যে দেশে মেলায় গাদাবন্দুকে বেলুন ফাটানোর মতো মানুষ মারে লোকে, সেখান থেকে পাততাড়ি গুটনোই সমীচীন– এই লজিকে সুটকেস গোছাই। দেশে ফিরি। সেখানে হঠাৎ একদিন ট্রেন ভর্তি আগুন খায় অসহায় যাত্রীরা, ভোটের সময় লুকনো অস্ত্র কলার তুলে ঘুরে বেড়ায়। এ ছাড়া ডাকাতি-রাহাজানি বা ব্যক্তিগত আক্রোশে খুন, যা ছোটবেলা থেকে দেখছি, গা সওয়া হয়ে যায়।
‘খুন’ শব্দের আরেকটি অর্থ যে রক্ত– একটু বড় বয়সে জেনেছি। এমারজেন্সির বছরগুলোয় আমি ক্লাস ওয়ান থেকে টু। তারপরেও বেশ কয়েক বছর টুপটাপ লাশ পড়েছে শহরের আনাচকানাচে। ‘শুনেছিস তো, কাল রাতে অমুক জায়গায়…’। শিশুমনে ‘খুন’ মানে লাল পিঁপড়ে মারা, কাগজের গদা বানিয়ে উড়ন্ত আরশোলাকে মাটিতে নামিয়ে আনা, মাকড়সা দেখে ভয়ে কাছে না গিয়ে দূর থেকে জল ঢেলে দেওয়া– এইসব। তারপর একদিন বাবার সঙ্গে দেখা করতে এলেন এক ভদ্রমহিলা, যাঁর ছেলে এবং তার বন্ধুকে নাকি খুন করা হয়েছিল শহরতলির রেল লাইনের ধারে। উনি এসেছিলেন ব্যক্তিগত প্রয়োজনে, ওই ঘটনার অনেক দিন পরে। তবু পাড়া-প্রতিবেশীর ফিসফাস, পর্দার ফাঁক দিয়ে উঁকি। অনেকটা এভাবেই জানতে পারলাম এক সকালে, বাড়ির বৈঠকখানার আড্ডায়, আগের রাতে একটি খুন, থুড়ি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। কাছেই, মানিকতলার মোড় পেরিয়ে। যে ডাক্তারবাবু আশ্চর্য দক্ষতায় আমার জীবন বাঁচিয়েছেন শৈশবে, একাধিকবার, তাঁরই বড় ছেলের গলার নলি কেটে দিয়েছে কেউ। নিজের বাড়ি থেকে মাত্র কয়েক পা দূরে।
ইলেভেনে? না কি টুয়েলভে পড়ি, বন্ধুর মা খুন হলেন। প্রায় প্রতিদিন ওর বাড়ি ক্যারম খেলতে যেতাম, সেদিন যাইনি বলে পাড়া ঘুরতে বেরিয়েছিল সে। নিমকি, ঘুগনির অফুরান জোগান দেওয়া আমার বন্ধুর মা, ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে দোতলা থেকে নামার সময় বারবার সাবধান হতে বলা আমার বন্ধুর মা, মাত্র কয়েকটা সোনার গয়নার কারণে খুন হলেন। বুঝলাম অর্থের প্রয়োজন হলে খুনও করা যায়। কলেজে স্নাতকস্তরে পড়ার সময় সামান্য রাজনীতি। বন্ধের দিন উল্টোদিকের দোকানে চা খাচ্ছি। হঠাৎ বোমা পড়ল, পেটো। তারপর আর একটা। উড়ে এল অগুনতি সোডার বোতল। কানের কাছে কে একজন বলল, ‘পালা, না হলে খুন করে দেবে।’ লাল্টু আমার হাত ধরে টেনে দৌড় লাগাল। হেদুয়ার মধ্যে দিয়ে কার্ল লিউইস দৌড়, রাস্তায় কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটছে। এভাবেই ছুটতে ছুটতে একদিন আমেরিকা পৌঁছে গেলাম– ‘দ্য ল্যান্ড অফ অপরচ্যুনিটি’। ও হরি, সেখানেও দেখি আখছার লাশ পড়ছে! নিউ ইয়র্কের কুইন্সে একটি তস্য গলিতে থাকি কিছুদিন। এক সন্ধ্যায় এটিএম থেকে টাকা তুলে ফেরার সময় শুনি, তার পাশের গলিতেই গুলি চলেছে একটু আগে। বছর শেষে হিসেব পেশ করার সময় জার্সি সিটির মেয়র সগর্বে ঘোষণা করেন, এ বছর খুনের পরিসংখ্যানে তাঁরা নিউ ইয়র্কের থেকে অনেক ভালো পারফর্ম করেছেন। একটা গোটা বছরে মাত্র সাড়ে ন’শো খুন হয়েছে! নিউ ইয়র্ক চিন্তিত হয়ে পড়ে, তবে তখনও সে জানে না যে, ৯/১১ আসছে। যে দেশে মেলায় গাদাবন্দুকে বেলুন ফাটানোর মতো মানুষ মারে লোকে, সেখান থেকে পাততাড়ি গুটোনোই সমীচীন– এই লজিকে সুটকেস গোছাই। দেশে ফিরি। সেখানে হঠাৎ একদিন ট্রেন ভর্তি আগুন খায় অসহায় যাত্রীরা, ভোটের সময় লুকনো অস্ত্র কলার তুলে ঘুরে বেড়ায়। এছাড়া ডাকাতি-রাহাজানি বা ব্যক্তিগত আক্রোশে খুন, যা ছোটবেলা থেকে দেখছি, গা সওয়া হয়ে যায়। অকারণে কেউ ধাঁই করে গুলি চালিয়ে দেয় না, একথা ভেবে নিশ্চিন্ত হই। তাছাড়া চোলাই মদ খেয়ে বা নয়ানজুলিতে বাস উল্টে একগাদা লোক মরে যাওয়া তো খুন নয়। এসব সত্ত্বেও জনসংখ্যায় আমরা জগৎসভায় এক নম্বর হব, এই ভেবে নিজেকে গুছিয়ে রাখি। হাতে রক্ত লাগতে দিই না।
তবু একদিন অস্ত্র হাতে নিতে হয়। সামান্য একটি নেংটি ইঁদুরের জন্য। যে, এক রাতে অযাচিত উপদ্রবের মতো, ঢুকে পড়ে ড্রয়িংরুমে। সে জানত না পরদিন সকালে আমাদের বেড়াতে যাওয়া– সুইজারল্যান্ড। কলকাতা থেকে দুবাই হয়ে জুরিখ। অগত্যা তাকে মারতেই হয়। বেডরুম, কিচেন, স্টাডি, বাথরুমের দরজা বন্ধ করে অস্ত্র খুঁজি। ক্রিকেট ব্যাট নয়, ফসকালে মার্বেল ফেটে যাবে। টেনিস র্যাকেট? যদি ভেঙে যায়। ঝাঁটার ঘায়ে ইনজুরি হতে পারে, কিন্তু মরবে কি? তাই বাথরুম থেকে জল টানার ডান্ডা নিয়ে আসি। ব্যাটা গেল কোথায়? একটা কি-ই-ই-চ শব্দ শুনে বুঝি এন্টারটেইনমেন্ট ক্যাবিনেটের নীচে লুকিয়েছে। একদিকে কয়েকটা বাক্স রেখে অন্যদিক কাভার করি। টর্চের আলোয় ওরা কি বিরক্ত হয়? ওই তো লেজ দেখা যাচ্ছে। দেওয়ালের এক কোণে বিস্কুটের টুকরো ফেলে রাখি। সে ফাঁদে পা দেয়। নিজেকে বোঝাই এটা খেলা মাত্র। সামনে একটা গল্ফ বল। আমি টাইগার উডস। একটা স্ট্রোকেই আধমরা। আর একটা স্ট্রোক, আহঃ… বার্ডি। একফোঁটা রক্ত পড়ে না। পরদিন নিশ্চিন্ত, নিরুপদ্রব, নিরপরাধ উড়ান।