আমার স্কেচিং-কাণ্ড শুরু হওয়ার পর যখন এদিক-সেদিক সাবজেক্ট খুঁজে বেড়াচ্ছি, ওখানে গিয়ে আবিষ্কার করেছিলাম গোটা মন্দির চত্বর জুড়ে টাঙানো মন্ত্রলেখা অজস্র উজ্জ্বল লাল, নীল, হলদে পতাকাগুলো রঙের কী তুলকালাম কাণ্ড বাধিয়ে রেখেছে! এমন দৃশ্য না এঁকে কিছুতেই ফেরা যায় না।
ম্যাল থেকে শুরু হয়ে অবসারভেটরি হিলকে ঘিরে আঁকাবাঁকা যে রাস্তাটা আবার ম্যালে এসে পড়েছে, সেই আদ্যিকালের ম্যাল রোড আজও দার্জিলিং শহরের এক বড় সম্পদ। কম-বেশি মাইল আড়াই লম্বা হলেও চড়াই-উতরাই নেই বলে যতবার খুশি পাক দেওয়া যায়। কিছুটা অন্তর ছাউনিওলা কাঠের বেঞ্চ আছে সামনে কাঞ্চনজঙ্ঘার ফার্স্ট ক্লাস ভিউ! এই রাস্তাটার আনাচ-কানাচে ঘুরে, ছবি এঁকে, বহু সময় কেটেছে আমার। ধারের নড়বড়ে লোহার পুরনো রেলিংগুলোর মধ্যে অদ্ভুত নস্টালজিয়া খুঁজে পাই। চোখের সামনে ভেসে ওঠে কাঞ্চনজঙ্ঘা ছবির বিভিন্ন দৃশ্য। কোনও এক ভোরে সেই স্মৃতি উসকে দিয়ে আমার গিন্নি দু’-কলি গেয়ে উঠেছিল, ‘এ পরবাসে রবে কে হায়’। পথচলতি এক বয়স্ক বাঙালি দম্পতি দাঁড়িয়ে পড়ে গোটা গানটা শোনানোর সবিনয় অনুরোধ জানিয়েছিলেন।
২০০২ সালের এমনই আরেকটা ভোরে বেঞ্চে গুছিয়ে বসে যখন আঁকছি, দামি গরম স্যুট পরা কেতাদুরস্ত এক ভদ্রলোক আমার প্রায় ঘাড়ের ওপর ঝুঁকে বেশ কিছুক্ষণ ধরে বোঝার চেষ্টা করলেন, কী করছি। দেখলাম, ওঁর সঙ্গে রয়েছে সশস্ত্র পুলিশের একটা ছোটখাটো পল্টন। কিঞ্চিৎ ঘাবড়ালাম, বেআইনি কিছু করে ফেলিনি তো? ভদ্রলোকের ছুঁচলো দাড়িসমেত সরু লম্বাটে মুখখানা কেমন যেন চেনা চেনা লাগল। কোনও কথা না বলে দলবল নিয়ে প্রস্থান করার পর খেয়াল হল, উনি আমাদের মাননীয় রাজ্যপাল বীরেন শাহ– প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছেন। তবে ছাউনির নিচে বসে একবার লম্বা আড্ডা দিয়েছিলাম ব্রিস্টল শহরের বাসিন্দা পল হ্যারিসের সঙ্গে, দার্জিলিং-এ এসে যার নাকি খালি মনে পড়ে যাচ্ছিল স্কটল্যান্ডের কথা। দেশে একটা দাতব্য সংস্থায় কাজ করলেও বৌদ্ধধর্মের চূড়ান্ত গোপন রহস্যগুলো জানার জন্য মাঝে রাতারাতি বৌদ্ধ হয়ে গিয়ে দীর্ঘদিন তিব্বতের নানা গুম্ফায় কাটিয়েছে পল। তারপর বিলেতে ফিরে লক্ষী ছেলের মতো আবার যিশুর চরণে নিজেকে সঁপে দিয়েছে। দেদার গল্পের স্টক ছিল ওই মধ্যবয়সি লোকটার। শেষে উদার হয়ে পল ওর হোটেলে বিয়ার সহযোগে লাঞ্চেও ডেকেছিল পরের দিন, যদি আমাকে হ্যাংলা ভেবে বসে, তাই আর যাইনি।
ম্যাল রোডের পুব দিকটায় রয়েছে পাহাড়ের টঙে মহাকালের মন্দিরে ওঠার রাস্তা, প্রথম প্রথম একবার অন্তত হুফহাফ করে উঠে শিবের দর্শন করে আসতাম। আমার স্কেচিং-কাণ্ড শুরু হওয়ার পর যখন এদিক-সেদিক সাবজেক্ট খুঁজে বেড়াচ্ছি, ওখানে গিয়ে আবিষ্কার করেছিলাম গোটা মন্দির চত্বর জুড়ে টাঙানো মন্ত্রলেখা অজস্র উজ্জ্বল লাল, নীল, হলদে পতাকাগুলো রঙের কী তুলকালাম কাণ্ড বাধিয়ে রেখেছে! এমন দৃশ্য না এঁকে কিছুতেই ফেরা যায় না। মনে আছে, পরের দিন সকাল থেকেই জোর বৃষ্টি! এদিকে আমিও নাছোড়, বাকিদের হোটেলে রেখে ভিজতে ভিজতে গিয়ে কোনওক্রমে একটা ছবি করতে পেরেছিলাম। এরপর বহুবার দার্জিলিং গিয়েছি, কিন্তু মহাকাল মন্দিরের ওই জায়গাটা নতুন করে আঁকার আর চেষ্টা করিনি, সেদিন ওইরকম খ্যাপামি নিয়ে ছুটে গিয়েছিলাম বলে যে স্পিরিটটা ছবির মধ্যে এসেছিল, জানি সেটা ফিরে পাওয়া কখনওই সম্ভব নয়।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved