বলল কুসুমডিহারের মাধাই। রেশমীকে সে আহ্বান করছে তাদের সভা শুনতে। বলে আরও একটি কথা, এই যে, ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টের আগে বন্দুক ধরলে দেশপ্রেমী, আর পরের দিন থেকে বন্দুক ধরলেই তারা সন্ত্রাসবাদী, জঙ্গি– এই ভাগাভাগির কী মানে!
পর্ব ৪
বাজার এলাকা, মোটামুটি জমজমাট। বিকেল গড়িয়ে সন্ধেতেই শেষ। রাত পর্যন্ত চলে না। ক্রেতা-বিক্রেতা সকলকে নিজের নিজের গ্রামে ফিরতে হয়। কখনও কখনও জঙ্গলের পথগুলোয় হাতি ভরে থাকে। আর ওই গোলমালের সময় থেকে সবার দিনের আলো থাকতে থাকতে বাড়ি ঢুকে যাওয়া অভ্যেস। তবে কুসুমডিহার বাজারটাতে চারপাশে বহুদূর থেকে লোকজন আসে। একসময় সপ্তাহে দু’দিনের হাট ছিল। এখন দোকানটোকান হয়ে বাজারের চেহারা।
মাধাই রেশমীর সঙ্গে কথা বলছে দেখে ইতিউতি অনেকেই তাকাচ্ছে। রেশমীর ছাত্রীদেরও কৌতূহল।
‘বলুন, ডাকলেন কেন?’
‘এই আজ একটা সভা করছি। আপনার ছেলেমেয়েদের একটু বলুন না, খানিকক্ষণ পরে একবার আসতে। আপনারাও আসতে পারেন। সকলের জন্যেই তো সভাটা করা।’
‘আমরা এসবে কী করব?’ নিস্পৃহ উত্তর রেশমীর। রুক্ষ হাসি দিয়ে মাধাই বলল, ‘এই হল সমস্যা। পাড়া জ্বলছে জ্বলুক। নিজের ঘরে আগুন না লাগলে কেউ বালতিতে জল নিয়ে বেরবে না। চারপাশের খবর রাখেন?’
‘রাখি। তবে আমরা কী করব?’ এই আলোচনা একটুও ভাল লাগছে না রেশমীর। আবার দুম করে চলে যাওয়াও ঠিক হবে না।
মাধাই বলল, ‘কী করবেন মানে? কী বলছেন দিদি? আপনি শিক্ষিকা, কত কী করতে পারেন! বড় বড় পার্টির সভা হলে শোনেন, বাইরের নেতা এলে দেখেন, ভোট দেন; কিন্তু সমস্যা কি এড়াতে পেরেছিলেন? আমরা যারা এলাকার অধিকারের কথা বলি, ছেলেমেয়েরা একটু সঙ্গে থেকে দেখুক না কী কাজ চলছে।’
রেশমী বলল, ‘দেখুন, সভা দূর থেকেও শোনা যায়। মাইক দিচ্ছেন তো। কিন্তু তারপর ওই বন্দুকের রাজনীতি, ওসব সমর্থন করি না। বাচ্চাদের আর মাথা খাবেন না।’ মাধাই একবার মাথা চুলকে বলল, ‘সভা আর প্রচার মানেই বন্দুক ধরা নয়। আপনি আমার সম্পর্কে কোন ধারণা থেকে এটা বললেন? আচ্ছা দিদিভাই, এটা বলুন তো, ’৪৭-এর ১৫ অগাস্টের আগের দিন পর্যন্ত বন্দুক হাতে নিলে দেশপ্রেমী বিপ্লবী, আর তার পরের দিন থেকে বন্দুক ধরলে সে সন্ত্রাসবাদী জঙ্গি, এই ভাগাভাগিটার যুক্তি আছে?’
পাশ থেকে বাহা বলল, ‘আরে স্বাধীন দেশ তো।’ মাধাই বলল, ‘এই যে তোদের গরিব মা-বোনেরা শাল গাছের পাতা কুড়িয়ে কত কষ্টে সংসার টানে, স্বাধীনতার মানে বোঝে? ঠিকঠাক মজুরি পায়? শোষণ চলছে না? হয়তো কমেছে। কিন্তু কিছু শয়তান আবার মাথা তুলছে। দেশ স্বাধীন, ওরা স্বাধীন? ভেবে দেখিস। শুধু আমি ভাল আছি ভাবলে হবে? পশ্চিমগড়ের দিকে যেটুকু চাষের জমি আছে, সেখানে যা যা ঘটছে, খবর নে। ওই দেখ, ওই দিকটা ঈশান কোণ। আমি দেখতে পাচ্ছি মেঘ জমছে।’
রেশমী হেসে পরিস্থিতিটা হালকা করে দিয়ে বলল, ‘খুব ভারি ভারি কথা। আমার মাথা অতটা নিতে পারবে না। তবে হ্যাঁ, কথাগুলো হয়তো কিছুটা ভাবার মতো। যাক, এখন আমরা চলি। আপনি সভা করুন।’
ততক্ষণে ব্যানার লেগেছে, ‘অরণ্য ও অরণ্যবাসীর অধিকার রক্ষা সমিতি। কুসুমডিহা শাখা।’ আর একটু এগিয়ে বুধনি বলল, ‘লোকটার কথাগুলোয় কিন্তু দম আছে।’ রেশমী জবাব দিল না। কথাগুলো ঠিক। কিন্তু মাধাইকে পছন্দ হয় না। ভাবল একবার পোস্ট অফিসটা ঘুরে গেলে কেমন হয়। সে বাবু কী করছেন, সারপ্রাইজ ভিজিটে একবার দেখে গেলে হত। রেশমী যখন ডাকঘরে ঢুকেছে সবাই মিলে, সুমিতের সামনে তখন নারায়ণ মাহাতো। ‘শ্রীচরণেষু’ বিদায় নিয়ে আলোচনা চলছে। পোস্ট কার্ড, ইনল্যান্ড, খামে যে ‘শ্রীচরণেষু মা’ চিঠি আসত, বছরের বিশেষ বিশেষ সময়ে ডাকঘরের ব্যস্ততা থাকত তুঙ্গে; এখন মুঠোফোন কেড়ে নিয়েছে চিঠির যুগ; তবু গ্রামেগঞ্জে, এই জঙ্গলমহলে কিছু চিঠি আসে, সেইসব কথা। রেশমী, সুমিতকে চশমার ফাঁক দিয়ে দেখলেন নারায়ণ। একবার নস্যি নিলেন। তারপর বললেন, ‘আমি আজ উঠি তাহলে।’
সুমিত বলল, ‘কী ব্যাপার, দিদিমণি সদলে?’
রসিকতা করে রেশমী বলল, ‘বাজারে মাধাইদের মিটিং শুনতে গিয়েছিলাম।’
‘বলেন কী! আমার তো এসব মিটিং মিছিল শুনলেই ভয় করে।’
‘কেন? আপনিও তো নানারকম কাজ করেন। শুনলাম দাতব্য চিকিৎসালয় করবেন।’
“আরে দশজনে মিলে অমন দু’চারটে কাজ চুপচাপ করা যায়। তাই বলে রাজনীতি, সভা, হুংকার? ওরে বাবা, আমার দ্বারা হবে না। তা আজ মিটিং-এ কী শুনলেন?”
এবার হেসে রেশমী বলল, ‘না মশাই, মিটিং শুনিনি। তবে মাধাই চারটি গভীর গভীর কথা শুনিয়ে দিল বটে।’
সুমিত বলল, ‘গভীর কথা শুনলে কখনও ফেলে দেবেন না। ভেবে দেখবেন। তা, চা চলবে তো সবার?’
‘না না, একটু আগেই ফুচকা খেয়ে এলাম।’
ঘরে ঢুকল পল্টু রানার।
‘কিছু বলবে?’ সুমিত জিজ্ঞেস করল। পল্টু উত্তেজিত, একটু হাঁপাচ্ছে। পাহাড় থেকে ফিরল। বলল, ‘একটা কথা বলতাম। জরুরি।’ সুমিত রেশমীদের একটু ঘরের বাইরে যেতে অনুরোধ করল।
(চলবে)