বদ্ধজীবের সংসারে এতখানিই আসক্তি যে, মৃত্যুর সময়ও সে ভগবানের নাম করবার সুযোগ পাচ্ছে না। কারণ চিরকাল সে সংসারই চিন্তা করে এসেছে। ঈশ্বর-চিন্তার কোনওরকম অভ্যাসই করেনি। ঠাকুর আবোল-তাবোল বলতে অবান্তর আড্ডা, তাস খেলা– এগুলোকে বুঝিয়েছেন। এ-কালে জন্মালে নিশ্চয়ই স্মার্টফোন কিংবা ফেসবুকের উদাহরণ দিতেন। ভগবানকে স্মরণ করবার জন্য ভগবান আমাদের অনেক সময় দেন। কিন্তু আমরা সে সময়ে বদ্ধজীবের মতো জালের মধ্যে মুখ গুঁজে ভাবি, ভালোই তো আছি।
প্রচ্ছদ শিল্পী: দীপঙ্কর ভৌমিক
৩.
১৮৮২। র্মাচের কথা।
“মাস্টার তখন বরাহনগরে ভগিনীর বাড়িতে ছিলেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করা অবধি সর্বক্ষণ তাঁহারই চিন্তা। সর্বদাই যেন সেই আনন্দময় মূর্তি দেখিতেছেন ও তাঁহার সেই অমৃতময়ী কথা শুনিতেছেন। ভাবিতে লাগিলেন, এই দরিদ্র ব্রাহ্মণ কিরূপে এই সব গভীর তত্ত্ব অনুসন্ধান করিলেন ও জানিলেন? আর এত সহজে এই সকল কথা বুঝাইতে তিনি এ-পর্যন্ত কাহাকেও কখনও দেখেন নাই। কখন তাঁহার কাছে যাইবেন ও আবার তাঁহাকে দর্শন করিবেন এই কথা রাত্রদিন ভাবিতেছেন।
দেখিতে দেখিতে রবিবার আসিয়া পড়িল। বরাহনগরের নেপালবাবুর সঙ্গে বেলা ৩টা-৪টার সময় তিনি দক্ষিণেশ্বরের বাগানে আসিয়া পৌঁছিলেন। দেখিলেন, সেই পূর্বপরিচিত ঘরের মধ্যে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ছোট তক্তপোশের উপর বসিয়া আছেন। ঘরে একঘর লোক। রবিবারে অবসর হইয়াছে, তাই ভক্তেরা দর্শন করিতে আসিয়াছেন। এখনও মাস্টারের সঙ্গে কাহারও আলাপ হয় নাই, তিনি সভামধ্যে একপার্শ্বে আসন গ্রহণ করিলেন। দেখিলেন, ভক্তসঙ্গে সহাস্যবদনে ঠাকুর কথা কহিতেছেন।
একটি ঊনবিংশতিবর্ষ বয়স্ক ছোকরাকে উদ্দেশ করিয়া ও তাঁহার দিকে তাকাইয়া ঠাকুর যেন কত আনন্দিত হইয়া অনেক কথা বলিতেছিলেন। ছেলেটির নাম নরেন্দ্র। কলেজে পড়েন ও সাধারণ ব্রাহ্মসমাজে যাতায়াত করেন। কথাগুলি তেজঃপরিপূর্ণ। চক্ষু দুটি উজ্জ্বল। ভক্তের চেহারা।
মাস্টার অনুমানে বুঝিলেন যে, কথাটি বিষয়াসক্ত সংসারী ব্যক্তির সম্বন্ধে হইতেছিল। যারা কেবল ঈশ্বর ঈশ্বর করে, ধর্ম ধর্ম করে তাদের ওই সকল ব্যক্তিরা নিন্দা করে। আর সংসারে কত দুষ্ট লোক আছে, তাদের সঙ্গে কিরূপ ব্যবহার করা উচিত– এ-সব কথা হইতেছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (নরেন্দ্রের প্রতি) – নরেন্দ্র তুই কি বলিস? সংসারী লোকেরা কত কি বলে! কিন্তু দেখ, হাতি যখন চলে যায়, পেছনে কত জানোয়ার কত রকম চিৎকার করে। কিন্তু হাতি ফিরেও চায় না। তোকে যদি কেউ নিন্দা করে, তুই কি মনে করবি?
নরেন্দ্র – আমি মনে করব, কুকুর ঘেউ ঘেউ করছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – না রে, অত দূর নয়। (সকলের হাস্য) ঈশ্বর সর্বভূতে আছেন। তবে ভাল লোকের সঙ্গে মাখামাখি চলে; মন্দ লোকের কাছ থেকে তফাত থাকতে হয়। বাঘের ভিতরেও নারায়ণ আছেন; তা বলে বাঘকে আলিঙ্গন করা চলে না। (সকলের হাস্য) যদি বল বাঘ তো নারায়ণ, তবে কেন পালাব। তার উত্তর – যারা বলছে “পালিয়ে এস” তারাও নারায়ণ, তাদের কথা কেন না শুনি?
“একটা গল্প শোন্। কোন এক বনে একটি সাধু থাকেন। তাঁর অনেকগুলি শিষ্য। তিনি একদিন শিষ্যদের উপদেশ দিলেন যে, সর্বভূতে নারায়ণ আছেন, এইটি জেনে সকলকে নমস্কার করবে। একদিন একটি শিষ্য হোমের জন্য কাঠ আনতে বনে গিছল। এমন সময়ে একটা রব উঠল, ‘কে কোথায় আছ পালাও – একটা পাগলা হাতি যাচ্ছে।’ সবাই পালিয়ে গেল, কিন্তু শিষ্যটি পালাল না! সে জানে যে, হাতিও যে নারায়ণ তবে কেন পালাব? এই বলিয়া দাঁড়িয়ে রইল। নমস্কার করে স্তবস্তুতি করতে লাগল। এদিকে মাহুত চেঁচিয়ে বলছে ‘পালাও, পালাও’; শিষ্যটি তবুও নড়ল না। শেষে হাতিটা শুঁড়ে করে তুলে নিয়ে তাকে একধারে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চলে গেল। শিষ্য ক্ষতবিক্ষত হয়ে ও অচৈতন্য হয়ে পড়ে রইল।
“এই সংবাদ পেয়ে গুরু ও অন্যান্য শিষ্যেরা তাকে আশ্রমে ধরাধরি করে নিয়ে গেল। আর ঔষধ দিতে লাগল। খানিক্ষণ পরে চেতনা হলে ওকে কেউ জিজ্ঞাসা করলে, ‘তুমি হাতি আসছে শুনেও কেন চলে গেলে না?’ সে বললে, ‘গুরুদেব আমায় বলে দিয়েছিলেন যে, নারায়ণই মানুষ, জীবজন্তু সব হয়েছেন। তাই আমি হাতি নারায়ণ আসছে দেখে সেখান থেকে সরে যাই নাই।’ গুরু তখন বললেন, ‘বাবা, হাতি নারায়ণ আসছিলেন বটে, তা সত্য; কিন্তু বাবা, মাহুত নারায়ণ তো তোমায় বারণ করেছিলেন। যদি সবই নারায়ণ তবে তার কথা বিশ্বাস করলে না কেন? মাহুত নারায়ণের কথাও শুনতে হয়।’ (সকলের হাস্য)
“শাস্ত্রে আছে ‘অপো নারায়ণঃ’ জল নারায়ণ। কিন্তু কোন জল ঠাকুর সেবায় চলে; আবার কোন জলে আঁচানো, বাসনমাজা, কাপড়কাচা কেবল চলে; কিন্তু খাওয়া বা ঠাকুরসেবা চলে না। তেমনি সাধু, অসাধু, ভক্ত, অভক্ত – সকলেরই হৃদয়ে নারায়ণ আছেন। কিন্তু অসাধু, অভক্ত, দুষ্ট লোকের সঙ্গে ব্যবহার চলে না। মাখামাখি চলে না। কারও সঙ্গে কেবল মুখের আলাপ পর্যন্ত চলে, আবার কারও সঙ্গে তাও চলে না। ওইরূপ লোকের কাছ থেকে তফাতে থাকতে হয়।”
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃতের একটি গল্প। অত্যন্ত পরিচিত। তবে, এই গল্পের দু’টি দিক আছে। এক, যেখানে ধর্মজীবন যাপন করবেন যে মানুষেরা, তাদের বলা হচ্ছে বাস্তববাদী হও। দুই, ঠাকুর বলছেন, আমাদের আধ্যাত্মিক সাধনায় যেন কোনও রকম নেতিবাচকতা না প্রবেশ করে। সর্বদা যেন ইতিবাচক জীবন-দৃষ্টি থাকে। দ্বিতীয় প্রসঙ্গটি নিয়ে প্রথমে আলোচনা করি। যখন নরেন্দ্রকে ঠাকুর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোকে যদি কেউ নিন্দা করে, তুই কী মনে করবি?’ নরেন্দ্র উত্তর দিয়েছিলেন যে, সে মনে করবে কুকুর ঘেউঘেউ করছে। ঠাকুর তৎক্ষণাৎ মানা করলেন। কেন? আসলে এই জাতীয় চিন্তায় কোনও ভগবৎ-বুদ্ধি নেই। যে সব মানুষেরা ধার্মিক মানুষদের নিন্দা করে তারা কুকুর-তুল্য– এ খুব নেতিবাচক ভাবনা। যেখানে নিন্দাকারী মানুষকে হীন বলে, ছোট বলে, তাদের যেন অমানুষ হিসেবে জ্ঞান করবার কথা বলা হচ্ছে। প্রসঙ্গত, স্বামীজি মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, আমরা যেন পাপকে ঘৃণা করি। পাপীকে নয়। কেন? প্রত্যেক সন্ন্যাসীর একটি অতীত আছে আর প্রত্যেক পাপীর আছে একটি ভবিষ্যৎ। অতীত জীবনে হয়তো সন্ন্যাসী ছিলেন দস্যু রত্নাকর! আজ তিনি বাল্মিকী। ঠিক এই দ্বন্দ্বেই, আমরা যদি ভাবি, দস্যু রত্নাকরের দস্যুতাকে ঘৃণা করব, আর শ্রদ্ধা করব তাঁর নবজীবনের ঋষিত্ব– তাহলেই আমাদের দৃষ্টি হবে ইতিবাচক।
ভগবদ্গীতায়, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে এ-কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। অর্জুন যখন জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আচ্ছা, যোগভ্রষ্ট যারা, তাদের কী দশা হয়? তারা কি এই আকাশের ছিন্ন মেঘের মতো নষ্ট হয়ে যায়? শ্রীকৃষ্ণ বললেন, যে যোগভ্রষ্ট হয়, তারও একটা ভবিষ্যৎ আছে। পুনরায় সে জন্মগ্রহণ করবে একটি সূচি, পবিত্র, শ্রী-সম্পন্ন গৃহে। নতুন করে একটি জীবন তৈরি ও নির্বাহের সুযোগ পাবে। সুতরাং, এই চিন্তা আমাদের শিখিয়েছে, কোনও মানুষের ভুলকে পৃথকভাবে নিন্দা করা যায়। কিন্তু সেই মানুষটির ভেতরে যে চৈতন্যময়, পবিত্রময় আত্মা রয়েছে– সেই অস্তিত্বকে স্মরণ করে শ্রদ্ধা করতে হয়। দ্বিতীয় যে দৃষ্টি উঠে এল– আধ্যাত্মিক জীবন যাপনে ইতিবাচকতা থাকবে বলেই আমাদের বাস্তববাদী হতে হবে।
আমরা অধিকাংশ সময় ভাবি, বাস্তববাদী হওয়ার অর্থ পাপের সঙ্গে সমঝোতা করা। তা কিন্তু কখনও নয়। বাস্তববাদের মূল সত্যটি আসলে বুঝতে হবে। যা বোঝার ক্ষেত্রে আমাদের প্রয়োগ করতে হবে যুক্তি এবং বুদ্ধি। আধ্যাত্মিক জীবনে আবেগ বা ভাবের অবকাশ রয়েছে। তা বলে বুদ্ধি-বিবর্জিত, যুক্তি-বিবর্জিত ভাব বা আবেগ আমাদের অনেক সময় বিপথে চালিত করে। স্বয়ং শ্রীরামকৃষ্ণ সমগ্র জীবন ধরে দেখিয়েছেন, ভাব-সমাধিতে নিত্য আরূঢ় হতে পারেন যিনি, অনায়াসে স্থিত হতে পারেন যিনি, তাঁরও যে বাস্তব জীবন সম্পর্কে সতর্কতা, সচেতনতা– এক অর্থেই বিস্ময়কর। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের আবির্ভাবের সময় থেকেই আধ্যাত্মিক সাধনা কেবলমাত্র ভাবজগতের আবেগময় বাসিন্দা হয়ে থাকছে না। তাঁর আধ্যাত্মিক সাধনা তাই খুব প্র্যাকটিকাল। যুক্তি, বুদ্ধি ও ভাবের যথার্থ সমন্বয়ে, সামঞ্জস্যে নির্মিত। শুধুই ভাবজগতে তলিয়ে যাওয়া নয়। আমাদের এ-জগতের আধ্যাত্মিক সাধনায় এ এক অভিনব দান।
‘একজন ভক্ত – মহাশয়, যদি দুষ্ট লোকে অনিষ্ট করতে আসে বা অনিষ্ট করে, তাহলে কি চুপ করে থাকা উচিত?
শ্রীরামকৃষ্ণ – লোকের সঙ্গে বাস করতে গেলেই দুষ্ট লোকের হাত থেকে আপনাকে রক্ষা করবার জন্য একটু তমোগুণ দেখানো দরকার! কিন্তু সে অনিষ্ট করবে বলে উলটে তার অনিষ্ট করা উচিত নয়।
“এক মাঠে এক রাখাল গরু চরাত। সেই মাঠে একটা ভয়ানক বিষাক্ত সাপ ছিল। সকলেই সেই সাপের ভয়ে অত্যন্ত সাবধানে থাকত। একদিন একটি ব্রহ্মচারী সেই মাঠের পথ দিয়ে আসছিল। রাখালেরা দৌড়ে এসে বললে, ‘ঠাকুর মহাশয়! ওদিক দিয়ে যাবেন না। ওদিকে একটা ভয়ানক বিষাক্ত সাপ আছে।’ ব্রহ্মচারী বললে, ‘বাবা, তা হোক; আমার তাতে ভয় নাই, আমি মন্ত্র জানি!’ এই কথা বলে ব্রহ্মচারী সেইদিকে চলে গেল। রাখালেরা ভয়ে কেউ সঙ্গে গেল না। এদিকে সাপটা ফণা তুলে দৌড়ে আসছে, কিন্তু কাছে না আসতে আসতে ব্রহ্মচারী যেই একটি মন্ত্র পড়লে, আমনি সাপটা কেঁচোর মতন পায়ের কাছে পড়ে রইল। ব্রহ্মচারী বললে, ‘ওরে, তুই কেন পরের হিংসা করে বেড়াস; আয় তোকে মন্ত্র দিব। এই মন্ত্র জপলে তোর ভগবানে ভক্তি হবে, ভগবানলাভ হবে, আর হিংসা প্রবৃত্তি থাকবে না।’ এই বলে সে সাপকে মন্ত্র দিল। সাপটা মন্ত্র পেয়ে গুরুকে প্রণাম করলে আর জিজ্ঞাসা করলে, ‘ঠাকুর! কি করে সাধনা করব, বলুন?’ গুরু বললেন, ‘এই মন্ত্র জপ কর, আর কারও হিংসা করো না।’ ব্রহ্মচারী যাবার সময়ে বললে, ‘আমি আবার আসব।’
“এইরকম কিছুদিন যায়। রাখালেরা দেখে যে, সাপটা আর কামড়াতে আসে না! ঢ্যালা মারে তবুও রাগ হয় না, যেন কেঁচোর মতন হয়ে গেছে। একদিন একজন রাখাল কাছে গিয়ে ল্যাজ ধরে খুব ঘুরপাক দিয়ে তাকে আছড়ে ফেলে দিলে। সাপটার মুখ দিয়ে রক্ত উঠতে লাগল, আর সে অচেতন হয়ে পড়ল। নড়ে না, চড়ে না। রাখালেরা মনে করলে যে, সাপটা মরে গেছে। এই মনে করে তারা সব চলে গেল।
“অনেক রাত্রে সাপের চেতনা হল। সে আস্তে আস্তে অতি কষ্টে তার গর্তের ভিতর চলে গেল। শরীর চূর্ণ – নড়বার শক্তি নাই। অনেকদিন পরে যখন অস্থিচর্মসার তখন বাহিরে আহারের চেষ্টায় রাত্রে এক-একবার চরতে আসত; ভয়ে দিনের বেলা আসত না, মন্ত্র লওয়া অবধি আর হিংসা করে না। মাটি, পাতা, গাছ থেকে পড়ে গেছে এমন ফল খেয়ে প্রাণধারণ করত।
“প্রায় এক বৎসর পরে ব্রহ্মচারী সেইপথে আবার এল। এসেই সাপের সন্ধান করলে। রাখালেরা বললে, ‘সে সাপটা মরে গেছে।’ ব্রহ্মচারীর কিন্তু ও-কথা বিশ্বাস হল না! সে জানে, যে মন্ত্র ও নিয়েছে তা সাধন না হলে দেহত্যাগ হবে না। খুঁজে খুঁজে সেইদিকে তার নাম ধরে ডাকতে লাগল। সে গুরুদেবের আওয়াজ শুনে গর্ত থেকে বেড়িয়ে এল ও খুব ভক্তিভাবে প্রণাম করলে। ব্রহ্মচারী জিজ্ঞাসা করলে, ‘তুই কেমন আছিস?’ সে বললে, ‘আজ্ঞে ভাল আছি।’ ব্রহ্মচারী বললে, ‘তবে তুই এত রোগা হয়ে গিছিস কেন?’ সাপ বললে, ‘ঠাকুর আপনি আদেশ করেছেন – কারও হিংসা করো না, তাই পাতাটা ফলটা খাই বলে বোধ হয় রোগা হয়ে গিছি!’ ওর সত্ত্বগুণ হয়েছে কি না, তাই কারু উপর ক্রোধ নাই। সে ভুলেই গিয়েছিল যে, রাখালেরা মেরে ফেলবার যোগাড় করেছিল। ব্রহ্মচারী বললে, ‘শুধু না খাওয়ার দরুন এরূপ অবস্থা হয় না, অবশ্য আরও কারণ আছে, ভেবে দেখ।’ সাপটার মনে পড়ল যে, রাখালেরা আছাড় মেরেছিল। তখন সে বললে, ‘ঠাকুর মনে পড়েছে বটে, রাখালেরা একদিন আছাড় মেরেছিল। তারা অজ্ঞান, জানে না যে আমার মনের কি অবস্থা; আমি যে কাহাকেও কামড়াব না বা কোনরূপ অনিষ্ট করব না, কেমন করে জানবে?’ ব্রহ্মচারী বললে, ‘ছি! তুই এত বোকা, আপনাকে রক্ষা করতে জানিস না; আমি কামড়াতে বারণ করেছি, ফোঁস করতে নয়! ফোঁস করে তাদের ভয় দেখাস নাই কেন?’
“দুষ্ট লোকের কাছে ফোঁস করতে হয়, ভয় দেখাতে হয়, পাছে অনিষ্ট করে। তাদের গায়ে বিষ ঢালতে নাই, অনিষ্ট করতে নাই।”
“ঈশ্বরের সৃষ্টিতে নানারকম জীবজন্তু, গাছপালা আছে। জানোয়ারের মধ্যে ভাল আছে মন্দ আছে। বাঘের মতো হিংস্র জন্তু আছে। গাছের মধ্যে অমৃতের ন্যায় ফল হয় এমন আছে; আবার বিষফলও আছে। তেমনি মানুষের মধ্যে ভাল আছে, মন্দও আছে; সাধু আছে, অসাধুও আছে; সংসারী জীব আছে আবার ভক্ত আছে।”
ফের একবার বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গির কথা উল্লেখ করলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। সংসারে যখনই আমরা থাকি, তখন কিছু মানুষ থাকবেই, যারা গোলমাল করতে অভ্যস্ত। আমাদের সাধনায় বাধা দেবে। বিরক্তি উৎপাদন করবে। অনিষ্ট করতে চাইবে। সেই ক্ষেত্রে কী করণীয়? ঠাকুর বলছেন, সেই সকল মানুষদের প্রতি ফোঁস করতে হবে। অর্থাৎ, সেই সকল মানুষের বিপক্ষে রুখে দাঁড়াতে হবে। তাই বলে তাদের অনিষ্ট করা যাবে না। আগের ঘটনায় এ-সত্যই কিন্তু প্রস্ফুটিত হয়েছিল। কারণ তা হল পাপ। যে কারণে ঠাকুর সহ্যের কথা বলেছেন। আমাদের শাস্ত্রেও তিতিক্ষা– একটি সাধনা হিসেবে গৃহীত হয়েছে। স্পষ্ট বলা হয়েছে, আধ্যাত্মিক সাধনায় কোনও রকম অনিষ্টের চিন্তা এবং বিলাপও করা যাবে না। কিন্তু কেউ যদি আমার সাধনায় বিঘ্ন ঘটাতে আসে? ওই যে ঠাকুর বললেন, তমোগুণ দেখানো দরকার। মনে মনে কিন্তু তমোগুণের প্রকাশ হোক, এমনটা চাইনি। কারণ তমোগুণ কখনও ভালো হতে পারে না। সপ্তগুণেরই প্রকাশ চাই ভগবৎ সাধনার পথে এগনোর জন্যে। তাই যেন একইসঙ্গে বাস্তববাদিতার কথা এবং আধ্যাত্মিক সাধনার যোগ্যতাটিকে অক্ষুণ্ণ রাখা– এই দুইকে ঠাকুর একসঙ্গে রাখতে বলছেন। এই তো আসলে আধ্যাত্মিক তিতিক্ষার সাধনা।
ঠাকুর বলছেন:
“জীব চারপ্রকার: – বদ্ধজীব, মুমুক্ষজীব, মুক্তজীব ও নিত্যজীব।
“নিত্যজীব: – যেমন নারদাদি। এরা সংসারে থাকে জীবের মঙ্গলের জন্য – জীবদিগকে শিক্ষা দিবার জন্য।
“বদ্ধজীব: – বিষয়ে আসক্ত হয়ে থাকে, আর ভগবানকে ভুলে থাকে – ভুলেও ভগবানের চিন্তা করে না।
“মুমুক্ষজীব: – যারা মুক্ত হবার ইচ্ছা করে। কিন্তু তাদের মধ্যে কেউ মুক্ত হতে পারে, কেউ বা পারে না।
“মুক্তজীব: – যারা সংসারে কামিনী-কাঞ্চনে আবদ্ধ নয় – যেমন সাধু-মহাত্মারা; যাদের মনে বিষয়বুদ্ধি নাই, আর যারা সর্বদা হরিপাদপদ্ম চিন্তা করে।
“যেমন জাল ফেলা হয়েছে পুকুরে। দু-চারটা মাছ এমন সেয়ানা যে, কখনও জালে পড়ে না – এরা নিত্যজীবের উপমাস্থল। কিন্তু অনেক মাছই জালে পড়ে। এদের মধ্যে কতকগুলি পালাবার চেষ্টা করে। এরা মুমুক্ষুজীবের উপমাস্থল। কিন্তু সব মাছই পালাতে পারে না। দু-চারটে ধপাঙ ধপাঙ করে জাল থেকে পালিয়ে যায়, তখন জেলেরা বলে, ওই একটা মস্ত মাছ পালিয়ে গেল! কিন্তু যারা জালে পড়েছে, অধিকাংশই পালাতেও পারে না; আর পালাবার চেষ্টাও করে না। বরং জাল মুখে করে, পুকুরের পাঁকের ভিতরে গিয়ে চুপ করে মুখ গুঁজরে শুয়ে থাকে – মনে করে, আর কোন ভয় নাই, আমরা বেশ আছি। কিন্তু জানে না যে, জেলে হড় হড় করে টেনে আড়ায় তুলবে। এরাই বদ্ধজীবের উপমাস্থল।”
“বদ্ধজীবেরা সংসারে কামিনী-কাঞ্চনে বদ্ধ হয়েছে, হাত-পা বাঁধা। আবার মনে করে যে, সংসারের ওই কামিনী ও কাঞ্চনেতেই সুখ হবে, আর নির্ভয়ে থাকবে। জানে না যে, ওতেই মৃত্যু হবে। বদ্ধজীব যখন মরে তার পরিবার বলে, ‘তুমি তো চললে, আমার কি করে গেলে?’ আবার এমনি মায়া যে, প্রদীপটাতে বেশি সলতে জ্বললে বদ্ধজীব বলে, ‘তেল পুড়ে যাবে সলতে কমিয়ে দাও।’ এদিকে মৃত্যুশয্যায় শুয়ে রয়েছে!
“বদ্ধজীবেরা ঈশ্বরচিন্তা করে না। যদি অবসর হয় তাহলে হয় আবোল-তাবোল ফালতো গল্প করে, নয় মিছে কাজ করে। জিজ্ঞাসা করলে বলে, আমি চুপ করে থাকতে পারি না, তাই বেড়া বাঁধছি। হয়তো সময় কাটে না দেখে তাস খেলতে আরম্ভ করে।”
দৃষ্টান্তগুলো অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। এত আধুনিক ও এত স্পষ্ট যে, আমাদের গায়ে কাঁটা দিতে বাধ্য। দেখুন, বদ্ধজীবের সংসারে এতখানিই আসক্তি যে, মৃত্যুর সময়ও সে ভগবানের নাম করবার সুযোগ পাচ্ছে না। কারণ চিরকাল সে সংসারই চিন্তা করে এসেছে। ঈশ্বর-চিন্তার কোনওরকম অভ্যাসই করেনি। ঠাকুর আবোল-তাবোল বলতে অবান্তর আড্ডা, তাস খেলা– এগুলোকে বুঝিয়েছেন। এ-কালে জন্মালে নিশ্চয়ই স্মার্টফোন কিংবা ফেসবুকের উদাহরণ দিতেন। ভগবানকে স্মরণ করবার জন্য ভগবান আমাদের অনেক সময় দেন। কিন্তু আমরা সে সময়ে বদ্ধজীবের মতো জালের মধ্যে মুখ গুঁজে ভাবি, ভালোই তো আছি।
……………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………….
নজরুলের একটি বিখ্যাত গান আছে, ‘জ্বলিয়া মরিবি কে সংসার জ্বালায়/ তাহারে ডাকিছে বা কোলে আয় কোলে আয়/ জীবন এ শ্রান্ত রে ঘুম পাড়াইতে তোরে…’। শ্মশানে যখন সে জানবে, তখন ধীরে ধীরে বুঝতে পারবে, সত্যি এই সংসার জ্বালায় আমরা জ্বলে মরছি। সংসারে আসক্ত থেকে কিন্তু বুঝতেই পারি না, কেমন করে এই দিনগুলো চলে গেল। সেই যে পান্নালাল ভট্টাচার্য গেয়েছিলেন, ‘আমি সখাত সলিলে ডুবে মরি শ্যামা, দোষ কারো নয় গো মা…’। আসলে নিজেই আমি এই সংসারের খাত কেটেছি, সেখানেই জল ঢুকেছে সুতরাং ডুবে মরছি। আমার কাছে সুযোগ ছিল, অবসর ছিল, আমি সেটা ব্যবহার করিনি। আমি এই সংসারে বদ্ধতাকে, আসক্তিকে স্বীকার করে নিয়েছি। তাই ঠাকুর বলছেন, মানুষকে প্রথমে বুঝতে হবে যে সংসার অত্যন্ত গোলমেলে জায়গা। সংসার হল বিদেশ। সেখানে বিদেশির বেশে ভ্রমে ঘুরে বেড়াচ্ছি। যেন অকারণেই। স্বদেশ হচ্ছে আমার চৈতন্য। আমার আত্মা। সেখানেই আমি স্থিত হতে পারলে আমার শান্তি। তবেই মুক্তি। সেই কারণেই একটি ব্রাহ্ম-সংগীতে বলছে, ‘মন চলো নিজ নিকেতনে।’
নিজের নিকেতন খুঁজে বের করতে হবে। তবে সেখানে যাওয়ার জন্যে আগ্রহ জন্মাবে। তবেই সংসারকে বিদেশ বলে মনে হবে। অন্যথা নয়।
… পড়ুন কথামৃতের বোঝাপড়া-র অন্যান্য পর্ব …
২. উনিশ শতকের নবজাগ্রত কলকাতার কাছে শ্রীরামকৃষ্ণ এক অদ্ভুত আঘাত
গত রবিবার (১৬ মার্চ) ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরকার ভয়েস অফ আমেরিকা এবং অন্যান্য সরকারপোষিত সংবাদমাধ্যমগুলোতে গণ ছাঁটাই আরম্ভ করেছে। আজকাল সারা পৃথিবীর কর্পোরেট চাকরিতে ইদানীং যা দস্তুর, সেই অনুযায়ী রাতারাতি ইমেল করে কর্মরত সাংবাদিক ও অন্যান্য কর্মীদের জানানো হয়েছে– কেটে পড়ো। যে সাংবাদিক চাটুকার নয়, তাকে নিয়ে ট্রাম্প কী করবেন?