মুম্বই থেকে এক ভাই আসে গরমের ছুটি কাটাতে। তার ওপর ফটাফট ইংরেজি বলে। ধর্মতলা থেকে হেদুয়ার ট্রামে ফিসফিসিয়ে সে আমাকে সেক্সের গূঢ় তত্ত্ব বোঝায়। ভাঙা বাংলায়, কারণ তখনও আমার ইংরেজি জ্ঞান ব্যাং বা পায়রার মতোই। তারপর কালের নিয়মে সেক্স আসে। ধর্মতলায় হলুদ বই বা হাসলারের হাত ধরে।
প্রথম যখন ইংরেজিতে ফর্ম ভরি, সেক্স-এর পাশে কলম আটকে যায়। তারপর বুঝি সেখানে ‘মেল’ লিখতে হবে। পাড়ায় মিঠু বলল, আসল সেক্স একটু অন্যরকম। অনেকটা প্লাগ আর প্লাগ পয়েন্টের মতো। ওদেরও তো মেল-ফিমেল বলে। মিঠু আমার থেকে একটু বড় একটি ছেলে। বয়ঃসন্ধি পেরিয়েছে। আমি বললাম, ‘সেক্স বলে সত্যি কিছু হয় না কি?’ সুবু বলল, ‘না হলে তুই হলি কী করে?’ সবাই আমায় নিয়ে খুব হাসাহাসি করল। স্কুলের পড়াশুনোতে এসব শেখা যায় না, তার ওপর বাংলা মিডিয়াম। জীবনবিজ্ঞানে তখন ব্যাঙের প্রজনন ব্যবস্থা শেখাচ্ছে। মানুষ হয়ে জন্মেছি, ব্যাং কী করে জন্মায়, তা জেনে কী হবে? আমি কী করে হয়েছি, সেটা বলবে কে? ‘সেক্স’ শব্দটা মাথায় স্ক্রুয়ের মতো প্যাঁচ মারে। স্কুলে, ফার্স্ট বেঞ্চে বসা একটি নিপাট ভালো ছেলেকে নিয়ে একদিন প্রবল খিল্লি হয়। কিছু অকালপক্ব তাকে জিজ্ঞেস করেছে, বল ব্যাটা মানুষের কোন ধরনের নিষেক হয়? সে সিলেবাসের বাইরে যেতে পারে না, বলে– বহিঃনিষেক। আর যায় কোথায়। তার কয়েক বছর আগে ডা. সুভাষ মুখোপাধ্যায় গত হয়েছেন। খুব হইচই। খবরের কাগজ, পাড়ার রক ইত্যাদির কল্যাণে টেস্ট টিউব বেবি সম্পর্কে একটা আবছা ধারণা হয়েছে। ছেলেটিকে কয়েকজন বলে, তাকে আর কষ্ট করে সেক্স করতে হবে না, তার গামলা বেবি হবে। সে ছেলে কেঁদে ফেলে। মানুষ হয়ে না জন্মে সে ব্যাং হয়ে জন্মালে তাকে এই অপমান সহ্য করতে হত না।
ঘাবড়ে গিয়ে আমি বাইরের জগৎ থেকে জ্ঞান আহরণের চেষ্টা করি। আলসেতে দু’টি পায়রা কী করছে? পায়রার ডাক শুনছি জন্মানোর পর থেকেই, কিন্তু এক জোড়া পায়রার এই ট্রাপিজের খেল কখনও দেখিনি। একটি ছেলে পায়রা, অন্যটি মেয়ে মনে হয়। তবে কি তারা…? ‘পায়রা দেখছ?’ স্যর কান পাকড়ে ধরেন, ‘বাড়িতে চিঠি পাঠাব!’ আমি কাঁচুমাচু। আর কখনও এমন কাজ করব না বলে নাকখত দিই। কিন্তু বাড়ি ফিরে চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই, একটা পায়রার ওপর আরেকটা বসে আছে। ব্যাঙের প্রজনন ব্যবস্থায় উৎসাহ হারিয়ে ফেলি।
মুম্বই থেকে এক ভাই আসে গরমের ছুটি কাটাতে। মুম্বইয়ের ছেলে-মেয়েরা বেশ চালাকচতুর। তার ওপর ফটাফট ইংরেজি বলে। ধর্মতলা থেকে হেদুয়ার ট্রামে ফিসফিসিয়ে সে আমাকে সেক্সের গূঢ় তত্ত্ব বোঝায়। ভাঙা বাংলায়, কারণ তখনও আমার ইংরেজি জ্ঞান ব্যাং বা পায়রার মতোই। তারপর কালের নিয়মে সেক্স আসে। ধর্মতলায় হলুদ বই বা হাসলারের হাত ধরে। কলেজের হোস্টেলে, ছুটির দুপুরে উচ্চৈস্বরে বটতলা পাঠ থেকে অথবা ভাড়া করা ভিসিপিতে প্রায় জড়িয়ে যাওয়া ভিএইচএস-এ শরীর গরম করা ছবি দেখে। ‘সেক্স’ আছে এমন শব্দ নিয়ে কথার খেলা শুরু করি আমরা, মানে ছেলেরা– এসেক্স, সাসেক্স, মিডলসেক্স। পুরনো কলকাতার ছাপোষা উচ্চারণে অচিরেই থিয়েটার রোড হয়ে যায় সেক্সপিয়র সরণি। এমনকী, ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়ও হোস্টেলের ছাদে বিনিদ্র সময় কাটাই রাতের পর রাত, ঝুঁকে পাঁচিলের সমান্তরালে, চিবুক রেখে, কখনও বা ডেসপারেশনে জলের ট্যাঙ্কের ওপর উপুড় হয়ে। উল্টোদিকের বাড়িগুলোর জানলায় নজর রাখে সেক্স দেখতে চাওয়া বুভুক্ষু একগাদা চোখ। আমি কিছুই দেখতে পাই না। যে রাতে আমি যাইনি, সেই রাতেই নাকি দেখা গেছে– এই গল্প শুনে শুনে বিরক্ত হই। যেদিন বড় হব সেদিন আমাকেও যে মনে করে পর্দা টানতে হবে শুতে যাওয়ার আগে, হরমোন সেকথা ভাবতে দেয় না ওই বয়সে।
বাড়ির বাইরে পা বাড়ালে নিজের দায়িত্ব নিজেকে নিতে হয়, নিজের শরীর নিজেকেই খুঁজতে হয় আর বুঝতে হয় দুটো শরীরের জড়িয়ে পড়ার মানে। তখন পায়রারা মানুষকে দেখে অবাক হয়। বিয়ের পর বিদেশ থেকে ফিরে কলকাতার নতুন ফ্ল্যাটে আসি। বাবা, মা ছিলেন। বেডরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিই। পরদিন সকালে দেখি ওঁদের মুখ গম্ভীর। অপমানিত হলেন না কি? পাত্তা দিই না। এখন, বছর পঁচিশেক পরে, আমি আর স্ত্রী যখন সেই বাবা-মা আর ছেলে তার বান্ধবীকে নিয়ে বাড়ি আসে ছুটির দিনে, আমরাই আবার বেডরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করি। আচ্ছা, ওরা ভাবছে না তো যে, আমরা সেক্স করছি? ভাবলেই বা কী! আমরাও তো ভাবছি ওরা সেক্স করছে। করি বা না করি, সেক্স দায়িত্ব নিয়ে পাশাপাশি দুটো ঘরের আগল তুলে দেয়। আলাদা করে দেয় দু’-জোড়া পায়রার জীবন না কি ডানা ঝাপটে উড়ে যায় ইনহিবিশন, সেটা সময় বলবে।