রাজনীতি অবশ্য অন্য খেলা। রাজা-মন্ত্রী-ঘোড়া-বোড়ে সামলে, সাদা পোশাকে কালো দাগ মারপ্যাচ বাঁচিয়ে সেখানে ক্ষুন্নিবৃত্তি চলে। আর চলে জোটের নামে সেটিং সেটিং খেলা। রাজনীতিতে ডার্বির নাম ভোট। ভোট এলেই জোটের ভূত সর্ষের বালিশে উসখুস করে। খোয়াইশ-ভরা স্বপ্নের পেঁজা তুলো উড়িয়ে ‘হাত বাড়ালেই বন্ধু’ বলে দু’কলি গায়। কখনও বা গলা সাধে, কখন তোমার আসবে টেলিফোন বলে। জোট আসলে ভয়ংকর শুভঙ্করী, কে. সি. নাগের কল খুলে ভরাডুবি দশা। কিংবা সিঁড়িভাঙা সরল। অঙ্কে ভুল হলেই হড়হড়িয়ে পিছলে পড়ে। তখন জোটের যোগসাজশ ফসকা গেরো।
গ্রাফিক্স: দীপঙ্কর ভৌমিক
৯.
সবে মিলি করি কাজ, হারি-জিতি নাহি লাজ।
অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদ নাকি ঈশপের গল্প– তা জানি না, তবে এটুকু জানি, এ হল বাল্যকালের নীতিশিক্ষা, যা শুনে শুনে হেজে যাওয়া কান মনকে পাখি পড়ার মতো বুঝিয়েছে, মান-অপমান, দুঃখ-আনন্দ, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি– যাই কপালে জুটুক, একার বদলে একত্রে ভাগ করে নিলে ব্যথা কম লাগে, নচেৎ বার্নল লাগাতে হয়। গুরুজনরা বলেন-টলেন বটে, ঐক্যবদ্ধ কাজে সাফল্য আসে বেশি করে, ব্যর্থতাও যে পিরানহা মাছের মতো কামড় বসায় না, তা নয়। তখন বিধি বাম বলে কপাল চাপড়ানো ছাড়া উপায় কী! তবু বল বল বাহুবল। তাতে যে সুফল মেলে, তা এ বাংলার দুধের শিশুটিও জানে। কবি তাই যতই বলুন, ডাক শুনে কেউ না এলে একলা চলাই বিধেয়, মন তাতে সায় দেয় না। বরং, বেঁধে বেঁধে থাকার মতো জোটে জোটে থাকার ইচ্ছাটা আরও ডালপালা মেলে। কথাতেই তো আছে, দশের লাঠি, একের বোঝা। অতএব, জোটে থাকাই বাঞ্ছনীয়।
কিন্তু জোট তো চাঁদনী মার্কেটের টুনি বাল্ব নয়, যে চাইলেই মেলে! জোট আসলে নবদ্বীপের নিমাই, নিপাতনে সিদ্ধ। লাল দই হজম হবে, তবু সে– উহু, বাওয়া, সহজে নয়। গিললে অম্লশূল, না গিললে গলার কাঁটা। তবে জোট আছে বলেই ঘোঁট আছে। আছে ভোটের রঙ্গ। তার টানেই বিদগ্ধরা পতঙ্গবহ্নি হয়ে ছোটে। ছুটে গিয়ে আগুনে পুড়ে মুখ কালো করে। ইতিহাস তার এলেম না বুঝুক, তাতে বয়েই গেল। আমপাবলিকের মন-মজলেই হবে। তবে জোটে শুধু আশঙ্কা আছে, আশা নেই– একথা মোটেই ভাববেন না। এটাও ভাববেন না, কোমড়-কষে জোটের অপপ্রচারে বেরিয়েছি। তাতে উল্টে ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হবে, লোকলজ্জা বাড়বে, সেসব হ্যাপা বাড়িয়ে লাভ নেই। বরং নস্ট্যালজিয়ায় আসা যাক। বাঙালির সে পরম ঐশ্বর্য।
…………………………………………
জোট আসলে শক্তি চাটুজ্যের কবিতা, ধর্মেও আছে, আবার জিরাফেও আছে। ঠিক পাড়াতুতো নসিরামের মতো। জাতে মোহনবাগান হলে হবে কী, পাতে তার ইলিশ চাই-ই চাই। একা নসিরামকে দোষ দিয়েই বা কী লাভ! সল্টলেকে ধুলো উড়িয়ে মাঠ-কাঁপানো কাঠ-বাঙালকে দেখেছি ভরা বাজারে চিংড়ির দর নিয়ে টানাটানি করতে। খেলায় আর রেলায় থাকা মোহনবাগানিও কচু-ঘেচুর স্বাদে কুপোকাৎ হয়। বুঝেছি, মাঠের লড়াই মাঠে হয়, সেখানে সূচ্যগ্র মেদিনী ছাড়াছাড়ি নেই। কিন্তু খেলার বাইরে পুরোটাই জোটের জটে জমকালো।
…………………………………………
জোট যে কী জিনিস, বুঝেছিলাম সে ছেলেবেলায়। আরও খোলসা করলে ইশকুলে। পক্ষ-বিপক্ষে, ক্লাস-সেকশনে দক্ষ-যজ্ঞের অভিজ্ঞতা স্মৃতিতে আজও টাটকা। কখনও তা মোলায়ম, কখনও তা মারাত্মক। খণ্ডযুদ্ধের পরে সমঝোতা উপপাদ্যে প্রমাণিত। আমরাও সেই সহজ সমীকরণে অভ্যস্ত ছিলাম। গোল বাঁধল বড়বেলায়। দেখলাম, পুরোটাই লরির পিছনে লেখা বাহনলিপি– আজ যা তোমার। কাল তা অন্য কারও। বুঝলাম, জোট আসলে শক্তি চাটুজ্যের কবিতা, ধর্মেও আছে, আবার জিরাফেও আছে। ঠিক পাড়াতুতো নসিরামের মতো। জাতে মোহনবাগান হলে হবে কী, পাতে তার ইলিশ চাই-ই চাই। একা নসিরামকে দোষ দিয়েই বা কী লাভ! সল্টলেকে ধুলো উড়িয়ে মাঠ-কাঁপানো কাঠ-বাঙালকে দেখেছি ভরা বাজারে চিংড়ির দর নিয়ে টানাটানি করতে। খেলায় আর রেলায় থাকা মোহনবাগানিও কচু-ঘেচুর স্বাদে কুপোকাৎ হয়। বুঝেছি, মাঠের লড়াই মাঠে হয়, সেখানে সূচ্যগ্র মেদিনী ছাড়াছাড়ি নেই। কিন্তু খেলার বাইরে পুরোটাই জোটের জটে জমকালো। সেখানে ভেদাভেদ নেই।
রাজনীতি অবশ্য অন্য খেলা। রাজা-মন্ত্রী-ঘোড়া-বোড়ে সামলে, সাদা পোশাকে কালো দাগ মারপ্যাঁচ বাঁচিয়ে সেখানে ক্ষুন্নিবৃত্তি চলে। আর চলে জোটের নামে সেটিং-সেটিং খেলা। রাজনীতিতে ডার্বির নাম ভোট। ভোট এলেই জোটের ভূত সরষের বালিশে উশখুশ করে। খোয়াইশ-ভরা স্বপ্নের পেঁজা তুলো উড়িয়ে ‘হাত বাড়ালেই বন্ধু’ বলে দু’কলি গায়। কখনও বা গলা সাধে, কখন তোমার আসবে টেলিফোন বলে। জোট আসলে ভয়ংকর শুভঙ্করী, কে. সি. নাগের কল খুলে ভরাডুবি দশা! কিংবা সিঁড়িভাঙা সরল। অঙ্কে ভুল হলেই হড়হড়িয়ে পিছলে পড়ে। তখন জোটের যোগসাজশ ফসকা গেরো! আঁধার গলিতে কানামাছির মতো পাবলিকের চোখে পুরোটাই ওপেন সিক্রেট। তখন শূন্যে আছাড় খাওয়া ছাড়া পথ থাকে না। এসবের ঢাক গুড়গুড়ের মধ্যে উপনির্বাচনের বাদ্যি বাজে। আর সেই বাদ্যি-বাজনা শুনে চেনা হাত মুঠো আলগা করে দেয়। জোটের রোমান্স তখন আলুনি লাগে। দু’-পক্ষই তখন গেরস্তের কর্তা-গিন্নি। গৃহযুদ্ধ শেষে প্রথম কথা কে বলবে– তার অপেক্ষায়। তার ফাঁকেই বেলা যে গলে যায়। সূত্র মেলে না, নেতা-নেতৃত্বের নাভিশ্বাস বাড়ে। সেসব দেখে চোখে ছানি পড়ে। জোটের জল্পনা শুনে শুনে কান হেজে যায়।
অগত্যা? হেজে যাওয়া কান ভাঙা টেপরেকর্ডারের মতো মনকে শোনায়– ‘মন তোমার এই ভ্রম গেল না!’
……………………… পড়ুন ওপেন সিক্রেট-এর অন্যান্য পর্ব …………………….
পর্ব ৮: দক্ষিণ বিসর্জন জানে, উত্তর জানে বিসর্জন শেষের আগমনী
পর্ব ৭: পুজো এলেই ‘সর্বজনীন’ নতুবা নিঃসঙ্গ?
পর্ব ৬: এক্সক্লুসিভের খোয়াব, এক্সক্লুসিভের রোয়াব
পর্ব ৫: শাসন-সোহাগের দ্বন্দ্বসমাস
পর্ব ৪: পাঁকাল সাধনায় নাকাল
পর্ব ৩: দেখা ও না-দেখার সিদ্ধান্ত
পর্ব ২: মহাবিশ্বে যে টোকে না, সে বোধহয় টেকেও না
পর্ব ১: অফিসে দৈবের বশে প্রেমতারা যদি খসে