কুয়াশার মতো অস্পষ্ট কণ্ঠস্বরে লাবণ্যময় ঘন উচ্চারণে জ্ঞানদা বলতে থাকে, আমি ছিটকিনিটি ধরে মুহূর্তকাল অপেক্ষা করলাম। ওই যে বললাম, তোমার উচ্চারণে শেক্সপিয়র মনে আসতেই, ‘আই ট্যারিড আ লিটল্’। আর অমনি দরজায় অপেক্ষমাণ মানুষটি ধৈর্য হারাল। দরজার গায়ে আর আঙুলের আধো, আড়ষ্ট টুকটুক নয়। এবার সজোর জুতোর ধাক্কা। যার মধ্যে নেই ছিটেফোঁটা সংকোচ বা লজ্জা। বরং এই জোর শব্দ জাহির করল অধিকারবোধ। নতুন, আমি মুহূর্তে বুঝে গেলাম দরজায় তুমি শব্দ করনি। দরজায় কে, আমার বুঝতে বিলম্ব হয়নি।
১৭.
ছাদে উঠেই আকাশের দিকে তাকায় জ্ঞানদা। পূর্ণিমার পরে চাঁদে সবে ভাঙন ধরেছে। তবু জ্যোৎস্না কিছু কম পড়েছে বলে মনে হল না জ্ঞানদার। ছাদের এককোণে নতুন পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে। যেন পাথরের মূর্তি।
–রাগ করেছ? নতুনের দিকে ধীর পায়ে যেতে-যেতে পিছন থেকে জিজ্ঞেস করে জ্ঞানদা।
কোনও উত্তর দেয় না জ্যোতিরিন্দ্র।
–অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছ তো? কী করব বলো, তোমার মেজদাদা যে ভোরবেলা হঠাৎ এসে পড়বে, আমি তো ভাবতেই পারিনি! আর এতদিন পরে আমাকে পেয়ে, তার কথা তো ফুরোতেই চায় না। এইমাত্র তিনি বেরলেন। কোন ক্লাবে নাকি আইসিএস-দের সান্ধ্যমজলিশ। বললেন, সেখানেই ডিনার। ফিরতে রাত হবে।
–তুমি জানতে না মেজদাদা আসবে? পিছন ফিরেই প্রশ্ন করে জ্যোতিরিন্দ্র।
–বিশ্বাস করো নতুন, বিন্দুবিসর্গ জানতেম না! জ্ঞানদা নতুনের পিঠে হাত রাখে।
জ্যোতিরিন্দ্র সামনে ফেরে। সরাসরি তাকায় জ্ঞানদার দিকে। চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে জ্ঞানদার রূপ।
–তুমি জানতে না মেজদাদা আসছে? পরশু তুমি চিঠি পেয়েছ মেজদাদার। আর আজ সকালে সে কলকাতায়! চিঠিতে তোমাকে জানায়নি, সে আসছে?
–আজ সকালে কী যে কেলেঙ্কারি থেকে বেঁচে গেছি। জানলে কী আর অমন ঘটনা ঘটতে পারত?
–কী ঘটনা, অবাক হয়ে জানতে চায় জ্যোতিরিন্দ্র।
–ঘটেনি যখন, তোমার জেনেও কোনও লাভ নেই নতুন। তাছাড়া লজ্জার মাথা খেয়ে আমি বলতেও পারব না।
–অদ্ভুত কথা তো! যে-ঘটনা ঘটেইনি, সেই ঘটনার কথা বলতে তোমাকে লজ্জার মাথা খেতে হবে?
–ও তুমি বুঝবে না নতুন।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
মেজবউঠাকরুণ। পর্ব ১৬: সত্যেন্দ্র ভাবছে জ্ঞানদার মনটি এ-বাড়ির কোন কারিগর তৈরি করছে
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
ভোরের বিছানায় তরুণীর মন, সেই ঢাকনা না খোলাই ভাল। জ্ঞানদার এই চোখের দৃষ্টি আগে কখনও দেখেনি জ্যোতিরিন্দ্র। এই মেজবউঠানকে সে কি চেনে? সে নীরবে তাকিয়ে থাকে। তারপর দু’টি হাত রাখে জ্ঞানদার কাঁধে। জ্ঞানদার মনে হয়, তাকে ছুঁলো কোনও দেবদূত। তার সমস্ত শরীর যেন কথা হয়ে ওঠে। তার মনে হয়, পরনে তার কোনও পোশাক নেই। চাঁদের আলো ছাড়া।
–নতুন, আজ সকালে আমাকে বাঁচিয়েছে তোমার শেক্সপিয়র!
নতুন একেবারে বুকের কাছে ঘন করে টেনে নেয় জ্ঞানদাকে। বলে, মেজবউঠান, আজ আমার কী হয়েছে কী জানি, তোমার কোনও কথার হদিশ পাচ্ছি নে। সামান্য সাহায্যের প্রয়োজন। খোলসা করো, আমার শেক্সপিয়র তোমাকে আজ সকালে কোন কেলেঙ্কারি থেকে কীভাবে বাঁচালেন?
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
মেজবউঠাকরুণ। পর্ব ১৫: জ্ঞানদার কাছে ‘নতুন’ শব্দটা নতুন ঠাকুরপোর জন্যই পুরনো হবে না
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
জ্ঞানদা নরমে গরমে জ্যোৎস্নামাখানো ছাদে আরও যেন গলে যায় জ্যোতিরিন্দ্রর বুকে। তারপর বলে, নতুন, আজ ভোরবেলা আমার দরজায় টোকা। খুব মৃদু টোকা। লজ্জায় ভয়ে সংশয়ে কোমল ঠুকঠুক। একবার। তারপর আরও একবার। আমি নিশ্চিত, এই টোকা তোমার…
–তারপর? জ্যোতিরিন্দ্র জ্ঞানদার মুখটা নিজের মুখের পানে ঈষৎ তুলে উদগ্রীব প্রশ্ন করে।
–তারপর আমি বিছানা থেকে উঠে গিয়ে দরজার শিকলিতে হাত দিয়ে ভাবলুম, খুব আস্তে, এতটুকু শব্দ না করে, খুলে দিই। কিন্তু তখুনি আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল! দরজার ছিটকিনি নামাতে গিয়েও আমি নামালাম না। নতুন, তোমার কণ্ঠে শেক্সপিয়রের মার্চেন্ট অফ ভেনিসের একটি মারাত্মক লাইন আমার মনে উল্কার মতো ছুটে এল।
–মার্চেন্ট অফ ভেনিসের কোন লাইন বউঠান?
জ্যোতি প্রশ্ন না করে পারে না।
–তোমার খুব প্রিয় লাইন নতুন, আমাকে মার্চেন্ট অফ ভেনিস পড়াতে-পড়াতে কতবার বলেছ!
‘ট্যারি আ লিটল্’।
–হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে, আমি প্রশ্ন করেছিলেম,
‘ট্যারি’ শব্দটার মানে জানো?
–আর আমি বলেছিলেম, না তো! কী মানে গো?
আর ঠাকুরপো, তুমি বলেছিলে, ‘ট্যারি’ মানে অপেক্ষা করো, একটু অপেক্ষা।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
মেজবউঠাকরুণ। পর্ব ১৪: জ্যোতিরিন্দ্রর মোম-শরীরের আলোয় মিশেছে বুদ্ধির দীপ্তি, নতুন ঠাকুরপোর আবছা প্রেমে আচ্ছন্ন জ্ঞানদা
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
–আর আমি বলেছিলুম, উইলিয়াম শেক্সপিয়র অ্যাট হিজ বেস্ট! ছোট্ট একটা বাক্য, ট্যারি আ লিটল্, কিন্তু চেষ্টা করলেও কোনও দিন ভুলতে পারবে না। উই ‘ট্যারি’ শব্দটাই ম্যাজিক-শব্দ বউঠান। কখনও-কখনও একটুকরো অপেক্ষা জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। কী সংক্ষেপে এই বার্তাটি রেখে গেছেন শেক্সপিয়র!
–নতুন, আই ট্যারিড আ লিটল্! তখুনি ছিটকিনি খুলে দরজাটা তোমার জন্য হাট করে দিইনি ঠাকুরপো। এক দৈব রিফ্লেক্স আমাকে বাঁচিয়ে ছিল।
–দরজা খুলে দিলে কী হত? বিস্মিত প্রশ্ন নতুনের।
–কেলেঙ্কারি হত নতুন, সর্বনাশ হত আমার, বলল জ্ঞানদা।
–কেন?
–আমি বলতে পারব না।
–কেন বলতে পারবে না? আমাকে জানতেই হবে।
–সব সত্যি জানতে নেই। নতুন, তুমিই তো বলেছ, গ্রিক ট্যাজেডি বারবার আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে, সত্য ধারণ করতে পারে কী সর্বনেশে রূপ! কতদূর অমঙ্গল ডেকে আনতে পারে সত্য, ঠাকুরপো সে কথা তো তুমিই আমাকে বলেছ। প্লিজ, সব বলতে জোর কোরো না আমাকে!
–বলতে তোমাকে হবেই মেজবউঠান। তাছাড়া, তোমার চোখ দেখে মনে হচ্ছে, আজ তুমি আর কিছুই লুকতে চাও না। সব উজাড় করে বলতে চাইছে তোমার মন।
জ্যোতিরিন্দ্র জ্ঞানদাকে তার বুকের মধ্যে নিবিড় করে জড়িয়ে ধরে। কারও মুখে কোনও কথা নেই। চাঁদের আলোর নীরব আড়ালে ছাদের এককোণে জ্ঞানদা আর জ্যোতিরিন্দ্র পরস্পরে মগ্ন হয়ে থাকে কিছুক্ষণ।
তারপর কুয়াশার মতো অস্পষ্ট কণ্ঠস্বরে লাবণ্যময় ঘন উচ্চারণে জ্ঞানদা বলতে থাকে, আমি ছিটকিনিটি ধরে মুহূর্তকাল অপেক্ষা করলাম। ওই যে বললাম, তোমার উচ্চারণে শেক্সপিয়র মনে আসতেই, ‘আই ট্যারিড আ লিটল্’। আর অমনি দরজায় অপেক্ষমাণ মানুষটি ধৈর্য হারাল। দরজার গায়ে আর আঙুলের আধো, আড়ষ্ট টুকটুক নয়। এবার সজোর জুতোর ধাক্কা। যার মধ্যে নেই ছিটেফোঁটা সংকোচ বা লজ্জা। বরং এই জোর শব্দ জাহির করল অধিকারবোধ। নতুন, আমি মুহূর্তে বুঝে গেলাম দরজায় তুমি শব্দ করনি। দরজায় কে, আমার বুঝতে বিলম্ব হয়নি।
–যে-ই হোক, আমি এখনও বুঝতে পারছি না মেজবউঠান, দরজাটা খুলে দিতে তোমার কী অসুবিধে ছিল! কী কেলেঙ্কারি হত তোমার দরজা খুললে?
কোনও কথা বলে না জ্ঞানদা। এর পরেও আর কতদূর বলা যায় নতুনকে?
–তুমি কাঁদছ কেন মেজবউঠান, অবাক হয়ে প্রশ্ন করে জ্যোতিরিন্দ্র। জ্ঞানদার গাল বেয় নামা চোখের জলে ঝিলমিল করছে চাঁদের আলো।
জ্ঞানদা কিচ্ছু বলে না। বলতে পারে না। চোখের সামনে জ্ঞানদাকে দেখতে পায় নতুন। কোনও পোশাক নেই জ্ঞানদার পরনে। চাঁদের আলো ছাড়া। জ্ঞানদা ছিটকিনি খুলে দেয়!
(চলবে)