দেখে এসে জ্যোতিঠাকুরপো জানায় জ্ঞানদাকে। ঘরের মেয়েরা নাকি এবার থেকে বাইরের শিক্ষকের কাছে পড়বে, শাড়ির বদলে পেশোয়াজ পরার ঘোষণা করেছেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। চোখের সামনে কি তবে রেনেসাঁস দেখবে জ্যোতি, জ্ঞানদারা?
৪.
সকাল থেকে জ্ঞানদার মন খুব খারাপ। মেজঠাকুরপো হেমেন্দ্র তাকে না কি আর পড়াবে না। বাবামশায় দেবেন্দ্রনাথ হুকুম জারি করেছেন, ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের সবাইকে লেখাপড়া শিখতে হবে ব্রাহ্মসমাজের উপাচার্য অযোধ্যানাথ পাকড়াশীর কাছে। কী সুন্দর বন্ধু-বন্ধু ঠাকুরপো হেমেন্দ্র! কী মিষ্টি করে ‘বউঠান’ বলে ডাকে! পড়া না পারলে ধমকও দেয়। কিন্তু মনে রাখে, আমি বয়সে ছোট হলেও তার মেজবউঠান। তাই ঠাকুরপোর ধমকেও ভালবাসা থাকে। দুধে দাঁত ফেলার জন্য হেমেন্দ্রই তো দেখিয়ে দিল চৌকাঠের নীচে ইঁদুরের গর্ত। এমন মিষ্টি ঠাকুরপোর কাছে বন্ধ হয়ে গেল লেখাপড়া! নতুন মাস্টারমশাই এখন থেকে অযোধ্যানাথ পাকড়াশী! নামটা শুনলেই কেমন যেন দৈত্য-দৈত্য মনে হয় জ্ঞানদার! বুকের মধ্যে একরাশ ভয়। কান্নায় ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে চোখ।
–মেজবউঠান! ঘরের পর্দা সরিয়ে ডাকে জ্যোতি।
–ওমা! বাইরে কেন? ভেতরে এসো নতুন ঠাকুরপো। ডাকে জ্ঞানদা।
ছুটে ঘরে ঢোকে জ্যোতিরিন্দ্র। জ্যোতিই তো জ্ঞানদাকে একদিন বলল, ভেবে দেখেছ আমরা কত কাছাকাছি।
–কাছাকাছি তো বটেই। আমি তোমার মেজবউঠান। আর তুমি আমার নতুন ঠাকুরপো।
–দূর, ওই কাছাকাছি নয়। অন্য কাছাকাছি। আমি জন্মেছি ১৮৪৯-এর ৪ঠা মে। আর তুমি ১৮৫০-এর ২৬ জুলাই। এ-বাড়িতে এত কাছাকাছি তোমার আর কেউ আছে?
–ঠিক তো নতুন ঠাকুরপো! তাই তুমি আমার সব মনের কথা বুঝতে পারো।
–তাহলে আমাকে ঠাকুরপো-ঠাকুরপো করবে না। শুধু ‘নতুন’ বলবে, কেমন?
–শুধু নতুন! কী ভাববে সকলে!
–কিচ্ছু ভাববে না। এ-বাড়িতে যে কোনও নতুন খুব তাড়াতাড়ি চলতি হয়ে যায়।
–তাই! হেসে ফেলে জ্ঞানদা। তারপর বলে, ঠিক আছে নতুন!
এসব বেশ কিছুদিন আগের ঘটনা। সব মনে পড়ে জ্ঞানদার। ততক্ষণে জ্যোতি একেবারে কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। জ্ঞানদা বসে আছে মস্ত বড় পালঙ্কের কোণে। মনখারাপের ছলছলে চোখ নিয়ে সে তাকায় জ্যোতিরিন্দ্রের দিকে।
–তোমার কীসের কষ্ট? তোমার চোখে জল?
–খুব ভয় করছে নতুন।
এই প্রথম নতুন ঠাকুরপোকে শুধু ‘নতুন’ বলে ডাকল জ্ঞানদা। আর মনে হল, বুকের মধ্যে একটা জানলা খুলে গেল। একরাশ আলো-বাতাস ঢুকল জানলা দিয়ে। গুমোট গেল।
–নতুন! আরও একবার শব্দটি উচ্চারণ করে জ্যোতির কাঁধে হাত রাখল জ্ঞানদা।
–আমার দায়িত্ব বেড়ে গেল।
–কীসের দায়িত্ব?
–চিরদিন নতুন থাকার।
খিলখিল করে হেসে উঠল বছর তেরোর জ্ঞানদা চোদ্দো বছরের দেবদূত-সুন্দর ঠাকুরপোর দিকে তাকিয়ে। বলল, খুব ভয় করছে, অযোধ্যানাথ পাকড়াশীর কাছে পড়তে হবে শুনে।
–কীসের ভয়?
–ওরকম নামের কাউকে আমি চিনিনি। লোকটা কি খুব রাগী?
–মেজবউঠাকরুণ, বলো, আমাদের আচার্যদেব কি খুব রাগী?
–পারব না। এ-বাড়িতে তোমরা বড্ড বানিয়ে-বানিয়ে কথা বলো। বাবামশায় তো নতুন ফ্যাশন বানাচ্ছেন। শুনেছ তো কথা?
–হ্যাঁ মেজবউঠান। তোমাদের পরনে তো শুধু একখানি শাড়ি। বাবামশায় তো বলেই খালাস, বাড়ির বাইরের পুরুষ এসে তোমাদের পড়াবেন। মা নাকি বাবামশায়কে জিজ্ঞেস করেছেন, ওই একখানা মাত্র শাড়ি পরে বাইরের পুরুষের সামনে বাড়ির মেয়েরা বেরবে তো? ওই একটি প্রশ্নে, বাবামশায়ের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে!
–সত্যি তো নতুন, কী হবে তাহলে?
–এইবার তো রূপকথার শুরু মেজবউঠান। চুপচাপ বসে দেখে যাও। বাবামশায় এখন ফ্যাশন-ডিজাইনার!
–নতুন, বুঝিয়ে বলো। বুঝতে পারছি নে!
–বলছি তো মেজবউঠান, চোখের সামনে এবার দেখবে রেনেসাঁস-এর রূপকথা। বাঙালির নবজাগরণে ঠাকুরবাড়ির অন্তরপুরিকাদের এবার ঘরে-বাইরে অন্য পোশাক।
–নতুন, আরও যে গুলিয়ে যাচ্ছে আমার, বলে জ্ঞানদা, তার একখানা শাড়ির একটিমাত্র আঁচল বুকের ওপর জড়িয়ে নিয়ে, ভাল করে দেখে, যেভাবে সে এতদিন কখনও দেখেনি নিজের বুক। সেদিকে তাকিয়ে তার এই প্রথম লজ্জা করে।
–শোনো মেজবউঠান, এইমাত্র বারবাড়ি থেকে আসছি। টাটকা খবরটা দিতে এলেম। বাবামশায় হিমালয় থেকে কলকাতায় ফিরেছেন। এবং ফিরেই ডিক্লেয়ার করেছেন, ঠাকুরবাড়িতে তোমাদের মতো একালের মেয়েরা সবাই পেশোয়াজ পরবে।
–শাড়ি নয়!
–শাড়ির যুগ শেষ, বলে জ্যোতি আচমকা উদ্দীপনায়!
–পেশোয়াজ কেমন?
–বাবামশায় স্পেশাল পেশোয়াজ ডিজাইন করছেন, ওস্তাগরের সাহায্যে। বৈঠকখানায় এখন নবজাগরণ ঘটছে। দেখে এলেম এইমাত্র। কোথাকার জল কোথায় গড়ায় দ্যাখো। অযোধ্যানাথ ঠাকুরবাড়ির অন্তঃপুর প্রবেশ করুন না করুন মেজবউঠান, ঢুকে পড়ল পেশোয়াজ!
–খুব ভাল হল। আজকাল এই একখানা আঁচল গায়ে আমার কেমন যেন লাগে, নতুন।
–আমার কিন্তু বেশ লাগে, খুব ভাল্লাগে তোমাকে। কথাটা বলতে বলতে জ্যোতির ফর্সা দেবানন রাঙা হয়ে ওঠে। সেদিকে তাকায় জ্ঞানদা।
(চলবে)
তথ্যসূত্র: রবীন্দ্রনাথের আত্মীয়স্বজন। সমীর সেনগুপ্ত। সাহিত্য সংসদ
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved