উনুন জ্বলেনি আর, বেড়ার ধারেই সেই ডানপিটের তেজি রক্তধারা…। এত কড়াকড়ি! ডালকুকুরের মতো নজরদারি! এর মধ্যেও ছুটে এসে কে বা কারা আশুর বুকের উপর একগোছা ফুল রেখে মিলিয়ে যায়! কাউকে দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু এদিক-ওদিক থেকে শ্লোগান উঠতে থাকে শহিদ হয়ে যাওয়া ছেলেটির নামে। গোটা কলোনির ঘরে ঘরে সেদিন অরন্ধন। শত্তুরেও স্বীকার করবে যে যাদবপুর-গরফা অঞ্চলের মানুষের নয়নের মণি ছিলেন আশু মজুমদার।
১৪.
আশু মজুমদার। ভারত
–আশু, যাইস না কইলাম! মিলিটারি ঢুকসে…
–জ্যাডাইমা, যাইতে অইবে। তুমি ঘরে যাও।
–আশু… বাপ কথা শোন…। অই তোরা ভোন্দা মাইরগ্যা বইস্যা আছস… পোলাডায় বাইরইয়্যা গেল… কইতে পারস না কিসু?
–কাকি তুমি ঘরে ঢোকো। আমাগো আশু ঘরে থাকার জন্য জন্মায় নাই। পাড়ায় পুলিশ মিলিটারি ঢুকসে আর আশু ঘরে… দ্যাখ্স কহনও? হ্যার নিজের মায়েও তারে আটকাইতে পারসে?
–আমার অইসে মরণজ্বালা! আশুর মা… দ্যাখ্স নি পোলাডায় বাইরইয়্যা গেল… ও আশুর মা!
ডেটলাইন ১০ মার্চ, ১৯৭১
“চিত্ত পাটারি যখন খবর দিচ্ছে–‘আশুদা.. মিলিটারি’– তখনও মিলিটারি খানিকটা দূরে। সময় তখন দশটা আঠারো। এমন সময় মিলিটারি একটা ফায়ার করে। এরপর আশু মজুমদার রিভলভার চেয়ে নিয়ে কয়েকটা বুলেট ভরে নিল। তারপর বলল, ‘দাঁড়া, দৌড়ব না, চিন্তা করে নিই কোথায় যাব।’ ততক্ষণে মিলিটারি আমাদের চেজ করে কাছে চলে এসেছে। অটোমেটিক রাইফেল উঁচিয়ে ওরা বলল–হল্ট! তখনও আমরা পাঁচ জনেই একসঙ্গে আছি, আমরা একসঙ্গে বললাম, দৌড়োও। আমরা দৌড়েছি। আশুদা দৌড়োয়নি। আমাদের বাঁচানোর জন্যে ও মিলিটারিকে ফায়ার করে যাতে আমরা দৌড়োনোর সময় পেয়ে যাই। সময়টা দশটা কুড়ি কি বাইশ হবে। আমরা আরো খানিকটা দৌড়ে যাবার পর খবর পাই, একজন পড়ে আছে। আশুদাই যে পড়ে আছে, বুঝতে পারি।” সঙ্গীরা যেতে পারলেও মিলিটারির চালানো গুলি আশুর কাঁধে লাগলে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। রক্তাক্ত অবস্থায় পুলিশ তাঁকে তুলে নিয়ে যায় যাদবপুর থানায়, সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ। কম খুঁজেছে তাঁকে পুলিশ! সত্তরের সে-সব অগ্নিগর্ভ দিনগুলিতে গরফা অঞ্চলের কলোনির মানুষ দু’-হাতে আগলে রাখত আশুকে। অবশেষে তাঁকে হাতে পাওয়া পুলিশের হিংস্র ক্রোধ নির্মম অত্যাচার হয়ে ঝরতে থাকে আশু মজুমদারের ওপর।
আগুনের মতো খবর ছড়িয়ে পড়ল। পাড়ার মহিলারা দল বেঁধে থানার বাইরে ভিড় জমালেন। আশুকে হাসপাতালে পাঠাতে হবে– দাবিতে পুলিশ ঘাবড়ে যেতে থাকে। তখনও শরীরে প্রাণ থাকা আশুকে হাসপাতালে নিয়ে যেতেও ভয় পেয়েছিল তারা। বাঙ্গুর হাসপাতালে আশু মজুমদারকে যখন নিয়ে আসা হয়, তাঁর শরীর প্রাণহীন তখন। হাসপাতাল রিপোর্টে দেখা যায়, আশুকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বেলা দুটোয়। তার দেহে অন্তত চার বার গুলি করা হয়েছে। দেহের নানা স্থান ছুরি দিয়ে ফালা ফালা করে কেটে দেওয়া হয়েছে।
তবুও কিন্তু পুলিশ তাঁর মুখ থেকে কোনও স্বীকারোক্তি, এককুচি অনুশোচনা বের করতে পারেনি। সেদিন যাদবপুর থানায় মাথা নিচু করে থাকা পুলিশের কনস্টেবলরা সাক্ষী, নিভে আসা গলাতেও বারবার তাঁর মুখ থেকে শুধু বেরিয়েছে– ‘সিপিআই (এমএল) জিন্দাবাদ!’ ‘কমরেড চারু মজুমদার জিন্দাবাদ!’
এরপরও পোস্টমর্টেমের অছিলায় দু’-দিন পুলিশ তাঁর মৃতদেহ আটকে রাখে। গণরোষ থিতোনোর অপেক্ষা? আশু মজুমদারের বিক্ষত মৃতদেহ পরিবার বা বন্ধুদের হাতে তুলে না দিয়ে, কড়া প্রহরায় পুলিশের গাড়ি করে কেওড়াতলা শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়। এত কড়াকড়ি! ডালকুকুরের মতো নজরদারি! এর মধ্যেও ছুটে এসে কে বা কারা আশুর বুকের উপর একগোছা ফুল রেখে মিলিয়ে যায়! কাউকে দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু এদিক-ওদিক থেকে শ্লোগান উঠতে থাকে শহিদ হয়ে যাওয়া ছেলেটির নামে। উনুন জ্বলেনি আর, বেড়ার ধারেই সেই ডানপিটের তেজি রক্তধারা! গোটা কলোনির ঘরে ঘরে সেদিন অরন্ধন। শত্তুরেও স্বীকার করবে যে যাদবপুর-গরফা অঞ্চলের মানুষের নয়নের মণি ছিলেন আশু।
আশুতোষ মজুমদার। পূর্ববাংলা থেকে রিফ্যুজি হয়ে আসা পরিবারের ছেলে। যাদবপুরের নবকৃষ্ণ পাল আদর্শ শিক্ষায়তন, তারপর শান্তিনিকেতনে প্রি-ইউনিভার্সিটি কোর্স, তারপর আবার যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে কলাবিভাগে ভর্তি হওয়া। সিপিআইএম-এ আন্তঃপার্টি লড়াই শুরু হলে যোগ দিয়েছিলেন ‘সূর্য সেন গ্রুপ’-এ। নকশালবাড়ির পরে ১৯৬৯-এ সিপিআই (এমএল) তৈরি হলে এলাকার সংগঠকেরা তাঁকে নিতে চাননি নতুন পার্টিতে। চারু মজুমদারের চোখ কিন্তু তাঁকে চিনতে ভুল করেনি, তাঁরই প্রত্যক্ষ পরামর্শে পার্টির ঢাকুরিয়া-হালতু এরিয়া কমিটির সদস্য হন আশু। ১৯৭১-এর ১০ মার্চ ছিল ভোটের দিন, তার আগের রাতেই অন্য এলাকায় চলে যাওয়ার কথা ছিল তাঁর। মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়ায় আটকে যান। ১০ মার্চ সঙ্গে মিলিটারি নিয়ে যাদবপুর আর কসবা থানার পুলিশ বাড়ি বাড়ি তল্লাশি চালাচ্ছিল। আশু মজুমদার তখন ছিলেন পাটোয়ারি পাড়ার সুধীরের বাড়িতে। মিলিটারিকে ওই দিকে এগোতে দেখে পাড়ার মোড়ে চায়ের দোকানে জটলা করা ছেলের দল তাঁকে সতর্ক করতে ছুট দেয়। এঁদের তাড়া করতে গিয়েই মিলিটারি আশু মজুমদার অবধি পৌঁছে গিয়েছিল। বাকিটুকু ইতিহাস, ওপরে যেমন লেখা রয়েছে।
ষাটের আগে থেকেই কবিতা লেখার শুরু। ১৯৬৫ অবধি আশুর কবিতা মানে শুধু খুঁজে চলা। বিষয়, আঙ্গিক। সমকালীন প্রতিষ্ঠিত কবিদের লেখার ছাপ স্পষ্ট তাঁর কবিতায়। কিন্তু সবকিছুর মধ্যেও বোঝা যায় বিচ্ছিন্নতা নয়, একাকিত্ব নয়, খুঁজে চলেছিলেন অনিঃশেষ এক রক্তগোলাপ।
স্পষ্টত দেখতে পাই, ঘাসে শ্যাওলা।
খুঁজে খুঁজে, সমাজ বিবর্ণ বেশ্যার অন্তরালে
মিছিলের দিকে পা বাড়ায়।
১৯৬৭ শুধু সেই মিছিলের অভিমুখ নির্ণয় করে দিয়েছিল। আশুতোষ মজুমদার সে-মিছিলের পথ থেকে পিছু ফেরেননি আর।
সন্দেহের তির্যক চোখে আলোকের
সাত রঙ খান খান হয়
এলোমেলো হাওয়ায় ঠিকানা হারায়
আলোকের সাত রঙ
ইন্দ্রধনুর সাত রঙ ……
আলোর সমুদ্র সময়
ফানুসের মত আয়ু তার রঙ
খুঁজবার দুর্বার মোহে বিদ্রোহী হয়,
সন্দেহের তির্যক চোখে
খুঁজে পেতে রক্তগোলাপ৷
ঋণস্বীকার: সত্তরের শহিদ: ভারত ও পূর্ব পাকিস্তান/বাংলাদেশ (প্রথম খণ্ড) স. স্বপন দাসাধিকারী ও দীপক রায়।
আশু মজুমদারের একমাত্র কবিতাপুস্তক ‘সন্দেহের তির্যক চোখে সাত রঙ’ থেকে পঙক্তিগুলি আহৃত। বইটির প্রকাশক এশিয়া পাবলিশিং।
…পড়ুন কবি ও বধ্যভূমি…
পর্ব ১৩: সিলারের পাপড়ি অথবা একজন পেশমেরগার মৃত্যু
পর্ব ১২: ডানার পালকে সূর্যকে নিয়ে…
পর্ব ১১: প্রিয় কমরেড, এসো একসাথে মরি
পর্ব ১০: প্রাণভিক্ষা? বেছে নিই মৃত্যুর অহংকার বরং!
পর্ব ৯: তিমিরের অন্তে যদি তিমিরবিনাশ
পর্ব ৮: অক্সিজেন মৃতদের জন্য নয়!
পর্ব ৭: আকাশে তারারা জ্বলছে, ফ্যলাস্তিনকে ভয় দেখিও না!
পর্ব ৬: কোথায় লুকোবে কালো কোকিলের লাশ?
পর্ব ৫: আমার দুঃখের কথা কি পাথরকে বলব?
পর্ব ৪: আমি সেই মেয়ে, যে আর ফিরবে না
পর্ব ৩: আমাকে পোড়াতে পারো, আমার কবিতাকে নয়!
পর্ব ২: এস্তাদিও চিলে আর চল্লিশটা বুলেটের ক্ষত
পর্ব ১: বিপ্লব, প্রেম ও কবিতাকে আমৃত্যু আগলে রেখেছিলেন দ্রোণাচার্য ঘোষ
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved