আধুনিক দ্রুতগতির যানবাহনের পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ায় ঢিমেতালের গোরুর গাড়ি, ঘোড়ায় টানা ছ্যাকরা গাড়ি আর অবুঝ পথচারী। ‘ট্রাফিক জ্যাম’ কলকাতা শহরে শতাব্দী প্রাচীন এক বৈশিষ্ট্য! পুলিশের কালঘাম ছুটে যেত ট্রাম-বাস-মোটর গাড়ির যাতায়াতের পথ পরিষ্কার রাখতে। যান চলাচলের নতুন নতুন আইন প্রবর্তন হতে শুরু করে এই সময় থেকে। ১৮৭০-এর পর থেকে পুলিশ রেকর্ডে বিভিন্ন অপরাধের তালিকায় নতুন একটা বর্গ যুক্ত হয়– ‘স্ট্রিট অফেন্সেস’, রাস্তাঘাটে নানাবিধ ‘বেআইনি’ কার্যকলাপের ফলে। ১৮৮৮ সালে দেখা যাচ্ছে, ২৯৩০টি গ্রেপ্তারির ঘটনা, রাস্তার ভুল দিক দিয়ে বা হেডলাইট ছাড়া গাড়ি চালানোর জন্য। আধুনিক শহরের রাস্তাঘাটে স্নান করা, অভব্য আচরণ বা মাতলামি– সব কিছুই পুলিশের ব্যস্ততা বাড়িয়ে দিয়েছিল।
আধুনিক শহরে চলাফেরা করার নানা নিয়ম, নানা বাধা, নানা হুকুম। এসবই আমরা কমবেশি মেনে চলতে বাধ্য হই, খুচখাচ ব্যতিক্রম যদিও নাগরিক জীবনের অঙ্গ। কিন্তু আমরা খুব ভাল করেই জানি যে, কখন নিয়ম ভাঙলাম, কখন সিগন্যাল দেখেও না দেখার ভান করলাম, কখন ফুটপাথ ছেড়ে রাস্তা দিয়ে খানিকটা জোর কদমে এগিয়ে গেলাম। পথচারীরা এসব করে পার পেয়ে গেলেও গাড়ির চালকদের নানাবিধ ফাইন দিতে হয় ট্রাফিক আইন ভাঙার জন্য, বিশেষত এখন যখন চারিদিকে সিসি ক্যামেরা বসানো থাকে, তখন সিগন্যাল মান্য না করে চললে মালিকের মোবাইলে তৎক্ষণাৎ ফাইনের রসিদ হাজির হয়ে যায়।
রাস্তায় গাড়ি চলার জন্য যে বিশেষ নিয়মকানুন প্রয়োজন, এই ধারণা উনিশ শতকের সাত-আটের দশক থেকে ধীরে ধীরে প্রশাসনের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কলকাতা শহরে প্রথমে ট্রাম, পরে বাস এবং মোটর গাড়ির আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের একটা কাজই হয়ে দাঁড়ায় রাস্তাঘাটে সুষ্ঠুভাবে যান চলাচল বজায় রাখা। এবং একইসঙ্গে সাধারণ জনগণের মধ্যে ‘রোড সেন্স’ তৈরি করার প্রক্রিয়া। কিন্তু জনতা আর কবে প্রশাসনের কথা মেনে চলেছে? কলকাতার নিম্নবর্গের মানুষদের দখলে ছিল রাস্তা, সেখানেই ব্যবসাপত্তর, খেলাধুলো, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, লাঠালাঠি আর হাতাহাতি, চলাফেরা, শোওয়া-বসা। চড়ক-গাজনে শহরের রাস্তায় যেন মেলা বসে যেত, বাঁধভাঙা জনতার স্রোত সেখানে। উচ্চবর্গীয় পশ্চিমি মনোভাবাপন্ন ভারতীয়রা এই বিষয়ে বিলিতি সরকারের পক্ষেই ছিল, এইসব আচার-আচরণকে তাঁরা আধুনিক নাগরিক সভ্যতার পরিপন্থী হিসেবেই দেখত। সরকার সময় বেঁধে দিয়ে এই অনুষ্ঠানে রাশ টানার চেষ্টা করেছিল। হুতোম লিখছে,
‘ক্রমে পুলিশের হুকুমমত সব গাজন ফিরে গেল। সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট রাস্তায় ঘোড়া চড়ে বেড়াচ্ছিলেন, পকেট-ঘড়ি খুলে দেখলেন, সময় উতরে গেছে, অমনি মার্শাল ল জারি হলো, “ঢাক বাজালে থানায় ধরে নিয়ে যাবে।” ক্রমে দুই একটা ঢাকে জমাদারের হাতে কোঁৎকা পড়ামাত্রেই সহর নিস্তব্ধ হলো। অনেকে ঢাক ঘাড়ে করে চুপে চুপে বাড়ী এলেন– দর্শকেরা কুইনের রাজ্যে অভিসম্পাত কত্তে কত্তে ফিরে গেলেন।’
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আরও পড়ুন: অলংকরণ শিল্পীর নামোল্লেখহীন পত্রপত্রিকার যুগেও রণেন আয়ন দত্তকে চেনা যেত এক লহমায়
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
উৎসব-অনুষ্ঠানের পাশাপাশি নতুন প্রযুক্তির কল্যাণে যখন আধুনিক যানবাহন রাস্তা দখল করতে শুরু করল তখন দেখা দিল মহাবিপত্তি! একদিকে ছিল গরুর গাড়ি, ঘোড়ায় টানা ছ্যাকরা গাড়ি, সাইকেল, আর ট্রাম, বাস, মোটর গাড়ি। স্বাভাবিকভাবেই এই দুইয়ের সহাবস্থান প্রথম যুগে খুব একটা সহজ ছিল না। আধুনিক এবং প্রাগানুধিক সময় যেন একইসঙ্গে শহরের বুকে উপস্থিত হল। বেশিরভাগ মানুষই চট করে নতুন প্রযুক্তি মেনে নেয় না, তা তাঁদের দৈনন্দিন জীবনকে ওলোটপালট করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে বলে। ধীরে ধীরে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নানা বদল আসে আমাদের জীবনচর্যায়। ফলে উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে যখন কলকাতার নাগরিক জীবনে নানা পরিবর্তন দেখা দিল, তখন রাস্তার অধিকার নিয়ে চাপানউতোর পুলিশের বিশেষ মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াল।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
১৮৮৩ সালে ৪৩ জন আহত হয় ট্রামের আঘাতে। ১৯০৩-এ ২৪০ জন গাড়ি চালককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ– বিপজ্জনকভাবে গাড়ি চালানোর জন্য। ১৯১৪ সালে গাড়ি দুর্ঘটনায় ৬৭ জন মারা যায়, আর ৯৮৮ জন আহত হয়। এই নানা পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায় যে, কীভাবে বিশ শতকের গোড়া থেকে কলকাতার রাস্তাঘাটের চেহারা ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছিল। এর কয়েক বছর পরে ক্যালকাটা ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্টের হাত ধরে আরও ব্যাপক আকারে পরিবর্তন ঘটবে শহরের রাস্তাঘাট আর যান পরিবহণের ক্ষেত্রে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
১৮৭৩ সালে ঘোড়ায় টানা ট্রাম চালু হয় কলকাতায়; ১৯০২ সাল থেকে তা হয়ে দাঁড়ায় ইলেকট্রিক-চালিত। ১৮৯৬-তে মোটর গাড়ি আর ১৯২২ সাল থেকে মোটর-চালিত বাস শহরের রাস্তায় নামে। এক হিসেব অনুযায়ী, ১৯১৪ সালে কলকাতায় গাড়ির সংখ্যা ছিল ৫১৭, ট্যাক্সি ২৪০, মোটর সাইকেল ১৫২, আর ট্রাক ২১ খানা। ১৯২৫-এ দেখা যাচ্ছে ২৮০টি বাস শহরের বিভিন্ন প্রান্তে চলাচল করছিল।
কিন্তু এই আধুনিক দ্রুতগতির যানবাহনের পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ায় ঢিমেতালের গোরুর গাড়ি, ঘোড়ায় টানা ছ্যাকরা গাড়ি আর অবুঝ পথচারী। ‘ট্রাফিক জ্যাম’ কলকাতা শহরে শতাব্দী প্রাচীন এক বৈশিষ্ট্য! পুলিশের কালঘাম ছুটে যেত ট্রাম-বাস-মোটর গাড়ির যাতায়াতের পথ পরিষ্কার রাখতে। যান চলাচলের নতুন নতুন আইন প্রবর্তন হতে শুরু করে এই সময় থেকে। ১৮৭০-এর পর থেকে পুলিশ রেকর্ডে বিভিন্ন অপরাধের তালিকায় নতুন একটা বর্গ যুক্ত হয়– ‘স্ট্রিট অফেন্সেস’, রাস্তাঘাটে নানাবিধ ‘বেআইনি’ কার্যকলাপের ফলে। ১৮৮৮ সালে দেখা যাচ্ছে, ২৯৩০টি গ্রেপ্তারির ঘটনা, রাস্তার ভুল দিক দিয়ে বা হেডলাইট ছাড়া গাড়ি চালানোর জন্য। আধুনিক শহরের রাস্তাঘাটে স্নান করা, অভব্য আচরণ বা মাতলামি– সব কিছুই পুলিশের ব্যস্ততা বাড়িয়ে দিয়েছিল।
অন্যদিকে যন্ত্রচালিত যানবাহন রাস্তায় দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। কলকাতার বহু রাস্তাই অপরিসর ছিল, আর সেইসব পথের মাঝ বরাবর যখন ট্রামলাইন পাতা হয় তখন মানুষজন, অন্যান্য যান, রাস্তার ধারের দোকানপাট মিলিয়ে মিশিয়ে এক জটিল সমস্যার সৃষ্টি হয়। ১৮৮৩ সালে ৪৩ জন আহত হয় ট্রামের আঘাতে। ১৯০৩-এ ২৪০ জন গাড়ি চালককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ– বিপজ্জনকভাবে গাড়ি চালানোর জন্য। ১৯১৪ সালে গাড়ি দুর্ঘটনায় ৬৭ জন মারা যায়, আর ৯৮৮ জন আহত হয়। এই নানা পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায় যে, কীভাবে বিশ শতকের গোড়া থেকে কলকাতার রাস্তাঘাটের চেহারা ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছিল। এর কয়েক বছর পরে ক্যালকাটা ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্টের হাত ধরে আরও ব্যাপক আকারে পরিবর্তন ঘটবে শহরের রাস্তাঘাট আর যান পরিবহণের ক্ষেত্রে।
তবে এই আধুনিকতার শর্তই ছিল যন্ত্রচালিত যান চলাচল আর গরুর গাড়ি বা পথচারীর মধ্যে এক অদৃশ্য প্রতিযোগিতা, যেখানে ট্রাম, বাস, মোটরগাড়ি প্রগতির সূচক আর অবাধ্য পশু বা পথচারী অনাধুনিকতার অবশেষ। আইন মোতাবেক ‘আদর্শ নাগরিক’ গড়ে তোলা যেন দুষ্কর! প্রশাসনের মতে, আধুনিক নগর পরিকল্পনার ক্ষেত্রে বিশেষ অন্তরায় ছিল রাস্তা জুড়ে লোকজনের চলাচল, ফুটপাথ ব্যবহার করার ব্যাপারে অনীহা। তবে এক্ষেত্রে মাথায় রাখতে হবে যে, কলকাতা শহরে বেশিরভাগ ভারতীয় এলাকাতেই ফুটপাথগুলি ছিল কাঁচা, কাদা ভর্তি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে লাল সুড়কি দিয়ে এগুলি পাকা করার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু এতে যে কোনও সুরাহা হবে না সে বিষয়ে কলকাতা ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্টকে একটা লম্বা চিঠি লেখেন স্কটিশ স্থপতি প্যাট্রিক গেডেস। তিনি বলেন যে, বেশিরভাগ ভারতীয়ই খালি পায়ে হাঁটাচলা করে, তাঁদের পক্ষে কাঁকড় বেছানো ফুটপাথ মোটেই সুবিধের হবে না। আর তাছাড়া কলকাতা শহরের রাস্তায় পায়ে চলা মানুষের সংখ্যা প্রচুর, আর তার ওপর রয়েছে জাতিগত ছোঁয়াছুঁয়ি বাঁচিয়ে পথ চলার তাগিদ– এসবের কথা মাথায় রাখলে দেখা যাবে যে, ফুটপাথগুলি নেহাতই অপরিসর। গেডেসের অভিমত ছিল যে, অন্তত ১৭ থেকে ২০ ফুট চওড়া ফুটপাথ দরকার কলকাতায়।
আধুনিক শহরের একটা মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে গতি– যে কোনও রকমের বাধা আধুনিকতার পরিপন্থী। রাস্তা জুড়ে নিরন্তর যান চলাচল শহরে প্রাণ সঞ্চার করে; কোনও রকমের ভিড়, জটলা, অবরোধ, ব্যারিকেড তাই প্রশাসনের বিশেষ চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু সাধারণ খেটে খাওয়া পথচলতি মানুষজন ছাড়া যে কোনও শহরই বিকল হয়ে পড়বে। তাঁদের শ্রমের ওপর ভিত্তি করেই আধুনিক নগরের দৈনন্দিন প্রক্রিয়া চালু থাকে। রাস্তার অধিকার নিয়ে লড়াই তাই লেগেই থাকে, নিয়ম কানুনের ফাঁকফোকর দিয়ে গলে সাধারণ মানুষ নিজের শহর গড়ে নেন।
তথ্যসূত্র: অনিন্দিতা ঘোষ, ক্লেইমিং দ্য সিটি: প্রটেস্ট, ক্রাইম, অ্যান্ড স্ক্যান্ডালস ইন কলোনিয়াল ক্যালকাটা, ১৮৬০-১৯২০ (২০১৬)
…কলিকথার অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৯: বৃষ্টি নিয়ে জুয়া খেলা আইন করে বন্ধ করতে হয়েছিল উনিশ শতকের কলকাতায়
পর্ব ৮: ধর্মতলা নয়, ময়দানই ছিল নিউ মার্কেট গড়ে তোলার প্রথম পছন্দ
পর্ব ৭: সেকালের কলকাতায় বাঙালি বড়মানুষের ঠাঁটবাটের নিদর্শন ছিল নিজের নামে বাজার প্রতিষ্ঠা করা
পর্ব ৬: কলকাতার বহিরঙ্গ একুশ শতকের, কিন্তু উনিশ-বিশ শতকের অসহিষ্ণুতা আমরা কি এড়াতে পেরেছি?
পর্ব ৫: কলকাতা শহর পরিকল্পনাহীনভাবে বেড়ে উঠেছে, একথার কোনও বিশেষ ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই
পর্ব ৪: ঔপনিবেশিক নগর পরিকল্পনার বিরুদ্ধ মত প্রকাশ পেয়েছিল যখন প্লেগ ছড়াচ্ছিল কলকাতায়
পর্ব ৩: ঔপনিবেশিক কলকাতায় হোয়াইট টাউন-ব্ল্যাক টাউনের মধ্যে কোনও অলঙ্ঘনীয় সীমানা
পর্ব ২: ‘জল’ যেভাবে ‘জমি’ হল এ কলকাতায়
পর্ব ১: চেনা কলকাতাকে না পাল্টেই বদল সম্ভব, পথ দেখাতে পারে একটি বাতিল রিপোর্ট