১৮৮১-র সেন্সাসে মোট দশটি এলাকাকে ‘সাবার্ব’ বলে চিহ্নিত করা হয়: কাশীপুর, চিৎপুর, উল্টোডাঙা, মানিকতলা, বেলেঘাটা, এন্টালি, বেনিয়াপুকুর, বালিগঞ্জ, টালিগঞ্জ, আর ভবানীপুর। এইসব অঞ্চলের মোট জনসংখ্যা ছিল ২,৫১,৪৩৯; আর খাস কলকাতায় ৪,০৫,০১৯। শহরের মূল বাসিন্দাদের তুলনায় শহরতলির জনগণের সংখ্যা নেহাত হেলাফেলা করার মতো আর ছিল না। তাই খানিক বাধ্য হয়েই, শহরের স্বাস্থ্য আর অর্থনীতির কথা ভেবে সরকার ভাবে কলকাতার আশেপাশের এইসব এলাকাকে কলকাতা কর্পোরেশনের আওতার মধ্যে নিয়ে আসা হবে।
২৬.
১৭৯৪ সালে কলকাতা শহরের যে সীমানা নির্ধারিত করা হয়েছিল, তা বহাল ছিল আরও প্রায় ৯০ বছর। তবে এই সীমানা ছিল নেহাতই খাতায়-কলমে। উনিশ শতক জুড়ে কলকাতার আশপাশের অঞ্চলে বহু লোক বসবাস করতে শুরু করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষই শহরে কর্মসূত্রে যাতায়াত করতেন। সরকারের নথিতে অবশ্য এই সব অঞ্চল ছিল ‘সাবার্ব’ বা শহরতলি। সেই অনুযায়ী বিভিন্ন মিউনিসিপ্যালিটি তৈরি হয়েছিল কলকাতা কর্পোরেশনের নির্দিষ্ট চৌহদ্দির বাইরে। টালির নালা আর সার্কুলার নালার উপর বেশ কয়েকটি ব্রিজ তৈরি হয় উনিশ শতকের বিভিন্ন সময়ে– উত্তরে চিৎপুর থেকে শুরু করে দমদম, উল্টোডাঙ্গা, মানিকতলা, নারকেলডাঙা হয়ে দক্ষিণে ভবানীপুর, আলিপুরে। এই ব্রিজ পারাপার করে কলকাতার ঠিক বাইরে থেকে বহু লোক নিত্যদিন শহরে আসতেন।
১৮৬০-’৭০-এর দশকে এই শহরতলিগুলি নিয়ে ঔপনিবেশিক সরকার বিশেষ চিন্তিত হয়ে পড়ে। এগুলির অবস্থা ভালো নয়, বস্তি-নালা-নর্দমা মিলিয়ে মিশিয়ে স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রায় নেই বললেই চলে, রোগ-মারী লেগেই রয়েছে– এই রকম কথাবার্তা কলকাতার স্বাস্থ্য দপ্তরে বেশ জোরালো হচ্ছিল। কলেরার প্রকোপ বাড়ছিল সেই সময়ে আবার। আশঙ্কা করা হল যে মূল শহরের আশেপাশের অবস্থার উন্নতি না হলে কলকাতারও রেহাই নেই। আবার অন্যদিকে এই সব অঞ্চলের বাসিন্দারা কলকাতার অর্থনৈতিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। নানা শ্রেণির খেটে-খাওয়া মানুষ কাশীপুর, মানিকতলা, এন্টালি, শেয়ালদা, টালিগঞ্জ, খিদিরপুর, বা গার্ডেন রিচের মতো এলাকায় থাকতেন। এঁদের ছাড়া কলকাতা ছিল অচল। ১৮৬৬ সালের এক হিসেব অনুযায়ী এই বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিদিন গড়ে প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষ শহরে যাতায়াত করতেন। আর তাছাড়া ছিল হুগলির পাড় ধরে পাটকল। কলকাতা থেকে উত্তরে যেতে সেই সব অঞ্চলেও নিজস্ব পৌরসভা গড়ে উঠেছিল উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে। তাদের অবস্থাও খুব একটা উন্নত নয় বলেই কলকাতার কর্তৃপক্ষ মনে করতেন।
১৮৭৬ সালে কলকাতা শহরের সেন্সাস রিপোর্ট তৈরি করার সময়ে কমিশনার হেনরি বেভার্লি মন্তব্য করেছিলেন যে, সার্কুলার রোডের এক ধারের বাড়িঘরদোর কলকাতার অন্তর্ভুক্ত আর অন্য পারেরটা নয়– এর কোনও যুক্তিই নেই। ১৮৮১ সালের রিপোর্টে তিনি আবার লিখলেন, “the boundary line which divides the Municipality of Calcutta from that of the suburbs, though of historical interest, is more or less artificial. The distinctions between the privileged town area governed by English law and subject to the original jurisdiction of the High Court, and the ordinary mofussil world outside the Circular Road, are fast dying out.”
একই ভাবে হাওড়ার জনবসতিকে আর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকেও কলকাতার হিসেবের মধ্যে ধরা উচিত বলে তিনি মনে করতেন: “The warehouses and the factory on the right bank of Hooghly contribute to the trade, wealth, and importance of Calcutta equally with those on the left. They equally attract population to the metropolitan centre, and in any statistical account which professes to deal with the population on the trade and commerce of the metropolis as a whole, they ought not to be omitted.”
১৮৮১-র সেন্সাসে মোট দশটি এলাকাকে ‘সাবার্ব’ বলে চিহ্নিত করা হয়: কাশীপুর, চিৎপুর, উল্টোডাঙা, মানিকতলা, বেলেঘাটা, এন্টালি, বেনিয়াপুকুর, বালিগঞ্জ, টালিগঞ্জ, আর ভবানীপুর। এইসব অঞ্চলের মোট জনসংখ্যা ছিল ২,৫১,৪৩৯; আর খাস কলকাতায় ৪,০৫,০১৯। শহরের মূল বাসিন্দাদের তুলনায় শহরতলির জনগণের সংখ্যা নেহাত হেলাফেলা করার মতো আর ছিল না। তাই খানিক বাধ্য হয়েই, শহরের স্বাস্থ্য আর অর্থনীতির কথা ভেবে সরকার ভাবে কলকাতার আশেপাশের এইসব এলাকাকে কলকাতা কর্পোরেশনের আওতার মধ্যে নিয়ে আসা হবে। স্বাস্থ্য আর পরিকাঠামোর উন্নতির কথা বলা হলেও আরও একটা উদ্দেশ্য ছিল ঔপনিবেশিক সরকারের। কলকাতা পুরসভায় ভারতীয় সদস্যদের বাড়তে থাকা উপস্থিতি নিয়েও ব্রিটিশরা বেশ উদ্বিগ্ন ছিলেন। পুরসভার এলাকার পুনর্বিন্যাস ঘটলে সেই সুযোগে সদস্য সংখ্যা নিয়েও ভাবনাচিন্তা করার উপায় থাকবে বলে মনে করেছিলেন তাঁরা। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রশ্নও জড়িয়ে ছিল এই ‘Suburb Amalgamation Scheme’-এর সঙ্গে। সরকারি এক রিপোর্টে উল্লেখ করা হল যে,
Foreign Governments do not draw fine distinctions between Calcutta and its suburbs. If cholera is endemic in the latter, the former suffers from quarantine restrictions on its trade as well as on its public health. The dock labourers of Calcutta live in the Suburbs, and…as long as there is cholera in the Suburbs, there will be cholera in the Port and in the Town.
১৮৮৫ সালের ২০ জুন সরকার সিদ্ধান্ত নেয় শহরতলির পুরসভাগুলিকে কলকাতার অন্তর্ভুক্ত করার। একটা কমিটি তৈরি করা হয় এই বিষয়ে মূল নথি তৈরি করার জন্য। কমিটির সদস্যরা প্রস্তাব দেন এন্টালি, বেনিয়াপুকুর, বালিগঞ্জ, ভবানীপুর, একবালপুর, আলিপুর, আর গার্ডেন রিচের পুবদিক কলকাতা পুরসভার আওতায় নিয়ে আসার জন্য। এর ফলে কলকাতার এলাকা ছয় বর্গ মাইল থেকে এক লাফে বেড়ে দাঁড়াবে ১২.২৫ বর্গ মাইল। সব মিলিয়ে ১৮.২৫ বর্গ মাইল; তবুও বম্বে (২২ বর্গ মাইল) বা মাদ্রাজের (২৬ বর্গ মাইল) তুলনায় কম। জনসংখ্যার নিরিখে কলকাতায় নতুন করে যোগ হবে ১,৮২,০০০ মানুষ, সব মিলিয়ে দাঁড়াবে ৫,৮২,০০০, যা বম্বের ৮ লক্ষের তুলনায় বেশ খানিক কম। বম্বে বা মাদ্রাজের সঙ্গে এই তুলনা করার উদ্দেশ্যই ছিল এই প্রস্তাবের বিরোধীদের আগে থেকেই নিরস্ত করা।
কমিটির প্রস্তাবে একটা জিনিস পরিষ্কার স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। শহরের দক্ষিণের শহরতলিগুলিকে তাঁরা একত্রিত করতে উৎসাহী ছিলেন, উত্তরের এলাকাগুলি নয়। উত্তরে মূলত ভারতীয়দের বাস ছিল, আর দক্ষিণে ইউরোপীয় আর দেশীয় মধ্যবিত্তদের। আর তাছাড়া ছিল খিদিরপুর, গার্ডেন রিচের বন্দর এলাকা। এই অঞ্চলগুলি কলকাতা পুরসভার সঙ্গে যুক্ত হলে কলকাতা শহরের উন্নতি হবে বলেই তাঁরা মত দেন, তবে তার জন্য শহরের উন্নতি খাতে পুরসভার বরাদ্দ টাকাও বাড়াতে হবে। সরকারের সহযোগিতা ছাড়াও পুরসভার আয় বৃদ্ধির একটা উপায় হিসেবে বার্ষিক কর বাড়ানোর কথা বলা হয়।
তবে কমিটির রিপোর্টের একটা বড় অংশ জুড়ে ছিল পুরসভার নিয়মকানুনে বদল আনার বিষয়টি। স্বাভাবিকভাবেই ভারতীয় সদস্যরা দ্বিমত পোষণ করে বড় বড় নোট যোগ করেন কমিটির মূল রিপোর্টের সঙ্গে। গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন যে, দক্ষিণের অনেক আধা-শহর, গ্রামকে কলকাতার সঙ্গে যুক্ত করার কথা বলা হলেও শহরের উত্তরের নগরায়িত এলাকাগুলিকে খানিক ইচ্ছে করেই উপেক্ষা করা হয়েছে। আর শহর জুড়ে বর্ধিত হারে কর চাপিয়ে দেওয়ার বিরোধিতাও করেন তিনি।
শহরের সীমানা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়বেই, সেটাই স্বাভাবিক। আঠারো শতকের শেষভাগের এলাকা ভাগ যে, উনিশ শতকের সায়াহ্নে আর বিশেষ অর্থ বহন করত না, তা বলাই বাহুল্য। তবে এই বিশেষ মুহূর্তের ঔপনিবেশিক মানসিকতাও খেয়াল রাখা দরকার। কলকাতা পুরসভার আওতায় এনে পরিকাঠামোর উন্নয়নের পিছনে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক স্বার্থ গভীরভাবে জড়িয়ে ছিল। একই সঙ্গে যুক্ত ছিল কলকাতা পৌর রাজনীতিতে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী নেতৃবর্গের ক্রমবর্ধমান ক্ষমতা সংকুচিত করার ইচ্ছে।
কলকাতার স্বাস্থ্য আর অর্থনীতি নিয়ে চিন্তিত ঔপনিবেশিক সরকারের শহরতলিকে নিজের আওতায় আনার এই পরিকল্পনা আধুনিক যুগের এক নগর-কেন্দ্রিক মানসিকতার ফসল, যেখানে নাগরিক জীবন সুরক্ষিত করার দায় ও দায়িত্বই যেন প্রশাসনের মূল কাজ। তাই শহরের বর্জ্য গিয়ে জমা হয় শহরের প্রান্তে, নিকাশি ব্যবস্থার অভিমুখ অন্য কোনও শহরতলিতে। কলকাতায় যার ফল ছিল পূর্ব কলকাতার বিস্তীর্ণ জলাভূমির সর্বনাশ। তাই শুধু শহরের দিকেই প্রশাসনের নজর থাকবে, শহরতলিতে নয়– এই মনোভাব যে কোনও শহরের বিকাশের অন্তরায়।
ঋণস্বীকার: Partho Datta, Planning the City: Urbanization and Reform in Calcutta, c. 1800-c.1940 (2012).
…কলিকথা–র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ২৬: দ্বীপের মতো করেই যেন গড়ে তোলা হয়েছিল কলকাতাকে
পর্ব ২৫: কালো ভিক্টোরিয়া ও থমথমে কলকাতা
পর্ব ২৪: ঘোড়ার কলকাতা: ট্রাম থেকে রেসের মাঠ
পর্ব ২৩: গোলদীঘি গণ আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল হিসেবে জেগে উঠেছিল স্বদেশি সময়ে
পর্ব ২২: স্মৃতিদের এক বিশাল সমাধিক্ষেত্র
পর্ব ২১: কলকাতার কেল্লা এবং ময়দানি মতবিরোধ
পর্ব ২০: সঙের গানে শতবর্ষের পুরনো কলকাতা
পর্ব ১৯: দেশভাগ ও উদ্বাস্তু মানুষদের শিয়ালদা স্টেশন
পর্ব ১৮: কলের গাড়ি ও কলকাতার নিত্যযাত্রীরা
পর্ব ১৭: বাবুদের শহর যেভাবে বদলে গেল আবেগের শহরে
পর্ব ১৬: ঘর-বন্দি হয়েও নাগরিক কলকাতার স্বাদ
পর্ব ১৫: গৃহভৃত্যর বেশিরভাগই ছিলেন পুরুষ, দু’দশকে বদলে যায় পরিস্থিতি
পর্ব ১৪: স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা সিনেমায় চাকরির ইন্টারভিউয়ের দৃশ্য সেই সময়ের আয়না
পর্ব ১৩: দাঙ্গা ও দেশভাগ বদলে দিয়েছে কলকাতার পাড়া-বেপাড়ার ধারণা
পর্ব ১২: প্রাচীন কলকাতার বোর্ডিং হাউস
পর্ব ১১: সারা বিশ্বে শ্রমিক পাঠানোর ডিপো ছিল এই কলকাতায়
পর্ব ১০: কলকাতার যানবাহনের ভোলবদল ও অবুঝ পথচারী
পর্ব ৯: বৃষ্টি নিয়ে জুয়া খেলা আইন করে বন্ধ করতে হয়েছিল উনিশ শতকের কলকাতায়
পর্ব ৮: ধর্মতলা নয়, ময়দানই ছিল নিউ মার্কেট গড়ে তোলার প্রথম পছন্দ
পর্ব ৭: সেকালের কলকাতায় বাঙালি বড়মানুষের ঠাঁটবাটের নিদর্শন ছিল নিজের নামে বাজার প্রতিষ্ঠা করা
পর্ব ৬: কলকাতার বহিরঙ্গ একুশ শতকের, কিন্তু উনিশ-বিশ শতকের অসহিষ্ণুতা আমরা কি এড়াতে পেরেছি?
পর্ব ৫: কলকাতা শহর পরিকল্পনাহীনভাবে বেড়ে উঠেছে, একথার কোনও বিশেষ ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই
পর্ব ৪: ঔপনিবেশিক নগর পরিকল্পনার বিরুদ্ধ মত প্রকাশ পেয়েছিল যখন প্লেগ ছড়াচ্ছিল কলকাতায়
পর্ব ৩: ঔপনিবেশিক কলকাতায় হোয়াইট টাউন-ব্ল্যাক টাউনের মধ্যে কোনও অলঙ্ঘনীয় সীমানা
পর্ব ২: ‘জল’ যেভাবে ‘জমি’ হল এ কলকাতায়
পর্ব ১: চেনা কলকাতাকে না পাল্টেই বদল সম্ভব, পথ দেখাতে পারে একটি বাতিল রিপোর্ট