হুমা কুরেশি তখনও তত বিখ্যাত নয়। তবে বিজ্ঞাপনসফল। কিন্তু ফিচারে আসেননি। মুম্বইয়ের এক ভোরে, সাদাটে শার্ট পরা আলগোছে হুমার ছবি উঠেছিল বেশ কিছু। তারই বাড়িতে। সেটা ২০০৯। যদিও এই ছবি তোলার নেপথ্যে ’৫১ সালের একটা ইতিহাস লুকিয়ে। কী সেই ইতিহাস? ছবি কীভাবে ধরে রাখে ইতিহাসের দু’-চার মুহূর্তের ম্যাজিক– পড়ে নিন এই লেখায়, এই অভিজ্ঞতায়। মিস করবেন না।
৪.
তখন মুম্বইয়ে থাকি। কাজ করি বায়োস্কোপে। বিজ্ঞাপনের ছবি বানাই। তারই সঙ্গে চলছে ছবি তোলা। একদিন রাত্তিরবেলা পুরনো পত্রপত্রিকা ঘাঁটছি। একটা ফোটোএসে-তে থমকে গেলাম। সাধারণত পাতার পর পাতা দ্রুত উল্টে চলি। দেখি। কিন্তু এই ফোটোএসে-তে থমকে যাওয়া স্থায়ী হল প্রায় ৫-৭ মিনিট! একটা ছবির সিরিজ এত সময় ধরে প্রায় কেউ-ই দ্যাখে না ব’লে আমার ধারণা। মাথায় কী একটা বুদ্ধি খেলে গেল! নোটখাতায় লিখে রাখলাম সেইসব।
ক’দিন পরে শুট করেছিলাম হুমা কুরেশির সঙ্গে। হুমা তখন আজকের মতো বিখ্যাত হুমা কুরেশি নয়। বিজ্ঞাপনে মুখ দেখিয়েছে। ইন্ডাস্ট্রির বাইরে আম পাবলিকের কাছে তেমন সুপরিচিত মুখ হয়ে ওঠেনি। তবে হতে খুব একটা দেরিও নেই। ‘গ্যাংস অফ ওয়াসিপুর’-এর শুটিং চলছে যখন, এটা সেই সময়ের কথা।
লোকেশন দেখে এলাম, যেখানে হুমার ছবি তুলব। লোকেশন অবশ্য হুমারই বাড়ি। ঠিক কোথায় শুট করব সেই বাড়িতে, ভেবে রেখেছি তাও। হুমাকে বললাম, ‘তোর কাছে সাদাটে কোনও শার্ট আছে?’
বলল, ‘না, আমার কাছে তো নেই।’
‘ঠিক আছে, তোর টাইট ডেনিমটা পর, আর একটা হাবিজাবি কিছু পরিস, শার্ট আমি নিয়ে আসছি।’
হুমার বাড়িতে গেলাম। শার্টটা দিলাম ওকে। পরিষ্কার ঝকঝকে শার্ট। একটু ভাঁজ করে নিয়ে পরল হুমা। তখন সদ্য ভোর হয়েছে মুম্বইতে। এককাপ কফি করে দিল ও। বললাম, ‘তুই উপুড় হয়ে শুবি, সোজা হয়ে নয়। আর যা খুশি নিজের মতো কর, আমার আপত্তি নেই।’
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
এসবের পর হুমা ব্যস্ত হয়ে পড়ল। পরপর অনেকগুলো ফিচার ছবি হাতে। আমারও হুমার সঙ্গে ধারাবাহিক যে যোগাযোগ, তা কমে এল। একদিন হঠাৎই ফোন করল হুমা। ওর বাড়িতে সেই ছবি তোলার প্রায় বছর চার-পাঁচ পর। উত্তেজিত গলা! অল্প রাগ আর অনেকটা আনন্দ মিলেমিশে আছে সে গলায়। কোনও হাই-হ্যালো নেই। হালজিজ্ঞাসা নেই। হুমা সেদিন প্রথমেই বলেছিল, ‘মধুবালা?’
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
মজার ব্যাপার, এই প্রত্যেকটা ছবিই মেকআপ ছাড়া। ওকে আগেই বলেছিলাম, ‘তুই গাঢ় মেকআপে সুন্দর সেজে আসবি না।’ অবশ্য আগের দিন রাতে ফোন করেছিলাম ওকে। বলেছিলাম, ‘যা, তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়, তাহলে সকালবেলায় তোকে ফ্রেশ লাগবে।’ হুমার যদিও বিনা মেকআপে একটু আপত্তি ছিল। কিন্তু শেষমেশ রাজি হয়ে গিয়েছিল।
এক রোল বা দেড় রোল মতো শুট করেছিলাম বোধহয়। হুমা ব্রেকফাস্ট করে দিল নিজের হাতে। দিল্লির বিখ্যাত ‘সালিমস’ রেস্তরাঁ যাঁদের, হুমা সেই পরিবারেরই মেয়ে। ওর হাতে একাধিকবার বিভিন্নরকম খাবার খেয়েছি এবং বিশ্বাস করুন, প্রতিবারই প্রত্যেকটা খাবারই ছিল অত্যন্ত ভালো খেতে! ওকে বলতাম, অভিনেত্রী না হলে, যে কোনও দিন তুই শেফ হয়ে যেতে পারতিস!
এ ঘটনার ক’দিন পর দিল্লি যাই একটা কাজে। সেসময় সালিমস-এর ছোট ছোট শাখা ছড়িয়ে ছিল দিল্লির এদিক-সেদিকে। খোঁজটোজ করে চলে যাই একটা সালিমস-এর শাখায়। হুমার কাছ থেকে আগেই জানা হয়ে গিয়েছিল কোন খাবারগুলো সালিমসের ‘মাস্ট ট্রাই’। খেলাম সেসব। এবং ফোন করলাম হুমাকে। বললাম, ‘তুই যা বলেছিলি, সেটা সত্যিই! তোদের খাবারগুলো অসাধারণ।’ হুমা একথা-সেকথায় জানার চেষ্টা করেছিল বটে আমি ঠিক কোন দোকানটায় রয়েছি। কিন্তু আমি সাফ জানালাম, ‘বলব না। তবে খাবার যে দারুণ, সেকথা বলতেই ফোন করেছি।’
এসবের পর হুমা ব্যস্ত হয়ে পড়ল। পরপর অনেকগুলো ফিচার ছবি হাতে। আমারও হুমার সঙ্গে ধারাবাহিক যে যোগাযোগ, তা কমে এল। একদিন হঠাৎই ফোন করল হুমা। ওর বাড়িতে সেই ছবি তোলার প্রায় বছর চার-পাঁচ পর। উত্তেজিত গলা! অল্প রাগ আর অনেকটা আনন্দ মিলেমিশে আছে সে গলায়। কোনও হাই-হ্যালো নেই। হালজিজ্ঞাসা নেই। হুমা সেদিন প্রথমেই বলেছিল, ‘মধুবালা?’
বললাম, ‘হ্যাঁ’।
বলল, ‘আপনি তো কোনও দিন বলেননি মধুবালা!’
‘আমি তো মধুবালার ছবি দেখেই ইন্সপায়ারড হয়ে ছবিটা তুলেছিলাম। আর অভিনেত্রী হিসেবে মধুবালা শুনলে একটু নার্ভাস হয়ে যেতিস না? ছবিটাও দেখতে চাইতিস হয়তো!’ বললাম আমি।
এখানে বলে নেওয়া ভালো, হুমা দিল্লির খানদানি মুসলমান পরিবারের মেয়ে। ও শহরে হুমা সকলকেই ‘আপ’ করে বলা শিখেছিল। আর কর্মসূত্রে এসে পড়েছিল মুম্বইতে– যেখানে ‘আপ’ করে বলার তেমন কোনও রেওয়াজ ছিল না। আমাকেও তাই ‘আপনি’ই বলত।
আমার তোলা ওর ছবিগুলো নিয়ে অনেক কথা হয়েছিল সেই ফোনবেলায়। অনেক দিন পর মধুবালার জন্য হুমার সঙ্গে কথা, মধুবালা এ জিনিস জানলেন না, এই যা।
শুরুতে যে ফোটোএসে-র কথা বলেছিলাম, যা দেখে সাধারণের তুলনায় একটু বেশিই সময় ব্যয় করেছিলাম, তা মধুবালারই। জেমস বুর্ক সেই ছবি তুলেছিলেন ১৯৫১ সালে। বেরিয়েছিল ‘লাইফ’ ম্যাগাজিনে। হুমা বলেছিল, ‘যখন জানতাম না এত কিছু, তখনও বলেছি ছবিটা ভালো, যখন জানলাম, তখনও বলছি– ভীষণ ভালো ছবি।’
মধুবালা ও হুমা, আপনাদের দু’জনকেই ধন্যবাদ। ধন্যবাদ জেমস বুর্ক, আপনাকেও।
(চলবে)
…ফ্রেমকাহিনির অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৩। রণেন আয়ন দত্তর বাড়ি থেকে রাত দুটোয় ছবি নিয়ে বেপাত্তা হয়েছিলেন বসন্ত চৌধুরী
পর্ব ২। ইশকুল পার হইনি, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত একটা ছোট্ট রামের পেগ তুলে দিয়েছিল হাতে
পর্ব ১। ঋতুর ভেতর সবসময় একজন শিল্প-নির্দেশক সজাগ ছিল
কিন্তু কেন আমরা এত হিংস্র হয়ে উঠলাম? কেন তাকে পিটিয়ে মারার আগে খেতে দিলাম? কী জানি, একেক সময় মনে হয়, পথের ধারে যে মাংসর দোকানের সামনে দিয়ে আমরা যাতায়াত করি আর লাইনে দাঁড়িয়ে থাকি, সেখানেও কাটার আগে পাঁঠাকে কাঁঠাল পাতা খেতে দেওয়া হয়।