্রীতীশদা, রীনাদি, আমি আর মধুমিতা।
ঝঞ্ঝাটবিহীন, পরিকল্পিত এবং শান্তশিষ্ট, আমার জীবনের চমকানো একটা বড় অনুষ্ঠানের গল্প করি এবার।
বেঙ্গালুরু ছেড়ে তখন মুম্বইয়ে এসেছি সবে। এই অনুষ্ঠানে আমি অংশীদার। প্রীতীশদার আর আমার কবিতা-ছবির যুগলবন্দি। মুম্বইয়ে প্রথম শো। ১৯৯০ সাল। আশীষ বলরাম নাগপাল, তখনকার একজন ডাকসাইটে যুবক গ্যালারিস্ট এই অনুষ্ঠানের আয়োজক। আশীষকে প্রীতীশদা কিংবা প্রীতীশদাকে আশীষ, কে কাকে ধরেছিল, তা আমি জানি না। এই খানে অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়, দেখা এবং আলাপ ইত্যাদি। বলতে গেলে, বড় তাপ উত্তাপের অংশ হওয়ার সুযোগ।
প্রীতীশদা হঠাৎ ইচ্ছা প্রকাশ করলেন আমার সঙ্গে কবিতা-ছবির প্রদর্শনী করবেন। উনি তখন বেশ বড় রকমের একজন জার্নালিস্ট এবং এডিটর, ‘দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া’ গ্রুপের। আমি গিনিপিগ, কিন্তু জীবনে এসবের মূল্য আছে। যে কোনও মাপের আনন্দের, অনুভূতির মূল্য আছে, সেটা বুঝেছি। অতএব একই ক্যানভাসে কখনও আমি আঁকছি তার ফাঁকে ফাঁকে উনি কবিতা লিখছেন, কখনও উনি কবিতা লিখছেন এবং তার ফাঁকে ফাঁকে আমি কিছু ছবি আঁকছি। ওঁর হাতের লেখা এবং ক্যালিগ্রাফির সেন্স অসাধারণ। তাই দৃশ্যত সত্যিকারের যুগলবন্দি হল।
প্রদর্শনী তো হল, কিন্তু খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি। অমিতাভ বচ্চন ওপেন করতে আসছেন। আর সঙ্গে সঙ্গে সবাই আসছেন। সাংবাদিক, কবি-সাহিত্যিক। খেলোয়াড়, থিয়েটারের মানুষ, ফিল্মস্টার, পুলিশের কর্তা। মুম্বইয়ের কেউকেটা সব। এমনকী আন্ডারওয়ার্ল্ডের লোকজন থেকে রাজনীতিক।
কাগজে বারবার বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে। আমি ওই এগজিবিশনের জন্য একটি পোস্টার করেছিলাম সেই পোস্টারটাই রোল করে মেলিং টিউবে ভরে ইনভাইটেশন কার্ডের পরিবর্তে আমন্ত্রণপত্র হিসেবে পাঠানো হল সবাইকে। শোয়ের দু’দিন আগের বিজ্ঞাপনের ভাষা, ‘আশা করি সমীর মণ্ডলের পোস্টারটি হাতে পেয়েছেন। যদি পান তাহলে আপনি ভাগ্যবান, না হলে পোস্টম্যানের চুল ছিঁড়তে থাকুন। যারা পেয়েছেন তাদের সন্ধে ঠিক সাতটায়, বলার দরকার নেই, কারণ আপনারা জানেন অমিতাভ বচ্চন যখন সাতটা বলেন তখন উনি আসেন ঠিক সাতটায়।’
খবরটা ঠিক পৌঁছে গেল কলকাতার মানুষদের কাছেও। গ্যালারি ৮৮-এর মিসেস সুপ্রিয়া ব্যানার্জি মুম্বই এসেছিলেন। আমাদের সঙ্গে দেখা হল। সুপ্রিয়াদি বললেন, ওই রকম একটা শো কলকাতায় হয় না? প্রীতীশদা বললেন, সমীর যদি ছবি এঁকে দেয় হতেই পারে। সেই শো হল কলকাতায়। তার গল্প অন্যরকম। শোয়ের চরিত্র মোটেই মুম্বইয়ের মতো নয়, একেবারে কলকাতার বাংলা মেজাজে।
খানিকটা বিয়েবাড়ির মেজাজ। শোয়ের আগের দিন বিকেলে বিকেলে যত আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব মুম্বই থেকে যাবে, তাদেরকে নিয়ে কলকাতায় পৌঁছনো হল। থাকার ব্যবস্থা ‘তাজ বেঙ্গল’ হোটেলে। ইকোনমি নয়, এগজিকিউটিভ ক্লাসে করে তাঁদের নিয়ে আসা হয়েছিল বরযাত্রীদের মতো। এম এফ হুসেন, আশীষ নাগপাল, সতীশ কৌশিক, অনুপম খের, কিরণ খের, দু’-চারজন শিল্পী বন্ধু এবং সাংবাদিক এসব মিলে একটা বড় টিম। প্রথম দিন রাতে একটা ইন্ট্রোডাক্টরি পার্টি আর আড্ডা কলকাতার বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে। তার মধ্যে শাবানা আজমি শুটিং করছিলেন কলকাতায়, তাদেরকেও ডেকে নেওয়া হল। আড্ডায় রাত গড়িয়ে গেল।
পরের দিন অর্থাৎ, প্রদর্শনী উদ্বোধনের দিন তাজ বেঙ্গলে সকাল থেকে লোকজন আসা শুরু হয়ে গেল। অমিতাভ বচ্চন তখন তার প্রফেশনাল ব্যাপারে তুঙ্গে, রাজনীতির ব্যাপারেও। দলবল নিয়ে সৌগত রায় এলেন দেখা করতে। সংবাদসংস্থা থেকে লোক আসছে। মধুমন্তি মৈত্র এলেন সঞ্চালনার কাজে আগে থেকে কিছু দেখে নিতে। অনুষ্ঠানের রেকর্ড করবেন এবং পরে একটা, সিডি বা ডিভিডি তখন ছিল না, ভিডিও ক্যাসেট হিসেবে কিছু করবেন। তাজ বেঙ্গল থেকে গ্যালারিতে যাওয়ার কনভয়। উদ্বোধনের সময় বিকেল ৪টে। সময় মতো রওনা হল অনেকগুলো গাড়ি এবং সামনে পিছনে পুলিশের গাড়ি নিয়ে কনভয়। রাস্তায় সিগন্যালের রেড লাইট মানে আমাদের জন্য সেগুলো গ্রিন।
অমিতাভ বচ্চন যেহেতু ভিআইপি এবং মুখ্য অতিথি, তাই পুলিশদের কাজ হল তাকে আগে নিরাপদে ভিতরে ঢোকানো এবং সেক্ষেত্রে বেশ ধস্তাধস্তি করেই কাজটা করতে হল, কারণ কলকাতার ভক্তবৃন্দ। গুরুকে নিয়ে উৎসাহের শেষ নেই, কখন কী করবে তার নিশ্চয়তা নেই। গ্যালারির সাইজটা বেশ ছোট, মোটামুটি একটা আইসক্রিম পার্লারের মতো। অতএব রাস্তায় ফুটপাতে বেড়া দিয়ে ছাউনি করে লোক বসার ব্যবস্থা। উপস্থিত ছিলেন হুসেন, যোগেন চৌধুরী, বিকাশ ভট্টাচার্য, শ্যামল দত্তরায়, পরিতোষ সেন প্রমুখ বিখ্যাত শিল্পীরা। এসেছিলেন সাহিত্যের সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, মঞ্চজগতের আনন্দশংকর, তনুশ্রী শংকর। শিল্প সমালোচক, সাংবাদিক এমন অনেক মানুষ। সব নাম মনে পড়ছে না এখন। থিয়েটার রোডে বেশ কিছুক্ষণ যানজট, মানুষের ভিড়। পাশের বাড়ির সব ছাদ-মাথা ভর্তি, মায় গাছের ওপর!
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গান নয়, একটি পথনাটিকা দিয়ে শুরু হল প্রদর্শনী। কবিতা-ছবির যুগলবন্দি এখানেও। বিষয়বস্তু পুরনো সংস্কৃত প্রেমের কবিতা তাই পুরনো দিনের সংস্কৃত একটি নাটক বাছা হয়েছে। রাস্তায় অভিনয় করবেন অনুপম খের ও সতীশ কৌশিক। নির্দেশক, সতীশ কৌশিক এবং সবাইকে অবাক করে অমিতাভ বচ্চন নিজেই এই নাটকে অংশ নিলেন সূত্রধার হিসেবে।
ভালোয় ভালোয় হোটেলে ফিরে এসে সোয়াস্তি। হোটেলে এসে ঠাট্টা-মশকরা শুরু হল খানিক। যা যা ঘটনা ঘটল সারা দিনে তাই নিয়েই মজার গপ্পসপ্প। এখানে প্রীতীশদাকে লক্ষ্য করে অমিতদা বলে উঠলেন, ‘দেখো প্রীতীশ একটু রাত গভীর হলে তোমাকে ভিক্টোরিয়ার সামনে রাস্তায় ফুচকা খাওয়াতে নিয়ে যাব। প্রীতীশ, আমি কলকাতা তোমার চেয়ে বেশি জানি। কারণ, আমি এখানেই কাজকর্ম করেছি। তার চেয়ে বড় কথা আমি কলকাতার জামাই।’ বারবার যেটা বলেন অমিতদা।
রাতে তাজ বেঙ্গলের ছাদে মহাসমারোহে মহাভোজ। কে যে খাওয়াচ্ছে তা জানি না, কে যে খেতে আসেনি সেটাই দেখার! কলকাতার সমস্ত কেউকেটা মানুষের ভিড়। এত ভিড় যে লাউড স্পিকারে কথা বলতে হচ্ছে। কর্ডলেস মাইক্রোফোন চলে যাচ্ছে হাত থেকে অন্য হাতে। সঞ্চালনা করতে হচ্ছে সেই ভোজন এবং আড্ডার। সঞ্চালনায় পুরো ছাদের ওই ভিড়ের মধ্যে লাউড স্পিকারে মাইকে সেই কাজটি করছেন রীতা ভিমানি। এছাড়া আর.পি.জি-র চেয়ারম্যান, হর্ষবর্ধন গোয়েঙ্কাকেও তদারকিতে দেখা যাচ্ছে। হয়তো তিনিই হোস্ট। তাঁর চিরপরিচিত দরাজ গলায় বক্তব্য রাখছেন অমিতাভ বচ্চন। তিনিই আজকের এই মহাযজ্ঞের মধ্যমণি।
অমিতাভ বচ্চনের ক্যারিশমা বা অমিতাভের উপস্থিতির ম্যাজিকের গল্প এখানেই শেষ হল না। চুপিচুপি বলে রাখি পরের দিন সকালে গিয়েছিলাম পার্ক স্ট্রিট পাড়ায়, যেখানে সমস্ত রকম ভাষায় খবরের কাগজ পাওয়া যায় সকালবেলা। সেখানে দেখতে গেলাম এই অনুষ্ঠানের কোন সংবাদ বেরিয়েছে কি না। বিভিন্ন ভাষায় অবিশ্বাস্যভাবে অসংখ্য কাগজে লেখা বেরিয়েছিল পরের দিনে।
আমাদের এই অনুষ্ঠানে কিংবা অন্যদের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে অমিতাভ বচ্চন কেমন আচরণ করেন তার উদাহরণ তো শোনা হল। এখন ওঁর বাড়ির অনুষ্ঠান হলে যখন আমরা অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হই তখন তিনি কেমন আচরণ করেন সে গল্পে আসি।
অমিতদার ৬০ বছরের জন্মদিনের কথা আগেই বিস্তারিত বলেছি জয়াদি বিষয়ে লেখায়। সেখানে বলেছি, আমন্ত্রণের একটা প্ল্যান বা পরিকল্পনা কত নিখুঁত করা যায় তার কথা। অতিথি বাছাই, আমন্ত্রণপত্র বিলি, সবাইকে অভ্যর্থনা এবং আতিথেয়তা, খাওয়া দাওয়ার তদারকি ইত্যাদি বাড়িশুদ্ধ সবাই মিলে করেছিলেন। এ ছাড়াও হলে গিয়ে অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে ভিড়ে দেখা হবে কি না, সে ভয় কাটাতে নিজেই ঠায় দাঁড়িয়েছিলেন হলের গেটে ততক্ষণই যতক্ষণ না সমস্ত অতিথি হলের মধ্যে ঢুকে যায়। বেশ কয়েকদিন ধরে ধন্যবাদ জ্ঞাপনের চিঠি, গিফট পাঠানো এবং গেটে ওঁর সঙ্গে করমর্দনের ছবি ইত্যাদি যা ফটোগ্রাফাররা তুলেছিল সেগুলোও জনে জনে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। এমন বিশাল পারিবারিক অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা আমি জীবনে দেখিনি।
৭০ বছরের জন্মদিন মুম্বইয়ের ‘ফিল্মসিটি’তে। এবারে আরও বিশাল এবং আরও নতুন চমক। কারণ ততক্ষণে আমরা পেরিয়ে গেছি আরও এক দশক। অনেক বেশি আধুনিকতার দিকে এগিয়ে গেছি। মুম্বইয়ের অন্য মেজাজ। আমন্ত্রণপত্রে আন্তরিকতার চেয়ে অনেক বেশি প্রযুক্তিনির্ভর। কার্ড করা হল এমন কোডেড মেটিরিয়ালে যা ডিটেক্ট করা যায় কোনও মেশিনে। হোটেলে নয়, বড় পরিবেশ তাই অসংখ্য লোক, অসংখ্য গাড়ি এবং সেগুলোকে ঠিকঠাক নিয়ন্ত্রণ করা। প্রায় দু’-তিন কিলোমিটার আগে থেকেই ব্যবস্থা। অর্থাৎ, শহর থেকে বড় রাস্তা পেরিয়ে পরের ঘাট এবং তারপর থেকে আরেকটি টার্নিং পয়েন্ট ইত্যাদি পেরিয়ে যাওয়ার সময়ে দু’-তিনটে জায়গায় সিকিউরিটি সিস্টেম রাস্তাতে। সেখানে রাস্তাতেই গাড়ি থামিয়ে কার্ড দেখাতে বলছে সিকিউরিটি-র লোক। ওদের কাছে হাতে একটা স্ক্যানার, সেটা স্ক্যান করছে এবং গাড়ি ছেড়ে দিচ্ছে দ্রুত। চেক করার একটা নতুন ব্যবস্থা দেখলাম।
এই অনুষ্ঠানে আগের মতো যা খুশি খোলামেলা নয়। কড়াকড়ি ছিল। প্রথমত ড্রেস কোড, স্ট্রিক্টলি ফর্মাল। খাওয়ার ব্যাপারে, সিটডাউন ডিনার ইত্যাদি। হলের মধ্যে অনুষ্ঠান আগেরবার ছিল লাইভ গানবাজনা। যার ইচ্ছা গান গাইতে আসছে গাইছে। অমিতাভ বচ্চন ছিলেন গেটে, এবারও উনি থাকলেন গেটে এবং মাঝে মাঝে ভেতরে কিন্তু এই হলে একটা বিশাল সেট বানানো হয়েছে। এত উঁচু যে সেখানে স্তরে স্তরে প্রায় চারটে বা পাঁচটা ফ্লোর-এর মতো করে ভাগ করে বিভিন্ন জায়গায় উপরে-নিচে অভিনয় হচ্ছে, নাচ, গান। মস্ত বড় হলে সব প্রোগ্রামই স্ক্রিপ্টে বাধা আর মাল্টিমিডিয়া। মানে জ্যান্ত মানুষরাই নানা রকমের ফিল্ম স্ক্রিনের সঙ্গে নাচ-গান করছে।
মানুষটার জনপ্রিয়তার কত যে টুকরো গল্প! একটা বলি।
ড্রেস কোড ফর্মাল এবার, স্যুট চাই। পুরনো স্যুট যা আছে আমার, তা পছন্দ হচ্ছে না। বড় দোকানে গেলাম রেডিমেড কিনতে। রং পছন্দ হয় তো স্টাইল পছন্দ হয় না। স্টাইল পছন্দ হয় তো আমার সাইজে পাওয়া যায় না। অগত্যা নতুন একটা বানাতে চাইলাম। হাতে সময় খুব কম। দেখলাম যে আমার হাতে সময় আছে দু’-তিন দিন আর ওরা নতুনের জন্য সময় নিতে চায় অন্তত সাত দিন, ট্রায়াল এবং কারেকশন মিলিয়ে। বৌয়ের দিকে তাকিয়ে মুখ থেকে বেরিয়ে গেল, অমিতাভ বচ্চনের জন্মদিনে আর যাওয়া হল না। কথাটা ভদ্রলোকের কানে গেল এবং হঠাৎ ঘুরে আমার দিকে তাকাল, কী বললেন? আমি বললাম, অমিতাভ বচ্চনের ৭০ বছরের জন্মদিন, ড্রেস কোড ফর্মাল। আর কোনও কথা নেই, দু’দিনে স্যুটটা বানিয়ে আমার বাড়িতে লোক দিয়ে পাঠিয়ে দিল।
৭০ বছরের জন্মদিনে ছবির প্রদর্শনী। বিশাল ক্যাটালগ। এই প্রদর্শনীটাও আগের ৬০ বছরের মতো জয়াদি প্ল্যান করেছিলেন। ভারতের ৭০ জন শিল্পীর ছবি বা শিল্পীকে বাছাই করেছিলেন শিল্প-বিশেষজ্ঞ দিয়ে। ‘অমিতাভ বচ্চন’ মানে কী? সেই বিষয়ে সারা ভারতের শিল্পীরা ছবি আঁকলেন।
…………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………
এইভাবে অমিতাভ বচ্চন-কে ঘিরে উৎসব আর অনুষ্ঠানের কথাই বলা হল কিছুটা। বাকি রইল আরও কিছু। মানুষটার সংসার, শরীর, রক্তমাংসের দিকে গেলাম না। তবে একটা কথা প্রমাণ হয় যে, একজন মানুষ সম্পর্কে আমরা যখন তখন ‘সেলিব্রিটি’ শব্দটার ব্যবহার করি আজকাল, তবে এই মানুষটার ক্ষেত্রে যথাযথ হবে ‘সেলিব্রেশন’ শব্দটা। জীবন অনেক বড়। জীবন মানে উদযাপন। এখানে আমি একজন বড় মানুষের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে বড় মাপের কোনও ঘটনার, কোনও অবস্থানের সাক্ষী হয়ে রইলাম।
… পড়ুন ‘মুখ ও মণ্ডল’-এর অন্যান্য পর্ব …
পর্ব ২৬। রুদ্রদা, আপনার সমগ্র জীবনযাত্রাটাই একটা নাটক, না কি নাটকই জীবন?
পর্ব ২৫। ক্ষুদ্রকে বিশাল করে তোলাই যে আসলে শিল্প, শিখিয়েছিলেন তাপস সেন
পর্ব ২৪: নিজের মুখের ছবি ভালোবাসেন বলে জলরঙে প্রতিলিপি করিয়েছিলেন মেনকা গান্ধী
পর্ব ২৩: ড. সরোজ ঘোষ আমাকে শাস্তি দিতে চাইলেও আমাকে ছাড়তে চাইতেন না কখনও
পর্ব ২২: মধ্যবিত্ত সমাজে ঈশ্বরকে মানুষ রূপে দেখেছেন রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়
পর্ব ২১: ‘তারে জমিন পর’-এর সময় আমির খান শিল্পীর আচার-আচরণ বুঝতেই আমাকে ওঁর বাড়িতে রেখেছিলেন
পর্ব ২০: আমার জলরঙের গুরু শ্যামল দত্ত রায়ের থেকে শিখেছি ছবির আবহ নির্মাণ
পর্ব ১৯: দু’হাতে দুটো ঘড়ি পরতেন জয়াদি, না, কোনও স্টাইলের জন্য নয়
পর্ব ১৮: সিদ্ধার্থ যত না বিজ্ঞানী তার চেয়ে অনেক বেশি কল্পনা-জগতের কবি
পর্ব ১৭: ডানহাত দিয়ে প্রতিমার বাঁ-চোখ, বাঁ-হাত দিয়ে ডানচোখ আঁকতেন ফণীজ্যাঠা
পর্ব ১৬: আমার কাছে আঁকা শেখার প্রথম দিন নার্ভাস হয়ে গেছিলেন প্রধানমন্ত্রী ভি. পি. সিং
পর্ব ১৫: শঙ্করলাল ভট্টাচার্য শিল্পীদের মনের গভীরে প্রবেশপথ বাতলেছিলেন, তৈরি করেছিলেন ‘বারোয়ারি ডায়রি’
পর্ব ১৪: নাটককে পৃথ্বী থিয়েটারের বাইরে নিয়ে এসে খোলা মাঠে আয়োজন করেছিল সঞ্জনা কাপুর
পর্ব ১৩: চেষ্টা করবি গুরুকে টপকে যাওয়ার, বলেছিলেন আমার মাইম-গুরু যোগেশ দত্ত
পর্ব ১২: আমার শিল্প ও বিজ্ঞানের তর্কাতর্কি সামলাতেন সমরদাই
পর্ব ১১: ছবি না আঁকলে আমি ম্যাজিশিয়ান হতাম, মন পড়ে বলে দিয়েছিলেন পি. সি. সরকার জুনিয়র
পর্ব ১০: তাঁর গান নিয়ে ছবি আঁকা যায় কি না, দেখার ইচ্ছা ছিল ভূপেনদার
পর্ব ৯: পত্র-পত্রিকার মাস্টহেড নিয়ে ম্যাজিক দেখিয়েছিলেন বিপুলদা
পর্ব ৮: সৌমিত্রদার হাতে কাজ নেই, তাই পরিকল্পনাহীন পাড়া বেড়ানো হল আমাদের
পর্ব ৭: ঘোড়াদৌড়ের মাঠে ফ্যাশন প্যারেড চালু করেছিলেন মরিন ওয়াড়িয়া, হেঁটেছিলেন ঐশ্বর্য রাইও
পর্ব ৬: একাগ্রতাকে কীভাবে কাজে লাগাতে হয় শিল্পের বিভিন্ন ক্ষেত্রে, ধরিয়ে দিয়েছিলেন গুরু গোবিন্দন কুট্টি
পর্ব ৫: কলকাতা সহজে জয় করা যায় না, হুসেন অনেকটা পেরেছিলেন
পর্ব ৪: যে পারে সে এমনি পারে শুকনো ডালে ফুল ফোটাতে, বলতেন চণ্ডী লাহিড়ী
পর্ব ৩: সহজ আর সত্যই শিল্পীর আশ্রয়, বলতেন পরিতোষ সেন
পর্ব ২: সব ছবি একদিন বের করে উঠোনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলাম, বলেছিলেন অতুল বসু
পর্ব ১: শুধু ছবি আঁকা নয়, একই রিকশায় বসে পেশাদারি দর-দস্তুরও আমাকে শিখিয়েছিলেন সুনীল পাল