আমরা সিনেমা দেখছি, যে কোনও মূহূর্তে ছিটকে আসতে পারে গুলি, এর মধ্যে পণ্ডিতের নজর পড়ায় গুলির আগেই খোকনদা ছিটকে বেরিয়ে গিয়েছিল। ঢুকে পড়েছিল পাশের গলিতে। গলিটার নাম মথুর সেন গার্ডেন লেন।
২.
পিচের রং কি তখন আলাদা ছিল? কালো কি এখন কম কালো হয়েছে? আকাশ কি অন্য নীল ছিল তখন? রয়ালের চাঁপ-এর সেই গন্ধটা আছে? স্কুল, কলেজ, অফিস, পাড়াটা, রাজ্যটা, দেশটা, কাকগুলো? অডি গাড়ির চাকায় হিসি করা পাড়ার নেড়িটা?
কত আর হবে বয়স তখন, এগজ্যাক্টলি বলতে পারব না, কিন্তু এটুকু মনে আছে ন’-নম্বর বি. কে. পাল অ্যাভিনিউ-এর বারান্দার ওদিকে কী ঘটছে, দেখতে হলে আমাকে একটা বাতিল গাড়ির ব্যাটারির খোলের সাহায্য নিত হত। বেঁটে ছিলাম, ব্যাটারির খোলের ওপর দাঁড়ালে পিচ রাস্তাটা দেখতে পেতাম। দেখতে পেতাম উল্টোদিকে নিপেনবাবুর টেলারিং শপ। তখন ট্রায়াল দিতে হত। ওই নিপেনবাবুর দোকানে পুজোর আগে ট্রায়াল দিতে গিয়ে কোমর থেকে ঢলঢলে প্যান্টটা আমার পড়ে গিয়েছিল। ছোটবেলার লজ্জাগুলো বড় হয়, মনে থেকে যায়। কোনওরকমে সে যাত্রায় বেঁচেছিলাম। নিপেনবাবুর মাপ নেওয়ার ভুলে আমার যে এমব্যারাসিং অবস্থা হয়েছিল, তা দ্রৌপদীর থেকে কম নয়।
ওই নিপেনবাবুর সঠিক নামটা বোধহয় ‘নৃপেনবাবু’ হবে, কিন্তু বেশিরভাগই ওঁকে ‘নিপেন’ বলেই ডাকত, বাঙালির র-ফলা অমিট (omit)-এর ইতিহাস খুব নতুন নয়। ওই নিপেনবাবুর দোকানেই আমি লুকতে দেখেছি খোকনদাকে (নাম পরিবর্তন করলাম), পুলিশের তাড়া খেয়ে। ওখানে বিকেলে বসে থাকতে দেখেছি বসন্ত চক্রবর্তীকে, ওই দোকানের সামনে দিয়েই দৌড়তে দেখেছি বসন্তবাবুর বড় ছেলেকে, হাতা গোটানো সাদা ফুলশার্ট আর মায়ের সরু লাল পেড়ে শাড়িটাকে লুঙ্গির মতো পরে। পিছনে হাত করে পেটো নিয়ে দৌড়চ্ছে আমাদের পাড়ার শ্যামলা সুঠাম হিরো। পুরো সিনেমা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিনেমা দেখেছি। পরে ‘দর্পণা’-র ব্যালকনিতে বসেও দেখেছি তার সিনেমা। সিটিও দিয়েছি আমাদের লোকাল হিরোর অ্যাকশনে। সি.আর.পি.– তাই বলতাম আমরা, তাদের প্রতি একটা অদ্ভুত ভয় ছিল সেই সময়ের মনে। আমার দুই পিঠোপিঠি মামাতো ভাই– উল্লাস, পরীক্ষিৎ আর আমি তিনজনে কিছু একটা ডানপিটেগিরি করছিলাম। আমড়া গাছে উঠে আমড়া-টামড়া পাড়ছিলাম বোধহয়। কড্ডের চক্রবর্তী ঠাকুরঘরে আমাদের ভয় ছিল সেজ মামিমা যদি জানতে পারে! সেজ মামিমার চোখ দেখলেই কীরকম ভয় লাগত, সেই ভয়ের কথা বলায় উল্লাস বলেছিল, ‘সেজ জেঠিমা কি সি.আর.পি. না কি?’– বি. কে. পাল অ্যাভিনিউ-এর রাস্তায় পুলিশের সঙ্গে মাঝেমধ্যেই দর্শন মিলত তাদের, খাঁকি পোশাকে।
এক সর্দারজি সি.আর.পি.-র কথা মনে আছে। হাঁটু গেড়ে বসে রাইফেল তাক করে আছে পণ্ডিতের চায়ের দোকানের দিকে। প্রায় শ’-দুয়েক মিটার দূরত্ব হবে, বন্দুক থেকে পণ্ডিতের চায়ের দোকানের। চায়ের দোকানে চা খেতে এসেছে খোকনদা। সর্দারজি মওকা পাচ্ছে না গুলি করার। মাঝেমধ্যেই জোড়াবাগান থানার বড়বাবু এসে ওর পাশে দাঁড়িয়ে কী যেন বলে যাচ্ছেন। ওকে কীরকম একটা নার্ভাস লাগছে। সর্দারজি অবিচল তার লক্ষ্যে, হাত তুলে ওসিকে আশ্বস্ত করে, আবার ডুব দিচ্ছে তার নিশানায়। আমরা সিনেমা দেখছি, যে কোনও মূহূর্তে ছিটকে আসতে পারে গুলি, এর মধ্যে পণ্ডিতের নজর পড়ায় গুলির আগেই খোকনদা ছিটকে বেরিয়ে গিয়েছিল। ঢুকে পড়েছিল পাশের গলিতে। গলিটার নাম মথুর সেন গার্ডেন লেন। ওই রোগা গলিটার ভেতরে ঢুকলে আরও একটা সরুতর গলি দিয়ে ঢুকে খানিকটা গেলে, তারপর তস্য সরু একটা গলিতে ঢুকলে বসন্ত চক্রবর্তীর বাড়ি। ওদিকে গেলে দেখে আসবেন। দেখা উচিত। তবে, বসন্তবাবুর বাড়ি না বলে, গৌরাঙ্গর বাড়ি কোনটা বললে, সুবিধে হবে। লোকে চট করে চিনিয়ে দেবে, দিতে পারে।
সেদিন গুলি চলেনি, খোকনদা বেঁচে গিয়েছিল।
কিন্তু গুলি চলেছিল, বোম পড়ত, আমাদের বাইরের ঘরে বড়কাকুর বন্ধুদের ব্রিজের আসর বসত, আর হঠাৎ বন্ধ করতে হত দরজা-জানলা– কাঁদুনে গ্যাসের ঝাঁঝে।