১৮৪২ সালে চালু হওয়া ‘ভবানীপুর ডিপো’ থেকে মরিশাসের উদ্দেশে লোক পাঠানো হত গোড়ায়, কিন্তু কিছুকাল পর থেকে ত্রিনিদাদ টোবাগো, জামাইকা, আর ডেমেরারার শ্রমিকদেরও ঠাঁই হয় এখানে। ৫, ৮, ১১, আর ৭১ নম্বর গার্ডেন রিচ ঠিকানাগুলি ছিল ত্রিনিদাদ টোবাগো, ফিজি, সেন্ট লুসিয়া, সেন্ট কিটস, সেন্ট হেলেনা, আর ব্রিটিশ গায়ানায় শ্রমিক পাঠানোর ডিপো। ২০ গার্ডেন রিচ থেকে সুরিনাম আর ৭৬ গার্ডেন রিচ থেকে কায়েন আর মার্টিনিকের উদ্দেশে পাঠানোর জন্য নির্ধারিত শ্রমিকদের জড়ো করা হত। এই দুই ডিপোর দেখভাল করত ওলন্দাজ আর ফরাসি সরকার।
১১.
কলকাতার ইতিহাসচর্চায় বন্দর এলাকা নিয়ে খুব বেশি লেখাপত্তর পাওয়া যায় না। কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিঃসন্দেহে হয়েছে, কিন্তু শহরের অতীত নিয়ে আলোচনায় কলকাতা যে মূলত একটা বন্দর-শহর– সেই প্রসঙ্গটি যেন খানিক ধামাচাপা পড়ে থাকে। আঠারো-উনিশ শতকে কোম্পানির আমলে কলকাতার কিন্তু প্রাণ-ভোমরা ছিল কলকাতা বন্দর। পরবর্তীকালে বিশ শতকের বিশ্বযুদ্ধের সময়ে কলকাতা বন্দর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পণ্যসামগ্রী ছাড়াও উনিশ-বিশ শতক জুড়ে কলকাতা বন্দর পূর্ব ভারত থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে শ্রমিক অভিবাসনের মূল কেন্দ্র ছিল।
‘ইন্ডেন্টচার্ড লেবার’ বা চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক ব্যবস্থা ভারতের শ্রম-ইতিহাসের এক বড় অধ্যায়। বিলেতে আইন করে দাস ব্যবস্থার অবসান ঘটে ১৮৩৩ সালে। এর ফলে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ (ব্রিটিশ গায়ানা, জামাইকা, ত্রিনিদাদ) বা মরিশাসের আখের খেতগুলি (সুগার প্ল্যান্টেশন) যে দাস-শ্রমিকের শ্রমের ওপর নির্ভর করে চলছিল সেখানে সমস্যা দেখা দিল। এই সময়েই ভারত থেকে শ্রমিক পাঠানো শুরু হয় এইসব দেশে। সাম্রাজ্যব্যাপী এক বিরাট শ্রমিক চলাচলের সূচনা হল উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যা আগামী বেশ কয়েক দশক বিশ্বব্যাপী চিনির ব্যবসা চালিয়ে নিয়ে যাবে।
১৮৩৮ সালের ২৯ জানুয়ারি ২৪৬ জনকে নিয়ে ‘হুইটবি’ আর ১৬৫ জন শ্রমিক নিয়ে ‘হেস্পেরাস’ জাহাজ দু’টি রওনা দেয় কলকাতা বন্দর থেকে, গন্তব্য ছিল ব্রিটিশ গায়ানা। ৫ মে পৌঁছয় সেখানে। গায়ানার বাসিন্দারা এখন এই দিনটি পালন করেন ‘ইস্ট ইন্ডিয়ান অ্যারাইভাল ডে’ হিসেবে। এই নয় যে আর আগে ভারত থেকে শ্রমিক কাজ করতে যায়নি অন্য কোথাও। কিন্তু ১৮৪০-এর দশক থেকে যে ব্যবস্থা চালু হল সেখানে সরাসরি ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অনুমোদন ছিল। এর ৪০ বছরের মধ্যে, ১৮৭০-এর দশকের শেষে, এই চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক ব্যবস্থা একটা নির্দিষ্ট রূপ পেয়ে যায় আর কলকাতা বন্দর হয়ে দাঁড়ায় ভারত থেকে বিদেশের বাগিচা-শিল্পে শ্রমিক পাঠানোর অন্যতম কেন্দ্র। পশ্চিমে ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চল থেকে বর্তমান ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলি অবধি ছড়ানো বিস্তীর্ণ পশ্চাদভূমি থেকে শ্রমিক নিয়োগ করা শুরু হয়। ‘সর্দার’দের হাত ধরে গ্রাম থেকে পুরুষ-মহিলাদের কলকাতায় নিয়ে আসা হত, তারপর সেখান থেকে সাগরপারে যাত্রা।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
এইসব ঠিকানা আমাদের কলকাতার এক অন্য অতীতের কথা বলে। যেখানে শহরটা এক দীর্ঘ যাত্রাপথের অংশ বিশেষ, কয়েক দিনের আস্তানা কিছু হতভাগ্য মানুষের, যারা নিজেদের গাঁ-ঘর পরিবার ছেড়ে এক অজানা অচেনা দেশে কাজ করতে চলেছে, খানিক উন্নত জীবনের আশায়। এইসব অভিবাসীদের পরবর্তী প্রজন্ম নানাভাবে বয়ে চলে এই যাত্রার স্মৃতি। ব্রিটিশ গায়ানায় এরকম এক লোকগীতি অনেক দিন ধরে প্রচলিত যা মনে করিয়ে দেয় দুঃসহ অতীতের কথা।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
ব্রিটিশ সরকারের বেশ কিছু সমালোচক বলতে শুরু করেন যে এই চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক ব্যবস্থা আসলে দাস ব্যবস্থারই নামান্তর। খাতায়-কলমে থাকলেও শ্রমিকের বিশেষ কোনও অধিকার যে মান্য করা হত, এমন নয়। চিনি ব্যবসায়ীরা অবশ্য এইসব কথাকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে রাজি ছিলেন না। বিশ্বব্যাপী যে বিশাল বাজার তৈরি হয়ে গেছে চিনির, তার জোগান নিয়েই তাঁরা তখন ব্যস্ত। সরকারেরও মুনাফার দিকে নজর ছিল। তবে নানা সমালোচনার কথা মাথায় রেখেই যেন নতুন আইন প্রণয়ন করা হল। ১৮৭১ সালে ‘ইন্ডিয়ান এমিগ্রেশন অ্যাক্ট’-এর মাধ্যমে এই যাত্রাপথের নানা নিয়ম-কানুন তৈরি করা হয়। ‘প্রোটেক্টর অফ এমিগ্রান্টস’ বলে এক ব্যক্তির ওপর দায়িত্ব বর্তায় শ্রমিকদের কলকাতা বন্দর এলাকায় থাকাকালীন দেখভাল করার। আরেক ব্যক্তি, ‘মেডিক্যাল ইন্সপেক্টর অফ এমিগ্র্যান্টস’-এর কাজ ছিল শ্রমিকদের শরীর-স্বাস্থ্য আর বন্দরের সার্বিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ওপর নজর রাখা। এই দু’জনের অন্য আরেকটি কাজ ছিল বন্দর ছেড়ে যাওয়ার আগে জাহাজগুলির পরিকাঠামো পরিদর্শন। সেগুলিতে ঠিকঠাক জায়গা আছে কি না, আলো-বাতাস চলাচলের পথ কতটা, খাবার-ওষুধ মজুত আছে কি না পর্যাপ্ত পরিমাণে– এইসব কিছুই তাঁদের দেখে নেওয়ার কথা। কিন্তু এইসব নিয়ম সত্ত্বেও সমুদ্রে যাত্রাকালীন বেশ কিছু শ্রমিক মারা যেতেন প্রায় প্রতি বছরই। একইভাবে, বিদেশে কর্মক্ষেত্রেও অনেকে মারা যেতেন চূড়ান্ত অব্যবস্থার শিকার হয়ে।
কলকাতার বন্দর এলাকা এই ইতিহাসের বেশ কিছু সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। নদীর পূর্বদিকে একটি ঘাটের নাম ‘সুরিনাম ঘাট’। গার্ডেন রিচে ‘সুরিনাম ডিপো’ ছিল ১৮৭৩ সালে যখন সেখান থেকে ‘লাল্লা রুখ’ জাহাজটি সুরিনামের (ডাচ গায়ানা, দক্ষিণ আমেরিকায় অবস্থিত) উদ্দেশে রওনা হয়। এই গার্ডেন রিচ অঞ্চলে উনিশ-বিশ শতকে বেশ কিছু বাড়ি ঘর ছিল যেখানে উত্তর আর পূর্ব ভারতের গ্রাম থেকে শ্রমিকদের নিয়ে এনে রাখা হত জাহাজে তোলার আগে। ‘৬১ নম্বর গার্ডেন রিচ’ যেমন ঠিকানা ছিল ‘ব্রিটিশ গায়ানা গভর্নমেন্ট এমিগ্রেশন এজেন্সি’র। এছাড়াও কলকাতার অন্যান্য জায়গায়ও এই রকম ‘ডিপো’ ছিল। ১৮৪২ সালে চালু হওয়া ‘ভবানীপুর ডিপো’ থেকে মরিশাসের উদ্দেশে লোক পাঠানো হত গোড়ায়, কিন্তু কিছুকাল পর থেকে ত্রিনিদাদ টোবাগো, জামাইকা, আর ডেমেরারার শ্রমিকদেরও ঠাঁই হয় এখানে। ৫, ৮, ১১, আর ৭১ নম্বর গার্ডেন রিচ ঠিকানাগুলি ছিল ত্রিনিদাদ টোবাগো, ফিজি, সেন্ট লুসিয়া, সেন্ট কিটস, সেন্ট হেলেনা, আর ব্রিটিশ গায়ানায় শ্রমিক পাঠানোর ডিপো। ২০ গার্ডেন রিচ থেকে সুরিনাম আর ৭৬ গার্ডেন রিচ থেকে কায়েন আর মার্টিনিকের উদ্দেশে পাঠানোর জন্য নির্ধারিত শ্রমিকদের জড়ো করা হত। এই দুই ডিপোর দেখভাল করত ওলন্দাজ আর ফরাসি সরকার।
এইসব ঠিকানা আমাদের কলকাতার এক অন্য অতীতের কথা বলে। যেখানে শহরটা এক দীর্ঘ যাত্রাপথের অংশবিশেষ, কয়েক দিনের আস্তানা কিছু হতভাগ্য মানুষের, যারা নিজেদের গাঁ-ঘর পরিবার ছেড়ে এক অজানা অচেনা দেশে কাজ করতে চলেছে, খানিক উন্নত জীবনের আশায়। এইসব অভিবাসীদের পরবর্তী প্রজন্ম নানাভাবে বয়ে চলে এই যাত্রার স্মৃতি। ব্রিটিশ গায়ানায় এরকম এক লোকগীতি অনেক দিন ধরে প্রচলিত যা মনে করিয়ে দেয় দুঃসহ অতীতের কথা।
When we reached Calcutta, our miseries increased.
We were stripped of all our beautiful clothes,
Rosary beads and sacred threads.
Bengali rags decorated us now.
The sadhu’s hair was shaved.
And sadhu, Dom, Chamar and Bhangi,
All were thrown together in a room.
কলকাতা শহরে এই মানুষগুলির উপস্থিতি ক্ষণিকের, তাই যেন পরবর্তীকালের ইতিহাসবিদদের লেখাতেও এঁরা অনুপস্থিত। কিন্তু এখানেই এঁদের পুরনো জীবন বদলে যায়, পুরনো পরিচিতি মুছে যায়।
২০১৫ সালে মেটিয়াবুরুজ অঞ্চলে ভারত ও সুরিনাম সরকারের যৌথ উদ্যোগে একটি মনুমেন্ট, ‘সুরিনাম মেমোরিয়াল’, স্থাপন করা হয় এই শ্রমিক ইতিহাসের কথা মনে করে। এই স্থাপত্যে লেখা হল:
১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে শুরু করে বিশ শতকের প্রারম্ভিক কয়েকটি বৎসর পর্যন্ত কলকাতা বন্দরের এই জেটি থেকেই বহু যুবক চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক হিসাবে কাজ করার জন্য সুদূর সুরিনাম-এর উদ্দেশে যাত্রা করেছিলেন। সে ছিল এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে যাত্রা।
পরবর্তীকালে সেইসব মানুষ তাঁদের কঠোর পরিশ্রম, অদম্য মানসিকতার দ্বারা সুরিনামের সামগ্রিক উন্নয়নে প্রভূত অবদান রেখেছেন। সেইসব ভারতীয় অভিবাসী কালক্রমে সুরিনামের বৈচিত্রময় সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছেন এবং সফলভাবে তাকে আরও এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। একই সঙ্গে তাঁরা তাঁদের ভারতীয় পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং কৃষ্টিও বহন করে গিয়েছেন।
আমরা তাঁদের নির্ভীক মানসিকতা, দৃঢ় প্রত্যয় ও আত্মনিষ্ঠাকে শ্রদ্ধা সহকারে স্মরণ করি।
(চলবে)
…কলিকথা–র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১০: কলকাতার যানবাহনের ভোলবদল ও অবুঝ পথচারী
পর্ব ৯: বৃষ্টি নিয়ে জুয়া খেলা আইন করে বন্ধ করতে হয়েছিল উনিশ শতকের কলকাতায়
পর্ব ৮: ধর্মতলা নয়, ময়দানই ছিল নিউ মার্কেট গড়ে তোলার প্রথম পছন্দ
পর্ব ৭: সেকালের কলকাতায় বাঙালি বড়মানুষের ঠাঁটবাটের নিদর্শন ছিল নিজের নামে বাজার প্রতিষ্ঠা করা
পর্ব ৬: কলকাতার বহিরঙ্গ একুশ শতকের, কিন্তু উনিশ-বিশ শতকের অসহিষ্ণুতা আমরা কি এড়াতে পেরেছি?
পর্ব ৫: কলকাতা শহর পরিকল্পনাহীনভাবে বেড়ে উঠেছে, একথার কোনও বিশেষ ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই
পর্ব ৪: ঔপনিবেশিক নগর পরিকল্পনার বিরুদ্ধ মত প্রকাশ পেয়েছিল যখন প্লেগ ছড়াচ্ছিল কলকাতায়
পর্ব ৩: ঔপনিবেশিক কলকাতায় হোয়াইট টাউন-ব্ল্যাক টাউনের মধ্যে কোনও অলঙ্ঘনীয় সীমানা
পর্ব ২: ‘জল’ যেভাবে ‘জমি’ হল এ কলকাতায়
পর্ব ১: চেনা কলকাতাকে না পাল্টেই বদল সম্ভব, পথ দেখাতে পারে একটি বাতিল রিপোর্ট