মৃণ্ময়ী প্রতিমা নয়, চিন্ময়ী প্রতিমার উপাসনা করা হচ্ছে। যে-বলছে মাটির প্রতিমা পুজো করা হচ্ছে– সে ভুল বলছে। কেন? কারণ, তার উপলব্ধি তৈরি হয়নি। সে কেবল মাটির প্রতিমাকেই দেখছে। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণ যখন উপাসনা করছেন, তখন দেখছেন, এ মাটির প্রতিমা কোথায়, মা তো তাঁর সঙ্গে কথা বলছেন! মায়ের শ্বাস পড়ছে, মা ঝমঝম করে কালীবাড়ির সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে যাচ্ছেন, নামছেন। সে প্রতিমা কী করে মৃণ্ময়ী হয়, সে তো চিন্ময়ী। মাটির প্রতিমাকে পুজো করা হয় না, চিন্ময়ী প্রতিমাকে পুজো করা হয়। এটি শ্রীরামকৃষ্ণ স্পষ্ট বলেছেন। প্রতিমা উপাসনার বিরুদ্ধে সেকালের বাংলা তথা ভারতবর্ষ ব্রিটিশদের কাছ থেকে শিক্ষা পেয়ে যে আলোড়ন তুলতে চেয়েছিল, শ্রীরামকৃষ্ণ তাকে থামিয়ে দিয়েছেন।
আমরা আগের দিন ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত’-এর দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ তথা মাস্টারমশাইয়ের ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণকে প্রথম দর্শনের কথা জেনেছিলাম। আজকে আমরা দ্বিতীয় দর্শন তথা তৃতীয় পরিচ্ছেদটির কথা তুলে ধরব।
দ্বিতীয় দর্শন
সকালবেলা, আটটার সময়। ঠাকুর তখন কামাতে যাচ্ছেন। এখনও একটু শীত আছে। তাই তাঁহার গায়ে মোলেস্কিনের র্যাপার। র্যাপারের কিনারা শালু দিয়ে মোড়া। মাস্টারকে দেখিয়া বলিলেন, তুমি এসেছ? আচ্ছা, এখানে বস।
এ-কথা দক্ষিণ-পূর্ব বারান্দায় হইতেছিল। নাপিত উপস্থিত। সেই বারান্দায় ঠাকুর কামাইতে বসিলেন ও মাঝে মাঝে মাস্টারের সহিত কথা কহিতে লাগিলেন। গায়ে ওইরূপ র্যাপার, পায়ে চটি জুতা, সহাস্যবদন। কথা কহিবার সময় কেবল একটু তোতলা।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)– হ্যাঁগা, তোমার বাড়ি কোথায়?
মাস্টার– আজ্ঞা, কলিকাতায়।
শ্রীরামকৃষ্ণ– এখানে কোথায় এসেছ?
মাস্টার– এখানে বরাহনগরে বড়দিদির বাড়ি আসিয়াছি। ঈশান কবিরাজের বাটী।
শ্রীরামকৃষ্ণ– ওহ্, ঈশানের বাড়ি! হ্যাঁগা, কেশব কেমন আছে? বড় অসুখ হয়েছিল।
মাস্টার– আমিও শুনেছিলাম বটে, এখন বোধ হয় ভালো আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ– আমি আবার কেশবের জন্য মার কাছে ডাব-চিনি মেনেছিলুম। শেষরাত্রে ঘুম ভেঙে যেত, আর মার কাছে কাঁদতুম, বলতুম, মা, কেশবের অসুখ ভালো করে দাও; কেশব না থাকলে আমি কলকাতায় গেলে কার সঙ্গে কথা কব? তাই ডাব-চিনি মেনেছিলুম। হ্যাঁগা, কুক সাহেব নাকি একজন এসেছে? সে নাকি লেকচার দিচ্ছে? আমাকে কেশব জাহাজে তুলে নিয়ে গিছিল। কুক সাহেবও ছিল।
মাস্টার– আজ্ঞা, এইরকম শুনেছিলুম বটে, কিন্তু আমি তাঁর লেকচার শুনি নাই। আমি তাঁর বিষয় বিশেষ জানি না।
মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে দর্শনের আগেই কেশবচন্দ্র সেনের সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণের সাক্ষাৎ হয়ে গিয়েছিল। কলকাতায় বস্তুতপক্ষে যাঁদের সঙ্গে প্রথম শ্রীরামকৃষ্ণের পরিচয় ঘটে বা যাঁরা শ্রীরামকৃষ্ণের কথা শুনে শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে এসে পৌঁছন, তাঁদের মধ্যে কেশবচন্দ্র সেন, যিনি নববিধানের প্রতিষ্ঠাতা, ব্রাহ্মসমাজের একটি শাখা, তিনি তাঁর অন্যতম। এবং কেশবের যে আধ্যাত্মিক জীবনযাপন, তার অনেকটাই শ্রীরামকৃষ্ণের ভালো লেগেছিল। সেই কারণেই কেশব তাঁর একজন চিহ্নিত ব্যক্তি ছিলেন, যাঁর সঙ্গে বসে একসঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ এই ভাগবত আলাপ করতেন। আসলে যাঁরা এই ভাগবত আলাপ করেন, তাঁদের সবার জীবনেই দেখা যায়, তাঁরা মনের মতো মানুষ খোঁজেন। আমরা প্রত্যেকেই জানি, বাউল সংগীতে একটি বিখ্যাত গান আছে, মনের মানুষের কথা। যেখানে বাউল বলছেন, মনের মানুষ সবাই হয় না এবং মনের মানুষকে চট করে পাওয়াও যায় না। এই যে বাউলরা মনের মানুষের কথা বলেন, তা এই অর্থে যে, তাদের আধ্যাত্মিক জীবনের যে তন্মাত্রা, যে স্পন্দন, তার সঙ্গে মিলতে হয়। সেটা যদি না মেলে, তাহলে কথা জমে না। আমাদের সংসারেও এমনটাই দেখি। ঠাকুরের ক্ষেত্রেও প্রথম দিকে কেশব সেন ছিলেন এমন একজন মানুষ, যাঁর মনের আধ্যাত্মিক তন্মাত্রা , তার সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের কিছুটা হলেও মনের মিল হয়েছিল। এই কারণেই তিনি কেশবকে এতটা ভালোবাসতেন। এই কারণেই কেশবের অসুখের কথা শুনে মায়ের কাছে ডাব-চিনি মানত করেছিলেন।
কুক সাহেব ছিলেন একজন বিখ্যাত খ্রিস্টান পাদরি। তিনি উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ভারতে এসেছিলেন এবং নববিধানের সঙ্গে, বিশেষত কেশবচন্দ্র সেন, প্রতাপচন্দ্র মজুমদার– এঁদের সঙ্গে কুক সাহেবের বিশেষ পরিচয় ঘটেছিল। শোনা যায়, তিনি নাকি ভালো বাংলাও শিখেছিলেন। ভারতবর্ষীয় ধর্মসম্প্রদায় সম্পর্কে এবং ভারতবর্ষের যে বিভিন্ন শাস্ত্র, তার সম্বন্ধেও তাঁর যৎকিঞ্চিৎ পড়াশোনা ছিল। এটা ‘ধর্মতত্ত্ব’ পত্রিকাও ঘোষণা করেছিল। সুতরাং, সেদিক থেকে কুক সাহেবের একটা অন্য পরিচিতি ছিল সেকালের ব্রাহ্মসমাজের ভদ্রবাঙালিদের কাছে। কেশব সেনের সঙ্গেও বেশ কিছুদিন তিনি ছিলেন। একথাও আমরা জানি যে, কেশব সেন যে স্টিমারে করে দক্ষিণেশ্বর থেকে শ্রীরামকৃষ্ণকে তুলে নিয়েছিলেন, সেদিন সেই স্টিমারে তথা জাহাজে কুক সাহেবও ছিলেন। তাঁর সম্বন্ধেই ঠাকুরের এই আগ্রহ। যেহেতু কুক সাহেবের মধ্যেও এই ধর্মভাবের উদ্দীপনা ছিল, ধর্মভাবের একটি বিশেষ লক্ষণ তাঁর মধ্যে ঠাকুর দেখতে পেয়েছিলেন, তাই ঠাকুরের মধ্যে তাকে নিয়ে একটা আগ্রহ ছিল। আসলে ঠাকুরের মধ্যে একটা সরলোচিত আগ্রহ সবসময়ই প্রকাশ পেত। যাঁরাই ঈশ্বর নিয়ে, ধর্মতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করতেন, তাঁদের ক্ষেত্রে শ্রীরামকৃষ্ণের এই বালকবৎ আগ্রহ, সেটি তাঁর জীবনে বহুক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখতে পাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ– প্রতাপের ভাই এসেছিল। এখানে কয়দিন ছিল। কাজকর্ম নাই। বলে, আমি এখানে থাকব। শুনলাম, মাগছেলে সব শ্বশুরবাড়িতে রেখেছে। অনেকগুলি ছেলেপিলে। আমি বকলুম, দেখ দেখি ছেলেপিলে হয়েছে; তাদের কি আবার ও-পাড়ার লোক এসে খাওয়াবে-দাওয়াবে, মানুষ করবে? লজ্জা করে না যে, মাগছেলেদের আর একজন খাওয়াচ্ছে, আর তাদের শ্বশুরবাড়ি ফেলে রেখেছে। অনেক বকলুম, আর কর্মকাজ খুঁজে নিতে বললুম। তবে এখান থেকে যেতে চায়।
শ্রীরামকৃষ্ণের যে আধ্যাত্মিকতা, তার বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সেটা খুব প্র্যাগম্যাটিক, বাংলার বললে, বাস্তববাদী বা প্রয়োগমূলক। যে সংসার করেছে, বিয়ে করেছে, সে তো তার পুত্র, স্ত্রী, পরিবারকে দেখবে– সেটা জেনেশুনেই সংসার করেছে। সেটা ছেড়ে দিয়ে বাড়ির কেউ না খেয়ে অনাহারে দিন কাটাল– সেদিকে খেয়াল না রেখে, এখানে এসে বসে থাকবে, ব্যাপারটা ঠাকুরের পছন্দ না। ধর্মজীবন যাপনের সঙ্গে আমাদের বাস্তব জীবনের যে কোনও বিরোধ নেই, শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন অনুধ্যান করলে আমাদের সততই এ জিনিস চোখে পড়ে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)– তোমার কি বিবাহ হয়েছে?
মাস্টার– আজ্ঞে, হাঁ।
শ্রীরামকৃষ্ণ (শিহরিয়া)– ওরে রামলাল (ঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্র ও কালীবাড়ির পূজারী), যাঃ, বিয়ে করে ফেলেছে!
মাস্টার ঘোরতর অপরাধীর ন্যায় অবাক হইয়া অবনতমস্তকে চুপ করিয়া বসিয়া রহিলেন। ভাবিতে লাগিলেন, বিয়ে করা কি এত দোষ!
ঠাকুর আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, তোমার কি ছেলে হয়েছে?
মাস্টারের বুক ঢিপঢিপ করিতেছে। ভয়ে ভয়ে বলিলেন, আজ্ঞে, ছেলে হয়েছে। ঠাকুর আবার আক্ষেপ করিয়া বলিতেছেন, যাঃ, ছেলে হয়ে গেছে! তিরস্কৃত হইয়া তিনি স্তব্ধ হইয়া রহিলেন।
তাঁহার অহঙ্কার চূর্ণ হইতে লাগিল। কিয়ৎক্ষণ পরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ আবার কৃপাদৃষ্টি করিয়া সস্নেহে বলিতে লাগিলেন, “দেখ, তোমার লক্ষণ ভাল ছিল, আমি কপাল, চোখ– এ-সব দেখলে বুঝতে পারি। আচ্ছা, তোমার পরিবার কেমন? বিদ্যাশক্তি না অবিদ্যাশক্তি?”
মাস্টার– আজ্ঞা ভালো, কিন্তু অজ্ঞান।
শ্রীরামকৃষ্ণ (বিরক্ত হইয়া)– আর তুমি জ্ঞানী?
শ্রীরামকৃষ্ণ– আচ্ছা, তোমার ‘সাকারে’ বিশ্বাস, না ‘নিরাকারে’?
মাস্টার (অবাক হইয়া স্বগত)– সাকারে বিশ্বাস থাকলে কি নিরাকারে বিশ্বাস হয়? ঈশ্বর নিরাকার, এ-বিশ্বাস থাকিলে ঈশ্বর সাকার এ-বিশ্বাস কি হইতে পারে? বিরুদ্ধ অবস্থা দুটাই কি সত্য হইতে পারে? সাদা জিনিস – দুধ, কি আবার কালো হতে পারে?
মাস্টার– আজ্ঞা, নিরাকার – আমার এইটি ভালো লাগে।
শ্রীরামকৃষ্ণ– তা বেশ। একটাতে বিশ্বাস থাকলেই হল। নিরাকারে বিশ্বাস, তা তো ভালই। তবে এ-বুদ্ধি করো না যে, এইটি কেবল সত্য আর সব মিথ্যা। এইটি জেনো যে, নিরাকারও সত্য আবার সাকারও সত্য। তোমার যেটি বিশ্বাস, সেইটিই ধরে থাকবে।
মাস্টার দুইই সত্য এই কথা বারবার শুনিয়া অবাক হইয়া রহিলেন। এ-কথা তো তাঁহার পুঁথিগত বিদ্যার মধ্যে নাই।
তাঁহার অহঙ্কার তৃতীয়বার চূর্ণ হইতে লাগিল। কিন্তু এখনও সম্পূর্ণ হয় নাই। তাই আবার একটু তর্ক করিতে অগ্রসর হইলেন।
মাস্টার– আজ্ঞা, তিনি সাকার, এ-বিশ্বাস যেন হল! কিন্তু মাটির প্রতিমা তিনি তো নন –
শ্রীরামকৃষ্ণ– মাটি কেন গো! চিন্ময়ী প্রতিমা।
মাস্টার ‘চিন্ময়ী প্রতিমা’ বুঝিতে পারিলেন না। বলিলেন, আচ্ছা, যারা মাটির প্রতিমা পূজা করে, তাদের তো বুঝিয়ে দেওয়া উচিত যে, মাটির প্রতিমা ঈশ্বর নয়, আর প্রতিমার সম্মুখে ঈশ্বরকে উদ্দেশ করে পূজা করা উচিত।
শ্রীরামকৃষ্ণ (বিরক্ত হইয়া)– তোমাদের কলকাতার লোকের ওই এক! কেবল লেকচার দেওয়া, আর বুঝিয়ে দেওয়া! আপনাকে কে বোঝায় তার ঠিক নাই।! তুমি বুঝাবার কে? যাঁর জগৎ, তিনি বুঝাবেন। যিনি এই জগৎ করেছেন, চন্দ্র, সূর্য, মানুষ, জীবজন্তু করেছেন; জীবজন্তুদের খাবার উপায়, পালন করবার জন্য মা-বাপ করেছেন, মা-বাপের স্নেহ করেছেন তিনিই বুঝাবেন। তিনি এত উপায় করেছেন, আর এ-উপায় করবেন না? যদি বুঝাবার দরকার হয় তিনিই বুঝাবেন। তিনি তো অন্তর্যামী। যদি ওই মাটির প্রতিমাপূজা করাতে কিছু ভুল হয়ে থাকে, তিনি কি জানেন না – তাঁকেই ডাকা হচ্ছে? তিনি ওই পূজাতেই সন্তুষ্ট হন। তোমার ওর জন্য মাথা ব্যথা কেন? তুমি নিজের যাতে জ্ঞান হয়, ভক্তি হয়, তার চেষ্টা কর।
এইবার তাঁহার অহঙ্কার বোধ হয় একেবারে চূর্ণ হইল।
তিনি ভাবিতে লাগিলেন, ইনি যা বলেছেন তা তো ঠিক! আমার বুঝাতে যাবার কি দরকার! আমি কি ঈশ্বরকে জেনেছি — না আমার তাঁর উপর ভক্তি হয়েছে! ‘আপনি শুতে স্থান পায় না, শঙ্করাকে ডাকে!’ জানি না, শুনি না, পরকে বুঝাতে যাওয়া বড়ই লজ্জার কথা ও হীনবুদ্ধির কাজ! একি অঙ্কশাস্ত্র, না ইতিহাস, না সাহিত্য যে পরকে বুঝাব! এ-যে ঈশ্বরতত্ত্ব। ইনি যা বলছেন, মনে বেশ লাগছে।
ঠাকুরের সহিত তাঁহার এই প্রথম ও শেষ তর্ক।
শ্রীরামকৃষ্ণ– তুমি মাটির প্রতিমাপূজা বলছিলে। যদি মাটিরই হয়, সে-পূজাতে প্রয়োজন আছে। নানারকম পূজা ঈশ্বরই আয়োজন করেছেন। যার জগৎ তিনিই এ-সব করেছেন– অধিকারী ভেদে। যার যা পেটে সয়, মা সেইরূপ খাবার বন্দোবস্ত করেন।
“এক মার পাঁচ ছেলে। বাড়িতে মাছ এসেছে। মা মাছের নানারকম ব্যঞ্জন করেছেন – যার যা পেটে সয়! কারও জন্য মাছের পোলোয়া, কারও জন্যে মাছের অম্বল, মাছের চড়চড়ি, মাছ ভাজা– এই সব করেছেন। যেটি যার ভাল লাগে। যেটি যার পেটে সয় — বুঝলে?”
মাস্টার– আজ্ঞে, হাঁ।
মাস্টার (বিনীতভাবে)– ঈশ্বরে কি করে মন হয়?
শ্রীরামকৃষ্ণ– ঈশ্বরের নামগুণগান সর্বদা করতে হয়। আর সৎসঙ্গ – ঈশ্বরের ভক্ত বা সাধু, এঁদের কাছে মাঝে মাঝে যেতে হয়। সংসারের ভিতর ও বিষয়কাজের ভিতর রাতদিন থাকলে ঈশ্বরে মন হয় না। মাঝেমাঝে নির্জনে গিয়ে তাঁর চিন্তা করা বড় দরকার। প্রথম অবস্থায় মাঝে মাঝে নির্জন না হলে ঈশ্বরে মন রাখা বড়ই কঠিন।
“যখন চারাগাছ থাকে, তখন তার চারিদিকে বেড়া দিতে হয়। বেড়া না দিলে ছাগল-গরুতে খেয়ে ফেলে। ধ্যান করবে মনে, কোণে ও বনে। আর সর্বদা সদসৎ বিচার করবে। ঈশ্বরই সৎ – কিনা নিত্যবস্তু, আর সব অসৎ – কিনা অনিত্য। এই বিচার করতে করতে অনিত্য বস্তু মন থেকে ত্যাগ করবে।”
মাস্টার (বিনীতভাবে)– সংসারে কিরকম করে থাকতে হবে?
“বড় মানুষের বাড়ির দাসী সব কাজ কচ্ছে, কিন্তু দেশে নিজের বাড়ির দিকে মন পড়ে আছে। আবার সে মনিবের ছেলেদের আপনার ছেলের মতো মানুষ করে। বলে ‘আমার রাম’ ‘আমার হরি’, কিন্তু মনে বেশ জানে– এরা আমার কেউ নয়।
“কচ্ছপ জলে চরে বেড়ায়, কিন্তু তার মন কোথায় পড়ে আছে জানো?– আড়ায় পড়ে আছে। যেখানে তার ডিমগুলি আছে। সংসারের সব কর্ম করবে, কিন্তু ঈশ্বরে মন ফেলে রাখবে।
“ঈশ্বরে ভক্তিলাভ না করে যদি সংসার করতে যাও তাহলে আরও জড়িয়ে পড়বে। বিপদ, শোক, তাপ – এ-সবে অধৈর্য হয়ে যাবে। আর যত বিষয়-চিন্তা করবে ততই আসক্তি বাড়বে।
“তেল হাতে মেখে তবে কাঁঠাল ভাঙতে হয়! তা না হলে হাতে আঠা জড়িয়ে যায়। ঈশ্বরে ভক্তিরূপ তেল লাভ করে তবে সংসারের কাজে হাত দিতে হয়।
কিন্তু এই ভক্তিলাভ করতে হলে নির্জন হওয়া চাই। মাখন তুলতে গেলে নির্জনে দই পাততে হয়। দইকে নাড়ানাড়ি করলে দই বসে না। তারপর নির্জনে বসে, সব কাজ ফেলে দই মন্থন করতে হয়। তবে মাখন তোলা যায়।
আবার দেখ, এই মনে নির্জনে ঈশ্বরচিন্তা করলে জ্ঞান বৈরাগ্য ভক্তি লাভ হয়। কিন্তু সংসারে ফেলে রাখলে ওই মন নীচ হয়ে যায়। সংসারে কেবল কামিনী-কাঞ্চন চিন্তা।
সংসার জল, আর মনটি যেন দুধ। যদি জলে ফেলে রাখ, তাহলে দুধে-জলে মিশে এক হয়ে যায়, খাঁটি দুধ খুঁজে পাওয়া যায় না। দুধকে দই পেতে মাখন তুলে যদি জলে রাখা যায়, তাহলে ভাসে। তাই নির্জনে সাধনা দ্বারা আগে জ্ঞানভক্তিরূপ মাখন লাভ করবে। সেই মাখন সংসার-জলে ফেলে রাখলেও মিশবে না, ভেসে থাকবে।
সঙ্গে সঙ্গে বিচার করা খুব দরকার। কামিনী-কাঞ্চন অনিত্য। ঈশ্বরই একমাত্র বস্তু। টাকায় কি হয়? ভাত হয়, ডাল হয়, কাপড় হয়, থাকবার জায়গা হয়– এই পর্যন্ত। ভগবানলাভ হয় না। তাই টাকা জীবনের উদ্দেশ্য হতে পারে না – এর নাম বিচার, বুঝেছ?”
এই যে দ্বিতীয় দর্শনটি চলছে, তার প্রথম থেকেই শ্রীরামকৃষ্ণ মাস্টারমশাইকে তাঁর অন্তরঙ্গ পরিধিতে আনার চেষ্টা করছেন। প্রথম দর্শনে শুধু সাক্ষাৎ হয়েছিল। সেখানে তাঁকে আহ্বান করেছিলেন– ‘আবার এসো’ বলে। দ্বিতীয় দর্শনে কিন্তু মাস্টারমশাইকে শ্রীরামকৃষ্ণ ‘নিজের লোক’ বলে চিনে নিয়েছেন এবং নিজের যে অন্তরঙ্গ পরিধি– সেখানে আহ্বান করছেন। সেই কারণেই তিনি মাস্টারমশাইয়ের যে কালোচিত তথা বয়সোচিত অহংকার, সেটিতে আঘাত করেছেন। ‘কালোচিত অহংকার’ মানে? সে সময়ে যারা নবজাগ্রত ব্রিটিশশাসিত কলকাতায় বুকে নতুন ইউরোপীয় শিক্ষায় শিক্ষিত, বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে এসে চাকরি-বাকরি ও সংসার নির্বাহের চেষ্টা করছিল বড়জোর ব্রাহ্মসমাজে গিয়ে তাদের সাপ্তাহিক উপাসনা কিংবা উৎসবগুলোয় অংশগ্রহণ করে, অনেকটা খ্রিস্টীয় পদ্ধতিতে, সাপ্তাহিক সাধন-ভজন– এই রকম একটি পথ অবলম্বন করছিল, মাস্টারমশাই তাঁদেরই একজন। তাঁর মধ্যেও ধর্মভাব ছিল। তিনি ব্রাহ্মসমাজে যাতায়াত করতেন, তিনি খ্রিস্টানদের শাস্ত্র-সম্পর্কে পরিচিত ছিলেন, এবং অবশ্যই নতুন যুগের শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন। স্বাভাবিক ভাবেই এমন ধরনের মানুষ যখন শ্রীরামকৃষ্ণের সামনে এসে উপস্থিত হলেন, তখন উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের মানুষগুলোর যে সংস্কার, ভাবনা তা সবই তাঁর মধ্যে রয়েছে। তাঁরা ভাবতেন যে, ইংরেজের স্কুলে পড়াশোনা করে পণ্ডিত হতে হবে, জ্ঞানী হতে হবে। দ্বিতীয়ত, সংসার যাপন করতে হবে। তৃতীয়ত, কোনও নির্দিষ্ট, যুক্তিসম্মত মতবাদকে আধার করে ধর্মীয় জীবনযাপন করতে হবে এবং সেসময়ে ব্রাহ্মসমাজের যে নিরাকারবাদী উপাসনা, তার সঙ্গে যুক্ত হতে হবে। এটি সে-যুগের সংস্কার। এই সংস্কারগুলো নিয়েই শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে মাস্টারমশাই এসেছিলেন। সেখানে আঘাত হিসেবে তাঁর কাছে এল শ্রীরামকৃষ্ণের দুটো প্রশ্ন– এক, তাঁর বিয়ে হয়েছে কি না? দুই, ছেলে হয়েছে কি না? অর্থাৎ, সংসারের পরিপূর্ণ আসক্তি পরিবৃত্তে তিনি জড়িয়ে পড়েছেন কি না? দেখা গেল, তিনি জড়িয়ে পড়েছেন। সুতরাং, ঠাকুর স্পষ্ট বলে দিলেন যে, এটি আধ্যাত্মিক জীবনযাপনের ক্ষেত্রে একটি বড় রকমের বাধা। সংসারে থেকে ভাগবত জীবনযাপন হবে না, সেটা নয়। কিন্তু এটি একটি বাধা। ভাগবত জীবনযাপনের ক্ষেত্রে এই যে আসক্তি, সংসার বাসনা বড় রকমের বাধা। সুতরাং, এই বাধার জন্য সচেতন হতে হবে। এটা বলার জন্যই এই দুটো প্রশ্ন। আর তার অভিঘাত মাস্টারমশাইয়ের কাছে প্রথম পৌঁছল। কারণ, এই কথা, তাঁর এতদিনের সংস্কারে কেউ তাঁকে বলেনি। ব্রাহ্মসমাজে এই নিয়ে তো কোনও আলোচনাই ছিল না। এই প্রথম তাঁর যে নিজস্ব সংস্কার, সেখানে আঘাত করল কেউ, আঘাত করলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। এতদিন পর্যন্ত তাঁর অহংকার ছিল, যেভাবে জীবনযাপন চলছে, সেভাবেই চলতে পারে। শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন, চলতে পারে। কিন্তু অসুবিধা আছে। তাই তোমাকে সচেতন হতে হবে।
দ্বিতীয় প্রশ্নে শ্রীরামকৃষ্ণ জিজ্ঞাসা করেছিলেন, বিদ্যাশক্তি না অবিদ্যাশক্তি? মাস্টারমশাই সেই প্রশ্নের যথার্থ তাৎপর্য বুঝতেই পারেননি। তিনি ধরে নিয়েছিলেন, তাঁদের কলকাতার যে সংস্কার, ইউরোপীয় শিক্ষার যে সংস্কার, সেই অর্থে জ্ঞানী নাকি অজ্ঞানী? অর্থাৎ, স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করে সার্টিফিকেট লাভ করা, চাকরি-বাকরি জোগাড় করা, আর নয়তো স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা না করা– এটাই হচ্ছে প্রধানত। এখনও যে সেই চিন্তাভাবনার প্রতিফলনই কিন্তু আমরা নিজেদের মধ্যে দেখি। আসলে চাল-কলা বাঁধা বিদ্যের বিপক্ষে যিনি প্রতিবাদস্বরূপ দাঁড়িয়ে ছিলেন, সেই শ্রীরামকৃষ্ণ স্বাভাবিকভাবেই এই নতুন ইউরোপীয় শিক্ষাপদ্ধতি, জ্ঞান বিতরণ ও অর্জনের পদ্ধতির বিরুদ্ধে মূর্তিমান চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ তাই আঘাত দিয়ে পৌঁছলেন মাস্টারমশাইয়ের কাছে, বললেন, ‘ও আচ্ছা, পরিবার অজ্ঞান, আর তুমি জ্ঞানী!’ তার মানে জ্ঞান আর অজ্ঞানের যে সীমারেখাটা এতদিন পর্যন্ত ইউরোপীয় শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে, ইংরেজের স্কুল-কলেজে পড়ে মাস্টারমশাই যেভাবে তৈরি করেছিলেন, সেই জায়গাতে গিয়েই শ্রীরামকৃষ্ণ আঘাত করলেন। পরিষ্কার বুঝিয়ে দিলেন, এই ধারণাটাই ভুল! উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সারা বিশ্ব যখন এই স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পুঁথিগত বিদ্যার ওপর জোর দিতে শুরু করেছে, সেই সময় কামারপুকুরের প্রান্তিক গ্রামে জন্ম এই সাধারণ ব্রাহ্মণ কলকাতায় এসে এত বড় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন, বলেছিলেন যে, চাল-কলা বিদ্যে শিখব না। আর যাঁরা চাল-কলা বিদ্যা শিখছেন, তাঁদের প্রশ্ন করছেন, ‘তুমি জ্ঞানী?’ সে মাস্টারমশাই বলুন, কি নরেন্দ্রনাথ দত্ত বলুন কি শরৎ মহারাজ বলুন– সকলের সামনেই তিনি প্রশ্ন রাখছেন স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্রকেও তিনি সরাসরি আঘাত করা থেকে পিছপা হননি। বিদ্যাসাগরের মধ্যেও আধ্যাত্মিকতার যে অভাব, সেই অপূর্ণতা ছিল, তা বলে দিতে কিন্তু তাঁর বিন্দুমাত্র দ্বিধা হয়নি। সবটাকেই কিন্তু তিনি নির্ণয় করেছেন ভারতের সনাতন আধ্যাত্মিকতার কষ্টিপাথরে। সেই কষ্টিপাথরে যাকে জ্ঞান বলে তাঁর মনে হয়েছে, তাঁকেই জ্ঞানরূপে গ্রহণ করেছেন, যাকে জ্ঞান বলে মনে হয়নি, তাকে কখনও মান্যতা দেননি।
মাস্টারকে শ্রীরামকৃষ্ণ তৃতীয় যে আঘাতটি দিলেন, সেটিও দুর্দান্ত। এতদিন পর্যন্ত এই ব্রাহ্মসমাজ, এই ধর্মপদ্ধতিগুলো, ধর্মাচার, ধর্মবিশ্বাসগুলো বলত, যে কোনও একটা বিশ্বাস রাখতে হবে– হয় সাকার, নয় নিরাকার। প্রাচ্য কিংবা পাশ্চাত্য উভয়ের কিন্তু বলে– কোনও একটি সত্য, অপরটি মিথ্যা। একটা বৈধ, তো অপরটি অবৈধ। আধ্যাত্মিক জগতে এমনটা চলে না। শ্রীরামকৃষ্ণের এই জায়গাতেই অসামান্য এক নিবেদন যে, ভারতবর্ষে সনাতন শাস্ত্র প্রমাণ করে দিয়েছে, সাকারও সত্য, নিরাকারও সত্য। এটি উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে কলকাতায় এক বিস্ময়কর বিবৃতি! কী করে তা সম্ভব। শ্রীরামকৃষ্ণ কিন্তু বলেই থামেননি, এ যে তাঁর জীবনের উপলব্ধি থেকে গড়ে ওঠা সত্য। তিনি নিজেই যে স্বয়ং চিন্ময়ী প্রতিমাকে দেখেছেন। মাস্টারমশাই যে পরে বলেছেন, মাটির প্রতিমা– বুঝিয়ে দিতে হবে। তারপর কী ভয়ানক আঘাত! আমাদের কলকাতার লোকের ওই এক, লেকচার আর বুঝিয়ে দেওয়া। উনিশ শতকের নতুন সভ্যতা, যুক্তি দিয়ে তাঁরা তো সব বলেন, যা কিছু তাঁরা বলছেন, সঙ্গে যুক্তি দিচ্ছেন। পাশ্চাত্যের বিখ্যাত দার্শনিক ডেকার্ত বলেছিলেন, আমি সংশয় করি, তাই আমার অস্তিত্ব রয়েছে। এই সংশয় থেকে তৈরি হচ্ছে নানা বিতর্ক। শ্রীরামকৃষ্ণ ওখানেই আঘাত দিচ্ছেন। বলছেন, কে কাকে বোঝায়, আগে তো নিজেকে বুঝতে হবে। আমার উপলব্ধি যদি সত্য না হয়, স্থিত না হয়, তাহলে দশজনকে বোঝাতে গেলেও কিছু হবে না। এটি নবজাগ্রত কলকাতার কাছে একটি অদ্ভুত আঘাত। মাস্টারমশাইয়ের দর্প চূর্ণ হয়ে গেল। তিনি ভাবতেই পারেননি এখানে আঘাত আসতে পারে। আমাদের আধুনিক পৃথিবী, আধুনিক সভ্যতা ভাবতেও পারবে না। মানুষের সমস্ত বিবৃতি, বক্তব্যকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে নিজের উপলব্ধির ওপর। তবেই সে কথা বলতে পারবে, নয়তো সে কথা বলার অধিকারী নয়। যার উপলব্ধি তৈরি হয়নি, সে কথা বলার যোগ্য নয়। আমাদের যদি অনুভূতি না হয়, উপলব্ধি তৈরি না হয় তাহলে কোনও প্রকার উচ্চচূড় বিবৃতি দেওয়ার অধিকার নেই। এটি শ্রীরামকৃষ্ণের ঘোষিত সিদ্ধান্ত। এই বিবৃতির সামনে উনিশ শতকের নবজাগ্রত কলকাতা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। আজও পৃথিবী স্তব্ধবাক্। এখানেই দাঁড়িয়ে আছে শ্রীরামকৃষ্ণের সাকার-সাধনা, প্রতিমার সাধনা।
মৃণ্ময়ী প্রতিমা নয়, চিন্ময়ী প্রতিমার উপাসনা করা হচ্ছে। যে-বলছে মাটির প্রতিমা পুজো করা হচ্ছে– সে ভুল বলছে। কেন? কারণ, তার উপলব্ধি তৈরি হয়নি। সে কেবল মাটির প্রতিমাকেই দেখছে। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণ যখন উপাসনা করছেন, তখন দেখছেন, এ মাটির প্রতিমা কোথায়, মা তো তাঁর সঙ্গে কথা বলছেন! মায়ের শ্বাস পড়ছে, মা ঝমঝম করে কালীবাড়ির সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে যাচ্ছেন, নামছেন। সে প্রতিমা কী করে মৃণ্ময়ী হয়, সে তো চিন্ময়ী। মাটির প্রতিমাকে পুজো করা হয় না, চিন্ময়ী প্রতিমাকে পুজো করা হয়। এটি শ্রীরামকৃষ্ণ স্পষ্ট বলেছেন। প্রতিমা উপাসনার বিরুদ্ধে সেকালের বাংলা তথা ভারতবর্ষ ব্রিটিশদের কাছ থেকে শিক্ষা পেয়ে যে আলোড়ন তুলতে চেয়েছিল, শ্রীরামকৃষ্ণ তাকে থামিয়ে দিয়েছেন। পরবর্তী কালে শ্রীরামকৃষ্ণের এই অপূর্বসুন্দর তত্ত্বকেই স্বামী বিবেকানন্দ আলোয়ারের রাজসভায় গিয়ে আলোয়ারের মহারাজাকেও বুঝিয়ে ছিলেন– আমরা তো কোনও ছবিকে, কোনও প্রতিমাকে পুজো করি না, তার মধ্যে যে চিন্ময়ী সত্তা তাকে পুজো করি। কে বলেছে সে প্রতিমা, সে ছবি! এই যে ঘোষণা শ্রীরামকৃষ্ণ মাস্টারমশাইকে বলে দিয়েছেন, ঠাকুরের এই যে আঘাতে মাস্টারমশাইয়ের অহঙ্কারটা ভাঙল। সেখানেই মাস্টারমশাই এবার প্রশ্ন শুরু করলেন। তার আগে পর্যন্ত মাস্টারমশাইয়ের কোনও প্রশ্ন ছিল না, বিস্ময়-দর্শন ছিল শুধু। সংশয় ছিল, তর্ক করার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু ওই যে বলছেন, এটাই প্রথম ও শেষ তর্ক। এবার সবটা ভেঙে গেল।
মাস্টারমশাই বুঝলেন, এবার তাঁকে শরণাগত হয়ে বসতে হবে। গীতায় যেমন অর্জুন শ্রীকৃষ্ণের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। অর্জুনের মতো মাস্টারমশাইয়ের অহঙ্কারগুলো ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে। সেই চূর্ণ-বিচূর্ণ অহঙ্কারের ওপর বসে মাস্টারমশাই ভক্তের মতো শ্রীরামকৃষ্ণের শরণাগত, ঠাকুরের কাছে জানতে চাইলেন, ঈশ্বরে মন তিনি কীভাবে অর্পণ করবেন? সেখানে শ্রীরামকৃষ্ণের স্পষ্ট ও অনাবৃত বক্তব্য, এক, ঈশ্বরের নামগুণগান সব সময় করতে হবে। দুই, সৎসঙ্গ করতে হবে। তিন, মাঝে মাঝে নির্জনে গিয়ে তা চিন্তা করতে হবে। ধ্যান করতে হবে। এই ধ্যান করাটাও খুব সুন্দর। ধ্যান করতে হবে– মনে, কোণে ও বনে। অপূর্ব তিনটি শব্দ এখানে শ্রীরামকৃষ্ণ চয়ন করেছেন। ধ্যান তো বাইরে হয় না, মনের ভিতরে হয়। সকলের মধ্যে থেকে নিজেকে আলাদা করে ধ্যান করতে হয়। আর কোণে বসা মানে হচ্ছে, নিজেকে আলাদা করে নিয়ে আসা। আর বন হচ্ছে নির্জনতার সাধনা। সংসারের মধ্য থেকে নিজেকে আলাদা করা। নির্জন জায়গায় গেলেই যে নির্জনতাকে উপলব্ধি করা যায় তা নয়। অনেকে বনে গিয়ে হই-হট্টগোল, গানবাজনা শুরু করে দেন। নির্জনতার খোঁজে বনে যেতে হবে, কিন্তু নির্জনতাকে উপলব্ধি করতে কোনটাকে দরকার। সবার মধ্য থেকে নিজেকে আলাদা করে নিয়ে আসতে হবে। সুতরাং, নিজের ভিতরে অন্যের থেকে নিজেকে আলাদা করে, নির্জনতায় এই ধ্যান, এই সাধনা করতে হয়। চার. সদাসৎ বিচার। কোনটি নিত্য বস্তু, কোনটি সৎ বস্তু। ঈশ্বরই নিত্যবস্তু, জগৎ অনিত্য। সংসারে আমরা খাচ্ছিদাচ্ছি ভালো আছি। কিন্তু সংসারে কোনও দুর্ঘটনা ঘটুক, কিংবা পরিবারে কারও মৃত্যু হলে সেই আনন্দ মুহূর্তে বিষাদে পরিণত হয়। সংসার তো অনিত্য। তাকে নিয়ে এত হইচই, হট্টগোল করে লাভটা কী! যদি না সে সংসারে আমরা ঈশ্বরের কথা চিন্তা করতে পারি। এবং পঞ্চমত, কর্ম করে যেতে হবে। সংসারে থাকলে কাজ করতেই হবে, কাজ করব না– তা হয় না। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতায় অর্জুনকে বলেছিলেন, একদম নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকা যাবে না, তোমাকে কাজ করতে হবে। আমিও তো নিত্য কর্ম করছি।
…………………………………………
পড়ুন কথামৃতের বোঝাপড়া-র প্রথম পর্ব: ঠাকুরের লোকচরিত্র, যুগচরিত্র ও সমাজচরিত্রকে বোঝার অসামান্য ক্ষমতাই ফুটে উঠেছে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃতে
…………………………………………
শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, কাজ করবে, কিন্তু কর্মের একটি কৌশল আছে। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, ‘যোগাঃ কর্মস্য কৌশলম্।’ দক্ষতা কিংবা কৌশল তা আছে যোগের মধ্যে, যুক্ত হয়ে থাকার মধ্যে। এই যুক্ত হয়ে থাকা ঈশ্বরের মধ্যে। শ্রীরামকৃষ্ণ এই কর্মের দক্ষতাকে আমাদের মধ্যে আনতে বলছেন। সংসারে থাকতে গেলে কাজ তো করতেই হবে, কিন্তু কোন টেকনিকের মাধ্যমে? শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, কাজ সবসময় করব, সেটাও ঈশ্বরে মন রেখে। কেমন ভাবে? তিনি উদাহরণ দিচ্ছেন, বড়লোকের দাসীর মতো। সে কাজ করছে কিন্তু মনটা পড়ে আছে বাড়িতে সন্তানের কাছে। দ্বিতীয়ত, কচ্ছপের মতো। কচ্ছপ জলে চরে বেড়াচ্ছে, অথচ মন পড়ে আছে যেখানে তার ডিমগুলো আছে। হাতে তেল মেখে কাঁঠাল ভাঙতে হবে। অর্থাৎ, ভক্তিলাভ করে কাজটা করতে হবে। ভক্তি মানে ভগবানে যেন মনটি থাকে। এটি হচ্ছে কর্মের কৌশল। কাজ করব, কিন্তু মনটি সবসময় ঈশ্বরে সমর্পিত থাকবে। এটি বারবার শ্রীরামকৃষ্ণ মাস্টারমশাইকে বোঝাচ্ছেন। ঈশ্বরে যদি ভক্তিরূপ মন লেগে থাকে, তাহলে সংসারের ওই কাঁঠালের আঠা আর কিন্তু আমাদের হাতে লাগবে না।
……………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………
রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত এখন ৯০ বছরের। আমাদের একান্ত ইচ্ছা, শতবর্ষ পালনটা ওঁর সঙ্গে আমরা একসঙ্গেই করব। এই যে নাটকের একটা আলাদা সংসার এবং সে সংসারে সদস্যদের সবার মন জুগিয়ে, ভালো-মন্দ বুঝে দীর্ঘদিন ধরে কাজটা সুন্দর করে করলেন রুদ্রদা, সেটা ওঁর আজকালকার হাসি দেখেই বুঝতে পারি।