এরকম কত মুখ, কত মুহূর্ত যে গচ্ছিত রয়ে গেল। যে জায়গায় তাদের রেখে এসেছিলাম ঠিক সেইখানে, সেই কালে তেমনই কি রয়ে গেছে তারা? কাল কি যাওয়ার সময় তুচ্ছ সেই মুহূর্তটিকে সঙ্গে নিয়ে যায়? হঠাৎ একদিন আমি যদি ফিরে চাই? তারা যদি ফিরে আসতে চায় সেই স্থানে? কোথায় আসবে তবে? সেইসব মাঠে, নদীতীরে, সর্ষে কি ভুট্টার খেতে, জঙ্গলপ্রান্তে যদি আর না থেকে থাকে মানুষের ফিরে যাওয়ার বসতি? যদি ভরে গিয়ে থাকে ব্যস্ত চওড়া এক্সপ্রেসওয়ে, ফ্ল্যাটবাড়ি, সুইমিং পুল, শপিং মল? উচ্চাশা, লোভ, অবিশ্বাসের পার্থেনিয়াম ঝোপে ভরে যাওয়া বাসস্ট্যান্ডে, রেলস্টেশানে যখন শুনেছি স্পর্ধিত ঘোষণা ‘কোনো সহযাত্রীর দেওয়া খাবার বা পানীয় নেবেন না, তা বিপজ্জনক হতে পারে’– এরকম কত কত মুখ আমার মুখের দিকে তাকায়। বিশ্বাস করব না? ভালোবাসব না? সহযাত্রীকে, প্রতিবেশীকে অপরিচিতকে? কোথায় যাব তবে?
১.
মুখ, মানুষের মুখই, মাঝে মাঝে মনে হয়, সবচেয়ে প্রিয় দৃশ্য। গাছপালা, পাখি, পোকা, নদীদের কথা মনে রেখেও বললাম। যতদূর আসি-যাই, কারও সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই পথচিহ্ন। মুখই সেই অভিজ্ঞান, যা দিয়ে পথচিহ্ন তৈরি হয়। কোনও মুখ রোজ দেখা দেয়, তবু ঢাকা পড়ে প্রতিদিনের ধুলোয়। কোনও মুখ একবার দেখা দিয়ে সময়কে স্থায়ী করে দিয়ে যায়। কতবার। কতভাবে।
মহারাষ্ট্রের নাসিক যাওয়ার পথে ছোট স্টেশন ‘একলহরে’। ইলেকট্রিক সাপ্লাই প্লান্টের ছোট কলোনি তখনও। গোদাবরী নদীর পাশে। আমরা যখন ট্রেন থেকে নামি, বিকেল ফুরিয়ে আসছে। গোদাবরীর লম্বা ব্রিজের ওপর দিয়ে কাজ শেষ করে ফিরছেন অনেক ক’জন মানুষ। মাথায় কিংবা হাতে ঝোলানো টিফিন কেরিয়ার, ঝুড়ি কোদাল, বেলচা। শহরের প্রান্ত থেকে ঘরের দিকে ফিরে যাচ্ছেন সূর্যাস্তের ওপর দিয়ে দীর্ঘ সিল্যুয়েটের ছবি ফেলে। পরদিন সকালে বেড়াতে বেরিয়ে চটির স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে গেল। বন্ধুটি কাছাকাছি কোনও মোড় থেকে এক মুচিকে ডেকে আনে। ছড়ানো সবুজ মাঠের পারে দূরে কী একটা কারখানার চিমনি থেকে সাদা ধোঁয়া বেরিয়ে আকাশের গায়ে যেন শরৎ ঋতু আঁকার চেষ্টা করছে। শান্ত আলোকিত সকাল। দাঁড়িয়ে আছি অচেনা জায়গায়। অচেনা এক রাস্তার মোড়ে। রাস্তার ধারে নিচু হয়ে বসে আমার চপ্পল সেলাই করে দিচ্ছেন আমারই দেশের একজন অপরিচিত মানুষ। কোনও দিন আর দেখব না এঁকে, এই জায়গাটায় আর এসে দাঁড়াব না কখনও। আমার জীবনের একটি সকাল রাখা রইল আমার দেশের এই দূর অচেনা জায়গায়।
……………………………..
দু’-একদিন সেটা চলার পর বহেনজি ঘুমিয়ে পড়লে পবন সুভাষ ইন্দ্ররা ঢিল ছুড়ে কুঁজোটা ভাঙল। পুরো ক্লাস জলে ভর্তি। সবাই চেঁচামেচি করছে। বহেনজি ধড়মড় করে উঠে পড়েছেন আর খুব বকছেন, কী করে জল এল? সবাই মিলে বলছে যখন আপনি ঘুমচ্ছিলেন, তখন কুঁজো ভেঙে গেছে। খুব রেগে বলছেন ‘কখন আমি ঘুমিয়েছি?’ আমাদের সঙ্গে রেখা বলে একজন গুজরাতি মেয়ে পড়ত। খুব সুন্দর ভজন গাইত ও। অত ছোটবেলাতেই মীরার ভজন, সুরদাস গাইতে পারত। বহেনজি রেখাকে ভালোবাসতেন। কোনও কোনও দিন ক্লাসে ওকে গান গাইতে বলতেন। মীরার একটা গান ছিল ‘মৈনে চাকর রাখো জি–’ এই চাকর চাকর গানটা আমার একদম ভালো লাগত না।
……………………………..
এরকম কত মুখ, কত মুহূর্ত যে গচ্ছিত রয়ে গেল। যে জায়গায় তাদের রেখে এসেছিলাম ঠিক সেইখানে, সেই কালে তেমনই কি রয়ে গিয়েছে তারা? কাল কি যাওয়ার সময় তুচ্ছ সেই মুহূর্তটিকে সঙ্গে নিয়ে যায়? হঠাৎ একদিন আমি যদি ফিরে চাই? তারা যদি ফিরে আসতে চায় সেই স্থানে? কোথায় আসবে তবে? সেইসব মাঠে, নদীতীরে, সরষে কি ভুট্টার খেতে, জঙ্গলপ্রান্তে যদি আর না থেকে থাকে মানুষের ফিরে যাওয়ার বসতি? যদি ভরে গিয়ে থাকে ব্যস্ত চওড়া এক্সপ্রেসওয়ে, ফ্ল্যাটবাড়ি, সুইমিং পুল, শপিং মল? উচ্চাশা, লোভ, অবিশ্বাসের পার্থেনিয়াম ঝোপে ভরে যাওয়া বাসস্ট্যান্ডে, রেলস্টেশনে যখন শুনেছি স্পর্ধিত ঘোষণা ‘কোনও সহযাত্রীর দেওয়া খাবার বা পানীয় নেবেন না, তা বিপজ্জনক হতে পারে’– এরকম কত কত মুখ আমার মুখের দিকে তাকায়। বিশ্বাস করব না? ভালোবাসব না? সহযাত্রীকে, প্রতিবেশীকে অপরিচিতকে? কোথায় যাব তবে?
এই মানুষের মুখ দেখাই চলা।
মানুষের মুখের মধ্য দিয়েই– পথ।
সেইসব মুখকে ফিরে দেখি। ফিরে দেখি নিজের ফেলে আসা পথ। অলস স্মৃতিচারণে নয়, রোদবাতাসের থেকে দূরে পড়ে থাকা সময়কে, তার সম্পদগুলিকে হারিয়ে দীন হয়ে না যাওয়ার জন্য। মানুষের মুখ বিস্মৃত না হওয়ার, না হতে দেওয়ার জন্য।
ভাঙা কুঁজোর খুশি
অন্য একটা বেনারস ছিল। এখানে ছিল একটা হিন্দু গার্লস স্কুল। সেখানে ক্লাস ফোরে ছেলেরাও পড়ত। দোতলায় ক্লাস ফোরের ঘরটার বাইরে একটা ন্যাড়া ছাদ, পরে হয়তো সেখানে আরও ক্লাসরুম তৈরি হবে। তার পিছনে মুসলিম কবরখানা। ক্লাস টিচার ছিলেন ধরমদেবী বহেনজি। তাঁর বয়স হয়েছিল। চশমা পরা। ঠোঁটের ওপর হালকা গোঁফের মতো। হালকা রঙের শাড়ি পরে আসতেন। বেশিরভাগ সময়ে আমাদের হাতের লেখা কিংবা তকলিতে সুতো কাটার কাজ দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তেন। কয়েকজন মেয়েকে বেছে নিজের ঠাকুরের কাপড় সেলাই করার কাজও দিতেন। আমাকেও দিয়েছিলেন একদিন। ছোট্ট ছোট্ট সিল্কের কাপড়। তার পাড়ে জরি বসিয়ে সেলাই করতে হত। বেশ কঠিন। হাতে ছুঁচ ফুটে যায়। আমি বাড়িতে মাকে, পিসিকে যেমন দেখেছি, সুতোটা মুখে দিয়ে সরু করে নিতে গিয়েছি, অন্যরা সবাই বলতে লেগেছে, ‘জুঠা কর দিয়া জুঠা কর দিয়া।’ বহিনজি রেগেমেগে আমার হাত থেকে কাপড়টা কেড়ে নিয়ে গেলেন। ছেলেরা একটু পরে পরেই ‘বহনজি, পানি পিনে যাউঁ?’ বলে কোনও উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলে ক্লাস থেকে পালিয়ে যেত আর ফিরে আসত না। স্কুলের মাঠে ঘোরাঘুরি করত। তাই নিয়ে কিছু নালিশ হয়ে থাকবে, একদিন দারোয়ান এসে ক্লাসে জলের কুঁজো রেখে গেল আর ‘পানি পিনে’ যাওয়া বন্ধ। দু’-একদিন সেটা চলার পর বহেনজি ঘুমিয়ে পড়লে পবন সুভাষ ইন্দ্ররা ঢিল ছুড়ে কুঁজোটা ভাঙল। পুরো ক্লাস জলে ভর্তি। সবাই চেঁচামেচি করছে। বহেনজি ধড়মড় করে উঠে পড়েছেন আর খুব বকছেন, কী করে জল এল? সবাই মিলে বলছে যখন আপনি ঘুমচ্ছিলেন, তখন কুঁজো ভেঙে গেছে। খুব রেগে বলছেন, ‘কখন আমি ঘুমিয়েছি?’
আমাদের সঙ্গে রেখা বলে একজন গুজরাতি মেয়ে পড়ত। খুব সুন্দর ভজন গাইত ও। অত ছোটবেলাতেই মীরার ভজন, সুরদাস গাইতে পারত। বহেনজি রেখাকে ভালোবাসতেন। কোনও কোনও দিন ক্লাসে ওকে গান গাইতে বলতেন। মীরার একটা গান ছিল ‘মৈনে চাকর রাখো জি–’ এই চাকর চাকর গানটা আমার একদম ভালো লাগত না।
যেদিন জেগে থাকতেন, ধরমদেবী বহেনজি অঙ্ক করাতেন। বাড়িতে পিসি বলত, অনেক দিন আগে যখন এই স্কুলে পড়ত তখন নাকি ধরমদেবী বহেনজি দারুণ অঙ্ক শেখাতেন। কিন্তু আমাদের ক্লাসে তো একটু কিছু দেখিয়ে আমাদের বলেন এবারে নিজেরা করো। নিজে একটু পরেই আবার ঘুমিয়ে যেতেন। আমরা দেখতাম বহেনজির মাথা কাত হয়ে থুতনিটা গলার কাছে নেমে এসেছে। একটু নাকও ডাকছে। রেখা বলেছিল ওঁর বাড়িতে কেউ নেই। উনি সকালে বাচ্চাদের সেকশনেও পড়ান। তাই ক্লাসে ঘুমিয়ে পড়েন।
রোজ তকলি কাটার ক্লাস ছিল। তুলোর বান্ডিল থেকে অল্প তুলো নিয়ে সেটাকে আমরা হাতে করে পিঁজে, তা থেকে লোহার একটা ছয়-সাত ইঞ্চি লম্বা কাঠিতে ফাঁসিয়ে সুতো কাটতে শিখেছিলাম। তকলিটা লাট্টুর মতো ঘুরত। ১৫ মিনিটে ৫০ হাত সুতো কাটতে হত। তকলি ঘোরানো সমান না হলে সুতো ছিঁড়ে যেত, গিঁট দিতে হত। গিঁট দেওয়া সুতো চরকায় ব্যবহার করা যায় না। পবন আর ইন্দ্র খুব চঞ্চল ছিল বলে ওদের সুতো বারে বারে ছিঁড়ে যেত। বকুনি খেত ওরা। আমি এমনিতেই খুব শান্ত। আমার পঞ্চাশ হাত সুতো খুব তাড়াতাড়ি হয়ে যেত। তারপর আমার তকলিটা পবনের হাতে দিয়ে ওরটা আমি নিয়ে নিতাম, কেটে দিতাম ওর ভাগের সুতোটা। তারপর ইন্দ্রের। এক একদিন টিফিনের পরের পিরিয়ডে ওরা কবরখানার গাছ থেকে কলা চুরি করে আনত। আমাকেও ভাগ দিত অবশ্য। ধরমদেবী বহেনজি নাকি খুব ভালো চরকাও চালাতে জানেন। রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদকেও দেখেছেন, বলেছিলেন একদিন। তাহলে কেন সকালে আর দুপুরে দুটো সময়ে ক্লাস নেন আর আমাদের ক্লাসে ঘুমিয়ে পড়েন? ভাবতাম।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved