‘ইতিহাস বলে, মাস্টারদা সূর্য সেন ছিলেন শান্ত দৃঢ় চরিত্রের নেতা। বিপ্লব মানে উগ্রপন্থার উৎকট আতিশয্য নয়, কেবল পেশীশক্তি বা অস্ত্রবল নয়, বিপ্লব একটি সমাজ পরিবর্তনের পদ্ধতি এবং বিজ্ঞান—এই বিশ্বাস যেমন মাস্টারদার ছিল, তেমনি মুরারিরও ছিল। কোন কিছুই তাঁকে চঞ্চল, ভীত বা উচ্ছ্বসিত করত না। দেখেছি, বোমার মশলা শুদ্ধ ব্যাগ নিয়ে মুরারিকে, যেন রবীন্দ্ররচনাবলী বহন করছেন। গুরুত্বপূর্ণ অ্যাকশনের মুহূর্তে মুরারি সংযত ধীর, অথচ দৃঢ়সংকল্পময়।’
১৬.
মুরারি মুখোপাধ্যায়। ভারত
পুব শহরতলির দমদম কিশোর ভারতী ইশকুলের এক ছাত্রকে তার মাস্টারমশাই শুনিয়েছিলেন মুরারির গল্প। শহীদ মুরারির গল্প! মাস্টারমশাই সুযশ ভট্টাচার্য ছিলেন সত্তরের আগ্নেয়দিনে মুরারি মুখোপাধ্যায়ের অনুজপ্রতিম সহযোদ্ধা। যে সত্তর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনশাস্ত্রের স্নাতকোত্তর তরুণ ছাত্র মুরারি মুখোপাধ্যায়কে সত্যিকারের জীবনদর্শনের দিশা দিয়েছিল। উত্তরবাংলার কৃষক বিদ্রোহের ঝড় তখন কলকাতা আর শহরতলির বুক থেকেও শুকনো মরা পাতাগুলিকে উড়িয়ে নিচ্ছে দমকা হাওয়ায় ঝাপটায়। সেই ঝোড়ো দুপুরগুলো ঠিক করে দিচ্ছে মুরারি মুখোপাধ্যায়ের মতো যুবক-যুবতীরা কোনদিক বেছে নেবেন।
কিন্তু যদি ভেবে থাকেন, ঝড়ের টানে ভেসে গিয়ে মুরারি দ্রোহকালের অশ্বারোহী হয়েছিলেন– ভুল করবেন! মুরারির মতো ধীর-স্থির, অচঞ্চল, স্থিতপ্রজ্ঞ যুবক লাখে একটা মেলে! সুযশ ভট্টাচার্য স্মৃতিচারণ করেছেন: ‘মুরারির সাধারণ জীবনযাত্রা, বিনয়ী বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার এবং সুশিক্ষিত মনের দৃঢ়তা দেখে আমি মনে করতাম মুরারি মুখোপাধ্যায় ছিলেন এ যুগের সূর্য সেন। ইতিহাস বলে, মাস্টারদা সূর্য সেন ছিলেন শান্ত দৃঢ় চরিত্রের নেতা। বিপ্লব মানে উগ্রপন্থার উৎকট আতিশয্য নয়, কেবল পেশীশক্তি বা অস্ত্রবল নয়, বিপ্লব একটি সমাজ পরিবর্তনের পদ্ধতি এবং বিজ্ঞান–এই বিশ্বাস যেমন মাস্টারদার ছিল, তেমনি মুরারিরও ছিল। কোন কিছুই তাঁকে চঞ্চল, ভীত বা উচ্ছ্বসিত করত না। দেখেছি, বোমার মশলা শুদ্ধ ব্যাগ নিয়ে মুরারিকে, যেন রবীন্দ্ররচনাবলী বহন করছেন। গুরুত্বপূর্ণ অ্যাকশনের মুহূর্তে মুরারি সংযত ধীর, অথচ দৃঢ়সংকল্পময়।’
আড়িয়াদহ-দক্ষিণেশ্বর অঞ্চলের সংস্কৃতিচেতন দক্ষ সংগঠক মুরারি এলাকায় ফ্রি কোচিং চলাতেন, সাংস্কৃতিক উদ্যোগ নিতেন– এর মধ্য দিয়ে কাছে টেনে আনতেন এলাকার উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের। এইসব তরুণ-তরুণীদের মধ্যে অনেকেই পরে সিপিআই(এমএল)-এর নিঃস্বার্থ কর্মী হয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে কাজ করেছেন। সুযশ ভট্টাচার্যও– যিনি মেদিনীপুরে ১৯৭১-এ জেল ব্রেক-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন– এভাবেই মুরারির কাছাকাছি এসেছিলেন। আর এসেছিলেন ভদ্রা চক্রবর্তী। মুরারির প্রেমিকা। গান-কবিতার আসরে আলাপ, রাজনৈতিক বিশ্বাসে কাছাকাছি আসা, এ ওর হাত শক্ত মুঠিতে ধরা। সে মুঠি ছাড়িয়ে মুরারিকে চলে যেতে হয়েছিল বাংলা–বিহার-ওড়িশা সীমান্তে, পার্টির কাজের দায়িত্ব নিয়ে। ভদ্রা রয়ে গেলেন দক্ষিণেশ্বরে। পিছু ডাকেননি, বলেছিলেন, অপেক্ষা করবেন মুরারির ফিরে আসার জন্য, ঘর বাঁধার জন্য। কারণ, মুরারির মতো ভদ্রাও মনে করতেন– চাঁদ নদী ফুল তারা পাখি/ দেখা যাবে কিছুকাল পরে/ কেননা এ অন্ধকারে শেষ যুদ্ধ বাকি/ এখন আগুন চাই আমাদের এই কুঁড়েঘরে।
১৯৬৯ সালের অক্টোবর-নভেম্বর নাগাদ মুরারি, পার্টি-নাম ছিল আনন্দ, গ্রেপ্তার হলেন বহড়াগোড়া-চাকুলিয়া অঞ্চল থেকে। এর শেষ হাজারিবাগ সেন্ট্রাল জেলের সেলে, ১৯৭১-এ। ২৫ জুলাই সেই জেল-হত্যার রাতে, ১৬ জন বিপ্লবী-বন্দিকে একসঙ্গে মেরে ফেলেছিল জেল কর্তৃপক্ষ। হাজারিবাগ জেলে সে-সময়েই বন্দি ছিলেন মেরি টাইলর– অনন্ত সিংহের ম্যান-মানি–গান-এর সক্রিয় সদস্য ব্রিটিশ নারী– যিনি সে রাত্তিরের স্মৃতি মনে করেছেন তাঁর ‘My Years in Indian Prison’ বইটিতে।
“For One Sunday afternoon, in a torrential down- pour, I was trying to urge some life into the fire to make our evening chapatis, when the alarm bell started clanging, followed by the urgent blowing of warders’ whistles. The wardress on duty ran to lock us all in our cells. Almost before our padlocks were fastened, the shooting started the next two hours I listened, trapped in the cell, helplessly clutching the bars, while shots rang out from every corner of the jail. The wardress her- self took shelter for fear of being hit by flying bullets. My heart was pounding, my whole body trembling. The agony of not knowing what was happening filled my head till it felt as if it would burst. …
Just before the anniversary of the shooting there was a further order from the “Super” for all trees and bushes to be cut down. The jasmine had started blossoming again, though sparsely, and the guavas were sending out new shoots. The margosa had grown new branches and was provi- ding us with a little shade again. Now, all was taken from us once more. On 25th July the male Naxalites shouted slogans for hours on end. The wind that day was coming from the south, and bore their resounding shouts to our ears, They were keeping up the challenge in the best way they could.”
আর ভদ্রা! স্পার্টাকাসের ভেরেনিয়া যেন! স্পার্টাকাসকে রোমান শাসকেরা মেরে ফেলল যখন, তাঁর প্রেমিকা ভেরেনিয়া পালিয়ে যেতে পেরেছিলেন রোম নগরী থেকে দূরে, পাহাড়ি গ্রামাঞ্চলে। সেখানে একজন সাদাসিধে কৃষককে বিয়ে করেছিলেন তিনি– কিন্তু জীবন, সন্তান সবকিছু তাঁর ঘিরে থাকত শহীদ স্পার্টাকাসের মহিমা। ত্যাগের রাজনীতিতে দীক্ষিত ভদ্রার অনুশোচনা ছিল না মুরারি শহীদের মৃত্যু বরণ করায়, গৌরব আর বেদনার বোধটুকু ছিল। অনেক পরে অন্য একজন কমরেডের সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন ভদ্রা, কিন্তু জীবনের শেষ দিন অবধি সবটুকু জুড়ে বেঁচেছিলেন মুরারিকে নিয়েই। সাময়িক পরাজয়ে, শেষ বিজয়ের স্বপ্নে।
——
মুরারি মুখোপাধ্যায়ের কবিতা ‘ভালোবেসে’
ভালোবেসে চাঁদ হয়ো নাকো
পারো যদি সূর্য হয়ে এসো
আমি সে উত্তাপ নিয়ে নিয়ে
আঁধার অরণ্য জ্বেলে দেবো।
ভালোবেসে নদী হয়ো নাকো
পারো যদি বন্যা হয়ে এসো
আমি সে আবেগ বয়ে নিয়ে
হতাশার বাঁধ ভেঙে দেবো।
ভালোবেসে ফুল হয়ো নাকো
পারো যদি বজ্র হয়ে যাও
আমি সেই শব্দ বুকে নিয়ে
দিকে দিকে লড়াই-এর বার্তা ছুঁড়ে দেবো।
ভালোবেসে পাখি হয়ো নাকো
পারো যদি ঝড় হয়ে এসো
আমি সেই শক্তি বয়ে নিয়ে
পাপের প্রাসাদ ভেঙে দেবো।
চাঁদ নদী ফুল তারা পাখি
দেখা যাবে কিছুকাল পরে
কেননা এ অন্ধকারে শেষ যুদ্ধ বাকি
এখন আগুন চাই আমাদের এই কুঁড়েঘরে।
……………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………….
…পড়ুন কবি ও বধ্যভূমি…
পর্ব ১৫: কামানের মুখে কলহাস্যে এ কী ভালোবাসা!
পর্ব ১৪: গান্ধিনগরে রাত্রি
পর্ব ১৩: সিলারের পাপড়ি অথবা একজন পেশমেরগার মৃত্যু
পর্ব ১২: ডানার পালকে সূর্যকে নিয়ে…
পর্ব ১১: প্রিয় কমরেড, এসো একসাথে মরি
পর্ব ১০: প্রাণভিক্ষা? বেছে নিই মৃত্যুর অহংকার বরং!
পর্ব ৯: তিমিরের অন্তে যদি তিমিরবিনাশ
পর্ব ৮: অক্সিজেন মৃতদের জন্য নয়!
পর্ব ৭: আকাশে তারারা জ্বলছে, ফ্যলাস্তিনকে ভয় দেখিও না!
পর্ব ৬: কোথায় লুকোবে কালো কোকিলের লাশ?
পর্ব ৫: আমার দুঃখের কথা কি পাথরকে বলব?
পর্ব ৪: আমি সেই মেয়ে, যে আর ফিরবে না
পর্ব ৩: আমাকে পোড়াতে পারো, আমার কবিতাকে নয়!
পর্ব ২: এস্তাদিও চিলে আর চল্লিশটা বুলেটের ক্ষত
পর্ব ১: বিপ্লব, প্রেম ও কবিতাকে আমৃত্যু আগলে রেখেছিলেন দ্রোণাচার্য ঘোষ