সুব্বারাও পাণিগ্রাহীর একহাতে রাইফেল তখন, কলম তাঁর অন্যহাতে। শ্রীকাকুলমের বাঁধভাঙা সংগ্রামের আখ্যান লিখে, গেয়ে ছড়িয়ে দিচ্ছেন তিনি দিকে দিকে। মুক্তিতৃষ্ণাতুর জনতা গলায় তুলে নিচ্ছেন সেই গান। কীরকম গান রচনা করতেন সুব্বারাও? চেতনায় যাঁর আন্তর্জাতিকতাবাদ আর শৈলীতে যিনি দেশজ? সুব্বারাওয়ের সৃজনের আঙ্গিক উঠে এসেছিল লোকজীবনের গভীরতম তল থেকে। শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় ‘বুর্রাকথা’ (বীরগাথা)-কে ঘষেমেজে ‘জম্মুকুলকথা’ নামে একটি গীতিআখ্যানের আঙ্গিক তৈরি করলেন তিনি। জম্মুকুলকথা-র আঙ্গিকটি এরকম– খোলা মঞ্চে দর্শকদের সামনে তিনজন এসে দাঁড়াবেন; তার প্রথমজন (পুরুষ) জম্মুকু নামের একটি বাদ্যযন্ত্র কাঁধে ঝুলিয়ে কথায় বা কবিতায় মানুষের সামনে বলা শুরু করবেন যা তাঁরা বলতে এসেছেন; মাঝেরজন (নারী) সে কথাকেই গানে গেয়ে শোনাবেন; আর তৃতীয়জন (পুরুষ) মূলত কৌতুক করে পুরোটাতে একটা গতির সঞ্চার করবেন। এই আঙ্গিকে মহাকাব্যিক কৃষকসংগ্রামের গাথা এত দ্রুত এত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে সুব্বারাও ও তাঁর দল জম্মুকুলকথা নিয়ে আসছেন শুনলে আক্ষরিক অর্থে সে এলাকার হাজারে হাজারে অনেক আগে থেকে ভিড় জমাতেন।
২২
সুব্বারাও পাণিগ্রাহী। ভারত
সে গ্রামের নাম বোড্ডাপাড়ু। অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীকাকুলম জেলার উপকূলের ধারে নারকেল গাছ আর কাজুবাদামের বাগানে ঘেরা ছোট্ট সেই গ্রাম। এ গ্রামে এমন একটিও বাড়ি নেই যেখানে ১৯৭০ থেকে ২০০০ সাল অবধি একবারের জন্য হলেও পুলিশ ঢোকেনি! কারণ এ গ্রাম দেশকে দিয়েছে ১৬ জন শহিদ। আগ্নেয় সত্তরে যে শ্রীকাকুলম দেশ জুড়ে ভিয়েতনামের সমতুল একটি নাম হয়ে উঠেছিল, তার আঁতুড়ঘর নিঃসন্দেহে ছিল এই বোড্ডাপাড়ু। এই ছবির মতো নিস্তরঙ্গ গ্রামটিতে এসে মিলেছিলেন তিনটি যুবক। তামাডা গণপতি, পঞ্চাদি কৃষ্ণমূর্তি আর সুব্বারাও পাণিগ্রাহী।
সুব্বারাও যুক্তিবাদী, নাস্তিক। মনে করতেন, ঈশ্বরকে তৈরিই করা হয়েছে গরিবকে দাবিয়ে রাখার জন্য। সেই সুব্বারাও করতেন কী? গ্রামের মন্দিরের পুরুতগিরি! কোনও মানে হয়? সুব্বারাওরা আসলে ওড়িশার মানুষ, রুটি-রুজির খোঁজে তাঁর পরিবার লাগোয়া অন্ধ্রের সোমপেটা এলাকায় চলে এসেছিলেন। বাবা শ্রীবৎস পাণিগ্রাহী ছিলেন নৈষ্ঠিক পূজারি ব্রাহ্মণ। এবং বৈদ্য। ছেলেকেও পুরুতগিরির প্রশিক্ষণই দিয়েছিলেন। কিন্তু ধর্ম নিয়ে লেগেই থাকত বাপ-ছেলের। পড়াশোনাতে মোটেও ভালো ছিলেন না। কিন্তু কমিউনিজমের বইপত্রের দিকে আকর্ষণ ক্লাস এইট না পেরোতেই। তেজেশ্বর রাওয়ের মতো তরুণ কমিউনিস্টরা তখন কাজ করেন ওই অঞ্চলে। কমিউনিস্ট পার্টি সোমপেটা থেকে বোড্ডাপাড়ু গ্রামে সুব্বারাওকে নিয়ে এল ওখানকার একমাত্র মন্দিরের পুরোহিত বানিয়ে। বোড্ডাপাড়ুতে এসে পেয়ে গেলেন সমমনা তামাডা আর পঞ্চাদি-কে। পুরোহিতের পরিচয়ে তাঁর কাজ হল দরিদ্র মানুষের সঙ্গে মেশা, পার্টির হয়ে সাংস্কৃতিক কাজ করা, যুবকদের সংগঠিত করা। তিনজনে মিলে গড়ে তুললেন ‘যুবজন সংঘম’। এই হচ্ছে শুরু।
ভিনান্দি বাড়ু বিষাদ গাড়া, গোদাভরী নদী ওয়রদালা বাধা।
গোদাবরীর বিধ্বংসী বন্যা নিয়ে লিখলেন, এবং তা গেয়ে টাকা তুললেন বন্যাত্রাণের জন্য। এবং এটা করতে গিয়েই বুঝতে পারলেন যে লেখা নয়, লেখার বাচিক রূপান্তর– বিশেষ করে তার গীতিরূপ– মানুষের কাছে অনেক তাড়াতাড়ি, অনেক সহজে বক্তব্যকে পৌঁছে দিতে পারে। নাটক আর গান দুই-ই লেখা চলল। আর চলল সংগঠনের কাজ– যুবজন সংঘম-এর পতাকাতলে মদ খাওয়া বন্ধ করা, কুয়ো খোঁড়া, রাস্তা সারাইয়ের মতো জনপ্রিয় সংস্কারমূলক কাজকর্মের মধ্যে দিয়ে আসলে জনভিত্তি মজবুত করে নেওয়া। যুবক-যুবতীদের সংস্কৃতিমনস্ক করে তোলার দিকে বিশেষ নজর ছিল সুব্বারাওয়ের। এর পাশাপাশি শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর মতো দাবিদাওয়াও সামনে তুলে আনতে লাগল সংঘম। নকশালবাড়ির ঝোড়ো বসন্তবজ্রের আওয়াজ ততদিনে শুনে ফেলেছে শ্রীকাকুলমও। পার্বত্য এলাকায় (‘এজেন্সি’ বলা হত যেগুলিকে) গিরিজনদের সংগ্রাম তখন নির্দিষ্ট অভিমুখ পেয়ে গেছে। তামাডা, পঞ্চাদি আর সুব্বারাও অন্য সহযোদ্ধাদের সঙ্গে মিলে সে লড়াইকে ছড়িয়ে দিলেন সমুদ্রপাড়ের সমতলে, ‘উদ্যানম’ বলা হত যাকে। পঞ্চাদি কৃষ্ণমূর্তি আর চৌধুরী তেজেশ্বর রাও কলকাতায় এলেন চারু মজুমদারের সঙ্গে কথা বলতে। চারু মজুমদার তাঁদের বলেছিলেন– নকশালবাড়ি যেখানে থেমে গিয়েছে, সেখান থেকেই শুরু করতে হবে শ্রীকাকুলমের কমরেডদের। বার্তা নিয়ে ফিরলেন তাঁরা; শ্রীকাকুলমে জোয়ার এল সংগ্রামের। বিপ্লবের মহাকাব্যের নতুন অধ্যায় লিখতে বসল। ‘ভারতের ইয়েনান’ হয়ে উঠতে না পারলেও, ভারতের বিপ্লবের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে উঠতে সময় নিল না এই অঞ্চল।
সুব্বারাও পাণিগ্রাহীর একহাতে রাইফেল তখন, কলম অন্যহাতে। শ্রীকাকুলমের বাঁধভাঙা সংগ্রামের আখ্যান লিখে, গেয়ে ছড়িয়ে দিচ্ছেন তিনি দিকে দিকে। মুক্তিতৃষ্ণাতুর জনতা গলায় তুলে নিচ্ছেন সেই গান। কীরকম গান রচনা করতেন সুব্বারাও? চেতনায় যাঁর আন্তর্জাতিকতাবাদ আর শৈলীতে যিনি দেশজ? সুব্বারাওয়ের সৃজনের আঙ্গিক উঠে এসেছিল লোকজীবনের গভীরতম তল থেকে। শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় ‘বুর্রাকথা’ (বীরগাথা)-কে ঘষেমেজে ‘জম্মুকুলকথা’ নামে একটি গীতিআখ্যানের আঙ্গিক তৈরি করলেন তিনি। জম্মুকুলকথা-র আঙ্গিকটি এরকম– খোলা মঞ্চে দর্শকদের সামনে তিনজন এসে দাঁড়াবেন; তার প্রথমজন (পুরুষ) জম্মুকু নামের একটি বাদ্যযন্ত্র কাঁধে ঝুলিয়ে কথায় বা কবিতায় মানুষের সামনে বলা শুরু করবেন যা তাঁরা বলতে এসেছেন; মাঝেরজন (নারী) সে কথাকেই গানে গেয়ে শোনাবেন; আর তৃতীয়জন (পুরুষ) মূলত কৌতুক করে পুরোটাতে একটা গতির সঞ্চার করবেন। এই আঙ্গিকে মহাকাব্যিক কৃষকসংগ্রামের গাথা এত দ্রুত এত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে সুব্বারাও ও তাঁর দল জম্মুকুলকথা নিয়ে আসছেন শুনলে আক্ষরিক অর্থে সে এলাকার হাজারে হাজারে অনেক আগে থেকে ভিড় জমাতেন। এতটাই ব্যাপক ছিল তাঁদের সে আবেদন যে একবার পি সুন্দরায়া খাম্মামে এক বিরাট জনসভায় প্রধান বক্তা হিসাবে হাজির হলে উপস্থিত জনতা চিৎকার করে বলেছিল– ‘সুব্বারাও কোথায়? তাঁর গান শুনতে চাই, তোমার বক্তৃতা নয়।’ লালের জোয়ার তুলে এভাবেই গ্রাম থেকে শহরে ছড়িয়ে পড়ছিল সুব্বারাওয়ের সৃজন, সুব্বারাওয়ের রাজনীতি।
ভয় কী লাল রঙে? আমাদের প্রিয় রং লাল
সূর্যের প্রথম কান্তি, উজ্জ্বল ও রক্তিম
সূর্যের অস্তলগ্নে লাল হয় পশ্চিম…
লাল নয় মধ্যম, উত্তম মনোরম লাল।
শহরে রাস্তার মোড়ে লাল আলো যখন জ্বলে
স্তব্ধ ধনিকের গাড়ি, পদাতিক পথ চলে…
ভয় কী? লাল রঙে ভয় কী?
ভয় কী লাল রঙে? আমাদের প্রিয় রং লাল
মানুষের মুক্তির যুদ্ধে যারা দিল প্রাণ নির্ভয়
তাদেরই রক্তের লাল রং আমাদের সারা দেহে বয়
তাদের প্রেমের রঙে আমাদের প্রাণ হল লাল
হাতের নিশান হল লাল…
তাই– আমাদের প্রিয় রং লাল।
সোমপেটার অগ্রণী সংগঠক ভাস্কর রাও শাহাদাত বরণ করলে তাঁর রক্তের লাল রং শরীরের প্রতি শিরায় বইয়ে নিয়ে এলাকার দায়িত্ব নিয়েছিলেন সুব্বারাও। বেশিদিনের জন্য নয় অবশ্য। অসম্ভব অসুস্থ শরীরে রঙ্গামাটিয়া পাহাড়ে সুব্বারাও পাণিগ্রাহী তাঁর আরও চার সহযোদ্ধার সঙ্গে ধরা পড়েন পুলিশবাহিনীর হাতে। এই চারজনের মধ্যে পঞ্চাদি কৃষ্ণমূর্তির জীবনসঙ্গিনী বিপ্লবী নির্মলাও ছিলেন। তাঁদের গাছের সঙ্গে বাঁধা হয়। তাক করা রাইফেলের সামনে দাঁড়িয়ে দুর্নিবার কণ্ঠে স্লোগান তোলেন সুব্বারাও, অকম্পিত গলা মেলান আর চারজন। রঙ্গামাটিয়া পাহাড়ের কাছাকাছি গ্রামের মানুষেরা শুনতে পেয়েছিলেন সে বজ্রনির্ঘোষ– বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক! পাঁচজন একসঙ্গে লড়েছিলেন, পাঁচজন একসঙ্গেই মরেছিলেন। বড় গৌরবের মৃত্যু!
হাত দিয়ে বল সূর্যের আলো রুধিতে পারে কি কেউ?
আমাদের মেরে ঠেকানো কি যায় জনজোয়ারের ঢেউ?
কমিউনিস্ট আমরা, আমরা কমিউনিস্ট
খেটে খায় যারা আমরা তাদের, আমরা কমিউনিস্ট
মানো বা না মানো মত আমাদের, আমরা কমিউনিস্ট।
[কসটাজীভলম মেমু কমিউনিস্টলম…]
ন্যায়ের পতাকা তুলেছি উর্ধ্বে অন্যায়েরই যম
বাধার পাহাড় ডিঙিয়ে লক্ষ্যে চলেছি জোর কদম
[কসটাজীভলম মেমু কমিউনিস্টলম…]
মোদের ঝান্ডা লালে লাল খুনে মেহনতি জনতার
দু-চোখে স্বপ্ন শত শহীদের চলেছি দুর্নিবার
[কসটাজীভলম মেমু কমিউনিস্টলম…]
জনতারে নিয়ে চলেছি এগিয়ে লক্ষ্য করিব জয়
সমাজেরে মোরা ভাঙিয়া গড়িব নির্মম নির্ভয়
[কসটাজীভলম মেমু কমিউনিস্টলম…]
…পড়ুন কবি ও বধ্যভূমি…
পর্ব ২১: অলিভ-বাগান, উম্ম সাআদ আর হাইফায় ফেরা
পর্ব ২০: যে তাঁত বুনেছে রক্তপতাকা
পর্ব ১৯: আমাকে দেখাও সেই বন্দিকক্ষ
পর্ব ১৮: কতটা দীর্ঘ হলে জনযুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয়? (২য়)
পর্ব ১৭: কতটা দীর্ঘ হলে জনযুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয়? (১ম)
পর্ব ১৬: পারো যদি বজ্র হয়ে এসো
পর্ব ১৫: কামানের মুখে কলহাস্যে এ কী ভালোবাসা!
পর্ব ১৪: গান্ধিনগরে রাত্রি
পর্ব ১৩: সিলারের পাপড়ি অথবা একজন পেশমেরগার মৃত্যু
পর্ব ১২: ডানার পালকে সূর্যকে নিয়ে…
পর্ব ১১: প্রিয় কমরেড, এসো একসাথে মরি
পর্ব ১০: প্রাণভিক্ষা? বেছে নিই মৃত্যুর অহংকার বরং!
পর্ব ৯: তিমিরের অন্তে যদি তিমিরবিনাশ
পর্ব ৮: অক্সিজেন মৃতদের জন্য নয়!
পর্ব ৭: আকাশে তারারা জ্বলছে, ফ্যলাস্তিনকে ভয় দেখিও না!
পর্ব ৬: কোথায় লুকোবে কালো কোকিলের লাশ?
পর্ব ৫: আমার দুঃখের কথা কি পাথরকে বলব?
পর্ব ৪: আমি সেই মেয়ে, যে আর ফিরবে না
পর্ব ৩: আমাকে পোড়াতে পারো, আমার কবিতাকে নয়!
পর্ব ২: এস্তাদিও চিলে আর চল্লিশটা বুলেটের ক্ষত
পর্ব ১: বিপ্লব, প্রেম ও কবিতাকে আমৃত্যু আগলে রেখেছিলেন দ্রোণাচার্য ঘোষ
বিশ্ব ক্রীড়াক্ষেত্র যে বাঁকে দাঁড়িয়ে, তাতে ভবিষ্যতের সাক্ষী মালিক, মনিকা বাত্রা, লক্ষ্য সেনদের বিকল্প পথের কথা ভাবতে শুরু করতে হবে। কমনওয়েলথ গেমসকে ভুলে অলিম্পিক, এশিয়াডের প্রস্তুতি হিসেবে পাখির চোখ করতে হবে নিজ খেলার আঞ্চলিক, মহাদেশীয় ও বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপগুলোকে।