সঙের গানে আর ছড়ায় ১০০ বছর আগের কলকাতার নানারকম বর্ণনা পাওয়া যায়। বিশেষ করে বাঙালি পাড়ার খবরাখবর। মধ্য-উত্তর কলকাতার রাস্তা ধরে বেরোত জেলেপাড়ার সঙের শোভাযাত্রা। ১৯৩০ সালে যেমন যাত্রাপথের সূচি দিয়ে বঙ্গবাণীতে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয় দিন পাঁচেক আগে: “৩০শে চৈত্র রবিবার ‘জেলেপাড়ার সং’ নিম্নলিখিত রাস্তা দিয়া শোভাযাত্রা বাহির হইবে। রমানাথ কবিরাজ লেন, ঠাকুরদাস পালিত লেন, অক্রুর দত্ত লেন, ওয়েলিংটন স্ট্রীট, কলেজ স্ট্রীট, হ্যারিসন রোড, আমহার্স্ট স্ট্রীট, শশীভূষণ দে স্ট্রীট (নেবুতলা), শাঁখারীটোলা লেন, বাঞ্ছারাম অক্রুর লেন ও ঠাকুরদাস পালিত লেন হইয়া রমানাথ কবিরাজ লেনে আসিবে।” [২৫ চৈত্র ১৩৩৬, ৮ এপ্রিল ১৯৩০]
২০.
বিগত বত্রিশ সন
পাননি সঙ-এর দর্শন,
তার কারণ, পুলিশের বারণ–
ক্ষমা ভিক্ষা তাই করছি নিবেদন।
গত চৈত্রে মৈত্রী খসিয়ে,
ভারতপুত্তুর শত্তুর হাসিয়ে,
ভাই হয়ে ভাইকে শাসিয়ে,
শহর ভাসিয়ে,
রেষারেষির বন্যা করেছিল আনয়ন।।
আইনে বন্ধ বাণ-ফোঁড়া (কিন্তু),
চলেছিল ইট ছোঁড়া আর চোরাই ছোরা,
থানার হল্লা, কেল্লার গোরা,
নেতাদের কেতাদোরস্ত মোটরে ঘোরা,
ঠাণ্ডা করতে ডাণ্ডার খেলা মেনেছিল হার।
ভাগ্যে ছিল বাংলার ছাত্র,
ভগ্নঅস্ত্র নগ্নগাত্র,
ত্যাগের বলে বলী মাত্র,
সেইসব স্নেহের পাত্রদের জোরে,
সে যাত্রা পারা গেছে পার।।
এখন জ্বরের নাইকো সাইন,
টেম্পারেচার নাইনটি নাইন,
আইন কিম্বা কুইনাইন করেছে অবস্থা নর্ম্যাল।
কমিশনার স্যার টেগার্ট,
(যাঁর) মাথায় আছে পার্ট,
আর বুকের ভিতর হার্ট,
এই দিশি আর্টটা রাখতে বজায়,
অর্ডার দেছেন ফর্ম্যাল।।
বাংলা ১৩৩২ সনে জেলেপাড়ার সঙ চৈত্র সংক্রান্তিতে কলকাতার রাস্তায় বেরোয়নি। পুলিশের অনুমতি মেলেনি শোভাযাত্রা করার। ১৯২৬ সালের দাঙ্গা কলকাতায় ভয়াবহ আকার নিয়েছিল। সঙ বেরলে ভিড় রাস্তায় আবার যদি কোনও ঝামেলা ঘটে– এই আশঙ্কায় সেই বছর আর শহরের কর্তারা কোনওরকম ঝুঁকি নিতে চাননি। পরের বছর সঙ ফিরে আসে স্বমহিমায়। আর সেখানেই গাওয়া হয় উপরে উল্লিখিত এই ক্ষমাপ্রার্থনা। দু’-চার ছত্রে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার কথা, হিংসার কথা, নেতাদের নিষ্ক্রিয়তা– সবই ফুটে উঠেছে। শেষ ছত্রে এসেছে মজার ছলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার প্রসঙ্গ। ইংরিজি-বাংলা মিলিয়ে সঙের মতো ‘দিশি আর্ট’কে সমর্থন করার জন্য পুলিশ কমিশনারকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন।
সঙের গানে আর ছড়ায় ১০০ বছর আগের কলকাতার নানারকম বর্ণনা পাওয়া যায়। বিশেষ করে বাঙালি পাড়ার খবরাখবর। মধ্য-উত্তর কলকাতার রাস্তা ধরে বেরোত জেলেপাড়ার সঙের শোভাযাত্রা। ১৯৩০ সালে যেমন যাত্রাপথের সূচি দিয়ে বঙ্গবাণীতে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয় দিন পাঁচেক আগে: “৩০শে চৈত্র রবিবার ‘জেলেপাড়ার সং’ নিম্নলিখিত রাস্তা দিয়া শোভাযাত্রা বাহির হইবে। রমানাথ কবিরাজ লেন, ঠাকুরদাস পালিত লেন, অক্রুর দত্ত লেন, ওয়েলিংটন স্ট্রীট, কলেজ স্ট্রীট, হ্যারিসন রোড, আমহার্স্ট স্ট্রীট, শশীভূষণ দে স্ট্রীট (নেবুতলা), শাঁখারীটোলা লেন, বাঞ্ছারাম অক্রুর লেন ও ঠাকুরদাস পালিত লেন হইয়া রমানাথ কবিরাজ লেনে আসিবে।” [২৫ চৈত্র ১৩৩৬, ৮ এপ্রিল ১৯৩০]
সঙের গানে সামাজিক-সাংস্কৃতিক বা রাজনৈতিক নানা বিষয় তো ছিলই, কিন্তু তার সঙ্গে বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায় কলকাতা নিয়ে নানা মন্তব্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার প্রশ্ন চুরি নিয়ে ১৯১৭ সালে হইহই পড়ে যায়। ভারতচন্দ্রের ‘বিদ্যাসুন্দর’-এর আদলে অমৃতলাল বসু ‘বিদ্যার মন্দিরে সিঁদ’ নামে রচনা করেছিলেন সঙের গান। আবার কেল্লা থেকে কয়েক ঘণ্টা অন্তর তোপ দেওয়ার পুরনো রীতি খরচ বাঁচাতে বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যেবার, তখন ছড়া কাটা হল ‘তোপ লোপ’–
থেমে গেছে তোপ বাবা থেমে গেছে তোপ,
কেউ আর বলে না তো তোপ পড়বে চোপ,
থেমে গেছে ঘড়ি খুলে
বসে থাকা কান তুলে
এক সঙ্গে একটায় দম দেওয়া লোপ,
‘টাইমের’ ঘাড়ে দেছে একনমি কোপ!
তবে বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে, যেমন কোনও রাজপুরুষের আগমনে, ‘খাতিরের তোপগুলি’ বহাল রইল, তাতে সরকারের নজর যায় না, সেখানে খরচ কমে না। এর আগে দিনে তিনবার করে তোপ পড়ত, আর সেই অনুযায়ী সবাই নিজের ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে নিত– ফলে ঘড়ি হত ‘ট্রু টু দি গন’! এখন আর সেই উপায় রইল না– ‘সকলেই ‘পাংচুয়াল’ বাহবা কি ‘ফন’! সকলের সময় কীভাবে এক করে মেলানো যাবে– এই নিয়ে চিন্তা দেখা দিল এবার–
বিষম লেঠায় ঠেকে গেছে এ সহর,
মাপে ছোট বড় হয় ঘনটা পহর;
পাঁজি হাতে সূর্য্যোদয়
দেখা ত সহজ নয়
গড়ের মাঠে দাঁড়ালেও দৃষ্টি বেধে যায়,
মনুমেন্ট চড়া ছাড়া না দেখি উপায়।।
তোপ লোপে যেমন ছড়া, তেমনই নতুন পার্ক নিয়েও আসরে জেলেপাড়ার সঙ। কলকাতা পুরসভা যখন মহিলাদের জন্য একটা নির্দিষ্ট পার্ক চালু করার কথা ঘোষণা করল, তখন লেখা হল:
পর্দা পার্ক
স্ত্রীর উক্তি:
মুন্সিপালের মজলিসে ওগো
হয়ে গেছে ধার্য্য।
এবার হুকুম অনিবার্য্য,
গিয়র পার্কে মার্কা মারা রমণীর রাজ্য।।
আদরের ভাতার আমার
সভামাঝে কল্লেন আবেদন।
নারীর গতর মাটি, শরীর কাঠি,
না করে হাঁটাহাঁটি, পাচ্ছেন প্রাণেতে বেদন।।
…
বাঁচা গেল, খাঁচা গেল, জীবনটা এখন
মিছে বলে হচ্ছে না আর বোধ।
কর্ত্তে যাব পায়চারি, মিলে যত নারী,
একটু পড়ে এলেই রোদ।।
কলকাতার প্রশাসন, শহরের হালচাল, দৈনন্দিন নানা ঘটনা নিয়ে সঙের গান রঙ্গ-ব্যঙ্গে ঔপনিবেশিক আমলের অসমতাগুলি তুলে ধরেছে। অন্যদিকে, জাতীয়তাবাদী ভাবধারা বিশেষভাবে ফুটে উঠেছে কিছু কিছু গানে। চিত্তরঞ্জন দাশ কলকাতার মেয়র হলেন, স্বরাজ পার্টি কলকাতা পুরসভায় ক্ষমতায় এল, এবার শহরের হাল ফিরবে, বিশেষ করে দেশীয়দের এলাকায়– এই নিয়ে নানা আশা ছিল শহরবাসীর মনে। সঙের গানেও নানাভাবে এসেছে সে প্রসঙ্গ। এর পাশাপাশি পাওয়া যায় ঔপনিবেশিক ব্যবস্থায় শহরের উন্নয়নের যে অসামঞ্জস্য, সেই নিয়ে মজার ছলে দু’ চার কথা–
নিলে খরচা করে দোতলায় নল,
মল্লিকঘাটের বেল্লিক কল,
পাম্প কর্ত্তে পারে না জল, closet তাতে হয় না মোটে ফ্লাসিং।
ট্রাম, ইলেকট্রিক, মুন্সীপাল,
খোঁড়েন রাস্তা করেন খাল,
অবসট্রাকসন চিরকাল, (কিন্তু আপনি আমি)
ফুটপাতে পাতলে টুল তখুনি রুল,
হয় না তাতে ব্লাসিং।।
চৌরঙ্গীর কি চারটে মাথা, তাই উড়ে পড়লে গাছের পাতা,
ধাঙ্গড় ছুটে ধরে হাতা, ঢাকনি ঢাকা ডাষ্টবিন
অষ্টপ্রহর সাফ।
আমরা বুঝি কন্দকাটা, তাই দশটার পর মেথর খাটা,
ধুলো উড়িয়ে বুলোয় ঝাঁটা, ভাঙ্গা ফাটা জঞ্জাল-বাক্স
যায় গড়াগড়ি পাপ।।
বাড়ি বাড়ি পাইপ দিয়ে জল পৌঁছনো বা জঞ্জাল পরিষ্কার করার মতো প্রাত্যহিক নাগরিক পরিষেবা যে শহরের কিছু অঞ্চলে নিয়মিত পাওয়া যেত না, সেই বিষয়ে ইতিহাসবিদরা নানা তথ্য ভাণ্ডার ঘেঁটে অনেক দিন ধরেই লিখে চলেছেন। ঔপনিবেশিক নগরায়নের এক বিশেষ রূপই বলা চলে একে। শাসক-শাসিতের জাতি ভেদাভেদের পাশাপাশি শ্রেণিবৈষম্যও এতে মিশে ছিল। শাসিতের স্বর চট করে পাওয়া যায় না সরকারি লেখ্যাগারে। সঙের গানে কিন্তু আমরা চমৎকার ছবি পেয়ে যাই সাধারণ নগরবাসীর দৈনন্দিনতার। শহরের বড় রাস্তাজুড়ে হইহই করে শোভাযাত্রা বের করার মধ্যে রয়েছে এক দেশজ নাগরিক উদযাপন। আর সেই যাত্রাপথের গানে-ছড়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নগর-জীবনের নানা সমস্যা, সুবিধে-অসুবিধের কথা। অবশ্যই ব্যঙ্গের ছলে, হাসি-ঠাট্টার মোড়কে।
তথ্যসূত্র: বীরেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলাদেশের সঙ প্রসঙ্গে (১৯৭২)
…কলিকথা–র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১৯: দেশভাগ ও উদ্বাস্তু মানুষদের শিয়ালদা স্টেশন
পর্ব ১৮: কলের গাড়ি ও কলকাতার নিত্যযাত্রীরা
পর্ব ১৭: বাবুদের শহর যেভাবে বদলে গেল আবেগের শহরে
পর্ব ১৬: ঘর-বন্দি হয়েও নাগরিক কলকাতার স্বাদ
পর্ব ১৫: গৃহভৃত্যর বেশিরভাগই ছিলেন পুরুষ, দু’দশকে বদলে যায় পরিস্থিতি
পর্ব ১৪: স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা সিনেমায় চাকরির ইন্টারভিউয়ের দৃশ্য সেই সময়ের আয়না
পর্ব ১৩: দাঙ্গা ও দেশভাগ বদলে দিয়েছে কলকাতার পাড়া-বেপাড়ার ধারণা
পর্ব ১২: প্রাচীন কলকাতার বোর্ডিং হাউস
পর্ব ১১: সারা বিশ্বে শ্রমিক পাঠানোর ডিপো ছিল এই কলকাতায়
পর্ব ১০: কলকাতার যানবাহনের ভোলবদল ও অবুঝ পথচারী
পর্ব ৯: বৃষ্টি নিয়ে জুয়া খেলা আইন করে বন্ধ করতে হয়েছিল উনিশ শতকের কলকাতায়
পর্ব ৮: ধর্মতলা নয়, ময়দানই ছিল নিউ মার্কেট গড়ে তোলার প্রথম পছন্দ
পর্ব ৭: সেকালের কলকাতায় বাঙালি বড়মানুষের ঠাঁটবাটের নিদর্শন ছিল নিজের নামে বাজার প্রতিষ্ঠা করা
পর্ব ৬: কলকাতার বহিরঙ্গ একুশ শতকের, কিন্তু উনিশ-বিশ শতকের অসহিষ্ণুতা আমরা কি এড়াতে পেরেছি?
পর্ব ৫: কলকাতা শহর পরিকল্পনাহীনভাবে বেড়ে উঠেছে, একথার কোনও বিশেষ ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই
পর্ব ৪: ঔপনিবেশিক নগর পরিকল্পনার বিরুদ্ধ মত প্রকাশ পেয়েছিল যখন প্লেগ ছড়াচ্ছিল কলকাতায়
পর্ব ৩: ঔপনিবেশিক কলকাতায় হোয়াইট টাউন-ব্ল্যাক টাউনের মধ্যে কোনও অলঙ্ঘনীয় সীমানা
পর্ব ২: ‘জল’ যেভাবে ‘জমি’ হল এ কলকাতায়
পর্ব ১: চেনা কলকাতাকে না পাল্টেই বদল সম্ভব, পথ দেখাতে পারে একটি বাতিল রিপোর্ট