Robbar

মাপের ভুলভাল, পাগলের মাপজোখ

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 7, 2025 7:23 pm
  • Updated:December 7, 2025 7:23 pm  

দূরত্ব, ওজন, সংখ্যার মাপ পরিমাপের নানা একক। নামগুলোও ছিল আমাদের ছেলেবেলায় অন্যরকম। গজ-ফুট-ইঞ্চি, মন-সের-ছটাক, রতি-ভরি-তোলা, কড়া-বুড়ি-গণ্ডা, টাকা-আনা-পাই, পণ-কাঠা-কাহন ইত্যাদি। আর ছিল আমাদের শরীরের অংশ। এক আঙুল, দু’-আঙ্গুল, চার আঙুল, এক বিঘৎ, এক হাত, দু’হাত। গণ্ডুষ, মুষ্ঠি। মানে, হঠাৎ কেউ এল বাড়িতে, তো আর দু’মুঠো চাল ফেলে দে হাঁড়িতে।

সমীর মণ্ডল

১৪.

শীত শীত কিংবা স্যাঁতসেঁতে মেজাজের সঙ্গে ধোঁয়া ওঠা একভাঁড় চায়ের যা সম্পর্ক, ঠিক তেমনই সম্পর্ক ‘বিড়ি’র সঙ্গেও। সোজা বাংলায়– বিড়ির টান, সে আপনি যে অর্থেই নিন। এই দুটো বাক্য লিখেই, মানে দু’টানেই আমার মেজাজ বেশ ফুরফুরে হয়ে গেল।

চিত্রকলার ব্যাপারে আমার জলরং সম্পর্কে ৫০ বছরে যেটুকু জ্ঞানগম্মি হয়েছে তাতে তেলরঙের সঙ্গে তার তফাত বুঝতেই অর্ধেকের বেশি সময় চলে গেল। এই পরিণত বয়সে আপনাদের চুপিচুপি বলি, এতদিন বুঝে এসেছিলাম তেলরং হচ্ছে ‘টাইটানিক’ আর জলরং ‘ডিঙি নৌকো’। ফাইটার প্লেন চালানো আর সাইক্লিং। আমি তাই ভেবে এসেছিলাম। কিন্তু এখন ফর্মুলা দাঁড়িয়েছে, সবার সমান অধিকার, কেউ কারও থেকে ছোট নয়। আমিও বিশ্বাস করতে শিখেছি, প্রতিটা জিনিসের একটা স্বতন্ত্র চরিত্র থাকে, তাদের মান থাকে। সেটা দামের দিক থেকে কিংবা সাইজের দিক থেকে বিচার করা যায় না।

শিল্পী: সমীর মণ্ডল

আরও একটা জিনিস হচ্ছে ‘নস্টালজিয়া’। এই নস্টালজিয়াটা কেউ কেউ খুব উপভোগ করছে। আনন্দ হচ্ছে। কিন্তু যারা ওই ফর্টিনাইনার্স বা নিচে, তারা শব্দটাকে ভীষণ ক্লিশে মনে করে। অর্থাৎ, যদি পিছনটা নিয়েই এত সময় নষ্ট, সামনেরটার কী পরিণতি হবে? সিভিলাইজেশন? প্রগতি? উন্নয়ন?

বিড়ির কথা তুলেছিলাম শুরুতে। ‘ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর’, এই সতর্কবাণী মাথায় রেখেই আমি স্মৃতি থেকে পুরনো দিনের একটু গল্প করব।

বিড়ির ধূমপান সাধারণত নিম্নবিত্তের সঙ্গে যুক্ত, কারণ দাম, সাধারণ সিগারেটের তুলনায় অনেক কম। উচ্চবিত্তের কেউ বিড়ি সেবন করলেও সবসময় প্রকাশ্যে নয়। যদিও সাম্প্রতিক কালে এই প্রবণতায় কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। প্রসঙ্গত মনে পড়ছে, মুম্বইয়ের শিল্পী ও সাহিত্যিক মিলন মুখোপাধ্যায় বিড়ি খেতেন নিয়মিত, আমাদেরও দিতেন, আর সেগুলোকে রাখতেন ‘555’ সিগারেটের প্যাকেটে। সাহিত্যিক সমরেশ বসুর ঝুল পকেটে থাকত বিড়ির বান্ডিল। ধন্য হয়েছি ওঁর কাছ থেকে বিড়ি চেয়ে খেয়ে, সেকালের ময়দানে বইমেলার মাঠে।

ধূমপানের স্থান-কাল-পাত্র দেখার মতো। যত্রতত্র নিত্যযাত্রীদের ট্রেনে বাসে একসময় প্রচুর পরিমাণে বিড়ি খাওয়ার অভ্যেস ছিল। অফিস কাছারিতে কাজের জায়গায় একাধিক মানুষ একজোটে আর ছুতোর মিস্ত্রী, কামার, কুমোর, রাজমিস্ত্রি, ঠাকুর গড়ার পোটো– এরা সব একা একা। বিড়ি টানার চমৎকার মেজাজ ছিল নাটকের দলে। ভাঁড়ে করে চা আর ওই ভাঁড়টাকেই ছাইদানি বানিয়ে রিহার্সালের ফাঁকে ফাঁকে।

গ্রামীণ যাত্রাপালায় কিংবা থিয়েটার চলাকালীন মাঝে মাঝে, দুটো সিনের মধ্যেকার অবসরে বিড়ি, মনের জোর বাড়ায়, মানে এনার্জি-বর্ধক। রামযাত্রায় মঞ্চের বাইরে দাঁড়িয়ে সীতাকে বিড়ি টানতে দেখে মজা পেয়েছে অনেকেই। ছৌ-নাচের একটা দৃশ্য কল্পনা করুন, যেখানে অনেক কসরতের পরে দুর্গা মহিষাসুরকে ত্রিশূলে বিদ্ধ করেছেন। কয়েক মুহূর্তের জন্য দৃশ্যটা ফ্রিজ হয়ে গেল। পুরোহিত-রূপী একজন এসে ঘণ্টা বাজিয়ে পুজো করতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে কম্পোজিশন ভেঙে গেল। মুহূর্তে পুরোহিত বেরিয়ে গিয়ে বিড়ি ধরাল। দু’টানের পর বিড়িটা চলে গেল অসুরের হাতে, অসুরের হাত থেকে বাঘ এবং বাঘের হাত ঘুরে শেষ পর্যন্ত দুর্গার মুখে!

বাংলার ঐতিহ্য, দেশের গর্ব: ছৌ-নাচ

আর ছিল কলেজ বিড়ি, ছোট ছোট সাইজ, দু’-তিন টান। দুটো পিরিয়ডের ফাঁকে বাইরে গিয়ে ফুঁক ফুঁক দু’-টান মেরে ফেলে দেওয়া। যারা শীতের রাতে খালে-বিলে নৌকো নিয়ে মাছ ধরতে যায়, তাদের কাছে বিড়ি বন্ধু। সঙ্গ দেয়, ভয় কাটায়, অবসাদ দূর করে। ওই সামান্য আগুনের সংস্পর্শে যেন সে শীত থেকে বেঁচে গেল, এমনই মানসিক অবস্থা। বিড়ি টানা এবং জ্বালানোর মধ্যেও কায়দা আছে। একটা দেশলাইকাঠিতে একটা বিড়ি ধরানো কৃতিত্বের ব্যাপার। সমুদ্রে যারা মাছ ধরতে যায় তাদের দেখেছি ঝোড়ো হাওয়ার মধ্যেও গ্যারান্টি দিয়ে একটা দেশলাইকাঠিতে একটা বিড়ি ধরাতে।

বিড়ির সঙ্গে থাকে হাতের মুদ্রা বা আঙুলের কম্পোজিশন। তর্জনী গোল হয়ে বৃদ্ধার মাথায়। তার ফাঁকে বিড়ি। কখনও বা তর্জনী আর মধ্যমার মাঝখানে বিড়ি। পাশে অনামিকা কনিষ্ঠা ঝুঁকে আছে তালুর দিকে, বৃদ্ধা সরে আছে বাইরে। সোজাসুজি মুখ থেকে বাইরের দিকে বিড়ির আগুন। মুদ্রায় কখনও অগ্নি, কখনও বরাভয়। গলগল করে ধোঁয়া মুখ দিয়ে কখনও বা নাক দিয়ে। দু’হাতে কাজ থাকলে দাঁতে চেপে বিড়ি, ঠিক যেমন উত্তমকুমার ঠোঁটের সিগারেটে হাত না ঠেকিয়ে ডায়লগ বলেন।

বিড়ি তৈরি কুটিরশিল্প শুধু নয়, তার নান্দনিক দিকগুলোও দারুণ। এর কারিগরি দিকগুলো আর হাতের মাপজোখ উপভোগ করার মতো। বিড়ির পাতা, যে সে পাতা নয়, দেখতে খানিকটা শালপাতার মতো হলেও সেটাও একটা তামাকপাতা। তার আবার উল্টো সোজাও আছে। গায়ে জল ছিটিয়ে কিছুক্ষণ ভিজিয়ে নরম করে তারপরে কাটতে হয় বিড়ির প্রয়োজনীয় ছাঁচে। টিনের টুকরো, পাতা কাটার ফর্মা, ছাঁচ বা টেমপ্লেট। অদ্ভুত জ্যামিতিক আকার! চতুর্ভুজ কিন্তু চারটে বাহুর চারটেই প্রায় বলতে গেলে চার রকম। পাতার উপরে ছাঁচ ফেলে চার পাশে কাঁচি ঘুরিয়ে কাটতে হবে। সাজানোটা খানিকটা জিগস পাজ্‌লের মতো। অপচয় চলবে না।

সুখটানের আয়োজন: বিড়ি তৈরির কাজ

পাতার মধ্যে তামাককুচি দিয়ে বিড়িবাঁধা। সরু মোটা দু’প্রান্তে দু’রকম মুখ বন্ধ। কঞ্চির কলমের মতো বস্তুটি দিয়ে দু’পাশের মুখ মোড়া হয়। এই দু’রকমের একদিকে সানাইয়ের যে অংশটা ঠোটে চেপে ফুঁ দিতে হয় সেরকম। অন্যদিকের মুখটা ধুতরো ফুল না হলেও কৃষ্ণকলির না-ফোটা কুঁড়ির মতো চেহারা। শিবঠাকুরের মতো কানে গুঁজে গ্রামীণ নিত্য বিড়ি সেবনকারীদের আকছার যত্রতত্র ঘুরে বেড়াতে দেখেছি।

পাতা তামাকে মোড়কের শেষ কাজ, এরপর পেটে সুতো দিয়ে বেঁধে দেওয়া। লাল সুতো, সবুজ সুতো, সাদা সুতো। সুতোর রঙের মানে আছে। রং তো নয়, আসলে তামাকের তলকের তীব্রতা আর কোমলতার সাংকেতিক চিহ্ন। তাছাড়া কাঁচা বিড়ি এবং সেঁকা বিড়ি, এই দুটো ব্যাপার ছিল। অর্থাৎ বিড়ি বাঁধার পরে যে মুখটা ফুলের মতো সেই দিকটা আগুন থেকে দূরত্বে রেখে সেঁকে নেওয়া হত। তার ওপরে অনেকটাই স্বাদ এবং ঝাঁঝের ব্যাপারটা নির্ভর করে। শেষে বিড়ির বান্ডিলের গায়ে জড়িয়ে দেওয়া কোম্পানির লেবেল।

বিড়ির ব্যাপারে একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে মনে হয়। কারণ, এই সিরিজে অর্থাৎ অল্পবিজ্ঞানে বিড়ি এতটা প্রাধান্য কেন পাবে? আসলে ‘মাপজোখ’ বিষয়ে লিখতে বসেছিলাম, গল্প করতে লেগে গেলাম।

পাঠক ভাবতে পারেন– তুমি কি তাহলে নিজেই বিড়ি বাঁধার কাজ করতে? আসল কথা খুলে বলি। আমি ছাত্রজীবনে নিয়মিত বিড়ি বাঁধতাম! তবে শিশু শ্রমিক হিসেবে নয়, বাবার জন্য। বাবা ছিল ধূমপায়ী এবং মিতব্যয়ী। প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক।

গ্রামীণ জীবনে ছাত্রাবাস্তায় বিড়ি-বাঁধা, ঝুড়ি-বাঁধা, বেড়া-দেওয়া থেকে সমস্তই আমাদের করতে হত বাবার সঙ্গে। অভাবের সংসারে সবকিছু কেমন মেপে মেপে। বাবার নানা মাপ। গাছের চারা লাগানোর মধ্যে ফাঁকের মাপ। নারকেল চারার নুন। গোলপাতার ঘর ছাউনি। মাটির দেওয়াল বানানোর কাদামাটির জলের মাপ, হাত-কোদালের কোপের মাপে কাঁচামাটির ইট কিংবা টাইল। আদা, হলুদ, ওল, কচু, পালং, মুলো, ফুলকপির চাষে জলের মাপ। শশা, চিচিঙ্গা, লাউ-কুমড়োর মাচানের মাপ। এছাড়াও স্কুলে পড়ার সময়ে আমাদের নানা রকম সমাজসেবা, হাতে-কলমে কাজ ইত্যাদি, যাকে পরবর্তীকালে ‘ওয়ার্ক এডুকেশন’ বলা হত– সেরকম কাজও করতাম। সেখানে পরিষ্কার বলা হত, এগুলো করলে তুমি হাতেকলমে শিখবে, আবার বড় হয়ে এই দিয়ে রোজগারও করতে পারবে।

গ্রামের মাটির বাড়ি

এই যে বিড়ি-বাঁধা, তা আমি শিখেছিলাম অনিলকাকার কাছে। অনিলকাকা, পেট-মোটা, কালো, টাকমাথা, খর্বকায় চেহারার হলেও তার চোখ দুটো জ্বলেজ্বলে আর মুখটাতে একটা অসম্ভব সুন্দর হাসি। রূপকথার সঙ্গে অনিলকাকার একটা অদ্ভুত মিল আছে। তা হল, ওরা সাত ভাই আর এক বোন। সাত ভাইয়ের মেজো ভাই। আর ছ’জন লেখাপড়া শিখে জীবনে প্রতিষ্ঠিত, চাকরি-বাকরি করে। অনিলকাকার পেশা– বিড়ি-বাঁধা।

এই বিড়ি-বাঁধার যে কারখানা ছিল আমাদের গ্রামে, সেখানে মাঝেমাঝেই যেতে ভালো লাগত অন্য কারণে। কাজ করতে করতে কর্মচারীরা সবাই কেমন সারাক্ষণ কথা বলে। নানা রকম খবরাখবর ছাড়াও অদ্ভুত অদ্ভুত সব ধাঁধা, মজা, রহস্য উদঘাটনের গল্প। পুরনো দিনের, বইয়ের বাইরের কত অজানা গল্প। আসল কথা, ব্রেন গেম, মানে মগজের যে ব্যায়াম, সেটা কিন্তু আমার, এই অনিলকাকা আর বিড়ির কারখানা থেকেই শুরু। পাশের রাস্তা দিয়ে যেতে দেখলেই ডাকত, ‘খোকা এদিকে আয়।’ কাছে গেলে কখনও ওজনের, কখনও দূরত্বের মাপের, দোকান বাজারে পয়সাকড়ির হিসেব ইত্যাদি জিজ্ঞেস করত। কথার প্যাঁচে কিছু উপস্থিত-বুদ্ধির পরীক্ষাও নিত কাকা। আমি কিছু কিছু উত্তর দিতে পারতাম বলে আমাকে বলত, ‘তোর মাথা ভালো।’

‘ধাঁধা’ ব্যাপারটাই আমি জেনেছিলাম অনিলকাকার কাছেই। একদিন আমায় ডেকে বলল, ‘এইটা ভালো করে শোন। একজন মহিলা শীতের সকালে পুকুরপাড়ে গাছের ছায়ায় বসে খেজুরের রস জ্বালিয়ে গুড় তৈরি করছিল। পথচারী কেউ একজন গুড়ের ওই ভুরভুরে গন্ধে দাঁড়িয়ে পড়ল, আর টাটকা গুড় দেখে আধ সের কিনতে চাইল। মহিলার হাতের কাছে তখন দাঁড়িপাল্লা নেই, কিন্তু তার কাছে একটা সরা, বড় মাটির হাঁড়ির সরা ছিল। আর কোনও কারণে ছিল একটা লোহার আধ সেরের বাটখারা। মহিলা বুদ্ধি খাটিয়ে গুড় বেচল। বল দিকি কী করে করল?’

দাঁড়িপাল্লা

এমন প্যাঁচালো ব্যাপারটা ভাবার মতো বয়স আমার হয়নি তখনও। অনিলকাকা নিজেই আমাকে উত্তরটা বুঝিয়ে দিল। সেটা এরকম– প্রথমে মহিলা ওই শুকনো সরাটাকে নিচে পুকুরের জলে ভাসিয়ে দিল। তারপরে খুব সাবধানে ওই আধ সেরের বাটখারাটা ওই সরার মাঝখানে রাখল। তাতে সরাটা আস্তে করে কিছুটা জলে ডুবে গেল আর তার নিচে জলের দাগটা গায়ে রয়ে গেল। মাটির জিনিসের গায়ে জল শুষে দাগটা বেশ পরিষ্কার বোঝা যায়। এরপরে আস্তে করে বাটখারাটা তুলে নিল এবং ওখানে বেশ খানিকটা আন্দাজ মতো গুড় রাখল। কম হয়েছিল, তবে আরও একটু একটু করে গুড় রাখল, যতক্ষণ না সারাটা জলের দাগ বরাবর ডুবে যায়। পরের ব্যাপারটা জলের মতো। আমি অভিভূত! এই প্রথম নানারকম ভাবে ভাবনা-চিন্তা করার একটা রাস্তা মাথার মধ্যে ঢুকে গেল।

ছোটবেলায় মনে আছে নৌকোয় মুদির দোকান। আমাদের ছোট্ট নদীর ঘাটে ঘাটে নৌকো এসে হকারদের মতো হাঁক দিত। বিশেষ করে মহিলারা তখন প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে যেত। নৌকোয় সমস্ত মুদিখানার জিনিস। দারুণ লাগত দেখতে, ছোট ছোট চৌকো কাঠের বাক্সে নানা রকমের ডাল, চাল, কাপড় কাঁচার সোডা, নুন, চিনি, আলু, পেঁয়াজ, আরও কত কী। সের-পোয়া-ছ’টাক-কাচ্চা, এই সমস্ত ওজনের মাপের নাম ছিল তখনকার দিনে।

তেল জাতীয় জিনিসগুলোকে রাখা হত কালো মাটির পাত্রে। কলসির মতো দেখতে কিন্তু ঠিক কলসিও নয়, একটু অন্য আকারের। তেলের সঙ্গে থাকতে থাকতে সেগুলো একটা অদ্ভুত ধরনের মজবুত মূল্যবান পাত্রে পরিণত হত। তেল তোলার হাতার মতো বস্তুটি ছিল তালের আঁটি থেকে তৈরি। তাল ফোপড়ার পরে অবশিষ্ট তালের শক্ত খোলাটি কেটে সেখানে দু’দিকে ফুটো করে ঢুকিয়ে দেওয়া হত কঞ্চির হাতল। অদ্ভুতভাবে চ্যাপ্টা গোলাকার পাত্রটির যে ধার দিয়ে তেল পড়ত, সেটা সরু একটা অংশ, যেখান থেকে তেল খুব সুরক্ষিতভাবেই মাপের পাত্রে ঢুকে যেত। তেল মাপার পাত্রগুলো বেশ দারুণ। বাঁশ থেকে তৈরি নানা সাইজের। ফাঁপা বাঁশের একটা গিট রেখে খানিকটা অংশ পরিমাণ মতো কাটা। ব্যবহারে সেগুলোও বেশ মসৃণ হয়ে উঠত। অসাধারণ ছিল সে সময়ের কারিগরি!

মুদির দোকানে মাপার পাত্র, কারিগরির বিস্ময়

দূরত্ব, ওজন, সংখ্যার মাপ পরিমাপের নানা একক। নামগুলোও ছিল আমাদের ছেলেবেলায় অন্যরকম। গজ-ফুট-ইঞ্চি, মন-সের-ছটাক, রতি-ভরি-তোলা, কড়া-বুড়ি-গণ্ডা, টাকা-আনা-পাই, পণ-কাঠা-কাহন ইত্যাদি। আর ছিল আমাদের শরীরের অংশ। এক আঙুল, দু’-আঙ্গুল, চার আঙুল, এক বিঘৎ, এক হাত, দু’হাত। গণ্ডুষ, মুষ্ঠি। মানে, হঠাৎ কেউ এল বাড়িতে, তো আর দু’মুঠো চাল ফেলে দে হাঁড়িতে।

তবে সবকিছু তো আর মেপে হয় না, আবার মাপজোখ ছাড়াও কিছু হয় না, সেটাও সার বুঝেছি। মাপের ভুলভাল, পাগলের মাপজোখ। দেখেছি জমি মাপার জন্য আসত সরকারি লোকজন। তাদের হাতে থাকত লোহার শিকল, যা দিয়ে মাপা হত জমি। তারপরে মতের মিল হল না তো সেই নিয়ে মারামারি, লাঠালাঠি এমনকী খুনোখুনি পর্যন্ত দেখেছি।

গ্রাম্যজীবনের সহজ, সরল ছন্দ

গড়, আন্দাজ, বিশ্বাস– এসবের একটা বড়সড় ভূমিকা থাকত, সেকালের হিসেব-নিকেশে। একটা মজার উদাহরণ দিই। আমাদের পাড়ায় গ্রামে কাছাকাছি কোনও বাজার ছিল না। ছিল না কোনও খাসির মাংসের দোকান। ঘরবাড়ির আড়ালে কোনও গাছের নিচে ছাগল কাটা হত। একজন ছাগল-কাটার বিশেষ মানুষ সব পাড়ায় থাকে। ডিম, দুধ এবং পোষা মুরগিও যেমন পাড়া থেকে কেনা হত, তেমনই একটা ছাগলকেও কেনা হত পাড়া থেকেই।

সেই ছাগলটা কেনার সময় একটা মজার ঘটনা ঘটত। দু’-তিনজন বিজ্ঞ লোক ছাগলটাকে কোলে তুলে আন্দাজ করে বলত, ‘২০ সের হবে।’ আর একজন তুলে বলত, ‘আমার মনে হয় ২২।’ আরেকজন বলত, ‘আমার তো মনে হয় ২০ সেরের চেয়ে কমই হবে।’ শেষে গড় করে ২০ সের ধরা হল। দরদস্তুর করে ছাগলের মালিককে দাম দেওয়া হল ৪০ টাকা। মানে দাঁড়াল দু’টাকা করে সের। ছাগলটা কাটার পরে মাংসগুলো ভাগ করা হল মাটিতে রাখা কলা পাতায়। ২০টা ভাগ। সলিড মাংসগুলো ২০ বার করে রাখা হল। হাড়ের অংশগুলোকেও ২০-২০ ভাগ করে রাখা হল, চর্বিও সেইভাবে। মেটেটা যত ছোটই হোক, ২০ টুকরো করে ২০ ভাগে রাখা হল। সহজ হিসেবে এক ভাগ মানে এক সের। যারা কিনবে তারা বাড়ি থেকে পাত্র এনে দু’ভাগ, তিন ভাগ ইত্যাদি নেবে প্রয়োজনমতো। লাভ-লোকসানের বালাই নেই। যে ছাগল কাটে সে চামড়াটা আর মাথাটা নিয়ে যাবে মজুরি হিসেবে।

কাঠের নৌকা, নির্মাণে রয়েছে নিখুঁত গাণিতিক মাপজোখ

গ্রামীণ খেলাধুলো বলতে, ডাংগুলি, মার্বেল, লাট্টুর যেমন মাপামাপির হিসেব ছিল তেমনই কাবাডি, এক্কা দোক্কা, বাঘবন্দি ইত্যাদিতে ছিল বোর্ড বা কোর্টের নামে ছকের নানা গাণিতিক আঁকিবুকি। গরুর গাড়ির চাকা, কাঠের নৌকা, দেবদেবীর মূর্তি, এমনকী ঘরবাড়ি তৈরিতে সূক্ষ্ম মাপের ব্যাপারটা ছিল ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসা ক্ষেত্রে ডাক্তারের লাল ওষুধ এবং শিশির গায়ে কাগজের দাগ কাটার  ব্যাপারটা জীবনে ভুলব না।

গরুর গাড়ির চাকা নির্মাণ

জীবন চলছিল সহজ সরল ছন্দে। একদিন অবাক করে হাতে এল– এক পয়সা, দু’-পয়সা, এক আনা, চার আনার বদলে ছোট্ট খেলনার মতো দেখতে ‘নয়া পয়সা’।

ভারতীয় মুদ্রার ইতিহাস, তার বিবর্তন

১৬ আনা কিংবা ৬৪ পয়সার বদলে নাকি ১০০ নয়া পয়সায় এখন এক টাকা! আরও কিছুদিন পরে ইন্দ্রজিতদের মুদিখানার দোকানে ভাঁজ করা কাঠের পাল্লায় দেখলাম কী-সব লিখে রেখেছে। দেখে আমরা হাসাহাসি করলাম। ১০ মিলিগ্রামে এক সেন্টিগ্রাম, ১০ সেন্টিগ্রামে এক ডেসিগ্রাম, ১০ ডেসিগ্রামে এক গ্রাম…।

…পড়ুন অল্পবিজ্ঞান-এর অন্যান্য পর্ব…

পর্ব ১৩: শব্দ কল্প দ্রুম

পর্ব ১২: হ্যালো, তুমি শুনতে পাচ্ছ কি?

পর্ব ১১: ‘শব্দ’ শুধুই আওয়াজ নয়

পর্ব ১০: শিল্পকলায় বিষ্ঠা মানে ব‍্যঙ্গ, বিদ্রুপ অথবা প্রতিবাদ

পর্ব ৯: বাস্তব আর ভার্চুয়ালের সীমান্তে দাঁড়িয়ে হাইব্রিড আর্ট প্রশ্ন করতে শেখায়– শিল্প কী?

পর্ব ৮: মগজে না ঢুকলে শিল্পও আবর্জনা

পর্ব ৭: ছবির অসুখ-বিসুখ, ছবির ডাক্তার

পর্ব ৬: বিসর্জনের মতোই একটু একটু করে ফিকে হয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর রং ও রূপ

পর্ব ৫: জীবন আসলে ক্যালাইডোস্কোপ, সামান্য ঘোরালেই বদলে যায় একঘেয়ে নকশা

পর্ব ৪: কুকুরেরই জাত ভাই, অথচ শিয়াল সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি?

পর্ব ৩: অন্ধকারে অল্প আলোর মায়া, ফুরয় না কোনওদিন!

পর্ব ২: বজ্রবিদ্যুৎ ভর্তি আকাশে ঘুড়ি উড়িয়ে আমাদের চিরকালের নায়ক হয়ে আছেন বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন

পর্ব ১: বস্তু নাকি ভাবনা, শিল্পকলায় কী খোঁজেন?